সৌমিত্র দস্তিদার
বিগত কয়েকদিন ধরেই সোশাল মিডিয়ায় ভেসে আসছে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের পরিসংখ্যান ও নানা তথ্য। খুব সম্প্রতি যে এ ধরনের কিছু ঘটেছে তা নয়, তবুও মাঝেমধ্যেই সীমান্তের এপারে এই নিয়ে আলোচনা জেগে ওঠে অথবা জোর করে জাগিয়ে তোলা হয়। সত্যিটা কী? দেশে মৌলবাদ থাকলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অবিচার থাকবেই। আছেও। কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের অস্তিত্ব ও তীব্রতা এই সময়ের বাংলাদেশে কতখানি গভীর?
অত চিন্তাভাবনা না করে একবার না হয় বাংলাদেশে সরাসরি ঘুরেই আসুন। দেখতে পাবেন যতটা খারাপ আপনি মনে মনে ভাবছিলেন, দেশটা কিন্তু ততটা খারাপ নয়। প্রকৃতির তো তুলনা নেই। যেতে যেতেই চোখে পড়বে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ, কত কত ঐতিহাসিক জনপদ, মন্দির, মসজিদ, দরগা। অজস্র, অসংখ্য নদী। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ, তিতাস, কীর্তনখোলা, আরও আরও কতশত জলধারা যা মায়ের মমতায় আপনাকে নিয়ত কাছে ডাকবে — আয় আয় করে। দু’দণ্ড নদীপাড়ে স্থির হয়ে বসুন। দূর থেকে ভেসে আসা আজান ও মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে শুনতে যাবতীয় বিদ্বেষ সরিয়ে রেখে একবার, অন্তত একবার সাবেক পুববাংলা, এখনকার বাংলাদেশের প্রতি আপনার ভালোবাসার হাতটা বাড়িয়ে দিন। দেখবেন আপনার মধ্যে দেশভাগের নানা কাহিনী, আখ্যান আশৈশব যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ চারিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের সাধারণ লোকের আতিথেয়তা, আন্তরিকতা, বুকের উত্তাপ কখন ধীরে ধীরে তা মুছে দিয়েছে।
এটা সত্যি যে আমাদের চেনাজানা বন্ধুস্বজনদের অধিকাংশেরই পুজোভ্রমণের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। দিল্লি, মুম্বাই, গোয়া, চেন্নাই বাদ দিন, পাটায়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইউ এস এ… সব থাকতে পারে, শুধু প্রতিবেশী বাংলাদেশ নেই। একেবারে নেই বলব না, তবে তা নিতান্তই কম। হতে পারে পাটায়া, নিদেনপক্ষে কাঠমাণ্ডুর গ্লামার ওদেশের নেই। বাংলাদশের তথাকথিত স্ট্যাটাসও মুক্ত অর্থনীতির এপার বাংলায় নবোত্থিত এলিট বৃত্তে কম। তার ওপর ওটা আবার আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ।
অনেকের মধ্যেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে গেছে ফেলে আসা অতীত। বসত, তুলসীতলায় প্রদীপ, পুকুরের মাছ, ঠাকুরদালান, দোল দুর্গোৎসব — সব ফেলে দেশত্যাগের গল্প। স্মৃতি রোমন্থনের এক সমস্যা থাকে, তা ক্রমে বাস্তব থেকে কল্পনায় চলে যায়। নির্মোহভাবে এতবছর বাদে আলাদা আলাদাভাবে উদ্বাস্তু আখ্যানের প্রতিটিকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবেন অনেক ঘটনার পিছনে সত্য নিশ্চিত ছিল, আবার অতিকথনও ছিল অনেক। দেশভাগের পরে পরেই বিপুলসংখ্যক হিন্দুর এপারে চলে আসার জন্যে দায়ী যদি ওপারের মুসলমানেরা হয়, তাহলে প্রশ্নটা ওঠা উচিত যে কলকাতা, নদীয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের দেশত্যাগের কারণ কী!
রাজশাহী গেলে শুনতে পাবেন অন্য এক ঘটিবাঙাল দ্বন্দ্ব। পুরনো রাজশাহীর বাসিন্দাদের কাছে এপার থেকে যাওয়া মুসলমানেরা ঘটি, মোহাজির হয়েই থেকে গেছেন। খুলনায় আমার এক বন্ধুর মা আমাকে চমকে দিয়ে শুনিয়েছিলেন — এই নব্বই বছর বয়সেও আমাকে ঘটি শব্দটা শুনতে হয়। খারাপ লাগে। কলকাতার শৈশবকে মনে পড়লে কষ্ট হয়। রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে ধূসর চোখে ওপারের চাঁচলের দিকে তাকিয়ে থাকেন আমার আর এক বন্ধুর মা। এরকম অজস্র চরিত্র পাবেন ওপারে। মিশতে মিশতে দেখবেন এপারের উদ্বাস্তু বিষাদ, ওপারেরও কম নয়।
দেশভাগের যন্ত্রণা তাই নিছক হিন্দুর নয়। মুসলমানেরও। দেশত্যাগের পিছনেও থাকে নানান হিসেবনিকেশ, জটিল অর্থনীতি। হিন্দু বলতে আমাদের সামনে যে জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়, যে একক সমাজের ছবি আঁকা হয়, তা তো সম্পূর্ণ ভুল। হিন্দুদের মধ্যে অজস্র বিভাজন, জাত পাত, উপসম্প্রদায়। বর্ণহিন্দুদের হাতে একদা ছিল পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক মালিকানা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে বিপুল জমিদারির সিংহভাগই ছিল হিন্দুদের দখলে। প্রজাদের বড় অংশ যেমন মুসলমান, তেমনি নিম্নবর্গের হিন্দুরাও ছিলেন। ১৯৪৭ সালের আগে থেকে সমাজের প্রভাবশীল হিন্দুরা সম্পত্তি বিনিময় করে এপারে থিতু হলেন। তাদের ওপর নির্ভরশীল নাপিত, পূজারী ঠাকুর, ঘটক, ধোপারাও আচমকা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় দেশ ছাড়লেন। পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে দেশ ত্যাগ করলেন। মুসলমানদের সঙ্গে থাকা যায় না — এই সাইকিও হিন্দুদের এদেশে চলে আসার পিছনে কাজ করেছে ও এখনও করছে। দাঙ্গা, ভয় দেখানো এসব কারণও নিশ্চয়ই ছিল, ও আছেও। তবু বলব যে ওপারের হিন্দু নির্যাতনের যে কাহিনী আপনি শোনেন, তা অনেকটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অতিকথন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের এক ব্যাঙ্ককে লাটে তোলা জনৈক অর্থনীতির গবেষকের ‘গবেষণা’ এপারে অনেক সাংবাদিক, বামমনস্কদেরও ইদানীং প্রভাবিত করছে। ওই যে তিনি বলেছেন — কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে। উনি অবশ্য নির্দিষ্ট করে কোন হিন্দু তা বলেননি। উচ্চবর্ণ না নিম্নবর্ণের দলিত তা জানা দরকার। উনি তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন প্রতিদিন ৬৩২ জন হিন্দু ওপার থেকে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। বিস্মিত হচ্ছি পাশাপাশি অন্য একটি তথ্য দেখে। ১৯৯৪ সালে আসামের রাজ্যপাল লেফট্যানেন্ট এস কে সিনহা ভারতের রাষ্ট্রপতিকে এক চিঠিতে জানাচ্ছেন, প্রতিদিন অসমে ৬ হাজারের কিছু বেশি মুসলমান বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকছে। সংখ্যাতত্ত্ব বলছে এরকম অনুপাতে ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটলে বাংলাদেশিরাই অসমে রাজ করবে। অসমিয়া জনসংখ্যার অনুপাতে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেশি এই হাস্যকর যুক্তি অবশ্য বেশিদিন ধোপে টেকেনি। কিন্তু এখন দু’পারের দুই গবেষকের মতামত পাশাপাশি রাখলে চিন্তিত হচ্ছি এটা ভেবে যে এভাবে অনুপ্রবেশ ঘটলে তো বাংলাদেশের জনসংখ্যাই একদিন শূন্য হয়ে যাবে। হিন্দুরা বাধ্য হয়ে এপারে আসছেন। অন্যদিকে আসামে মুসলমানেরা যাচ্ছে দাঙ্গাফ্যাসাদ করতে। দুটির সংখ্যাই, কী আশ্চর্য প্রতিদিন ৬ হাজারের বেশি। তাহলে রোজ ১২ হাজারের বেশি লোক বাংলাদেশ থেকে চলে এলে গোটা দেশ জনমানবহীন হতে আর কতদিন লাগবে তাই নিয়ে নতুন গবেষণার সময় এসেছে। প্রসঙ্গত, দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১.৩৩ কোটি, শতাংশের হিসেবে এখন হিন্দুরা মোট জনসংখ্যার অনেক কম হলেও এই মুহূর্তে হিন্দুদের সংখ্যা ২ কোটির বেশি, আর সংখ্যা হিসেবে এটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। মোট জনসংখ্যার ৮-১০% হয়েও সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্যরকম বেশি। এই তথ্য কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলাদেশে হিন্দুদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে যে প্রচলিত একমাত্রিক ন্যারেটিভ, তার বিরুদ্ধে কথা বলে৷
না, আমার কথাও বিশ্বাস করার দরকার নেই। তার চেয়ে আপনাকে বলব পারলে এবারের পুজোতেই ঘুরে আসুন বাংলাদেশ। নিজে সরেজমিন তদন্ত করে আসুন। একটা দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলার আগে একবার অন্তত জেনে আসুন প্রকৃত ছবিটা কী!
চলে যান পুটিয়া নাটোরের মাঝামাঝি অবিভক্ত বঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপুজোর আসরে। রাজা কংসনারায়ণের তাহেরপুরের প্রাসাদ আজও চলেছে সেই পুজো। পুটিয়ার শিবমন্দির বা নাটোরের অভিজাত স্থাপত্য দেখতে ভুলবেন না। কুষ্ঠিয়ার লালন শাহ-র মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি তো দেখবেনই। ঘুরতে ঘুরতে আপনি জেনে যাবেন শতাংশের হিসেবে কম হলেও এখনও ওপারে হিন্দু জনসংখ্যা দু’কোটির ওপরে। জানবেন এখনও ওপারে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা হিন্দুদেরই হাতে। রাজশাহীর ভোলানাথ হিন্দু অ্যাকাডেমিতে গিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের সম্মিলিত গীতাপাঠের সাক্ষী থাকুন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি তো দেখবেনই, পুরনো ঢাকার বিউটি লজেও একবার যান। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে নেতাজী, হালের জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আড্ডার জায়গা ছিল ওই লজ। এরকম চেনা অচেনা জনপদে হাঁটতে হাঁটতে টেরই পাবেন না কখন আপনি মুসলিম বিদ্বেষের থেকে বেরিয়ে এসেছেন। দাঙ্গা কখনও একতরফা হয়নি। হয়ও না। তাই শুধু একটিমাত্র জনগোষ্ঠীকে সারাজীবন অপরাধী করে রাখা নির্বুদ্ধিতা। স্মৃতি থেকে বেরিয়ে সারা বাংলাদেশের চমৎকার সব ঝলমলে মুখের দিকে তাকান। গল্পকার, সিনেমা পরিচালক, কবি, চিত্রশিল্পী, ছাত্র, রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি অজস্র সাধারণ মানুষের উষ্ণতা আপনাকে জড়িয়ে রাখবে। অন্যের সুকৌশলে গিলিয়ে দেওয়া হিন্দু-মুসলমান সমীকরণটা মনে না রেখে ভালোকে সোজাসুজি ভালো, খারাপকে খারাপ বলুন। দেখবেন আপনার ভালো লাগবে। আর তাহলেই আমরা দুই ধর্মের আড়ালে থাকা ঘৃণা-ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করতে পারব।