নাহার তৃণা
একটা অদ্ভুত মানসিকতায় মোড়া আমাদের সমাজ সংসার। বিশেষত এই উপমহাদেশীয় সমাজ-সংসার, সহস্র বছরের স্থির বিশ্বাসের হেজিমনিতে যে কোনও আঘাত সহজে সইতে পারে না। সংস্কারের মিথ খসে পড়বার আশঙ্কা দেখা দিলেই সবাই কেমন এককাট্টা হয়ে হৈ হৈ করে ওঠে। একজন মানুষ নানা সংস্কারের শেকলে বাধা পড়ে হয়ত ছটফট করছে। চাইছে তা থেকে তার মুক্তি ঘটুক। কিন্তু তার মাধ্যমে সংস্কারের পান থেকে চুন খসে পড়ুক, এমনটা মোটেও সহানুভূতির দৃষ্টিতে নেয়া হবে না। বরং শা শা করে তার দিকে ছুটে যাবে তীব্র কথার তীর। শোনানো হবে শাস্তির বয়ান।
এহেন সমাজে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন, জখম, রাহাজানি, ইভটিজিং চলতে পারে। দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নেবার প্রতিযোগিতাও সবুজ বাতির আশকারা পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসা বিষয়ক অনুভূতির প্রকাশকে খোলা মনে গ্রহণ করায় শতেক হ্যাপা, অনেকক্ষেত্রেই তা পাপ কিংবা গর্হিত অপরাধ। প্রকাশ্য রাস্তায় আপনি সপাটে হিসু করেন, কেউ তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে আসবে না। কিন্ত প্রেম করবার জন্য উপযুক্ত স্থানের অভাব বঞ্চিত যুগলদের হাত ধরাধরি করে বসে থাকতে দেখলেই আইন তার চোখের পট্টি খুলে দৌড়ে আসবে। বিশেষ দিনগুলোতে সন্ত্রাসী ধরবার কায়দায় বাড়তি ঘাম ঝরাতে কসুর করে না ভ্রাম্যমান মোবাইল কোর্ট। তখন মোবাইল কোর্টের তৎপরতা দেখবার মতোই হয় বটে। সংবাদমাধ্যমগুলোও বসে থাকে না। সমাজ সংসারকে অনৈতিক(!) অসামাজিক(!) কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ধারের বৈপ্লবিক তাড়নায় ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ’ বলে আগুয়ান হয়।
এমন যে সমাজ উপযুক্ত বয়সের ছেলে-মেয়ের প্রেম-ভালোবাসাকে অসামাজিক অনৈতিক অভিধায় অভিযুক্ত করে, সে সমাজের চোখে একজন মধ্যবয়স্ক বিধবা নারী কিংবা স্ত্রী-পরিত্যক্ত একজন পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে যে রীতিমত দণ্ডণীয় অপরাধ হিসেবে দেখা হবে সে তো বলাই বাহুল্য।
এক্ষেত্রে যদিও বা পুরুষটি খানিক ছাড় পাওয়ার অধিকার রাখেন, নারীর ক্ষেত্রে সেটি নৈব নৈব চ! তার উপর সেই বিধবা নারী যদি বিবাহযোগ্য সন্তানের মা হয়ে থাকেন তবে আর যায় কোথায়! পারলে অলিন্দ নিলয় ফুঁড়ে মানুষটির যাবতীয় জৈবিক অনুভূতি কেড়ে নেওয়ার নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদের অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি হল, মা নামের মানুষটির কেন আলাদা অস্তিত্ব থাকবে! এমন মা তথা নারীটির আর কোনও নিজস্ব চাওয়াপাওয়া থাকতে পারে না। নিজের যাবতীয় শখ আহ্লাদের চটিবাটি গুটিয়ে আন্দামানে চালান করে, তার একমাত্র কাজ নিজের জীবন ঘষে সন্তানদের জীবনে আলো জ্বেলে দেয়া। এমন মায়ের আলাদা ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব স্বীকারে আমাদের স্বার্থপর সমাজ ভীষণ রকম কুণ্ঠিত।
কুণ্ঠা আর স্বার্থপরতায় অন্ধ আপন সন্তানও তখন মায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। সন্তানের আগামীর জন্য মায়ের বর্তমান উৎসর্গ করাটা দায়িত্ব-কর্তব্য জ্ঞান করলেও সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতি নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য বেমালুম ভুলে যেতেও দ্বিধা হয় না। একদিকে প্রচলিত সমাজ সংসারের বেঁধে দেয়া সংস্কার, অন্যদিকে দু’জন একাকী মানুষের একাকিত্ব ভুলে একে অন্যের সঙ্গ চাওয়ার এক সরল অথচ জটিল আর্বতের গল্প শোনান Fernes Land খ্যাত কানওয়াল শেঠি (Kanwal Sethi) তাঁর সাম্প্রতিক সিনেমা ‘ওয়ান্স এগেইন’-এ। এটি ইন্ডিয়া-জার্মানি যৌথ উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্র।
নীলিমা নামের ছোট্ট রেস্টুরেন্টের মালিক অকালে বিধবা হওয়া তারা শেঠি (শেফালি শাহ), যিনি নিজের শখ আহ্লাদের কথা না ভেবে দুই সন্তানকে বড় করেন। ছেলে দেব (প্রিয়াংশু পেইনুলি), মেয়ে মীরা (বিদিতা বাগ)-ই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। তারপরও কর্মব্যস্ত দিন পেরিয়ে শিশিরের শব্দে নেমে আসা সন্ধ্যা, কিংবা কোনও একটা নির্ঘুম রাত খুব নীরবে জানান দেয় তারা’র একাকিত্ব। অন্যদিকে স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়া চলচ্চিত্র তারকা অমর কুমার (নিরাজ কবি)। যার প্রাচুর্য আছে, আছে কর্মব্যস্ত জগত, বাড়িময় নানান গাছের সাথে যাপিত সময়ের কথকতা, বাবার প্রতি সহানুভূতিশীল সন্তান স্বপ্না (রাসিকা দুগাল)। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্লাইড ডোরের কাঁচে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার ভঙ্গিতে, সিলিংয়ে ছুঁড়ে দেয়া শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় একাকিত্বের চুপ কথা ঠোঁট নেড়ে যায় —
‘এমন দিনে মন খোলা যায়
…সে কথা শুনিবে না কেহ আর
নিভৃত নির্জন চারিধার’
দু’জন মানুষের একাকিত্ব ঘুচিয়ে দেবার দরদী মন নিয়ে কাহিনীকারদ্বয় (কানওয়াল শেঠি, অজিতপাল সিং) গল্প বোনেন। তাই দেখা যায় যথেষ্ট খ্যাতিমান হওয়া সত্ত্বেও অমর কুমার শহরের অন্যান্য নামী রেস্টুরেন্টের শরণাপন্ন না হয়ে ‘নীলিমা’য় নিজের জন্য প্রতিদিনের খাদ্য সরবরাহের আসন পাতেন। তারা রোজ রান্না শেষে নিজ হাতে সযত্নে অমর কুমারের পছন্দের খাবার টিফিনবাটিতে ভরে অমরের বাড়ি পাঠায়। রাতে ফোন করে জেনে নেয় খাবার ঠিক ছিল কিনা। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ফোনের আলাপরত সময়টুকু এই দু’জনের একান্ত আপন। পর্যায়ক্রমে যা একান্ত আরাধ্য হতে থাকে বহুল চর্চিত ইংরেজি প্রবাদের হাত ধরে —
‘The way to a man’s heart is through his stomach’
‘হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার।’
কিন্তু এসব ভাবালুতা সংস্কারের ভূতে ধরা মানুষ বা সমাজ-সংসার মানবে কেন! স্বভাবতই, সরল ধারায় চলতে থাকা সম্পর্কগুলোতে জটিলতা ছায়া ফেলে। সে ছায়া সরিয়ে ‘আন্টিজি’র শাবানা আজমির মতো বয়স বা ছেলের নিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শরীরে শখের ট্যাটু এঁকে স্বাধীনতা উপভোগের উচ্ছ্বাসকে নিজের করে নেবার মতো সাহস তারা-অমরও কী দেখাতে পারে? ওদের আনন্দটুকু কেড়ে নিতে উদ্যত সমাজ সংসারের উদ্দেশ্যে সপাটে বলার সাহস দেখায় কী ‘আর কটা দিন… বাঁচি, বাঁচার আনন্দে? গল্পের সেটুকু জানতে হলে অবশ্যই আপনাকে থিয়েটার হলে গিয়ে ‘ওয়ান্স এগেইন’ দেখে নিতে হবে।
প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টার সিনেমা ‘ওয়ান্স এগেইন’-এর চরিত্রগুলোর মাপা অভিনয় এ সিনেমার প্রাণ। কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা শেফালি শাহ-নিরাজ কবি জুটির চমৎকার পরিমিত অভিনয় সাধুবাদযোগ্য। সিনেমা জুড়ে আরও এক চরিত্র নিঃশব্দে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। সেটি হল একাকিত্বের নিজস্ব নৈঃশব্দ্য। কী মানুষের, কী ব্যস্ত শহরের, নানান রঙের-ঢঙের অবয়ব/কোলাহলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে থেকেছে একাকিত্বের চুপ কথা। অন্ধকারেরও যেমন নিজস্ব আলো থাকে, কোলাহলের বুকের ভেতরেও চুপচাপ বসে থাকে একাকিত্ব। মানুষের পাশাপাশি একটা শহরও বয়ে বেড়ায় নিজস্ব একাকিত্ব। সিনেমাটোগ্রাফিতে ঈশীত নারেইন (Esshit Narain)-এর দক্ষ হাতের কারুকাজ দর্শক চোখ-মন টানবে নিশ্চিত। শ্রুতিমধুর সঙ্গীতায়োজনে তালভিন সিং (Talvin singh) সিনেমার টোনের সাথে চমৎকার সামঞ্জস্য ধরে রেখেছেন পুরোমাত্রায়। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজের, পরিমিত স্ক্রিপ্ট, অভিনয় ইত্যাদির জন্য ‘ওয়ান্স এগেইন’ সিনেমা টিমকে আন্তরিক সাধুবাদ।
ওয়ান্স এগেইনের গল্প খুব নতুন তা হয়ত বলা যাবে না। গল্পের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র তাদের নামহীন সম্পর্কটিকে কে কতটা গ্রেসফুলি বা ডিসগ্রেসফুলি হ্যান্ডেল করেন সেটির সেলুলয়েডীয় মীমাংসা অবশ্যই দর্শকের মনে খানিক হলেও দাগ রেখে যাবে বলে মনে করি। যদিও একখানা সিনেমার মাধ্যমে রাতারাতি সমাজ পরিবর্তন সম্ভব না, কিন্তু কে বলতে পারে, ‘ওয়ান্স এগেইন’ দেখে সমাজের কিছু মানুষ তাদের ভেতরে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে চাইবেন না! যে যার পছন্দমাফিক জীবন যাপনের স্বাধীনতা রাখেন, তাতে তৃতীয় ব্যক্তির অনধিকার নাক গলানো যে অন্যায়, অরুচিকর সে শিক্ষাটা সিনেমা হল ফেরত দর্শক বাড়ি বয়ে যদি নিয়ে যান মন্দ কী!