দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
কেউ কেউ বলেন, আমাদের এই যুগটা নাকি ‘সিভিল সোসাইটি’ আন্দোলনের যুগ (‘সুশীল সমাজ’ নামক মিডিয়া-নির্মিত বাংলা কয়েনেজ-টি আপত্তিকর বলে মনে হওয়ায় ইংরিজি কথাটাই সোজা বাংলা বানানে লিখে দিলাম)। সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের যথার্থ স্বরূপ ও কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু আধুনিক সমাজের নানা ধ্যানধারণাকে ধারণ করা, আকার দেওয়া ও প্রকাশ করার ব্যাপারে এর গুরুত্ব নিয়ে বোধহয় খুব বেশি সংশয় নেই।
এই যে পারিবারিক বা কৌম বন্ধনের সাথে সম্পর্করহিত কিছু মানুষের সমাহার, যাঁরা যৌথ শ্রম ও সময় ব্যয় করেন রুটি-রুজির তাগিদে নয়, বা এমনকি ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আশাতেও নয়, স্রেফ কোনও একটি ধারণাকে রূপায়িত হতে দেখার তাগিদে — এটাই বোধহয় আমাদের আজকের সময়ের স্বাক্ষর। সে ধারণা মুক্তচিন্তা যুক্তিবাদ বিজ্ঞানমনস্কতা এইসব নিয়ে হতে পারে, মানবাধিকার বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে হতে পারে, নারী স্বাধীনতা নিয়ে হতে পারে, বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্পের কোনও নতুন ধারার চর্চা নিয়ে হতে পারে, জীবজন্তুর ক্লেশ নিবারণ নিয়ে হতে পারে, বা অযৌক্তিক ও বিভেদমূলক কোনও সামাজিক ট্যাবু নিয়েও হতে পারে। কখনও একই ব্যক্তি একাধিক ধারণা ও প্রয়াসের শরিক হতে পারেন, কেউ আবার সারাজীবন একটিমাত্রকেই আশ্রয় করে থাকতে পারেন, এমনকি এক ধারণা নিয়ে থাকা মানুষ অনেক সময় অন্য আরেকটি ধারণার বিরোধীও হতে পারেন।
কিন্তু, যে ধারণা নিয়েই আন্দোলন গড়ে উঠুক না কেন, তার পেছনে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে খুব সাধারণ কতকগুলো ধরে নেওয়া কথা সব সময়ই থাকে। সে কথাগুলো হচ্ছে, আমি কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় ‘অথরিটি’-র মতো করে ভাবতে বাধ্য নই, আমি সত্য ও মানবতার খাতিরে আমার গোষ্ঠী দেশ ধর্ম সময় সমাজকে অতিক্রম করতে চাইতেই পারি, সে চাওয়া আমি অবাধে প্রকাশ করব, যদি আমি মনে করি যে আমাকে ঘিরে থাকা সমাজ রাজনীতি রাষ্ট্র আমার এই চাওয়ার উপযুক্ত নয় তাহলে তার বিরোধিতা করব, এবং আমার সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেই সেই বিরোধিতার পরিসর আছে, থাকবে। আমার সেই চাওয়া নিয়ে আমি রাষ্ট্রকে ভেবে দেখতে বলতে পারি, তাতে কাজ না হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে যেতে পারি, আদালতে যেতে পারি, গণমাধ্যমের কাছেও যেতে পারি।
সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের সাথে যুক্ত সব মানুষই যে এইসব ধরে নেওয়া কথায় মনে মনে খুব বেশি ভরসা রাখেন এমন নয়, কিন্তু ভরসা থাকুক বা না থাকুক, মোটের ওপর তাঁরা এই কাঠামোতেই চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্ম চালিয়ে থাকেন, কারণ এর বাস্তব বিকল্প খুব বেশি নেই। কিছু কিছু কমবেশি করে এই একই রকম ধরে নেওয়া কথাগুলো থাকে অন্য সব রকম আন্দোলনেও — ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, এমনকি পাড়ার ভাঙা রাস্তাটি মেরামতের আন্দোলনেও। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রে আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে একটি গোষ্ঠীর যৌথ স্বার্থপূরণ, শুধুমাত্র একটি ধারণাকে রূপায়িত হতে দেখার আকাঙ্ক্ষামাত্র নয়। তাই, সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের মধ্যে বোধহয় এই কথাগুলো থাকে অনেক বিশুদ্ধ আকারে, এবং সেই হেতু গণতন্ত্র প্রগতি মানবতার ধ্যানধারণাগুলোকে তা বাঁচিয়ে রাখে অন্য বিমূর্ততর এক স্তরে। উল্টোদিকে, রাষ্ট্র ও সমাজ কিছুটা সীমা পর্যন্ত এই কথাগুলোকে সহ্য করে, কারণ, বিরোধিতাকে সহ্য করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ কিছু দীর্ঘমেয়াদি নৈতিক বৈধতা লাভ করে।
কিন্তু মনে করুন, এই কথাগুলোকে ধরে নেওয়া যদি আর তত নিরাপদ না থাকে? যদি বিরোধিতা করতে গিয়ে মানবাধিকার কর্মী গৃহবন্দি হন, যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তক খুন হন, দলিত ও ভিন্নধর্মীরা খুন জখম হয়ে যান, ছাত্র গ্রেফতার হন বা আত্মহত্যা করেন, যদি মানুষকে নিঃস্ব করে যথেচ্ছ লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বললে পাকিস্তানে যেতে বলা হয়? যদি সর্বোচ্চ আদালতের কতিপয় বিচারক অভিযোগ করেন যে, বিশেষ বিশেষ মামলাকে আইন ভেঙে পছন্দের বেঞ্চে পাঠানো হচ্ছে, গণহত্যার নায়ককে আইনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য? যদি সংবাদ-মাধ্যমেরই গোপন তদন্তে প্রকাশ পায় এই ভয়ঙ্কর তথ্য যে, বেশিরভাগ প্রভাবশালী গণমাধ্যমের কর্তারা অর্থের বিনিময়ে ধর্মীয় মৌলবাদের শাসনকে সমর্থন দিতে রাজি?
মনে করুন, যদি এমন হয় যে, দেশের সমস্ত জটিল সমস্যার মোকাবিলা করা হয় অশিক্ষিত ধূর্তামি আর হিংস্র গা-জোয়ারি দিয়ে? যদি অগণিত মানুষের অসহায়তাকে চাপা দেওয়া হয় ধর্মীয়-গোষ্ঠীগত নিরাপত্তার ভুয়ো আতঙ্কের তলায়? যদি ধর্ম-রাজনীতি-রাষ্ট্র-প্রশাসন মিলেমিশে বানিয়ে নেয় এক অখণ্ড নিটোল গুণ্ডামি আর বুজরুকির আসর?
তখনই বোঝা যায়, এসে পড়েছে সেই কুৎসিত সময়, যখন আমাদের মস্তিষ্ক ও চেতনায় কামড়ে ধরে থাকে অন্ধ প্রাচীন কুসংস্কার, ক্ষমতার প্রতি এক ভীতিমাখা আকর্ষণ, এবং অন্য পরিচয়ের ক্ষমতাহীন মানুষের প্রতি লুকোনো অযৌক্তিক ঘৃণা। আধুনিক কালের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চাপে সে ঘৃণারা এমনিতে চাপা পড়ে থাকে, আর সমাজ ও ইতিহাসের দুর্বল কোনও সঙ্কট-মুহূর্তে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে। আমাদের দেশ ও ক্ষমতাবান বহিঃপৃথিবীর এক বড় অংশ সম্ভবত আজ তেমনই এক প্রবল ঢেউয়ে আক্রান্ত। এ এমনই এক অদ্ভুত সময় যখন মানুষ প্রকাশ্যে নিজের মূর্খতা, অন্ধত্ব ও ঘৃণার কথা ঘোষণা করাটা বিশেষ জরুরি কাজ বলে মনে করে, নিজেদের কোনও এক কল্পিত গোষ্ঠীগত নিরাপত্তা ও ইজ্জতের সাথে এগুলোকে যুক্ত করে নেয়। এই সেই সময় যখন দেশের সরকার জাতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনে পৌরাণিক আগড়ম-বাগড়ম হাজির করতে লজ্জা পায় না, যখন মানুষের চেয়ে গরুর সম্মানরক্ষা অনেক বেশি জরুরি বলে মনে হয়, যখন সত্য-মিথ্যা বিচারের চেয়ে কল্পিত শত্রু-মিত্র বিচারে আগ্রহ বেশি জন্মায়, যখন পৌরাণিক চরিত্রের সম্মানরক্ষার জন্য নির্দোষ বিধর্মী-হনন অতি স্বাভাবিক কর্তব্য বলে বোধ হয়, যখন মূর্খতা আর ঘৃণা যাপনের উৎসবের মধ্যে রোজগার-পড়াশোনা-স্বাধীনতা-সাম্যের কথা তুলতে মানুষ কুণ্ঠাবোধ করেন।
কী করবে তখন সিভিল সোসাইটি, যখন অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে আর ওই ধরে নেওয়া কথাগুলোর নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না?
তখন সিভিল সোসাইটি প্রশ্ন করবে। তখনই তো মৌলিকতম প্রশ্নগুলো তোলবার আসল সময়! সমাজের নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন, রাষ্ট্রের নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন, ধর্মের নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন, আমাদের সমগ্র নাগরিক অস্তিত্বের মূল শিকড়গুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন।
সে সব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? সম্ভবত কেউই না। আপনি কতদূর পড়াশোনা করেছেন, আপনি বিয়ে করেছেন কিনা, এই সমস্ত অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তরও তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী চট করে দেন না, অনেক দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে তবেই দেন। আর এইসব কঠিন প্রশ্ন করলে হয়ত উত্তরই দেবার প্রয়োজন বোধ করবেন না, হাতে তালি মেরে দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে গা গরম করা বক্তৃতা শুরু করে দেবেন।
কিন্তু, তদবিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া — গীতায় বলেছে। যস্যার্থ, উদ্ধার পেতে গেলে শুধু প্রণিপাত নয়, অথরিটিকে পরিপ্রশ্নও করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গীতার এই জায়গাটা দেখেছেন নিশ্চয়ই?