থাকবে বকুলফুল… রমামাসি…

রুখসানা কাজল

 

সমাধির দেশে চলে গেলেন রমা চৌধুরী। সাগর, টগর, টুনু এবার ওদের মাকে কাছে পাবে। আর অজস্র ফুল, গগন কাঁপানো তোপধ্বনির আড়ালে বাংলাদেশ লুকিয়ে কাঁদল। সময় কোথায় একাত্তরের এক ধর্ষিতাকে মনে রাখার! এখন যে কেবল সামনে চলার সময়।

লাল সবুজ পতাকা নেমে এল পতাকাদণ্ডের কাছে, বরিষ্ঠ শুনেছ, রমামাসিও চলে গেল।

জ্যেষ্ঠর গাম্ভীর্য নিয়ে পতাকাদণ্ড জানায়, উনিশ শ একাত্তর। তোর তখনও জন্ম হয়নি রে পতাকা। পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি নিধনে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালি উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে বাবার বাড়িতে রমা চৌধুরী ছেলেদের নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। পাকিস্তান আর্মি ষড়যন্ত্রের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে একযোগে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে নেমে পড়েছে। নারকীয় অত্যাচার নির্যাতন ধর্ষণ এবং হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত খবর পৌঁছে যাচ্ছে শহর নগর ছাড়িয়ে গ্রাম অজ গ্রামান্তরে।

১৩ মে ১৯৭১, রমা চৌধুরীদের গ্রামে আসে পাকিস্তানি হায়েনারা। লুঠতরাজ, হত্যাযজ্ঞ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার সাথে ধর্ষণ করে বাঙালি নারীদের। রমা চৌধুরীও ধর্ষিতা হন। তবু প্রাণ বাঁচাতে ধর্ষিতা রমা চৌধুরী পুকুরের জলে লুকিয়ে পড়েছিলেন। আর সেখান থেকেই দেখেন, পাকিস্তান আর্মিরা গান পাউডার ছড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি।

এ ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি নদী, খাল, ঘাট, ধূলিকণারা জানে। বলা হয় বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ। প্রতিটি শহর, নগর, গ্রামে রয়েছে একাধিক বধ্যভূমি। রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনলক্ষ বাঙালি নারীর ধর্ষণের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু এই নারীদের বলেছিলেন, “বাংলার দোয়েল”। তাদের তিনি সম্মানিত করেছিলেন “বীরাঙ্গনা” উপাধি দিয়ে। ধর্ষিতা মেয়েদের বিমুখ পিতামাতা ভাই, স্বামীরা ঘরে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করে। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন ওদের পিতার নামের জায়গায় লিখে দাও আমার নাম। আর ঠিকানা দাও আমার বাসার, ধানমন্ডি, বত্রিশ নম্বর। রমা চৌধুরী জাতির জনকের সেই দোয়েল কন্যা। সর্বস্বহারা এক বীরাঙ্গনা।

হয়ত অত্যাচারিত ধর্ষিত রমা চৌধুরীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কোথাও তার ছিঁড়ে গেছিল। একে একে হারিয়ে ফেলেছিলেন তার দুই ছেলে সাগর টগরকে। একদিকে স্বাধীনতার উল্লাস অন্যদিকে মা রমার বুক থেকে মৃত্যুদেবতা কেড়ে নিয়েছেন তার বুকের ধন, দুই ছেলে সাগর টগরকে। শেষ সন্তান টুনু, সেও এক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯৯৮ সালে চলে গেল চির অসীমে। বিধাতা যদি কেউ থাকেন তো তিনি নিজের হাতে, রমা চৌধুরীর ভাগ্যে লেপে দিয়েছিলেন দুঃখ, দহন আর বঞ্চনার অমোচনীয় রঙমশাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে বাংলায় মাস্টার্স রমা চৌধুরী ছিলেন শিক্ষক। বেদনাহত এই জীবনে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। এ পর্যন্ত তিনি ২০টি বই রচনা করে গেছেন। সহজ গল্প বলার রীতিতে তিনি লিখে গেছেন দুঃখ, সুখ, স্বপ্ন, বাস্তবতার কথা। সহজপাঠের সরল কবিতার মতো তিনি তার লেখায় বলেছেন, স্বর্গে যদি বকুল না ফোটে তবে সে স্বর্গে তিনি যেতে চান না। কিছুতেই না।

যে মাটিতে তার ছেলেদের সমাধি রচিত হয়েছে, তিনি জুতা পরে হাঁটতে চাননি সে মাটিতে। যতদিন বেঁচেছিলেন, নগ্নপায়ে মাটিমায়ের বুকে পা রেখে চলেছেন। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে তার সাথে দেখা করার সময়েও তিনি গিয়েছিলেন নগ্ন পায়ে। আর নিজের জন্যে কিছুই দাবি করেননি তিনি। কেবল চেয়েছিলেন অনাথ নিরাশ্রয়দের জন্যে আশ্রয় দেওয়ার সাহায্য। এই ভোগের পৃথিবীতে তিনি শুধু চেয়েছিলেন মাত্র একুশে ঝরে যাওয়া ছোট ছেলে দীপঙ্কর সুকান্তের নামে স্থাপিত “দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়”-কে গড়ে তুলতে।

রমা চৌধুরী কলম ফেরি করেছেন, বই পত্রিকা বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করেছেন। তার পাশে চেষ্টা করে গেছেন দীপঙ্কর অনাথালয়কে প্রতিষ্ঠা দিতে। কারও কাছে হাত পেতে ভিক্ষের দান গ্রহন করেননি তিনি। তাকে নিয়ে এই যে লেখার বন্যা বইয়ে দিচ্ছি, বেঁচে থাকতে একবারের জন্যেও আমরা খোঁজ নিইনি। জানতে চাইনি, কেমন আছে বাংলার দোয়েল বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। “জন্মিলে মরিতে হবে”-র মতো আমরা মেনে নিয়েছিলাম, স্বাধীনতার জন্যে এই যে আত্মত্যাগ এটা তো স্বাভাবিক। আর যুদ্ধ কি কখনও আলুনে হয়? হত্যা, খুন, জ্বালাও পোড়াও, ধর্ষণের মতো ঘটনা না ঘটলে আর যুদ্ধ কি! কেউ মরবে, কেউ বাঁচবে, কেউ সব হারাবে, কেউ পঙ্গু, পীড়িত, পাগল হবে। তবে না যুদ্ধ! রমা চৌধুরী ছিলেন সেই সামান্য “কেউ”।

সেই সামান্য “কেউ” রমা চৌধুরী মারা গেলেন ৩রা সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রামে। মৃত্যুকালে তার বয়েস হয়েছিল সাতাত্তর বছর। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে, বোয়ালখালি উপজেলার পোপদিয়া গ্রামে। তিনি দাহ চাননি। ছেলেদেরও তিনি দাহ করেননি। ছোট ছেলে টুনুর কবরের পাশে নিজেকে সমাহিত করতে চেয়েছিলেন। তার এই ইচ্ছাটি পূরণ করেছে তার পরিবারের সদস্যসহ স্বজন বন্ধু সকলে মিলে।

অনার্স ক্লাশের চল্লিশ পঞ্চাশজন ছাত্রী রমা চৌধুরীর জীবন কাহিনী শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ওদের চোখে ফুটে ওঠে বকুলফুলের নরম আলো। অজস্র ঝরা বকুল যেমন তাকিয়ে থাকে মা বকুলগাছটির দিকে, ছাত্রীরা তেমনি নরম আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল দৈনিক কাগজে ছাপা রমা চৌধুরীর ছবি।

এই তো তোমার স্বর্গ রমা মাসি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...