এবারের কলকাতা লিগ : প্রাপ্তির ভাঁড়ার ভালোই

শুভাশিস রায়চৌধুরী

 

কলকাতাকে ফুটবলের মক্কা বললে ভারতের যে সমস্ত প্রান্তে ফুটবল খুব জনপ্রিয় সেখানের লোকজনেদের গোঁসা হয়। সত্যিই তো, গত দেড় দশক ধরে ভারতীয় ফুটবলকে একছত্রভাবে গোয়ানিজরা শাসন করে এসেছে। উল্টোদিকে মিজোরাম, মণিপুরের কন্ট্রিবিউশনও কম কিছু না। তাদের সাথে কখনও তাল মিলিয়েছে কেরালা, মহারাষ্ট্র বা পাঞ্জাব। তবুও কেন শুধু কলকাতাকে ফুটবলের মক্কা বলা হবে, এ প্রশ্ন তাদের মনে জাগাটা অস্বাভাবিক নয়। এর কারণ একটাই। কলকাতায় ফুটবল খেলতে গেলে পেশাদারিত্বের থেকে অগ্রাধিকার পায় আবেগ। তা বলে কি আর ভারতের বাকি প্রান্তে ফুটবলারেরা আবেগ দিয়ে খেলে না? অবশ্যই খেলে, কিন্তু কলকাতার ময়দানে পা রাখার সাথে সাথে সেই আবেগ যেন চতুর্গুণ হয়ে যায়। সদ্যসমাপ্ত কলকাতা লিগ আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল কলকাতার ফুটবল নিয়ে এই আবেগ। যতই আইএসএল নিয়ে নাচুক ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা, কলকাতা লিগের দর্শক সংখ্যার সাথে পাল্লা দিতে ‘তথাকথিত’ ভারতের শ্রেষ্ঠ লিগের এখনও অনেক দেরি। কলকাতা ডার্বি তো ছেড়ে দিলাম। আইএসএল আগে এবারের মোহনবাগান বনাম জর্জ টেলিগ্রাফ বা ইস্টবেঙ্গল বনাম পিয়ারলেস ম্যাচের মতো দর্শক জোগাড় করুক তারপর কথা হবে। এখানে হাজার হাজার মানুষের গলার আওয়াজে গমগম করতে থাকা স্টেডিয়ামে যে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হয় তার কোনও বিকল্প হয়ত আর নেই। এই আবেগ সবার ক্ষেত্রেই খাটে। কি কোচ, কি প্লেয়ার, কি দর্শক, সবার জন্য। যেমন এবার খাটল কলকাতা লিগজয়ী কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তীর।

যারা ভারতীয় ফুটবল নিয়ে টুকটাক খোঁজখবর রাখে তারা জানে জন্মলগ্ন থেকে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি বহু প্রতিভার সন্ধান দিয়ে এসেছে ভারতের ফুটবল বাজারে। প্রতি বছর দু চোখে স্বপ্ন নিয়ে কচিকাঁচাদের ভিড় হয় সেখানে। কারও স্বপ্ন সেদিনই ভেঙে যায় আবার কেউ সেদিন লম্বা একটা পা বাড়ায় নিজ স্বপ্নের দিকে। এভাবেই একদিন টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে কলকাতা ময়দানে পা রেখে স্বপ্ন দেখেছিলেন শঙ্করলাল চক্রবর্তী। স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন নামকরা ফুটবলার হবেন। সুযোগও পেয়ে যান কলকাতার দুই বড় দলে। ভালোই চলছিল এই প্রতিভাবান ফুটবলারের নিজ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু বাধ সাধলেন ফুটবল ঈশ্বর। ১৯৯৭-এর অগাস্ট মাসে ইস্টবেঙ্গল দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে শঙ্করলাল খেলতে নামেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। মোহনবাগানের বিখ্যাত নাইজিরিয় স্ট্রাইকার চিমা ওকোরিকে যেন সেদিন বোতলবন্দি করে ফেলেছিলেন শঙ্করলাল। চিমা যেখানে শঙ্করলাল সেখানে। আস্তে আস্তে বিরক্ত হচ্ছিলেন চিমা আর খেলার বয়স যখন ৩৬ মিনিট তখনই করে ফেললেন সেই মারাত্মক ভুল। তাঁর কড়া ট্যাকেলে দু টুকরো হয়ে গেল শঙ্করলালের শিন বোন। কথিত আছে সেই হাড় ভাঙার আওয়াজ সেদিন শোনা গিয়েছিল যুবভারতীর প্রেসবক্স থেকেও। শিউরে ওঠেন মাঠে উপস্থিত সকলে। চিমার এই কাজ ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত সেই প্রসঙ্গে আজ যাচ্ছি না, তবে সেদিনই মোটামুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল শঙ্করলালের বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। যদিও চোট সারিয়ে দুই বছর পরে মাঠে ফিরে আসেন তিনি, তবুও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তাঁর ফুটবল জীবন। আরেকবার একই জায়গায় চোট পেয়ে খেলা থেকে দূরে চলে যেতে হয় শঙ্করলালকে। ২০০১ মরসুমে শেষবার ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে পাকাপাকিভাবে অবসর নেন তিনি। অকালেই মৃত্যু হয় টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে প্রথমদিন পা রেখে দেখা সেই স্বপ্নের।

কিন্তু আবার বাধ সাধেন সেই ফুটবল ঈশ্বর। যে মানুষটা ছেলেবেলা থেকেই নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন ফুটবলকে তাকে কি আর বেশিদিন ফুটবল থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়? তাই মহম্মদ পাহাড়ের কাছে না এলে, পাহাড়ই গেল মহম্মদের কাছে। স্ত্রী পৌলোমীর উৎসাহে কোচ হিসাবে নিজের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন শঙ্করলাল। একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে লাভ করলেন দরকারি কোচিং ডিগ্রি আর খেলা ছাড়ার প্রায় দশ বছর পরে ফিরে এলেন মূলস্রোতে। এবারে আইএফএ অ্যাকাডেমির কোচ হিসাবে। তাঁর নিজের ফুটবল জীবন নষ্ট হওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে দিল শয়ে শয়ে উঠতি প্রতিভাদের জীবন গড়ে দেওয়ার হাতছানি। বুটজোড়া তুলে রাখার দিন যারা বলেছিল শঙ্করলাল ফুরিয়ে গেছে তাদের জানান দিতে ইচ্ছে করত ‘না শঙ্করলাল শেষ হয়ে যায়নি’, কিন্তু শান্ত, সহজ সরল স্বভাবের শঙ্করলাল তাড়াহুড়া করেননি। অপেক্ষা করেছিলেন সঠিক সুযোগ আর সঠিক সময়ের। আর সেই সুযোগ একদিন হঠাৎ করেই তাঁর সামনে এসে গেল। ২০০১-০২ সিজনে ইস্টবেঙ্গল দলে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন ময়দানের পোড় খাওয়া কোচ সুভাষ ভৌমিক। খুব স্নেহ করতেন তিনি শঙ্করলালকে। এবারেও সেই সুভাষ ভৌমিকই শঙ্করলালকে দিলেন তাঁর জীবন কোচ হিসাবে অন্যতম ব্রেক। মরক্কান কোচ করিম বেঞ্চেরিফাকে সরিয়ে মোহনবাগান কর্তারা নিয়ে আসেন সুভাষকে আর সুভাষ নিজের সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করেন তাঁর প্রিয় শিষ্য শঙ্করলালকে। প্রায় এক দশক পর বড় ক্লাবের তাঁবুতে ঢোকেন তিনি আর তারপরে শুরু হয় কোচ হিসাবে তার খ্যাতির দিকে পথ চলা। সুভাষ কিছুদিন পরে মোহনবাগান থেকে ছাঁটাই হলেও বাগান কর্তারা আস্থা রাখেন শঙ্করলালের ওপর। নিয়ে আসা হয় সঞ্জয় সেনকে। সঞ্জয়বাবু দায়িত্ব নিতেই ফেডারেশন কাপে মোহনবাগান চূড়ান্ত বাজেভাবে হেরে বেরিয়ে যাওয়ায় আবার কর্তারা নড়ে চড়ে বসেন। ঠিক হয় সঞ্জয়-শঙ্করলাল দুজনকেই আর রাখা হবে না। কিন্তু কি মনে হতে তাদের আরেকটা সুযোগ দেওয়া হয় আর তাতেই হয় বাজিমাত। সঞ্জয় সেন-শঙ্করলাল জুটি চোদ্দ বছর পর বাগান তাঁবুতে এনে দেয় আই লিগ। সঞ্জয় সেন পাকাপাকিভাবে মোহনবাগানের কোচ হিসাবে থেকে যান আর শঙ্করলাল রয়ে যান তার সহকারী। এই জুটি পরের বছর মোহনবাগানকে ফেড কাপও জেতায়। ২০১৭-১৮ সিজনের আই লিগে চেন্নাই সিটি এফ সির সাথে ম্যাচে বাজেভাবে হেরে বিদায় নেন সঞ্জয় সেন। সহকারী থেকে প্রধান কোচের আসনে বসেন শঙ্করলাল। লিগ টেবিলের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় চলে যাওয়া মোহনবাগানকে তৃতীয় স্থানে এনে লিগ শেষ করেন। চেষ্টা চললেও এককভাবে ট্রফি অধরাই ছিল শঙ্করলালের। সিকিম গোল্ড কাপ জিতলেও তা যেহেতু প্রথম সারির টুর্নামেন্ট নয় তাই অতটা প্রচার পাননি শঙ্করলাল। এবারের কলকাতা লিগ তাই শুরু থেকেই জেতার জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন তিনি। জোর দিয়েছিলেন নতুন প্রতিভাদের দিকে। নিয়মিত খেলিয়ে গেছেন সৌরভ দাস, পিন্টু মাহাতো, শঙ্কর রায়দের মতো অনামী জুনিয়রদের। তারা শঙ্করলালের এই আস্থার যোগ্য দাম দিতে এবারের কলকাতা লিগ ঢোকে বাগান তাঁবুতে। কোচ হিসাবে এককভাবে শঙ্করলালের প্রথম বড় সাফল্য। এই উত্থানের গল্প যেন সিনেমার স্ক্রিপ্ট।

উত্থানের গল্পের কথা যদি ওঠে তাহলে অবশ্যই এবারের কলকাতা লিগের প্রেক্ষিতে নাম উঠে আসবে জঙ্গলমহলের পিন্টু মাহাতোর। জঙ্গলমহল শব্দটা শুনলেই মজা করতে গিয়ে আমরা অনেকে পরের শব্দটায় বলি “হাসছে”। মুখ্যমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী আদতে গোটা জঙ্গলমহল সত্যিই হাসছে কিনা সে তর্কে যাচ্ছি না তবে এবারের কলকাতা লিগে পিন্টুর খেলা দেখে কিন্তু সত্যিই জঙ্গলমহল হেসেছে।

বাবা-মা দুজনেই মজুরি করেন। পরিবার থাকে কুঁড়েঘরে। সেখান থেকে আট বছর আগে কলকাতায় ট্রায়াল দিতে এসে পিন্টুর খেলা চোখে পড়ে যায় মোহনবাগান যুব দলের কোচ অমিয় ঘোষের। বেহালা নিবাসী অমিয় ঘোষ নাকি ট্রায়ালের পর সেদিন পিন্টুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
তুই এখানে থাকবি কোথায়?
উত্তর এসেছিল,
হাওড়া স্টেশনে।
এখানে থাকার জায়গাটুকুও ছিল না ওর। জঙ্গলমহলের নাম না জানা গ্রাম থেকে দু চোখে স্বপ্ন নিয়ে এই স্বপ্নের শহরে কি ভাগ্যিস সেদিন চলে এসেছিল পিন্টু। নাহলে জঙ্গলমহলের এই হাসি অধরাই থেকে যেত।
নিজের জীবনের প্রথম ডার্বি খেলতে নেমে, ডার্বির মতো হাই ভোল্টেজ ম্যাচে, সদ্য রাশিয়া থেকে বিশ্বকাপ খেলে আসা কোস্টারিকান জনি অ্যাকোস্টা খচিত ডিফেন্স লাইনের বিরুদ্ধে চকিত শটে পিন্টু যখন গোল করে গেল তখন জঙ্গলমহল তো হাসতে বাধ্য। আর শুধু জঙ্গলমহল কেন? সাথে আসমুদ্রহিমাচলে বাংলার প্রতিটা ফুটবলপ্রেমী সেদিন প্রাণভরে হেসেছে। সে তাদের জার্সির রং যেটাই হোক না কেন। প্রথম ডার্বি খেলতে নেমে বহুদিন পর কোনও বাঙালি গোল করে গেল এবারের কলকাতা লিগের ডার্বিতে।

একটু আগেই ২০১৭-১৮ সিজনের আই লিগে চেন্নাই সিটি এফ সির ম্যাচের উল্লেখ করেছি। সেদিন সৌরভ দাসের একটা মিসপাস থেকে চেন্নাইয়ের জোয়াকিম গোল করে হারিয়ে দেন মোহনবাগানকে। তুমুল সমালোচনা হয় সৌরভের। সৌরভের মতো আনকোরা একজনকে এরকম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলানোর জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে সঞ্জয় সেনকে অনেক কথা শুনতে হয়। চাকরি যায় তাঁর। নয় মাস পর সেই সৌরভ এখন মোহনবাগানের মাঝমাঠের স্তম্ভ। যেমন সুন্দর স্ন্যাচিং সেরকম সুন্দর ডিস্ট্রিবিউশন ছেলেটার। চেন্নাই সিটির ম্যাচের পর হয়তো সেদিন বড় দল থেকে বাদই পরে যেত সৌরভ। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগিয়ে এইভাবে ফিরে আসা যেন আরেক রূপকথার গল্প। আর শুধু সৌরভ কেন? এবারের লিগে সুযোগ কাজে লাগিয়েছে শঙ্কর রায়, অরিজিৎ বাগুইদের মত বাঙালি তরুণেরা। শিল্টন পালের মতো একজন অভিজ্ঞ গোলকিপার ডার্বির মতো ম্যাচে শিশুসুলভ ভুল করতে সুযোগ এসে যায় শঙ্করের কাছে। গত একবছর তাকে শিল্টনের ছায়াতে থাকতে হয়েছে দলের দ্বিতীয় গোলকিপার হিসাবে। প্রথম সুযোগেই বাজিমাত করে শঙ্কর। অনবদ্য আউটিং এবং গ্যাদারিং দেখিয়ে দর্শকদের মন এমনভাবে জয় করেছে শঙ্কর যে এবার শিল্টনের ফিরে আসা মুশকিল। চোখের সামনে আইএসএলে মোটা টাকার বিনিময়ে চলে যেতে দেখেছে নিজের সতীর্থ শেখ ফৈয়াজ, নিখিল কদমদের। তাদের থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না কোন্নগরের অরিজিৎ বাগুই। সেই প্রত্যাখ্যান যেন এবারে তার খেলাতে চরম বদল এনে দিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে অসাধারণ সব ক্রস বাড়িয়েছেন এবারের কলকাতা লিগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উইং ব্যাক অরিজিৎ। শুরুতেই বলেছি কলকাতা লিগে পেশাদারিত্বের থেকেও বড় চালিকাশক্তি হল আবেগ। সেটাকেই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে এগিয়ে চলেছে এই অনামী বাঙালি তরুণেরা। সযত্নে লালন করেছে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নকে। আবেগের তাড়না না থাকলে রহিম নবি, দিপেন্দু দুয়ারি, অরূপ দেবনাথ, শুভ কুমারদের মতো একদা বড় ক্লাবে খেলে যাওয়া ফুটবলাররা কেনই বা নামবে? লোকে বলবে অফিসের হয়ে খেলতে হয় তাই নামে। কিন্তু কোথাও তাদের খেলার মধ্যে সেই দায়সারা ভাবটা চোখে পড়ে না তো। হাজার হাজার সমর্থকদের চিৎকারে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় যৌবনে। রহিম নবি মনে করেন লাল হলুদ জার্সিতে তাঁর নিজের যৌবনের দিনগুলোকে। শুভ কুমার ফিরে যান সবুজ মেরুন জার্সিতে ফেলে আসা তার অতীতে। তরুণদের প্রমাণ করার তাগিদ আর অভিজ্ঞদের ফুরিয়ে না যাওয়ার হুঙ্কারই কলকাতা লিগকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রাউড পুলার বানিয়েছে। এখানে কোচ, খেলোয়াড় নির্বিশেষে নিজেদের প্রমাণ করার খেলায় মত্ত।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...