উন্নয়নের মডেল : অজ্ঞানের আলোচনা

সুজন ভট্টাচার্য

 

সাতের দশক। নকশালি বিপ্লবের আগুন তখন নিভেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধের টগবগে আগুনের মধ্যেই শুরু হল আরেক ‘বিপ্লব’, সবুজ বিপ্লব। ভাকরা-নাঙালের জল, উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আর ট্রাক্টরের মহোৎসবে পাঞ্জাবে শুরু হল সবুজ বিপ্লব। এত গম ফলানো হবে যে আর আমদানি করতে হবে না। সবাই খুশি। সংবাদপত্রের পাতায় বড় বড় বিজ্ঞাপন, ট্রাক্টর চালাচ্ছে মাথায় পাগড়িপরা বুড়ো শিখ চাষি, হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার বৌ আর মেয়ে। আর পাঁচ বছরের পরে পাঞ্জাবেই কানাঘুষো শুরু হয়ে গেল, গোটা দেশকে খাওয়াতে হবে বলে সরকার পাঞ্জাবের ছোট কৃষকদের বলি চড়িয়েছে। খরচ সামলাতে না পেরে জমি বেচে দিতে বাধ্য হল বহু ছোট কৃষক। আর সেই জমি কিনে নিয়ে আরও ফেঁপে উঠল হাতগুনতি কিছু ধনী চাষি। আর সেই বিক্ষোভই ইন্ধন যোগাল খালিস্তানি আন্দোলনে। কৃষি উন্নয়নের মিথ বদলে গেল কার্তুজের পোড়া গন্ধে।

সবুজ বিপ্লব কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধরা যাক দামোদর উপত্যকার কথা। দামোদর আর তার শাখানদীগুলোর জন্য প্রতিবছর প্রবল বন্যা হয়। তাই স্বাধীনতার পরপরই আমেরিকার টেনেসি ভ্যালির অনুকরণে শুরু হল ডিভিসির কাজ। কত আলো, কত জল, উন্নয়ন বয়ে যাচ্ছে ফিডার ক্যানালের স্রোত বেয়ে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করালেন এক আদিবাসী মেয়েকে দিয়ে। হাততালি, ফ্ল্যাশের ঝলকানি, খবরের কাগজে বড় বড় ছবি, দেখেছ আমাদের প্রধানমন্ত্রী কত মহান! বোকারো, তিলাইয়া, মাইথন আর পাঞ্চেতে চারখানা বাধ। বাধের পিছনে জলাধার। সারাবছর যেখানে বোকারো আর দামোদরের স্রোত বাধা পড়ে থাকবে। কোথায় হল সেই সব জলাধার? আকাশে? নয়তো। জল ডুবিয়ে নিল শয়ে শয়ে আদিবাসী গ্রাম, তাদের ভিটে, দেবতার থান, চাষের জমি। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের প্রকল্পে তারা বাধ্য হল ঠিকানা সরিয়ে নিতে।

ডিভিসি চাকরি দিয়েছে শহুরে উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মানুষদের। তাদের পরিবারে বয়ে এনেছে স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতার সুযোগ। ডিভিসির চাকুরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য মেয়ের বাবারা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধই বাঁধিয়ে ফেলেন আর কি। কোথায় গেল সেই কানু সরেন আর বিলাসী হেমব্রমরা? যাদের ভিটে ডুবে গেল পাঞ্চেতের জলাধারে? যাদের চাষের জমি চলে গেল মাইথনের গর্ভে? কোথায় আছে তারা? তাদের কজনের চারচাকা জুটেছে? কজনের ঘরে আছে পাওয়ার সেভার এসি মেশিন? উত্তরটা আপনারা সবাই জানেন। কাজেই নতুন করে দিয়ে আর পরিশ্রম করতে চাই না।

আসলে উন্নয়ন কাকে বলে, এই বিষয়ে কোনও একক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় কোনওদিনই। ধরুন, আপনার অঞ্চলে একটি বিশাল মাপের বেসরকারি হাসপাতাল তৈরি হল। আপনি খুব খুশি, হার্ট অ্যাটাক কিংবা ক্যান্সারে আর বাইরে যেতে হবে না। আপনার পাড়ার রিক্সাস্ট্যান্ডের বিশু কিংবা আনোয়ারও খুব খুশি। আগে এখানকার লোকজন ঐ জনশূন্য অঞ্চলে যেত না। এখন যায়, ডাক্তার দেখানোর জন্য কিংবা পেশেন্টকে দেখতে। এটা নিশ্চয়ই উন্নয়ন। আপনার স্বাস্থ্যের চিন্তা কমল, আর বিশুদের রোজগারের সম্ভাবনা বাড়ল। কিন্তু যেদিন বিশু পড়ে গেল রিক্সা উল্টে আর তার স্ট্যান্ডের লোকজন তাকে নিয়ে দৌড়ল সেই বড় হাসপাতালে, সেদিনই তাঁরা বুঝে গেল ওক্টা তাদের জন্য নয়। কারণ তাদের পকেটে টাকা নেই। সঙ্গে সঙ্গেই সেই উন্নয়ন তাদের কাছে হয়ে গেল অর্থহীন।

মোদ্দা কথা হল এটাই। যে সমাজে মুকেশ আম্বানি আর হরি বাছারের একটা করেই ভোট, সেখানে এমন কোনও উন্নয়ন সম্ভব নয় যা দুজনকেই একইভাবে উপকৃত করবে। আগের উদাহরণটাই ধরা যাক। হাসপাতাল। বেসরকারি হাসপাতাল। মানে আমাদের বাইপাসের মতো। সেই হাসপাতাল বানাতে এল কেন? উদ্বোধনের মঞ্চে নেতানেত্রীরা এবং উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই গদগদ মুখে বলেছেন জনসেবা করার জন্য। আদতে কী হবে? বিল না মেটাতে পারার জন্য মৃতদেহ আটকে রাখার অনেক ঘটনা আমরা জানি। আবার বিল বাড়ানোর জন্য কত মৃতদেহের যে ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয় না, সেটাও আমরা জানি। তার মানে ব্যবসা হচ্ছে। অর্থাৎ উন্নয়নের প্রাথমিক এবং প্রধান সুফল পাচ্ছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সেই সুফল পাবে বলেই তাঁরা উন্নয়নকে নিয়ে এসেছে আপনার দোরগোড়ায়।

যাতে ব্যবসা হয়, তার গুণগান গাইবার বন্দোবস্ত রাখতে হয় বৈকি। তাতে দুটো লাভ। একদিকে আপনার খদ্দেরের সংখ্যা বাড়বে। অন্যদিকে আপনার ব্যবসার লাভলোকসানের অঙ্ককে ঢেকে রাখা যাবে উন্নয়নের মোড়কে। ফলে একটা তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতেই হবে। আছে স্পন্সর্ড মিডিয়া, কাগজ, আছে পেশাদারি বুদ্ধিজীবী যারা রোকরা পেলেই যা চাইবেন, তেমনটাই লিখে দেবেন, সেমিনারে বলবেন। ব্যবসায়ী শিখিয়ে দিলেন, বলুন উন্নয়নের জন্য পরিকাঠামো চাই। পরিকাঠামোর বিস্তার না হলে এদেশের মানুষের হাল ফিরবে না। এটাই উন্নয়ন। চাই রাস্তা, হেমা মালিনীর গালের মতো না হোক, কাছাকাছি কিছু। হবেটা কোথায়? জমি কোথায়? কেন? চাষের জমি কেড়ে নিলেই হবে। দেশ-দশ ও এগারোর জন্য এটুকু কৃচ্ছ্রসাধন তো করতেই হবে। নাহলে দেশ এগোবে কী করে? আর যদি বেগড়বাই করে, সিম্পলি গায়ে দাগা মেরে দেব দেশদ্রোহী বলে। তার মানে উন্নয়নের ফসল ভোগ করবে অন্য লোক, দাম দেবে আদিবাসী আর চাষি।

মোটামুটি নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই একটা আওয়াজ উঠল দেশে, সরকারি ক্ষেত্র মানেই অকর্মণ্য। সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়। কাজেই এক্ষুনি চাই বিলগ্নীকরণ। ইন্টেলেকচুয়ালরা কীর্তন শুরু করে দিল। বিলগ্নীকরণের জন্য একটা মন্ত্রকও তৈরি হয়ে গেল। সম্পত্তি বেচার টাকাতেই নাকি উন্নয়ন হবে। আবার নানাদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা দৌড়ে আসবে কারখানা করার জন্য। ওহ, কত্ত উন্নয়ন হবে রে বাবা, একটা নিলে একটা ফ্রি। একজনও প্রশ্ন করল না, দেশে সরকারি ক্ষেত্রের জন্মটা হল কীভাবে? কিছু সংস্থা নিশ্চয়ই সরকার নিজেই বানিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশই তো ছিল আদতে প্রাইভেট। চলছিল না, চালাতে পারছিল না বলেই তো সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হয়েছিল। তার মানে বেসরকারি সংস্থারও অকর্মণ্যতা থাকে। বেসরকারি সংস্থাও লাটে ওঠে। আবার যদি লাট খায়, তখন কে সামলাবে? কী শেখাল আমাদের বিজয় মাল্যা আর নীরব মোদি?

উন্নয়ন আসলে একটা ব্যবসা, যাকে জনহিতকরী একটা ঘোমটা পরানো যায়। তামিলনাড়ুতে স্টারলাইটের তামার কারখানা নিশ্চয়ই একটা উন্নয়ন। কত লোকের চাকরি হল বল দেখি? হুম, ছিল তো অজ পাড়াগাঁ। দেখেছ এখন কত্ত বড় বড় রাস্তা, বাড়ি, দোকানপাট, মল। ওমা, সেই উন্নীত লোকজনও দেখি ঘেরাও করে বসল জেলাশাসকের অফিস। কী দাবি? তামার বিষে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে মানুষ, পরিবেশ। এমনকি দশ মাইল দূরের চাষের জমিতেও থাবা বসিয়েছে সেই বিষ। বন্ধ করো কারখানা। কোথায় যাবে তাহলে উন্নয়ন? মধ্য ভারতের অরণ্য আর পাহাড় দখল করে, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তো খনি আর কারখানা বসিয়েছিল সরকার। আর এখন সেই কাজটাই করে বেদান্ত বা স্টার লাইট, সরকার কেবল তাদের উন্নয়নের হাত শক্ত করে। যারাই বিরোধিতা করে, তাদের উচ্ছেদের জন্য আর্মি নামিয়ে রেখেছে। বুঝেছ বাওয়া, উন্নয়নের কত জোর!

বুঝেছে কেরালা। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার স্থানে-অস্থানে পাহাড় কেটে বানানো খনি আর রিসর্ট যে মাটি আলগা করে দিচ্ছে, হুঁশিয়ারি এসেছিল অনেক আগেই। পাত্তা দেবে কে? উন্নয়নের মজা তো বহুমুখী। একটা প্রত্যক্ষ, আর অন্যগুলো আসে টেবিলের তলা দিয়ে। আর পরকীয়া প্রেমের রস তো আলাদা। অতএব চালাও পানসি ব্যাক ওয়াটার। আর আগস্টের বন্যা যখন সবকিছু ধুয়েমুছে সাফ করে দিল, তখনও কি টনক নড়েছে? পুঁজির টনক নড়ে না। মুনাফার গন্ধ ছাড়া সে অন্য কিচ্ছু বোঝে না। তাই কেরালার ভয়ানক অভিজ্ঞতার পরেও এমন উন্নয়নে কোনও রাশ টানা হবে না। আর কেনই বা হবে? উন্নয়নের প্রচলিত মডেলের মানেই তো হল কোম্পানির স্বার্থে পিপড়েতুল্য মানুষদের আত্মবলিদান।

যদি সাদা চোখে বলা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের চাকচিক্য যে অনেক বেড়েছে, সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু তারও একটা মিটার আছে, যাকে বলা হয় মাথাপিছু জিডিপি। ১৯৪৭ সালে ৩১ কোটি মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৯০০০ টাকা। আর ২০১৮ সালের মার্চে সেটাই ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। জনসংখ্যা যখন আনুমানিক ১৩৪ কোটি। অর্থাৎ এই ৭১ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ৪৩২%, আর মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ১৩৩৩%। তার মানে প্রতি ১% জনসংখ্যার বৃদ্ধির উপর মাথাপিছি জিডিপি বেড়েছে ৩০৮%। কে বলে উন্নয়ন হয়নি? মুশকিল হল, একই সাথে এই কথাটাও বলা হয় যে জিডিপির ৭০% রয়েছে ১০% মানুষের হাতে। আর বাকি ৩০% আছে ৯০% মানুষের হাতে। এই দুটো ফ্যাক্টরকে মেলালে দেখা যাবে উপরের ১০%-এর মাথাপিছু জিডিপি হল ৮,৪০,০০০ টাকা। আর নিচের ৯০%-এর মাথাপিছু এই হার হল ৪০,০০০ টাকা। এর মধ্যেও নানান স্তর আছে। অঙ্কটাকে জটিল না করেও বোঝা যায়, মাথাপিছু জিডিপির অঙ্ক দিয়ে বাস্তবতাকে ছোঁয়া যাবে না।

উন্নয়ন কোনও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নয়, একটা নিখাদ রাজনৈতিক পলিসি। কার স্বার্থে উন্নয়ন, কাদের দামে উন্নয়ন — এই দুটো প্রশ্নকে বিচার না করে উন্নয়নের মুখ বোঝা যাবে না। অর্থনীতির তত্ত্বে ট্রিকল ডাউন থিওরি বলে একটা কথা আছে। সেটা যদি সত্যি বলে মানা হয়, তাহলে কালো টাকারও সমাজে একটা সদর্থক ভূমিকা আছে বলেই মানতে হবে। সেই বিতর্কে না ঢুকে বরং একটা সাম্প্রতিক সমস্যায় আসা যাক। বিজয় মাল্যা কিংবা নীরব মোদিকে নিয়ে এত হৈচৈয়ের কারণ তারা ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে পালিয়ে গেছে। এমন সব বকেয়া ঋণের একটা অংশ ব্যাঙ্কগুলো তাদের খাতা থেকে মুছে ফেলেছে। শুধু স্টেট ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই এই অঙ্কটা হল ২,৪৯,৩২৭ কোটি টাকা। তার মানে বড় বড় কোম্পানিগুলো এই টাকা ব্যাঙ্কের থেকে ধার নিয়ে আর শোধ দেয়নি।

ব্যাঙ্ক সেই টাকাটা কোত্থেকে পেয়েছিল? সাধারণ মানুষের আমানত থেকে। যদি ধরেও নেওয়া যায়, ব্যাঙ্কের আমানতকারীদের অন্তত ৫০% আগের হিসাবের উচ্চতর ১০%-এর মধ্যে পড়ে, তাহলে বাকি ৫০% অন্তত নিচের ৯০%-এর প্রতিনিধি। তার মানে তাদের আমানত মেরে শিল্পপতি বা বড় ব্যবসায়ীদের ফুটুনি চলছে। সেই ক্ষেত্রে বলতে হবে ট্রিকল ডাউন নয়, এই প্রক্রিয়ার মানে হল সাকিং ফ্রম দা বিলো, নিচ থেকে চুষে নেওয়া। যে অর্থনীতিতে সাকিং ফ্রম দা বিলো-ই হলো প্রবণতা, সেখানে উন্নয়নও অবশ্যই নিচতলাকে ধ্বংস করেই হতে হবে, উপরতলার স্বার্থে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...