কাষ্ঠসুন্দরী ও বাজারের দুনিয়া

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

জঙ্গলের আড়ালে পড়ে ছিল মানুষের মাপের বড়োসড়ো একটা কাঠের টুকরো । অদ্ভুত তার গন্ধ । তাকে ঘরে নিয়ে এলাম।

হলুদ উজ্জ্বল তার রঙ। আমার ঘরে সেই মানুষ-কাঠটি থাকে, তার দিনরাত নানা আবদার।

বললো, আমার চোখদুটো সুন্দর করে দাও। অনেক রাত জেগে নরুন আর বাটালি দিয়ে করে দিলাম তার পটলচেরা চোখ।

বললো, আমার পেটটা সরু আর কোমরটা চওড়া করে দাও । আর স্তন দুটো করে দাও ভারী । প্রচন্ড খাটলাম, জুড়লাম, বাদ দিলাম । খুব আদরে তাকে বানিয়ে তুললাম সুন্দরী । আমার দিন গেলো, কাজ গেলো –

আমি দেখলাম কাঠমানুষ মেয়েটির যা যা চাই সবই আছে। শুধু দরকার কিছুটা মন আর হৃদয় ।

আমার মন থেকে পাম্প করে কিছুটা মন ঢুকিয়ে দিলাম তার মধ্যে। আমার ডাক্তার বন্ধুকে বললাম, আমার হৃদয়ের আদ্ধেকটা সার্জারি করে ওর বুকে বসাও। হা হা করে উঠলো ডাক্তার – ‘ তাহলে তুমি অকেজো হয়ে যাবে!’ আমি বললাম, ‘তা হোক, তবু যত দিন বাঁচি সুন্দরকে দেখবো, সুন্দরকে ছোঁব।’

শেষ পর্যন্ত ডাক্তার আমার হৃদয়ের আদ্ধেকটা বসিয়ে দিল সেই কাঠ মানুষ মেয়েটির বুকে।

মেয়েটির মধ্যে তখন আর একটুও কাষ্ঠত্ব নেই । পরিপূর্ণতায় ভরপুর অপূর্ব সুন্দরী । নাচে গায় হাসে, ফিস ফিস কথা বলে, নিজে মাতে, অন্যকে মাতায়।

কাগজের পাতায় পাতায় মাল্টি-ন্যাশানাল বিজ্ঞাপন। মুখরোচক নানা শব্দ আর ভাবনার হাতছানি। পৃথিবীটা নাকি খুব ছোট হয়ে আসছে।

একদিন হলো কি ? আমার পৃথিবীটাকে ছোট করে দিয়ে, আমার হৃদয়ের অনেকখানি আত্মসাৎ করে, আমাদের ঘরের মেয়েটি পালিয়ে গেলো কোথাও । কোন বিদেশ বিভূঁইয়ে । পরে শুনলাম, বিশ্ববাজার নিয়ে নিয়েছে তার পেটেন্ট ।

সেই থেকে আমি আদ্ধেক হৃদয়ের বোঝা বয়ে বেড়াই । সেই থেকে আমি খুঁজি আরো এক মানুষীকে। আমার অবশিষ্ট হৃদয়টুকু তাকে দেব । তাকে দেবো আমার ক্ষমতা আর স্পর্ধা । তাকে দেবো আমার স্তব্ধতা । সে কখনো পেটেন্ট হবে না । সে কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না ।

Be the first to comment

আপনার মতামত...