যশোধরা রায়চৌধুরী
যে কোনও বায়োপিক দেখার ক্ষেত্রে দর্শকের একটা ঝুঁকি থাকে। বিখ্যাত কোনও চরিত্র, যে কোনও সেলিব্রিটি, দর্শকের মনের ভেতরে একভাবে বাসা বেঁধে থাকেন। তাঁর একটা ছবি তো থেকেই যায় মানসপটে।
সে ছবির সঙ্গে যদি পরিচালকের ছবিটি না মেলে? এই ভয়টা তাড়া করে ফেরে। আমি ক্রিকেটপ্রেমী নই, কিন্তু কল্পনা করতে কষ্ট হয় না শচীন তেন্ডুলকর বা মহেন্দ্র ধোনির ভক্তদের তাঁর বায়োপিকনির্মাতার কাছে কী ধরনের আশা আকাঙ্ক্ষা থাকবে। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে সাযুজ্য সেখানে না–ও থাকতে পারে। “যা ইতিমধ্যেই ভক্ত জেনে বসে নেই এমন নতুন কোনও উপাদান কি পাবেন তিনি? নতুন কোনও আলো পড়বে কি, আইডলের জীবনে?” প্রশ্ন থাকে এখানেই। এবং বহুক্ষেত্রেই ঢ্যাঁড়া পড়ে পরিচালকের পেরে ওঠায়।
মন্টোভক্ত হিসেবে মন্টোর ওপর ছবি দেখতে যাবার আগে, গত দু বছরে খবর হিসেবে পড়া মন্টো ছবিটি নিয়ে নানা আলোচনা, বিতর্কও মাথায় থেকে গেছে। আমার আকৈশোরের মন্টোপ্রীতি, তাও তো বস্তুত, আর্থসামাজিক এক ঘটনাই।
সত্তরশেষের –– আশির দশকে বেড়ে ওঠা বাংলা অনুবাদে প্রথম মন্টো পড়েছিলাম ক্লাস টেনে। কোনও আঁতেল বন্ধু বা দিদিদাদার হাত ধরেই। নারীকেন্দ্রিক বেশ কিছু গল্প এবং হ্যাঁ, টোবা টেক সিং গল্পের অভিঘাত এখনও মাথায় থেকে গেছে। বহু পরে মন্টোর লেখা বলিউডের ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিকথা ইংরেজি অনুবাদে কিনি, যেখানে তরুণ অশোক কুমারের নায়ক দশার কথা পড়েছি। আরও পরে মন্টো ও ইসমতের ইনটেলেকচুয়াল বন্ধুত্ব ও প্রীতির কাহিনি পড়েছি। এইসব পড়া জানা শোনা, মন্টো সম্বন্ধে আমাকে যতটা আগ্রহী করেছে ততটাই পোজেসিভ করে তুলেছে।
অন্যদিকে দেশভাগ ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত যাবতীয় অরূপকথা ও রূপকথা আমাকে যুগপৎ মুহ্যমান ও তাড়িত করে। সেই সময়ের সাদাকালো ছবিগুলোকে রঙিন দেখানোর ভয়, অধিক সেন্টিমেন্টালাইজ করার (এ শব্দের বাংলা নেই!) বা ক্লিশেতে পরিণত করার ভয় থাকে। বিশেষত ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল অব্দি বিধৃত একটা কাহিনি আজকের বলিউড মুভি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বিপদ, যা ইদানীং হিন্দি ছবির সব পিরিয়ড পিসেই থাকে।
পুরনো ফোন, হোঁৎকা কালো। অথবা গোল হলদেটে আলোর ডুম। চেয়ে চেয়ে থাকে পিরিয়ড ভুল করে এনে ফেলা এক গাদা প্রপ–এর বাড়াবাড়ি, অন্দরসজ্জার নিখুঁত রংমিলান্তি চিত্রায়ণ, সবটাই মিলেমিশে না গিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে চেয়ে চেয়ে থাকে ভালো রান্না না হওয়া আলুপটলের মতো।
এবং শেষমেশ প্রাপ্তি হয় কিছু স্মার্ট ডায়ালগ আর জড়ভরতের মতো চরিত্রদের আসাযাওয়াসম্বলিত এক হাস্যকর পাপেট শো।
সেই সাবধানী ও ঈষৎ সন্দিহান মন নিয়ে দেখতে গেলাম মন্টো।
নন্দিতা দাসের মন্টো। নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকি অভিনীত মন্টো। সৎ কিন্তু সেন্টিমেন্টাল কোনও পিরিয়ড পিস, অথবা অসৎ ও শব্দমুখর কোনও কুনাট্য হতেই পারত। হল না।
যদিও জানতাম অভিপ্রায় ভালো থাকবেই থাকবে এ ছবিতে। তবু। অতিরিক্ত অসাম্প্রদায়িক মেসেজ, অতিরিক্ত সেকুলার রাজনৈতিক–সঠিক বাণী, সবটাই ক্লিশে হয়ে যাবার ভয় আমার মর্মে।
হল না। যা আশা করেছিলাম তারও চেয়ে কয়েক গজ ওপর দিয়ে কেটে বেরিয়ে গেল এই ছবি। আজকাল যেটা সচরাচর ঘটে না। পরিচালককে অভিনন্দন, সব “বাণী”র ওপর দিয়ে একজন আস্ত মানুষের গল্প বলে গেলেন তিনি। এক মানুষের ক্ষতবিক্ষত জীবনের গল্প। ব্যক্তি, বিশেষ করে সে যখন এক লেখক… তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও ব্যঙ্গে জর্জর করেন যিনি লেখায় তাঁর আশপাশকে, সেই লোকটির অন্তর্লীন ভালনারেবিলিটি। ভুল সিদ্ধান্ত। হেরে যাওয়া। সবার থেকে সরে যাওয়া। এলিয়েনেশন। প্রচণ্ড ইমপালসিভ, আবেগপ্রবণ এক সত্তার ক্রমশ ভ্রান্তি ও মানসিক অসুখের দিকে চলে যাওয়া। সবটা মিলিয়ে নিঝুম করে দেওয়া এক “চেনা মানুষের” কথা।
গল্প বলে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। মন্টো সম্বন্ধে যাঁর বিশেষ ধারণা নেই তিনি এ ছবিতে হয়ত আরও বেশি পাবেন…। তবে মন্টো যেমন এই ছবির চরিত্র তার পাশাপাশি ১৯৪৬ , ১৯৪৭, ১৯৪৮ও এই ছবির চরিত্র। ভারত এবং পাকিস্তান, সদ্য ছুরিকাঁচি চালানো দুই উপমহাদেশিক সদ্যোজাত রাষ্ট্র এই ছবির চরিত্র। দেশভাগের বেদনা এই ছবির অন্যতম উপাদান। সাম্প্রদায়িক হানাহানি, হিন্দু মুসলমানের ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ। যেগুলো আজকের, ২০১৮-র ভারতের প্রেক্ষিত থেকে একেবারেই তাৎপর্যময়। কিন্তু সে চালচিত্রকে বাদ দিলেও, মন্টো ছবি হিসেবে স্পর্শ করে আরও অনেক জায়গায়।
স্ক্রিপ্ট সম্বন্ধে ইতিমধ্যেই ক্রিটিকদের রিভিউ খুব ভালো। যেন অনায়াসগতিতে মসৃণ কাহিনি বয়ন। রসবোধে টইটুম্বুর। বন্ধুত্ব প্রেমের কথার ভেতরে আড়ষ্টতা নেই। বিশ্বাসযোগ্য পাকিস্তানি ভদ্রতার ছবিগুলিও। মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন প্রতি পদে নন্দিতা। একেবারে তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘটনাকে বুনে দিয়েছেন বড় ঘটনার সঙ্গে। জীবনযাপনের গল্প হয়ে উঠেছে তাই। সবচেয়ে ঝকঝকে, উইট সম্পন্ন, তীব্র তীক্ষ্ণ হল স্ক্রিপ্টের যে জায়গাগুলো মন্টোর কথা, সেগুলো। বই থেকে তোলাই বলা যায় প্রায়। অথচ কেতাবি লাগে না একেবারেই। কেননা তার পেশকারির মধ্যে আছে অসম্ভব পরিণত ভাবনা। অবশ্যই অভিনয়। মানে নওয়াজ।
পরিমিত অভিনয়গুলো মনে দাগ কেটে যায়। নওয়াজ তো চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেনই। শুধু তাঁর মুখ বা চোখদুটিকে ব্যবহার করেই অনেক সময় দৃশ্যের পর দৃশ্য গড়ে উঠেছে। নওয়াজ সব ম্যানারিজম ছেড়ে এখানে কাজ করেছেন বলেই তিনি ধন্যবাদার্হ। তবে আরও উল্লেখের দাবি রাখে সাফিয়া চরিত্রের অদ্ভুত সংবেদনশীল অভিনেত্রী রসিকা দুগল। আর আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত ইসমত চুঘতাইয়ের চরিত্রে রাজশ্রী দেশপান্ডে। শ্যাম চরিত্রে তাহির রাজ ভাসিন যথাযথ।
তরুণ ‘অশোককুমার’-এর ম্যানারিজম সহ অভিনয় চমৎকার। আর একটু হলেই ক্যারিকেচার হয়ে উঠত, কিন্তু হল না। দক্ষতা পরিচালকের। সংযম বোধে ভরপুর তিনি। পুরনো প্রায় প্রতি চরিত্র কথা বলে ওঠে। চেনা যায় না আজকের অভিনেতাকে। সাজসজ্জায় চল্লিশ পঞ্চাশের দশকের উপস্থাপনা এতটাই বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। হয়ত আরও দক্ষ দর্শক ভুল বার করতে পারবেন। আমি পারিনি।
আর অসম্ভব সুপ্রযুক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, গোটা ছবিতে একটি কি দেড়খানা গানের ব্যবহার, স্নেহা খানওয়ালকারের সঙ্গীত পরিচালনা মুগ্ধ করে। কেননা এ ছবিতে আবহসঙ্গীতের বাছাই আমার কাছে প্রায় ছবির চরিত্রের মতোই স্পষ্ট এক উপস্থিতি। এই ব্যক্তিত্বময়তা নন্দিতা দাসকে পরিচালক হিসেবে অনেক উঁচুতে তুলে দিল আমার চোখে। একটি বিশেষ ব্যক্তির অনুষঙ্গে জ্যাজের প্রয়োগ। কাটাকাটা স্পষ্ট নোটস। একটি অনুভবের সঙ্গে সরোদের উপস্থিতি। এসব ছাড়াও গোটা ছবি জুড়ে রসুল পুকুট্টির সূক্ষ্ম কারুকাজ বয়ে গেছে। আমার ছবিটা আরও একবার দেখার ইচ্ছা শুধু এই শব্দঝংকার অনুভব করার জন্যই।
মন্টোর তীব্র শ্লেষের ঝলক প্রতি ছত্রে। তবু এ ছবি শুধুই স্মার্ট ডায়ালগের পিণ্ড নয়। তার চেয়ে অন্তত আশি শতাংশ বেশি অন্য কিছু। জোরালো ভিশুয়াল আর অন্তত পাঁচটি ছোট, বা অণু সিনেমা।
সবচেয়ে বড় অপ্রত্যাশিত নন্দিতা দাসের এ উপহারটাই।
ছত্রে ছত্রে মন্টোকে পড়ার প্রমাণ নন্দিতা রেখেছেন এ ছবিতে। প্রাত্যহিক ‘সত্য’ চরিত্রের হাঁটাচলার মাঝে মাঝে মন্টোর গল্পের ‘নির্মিত’ চরিত্রকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে এক বিভ্রান্তি বা “মজা”র সৃষ্টি করেছেন। এই খেলা বা এই নির্মিতিটা দেখার অভিজ্ঞতাই একেবারে হাঁ করে দিয়েছে আমার মতো দর্শককে। চেনা গল্প হোক বা অচেনা গল্প, মন্টোর গল্পের পাঞ্চ অক্ষত রেখে, তাঁকে তাঁর জীবনকাহিনির সঙ্গে মেলানোমেশানোর আশ্চর্য কৌশল আমার মতে এ ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ঝটকা লাগে।
দর্শক হলে গিয়ে দেখে আসুন, বলে দিলে অর্ধেক মজাই মাটি।
একেবারে শেষে শুধু একটাই অনুযোগ, বা আফটার থট। শেষের দিকে মন্টোর পতন বড় ধীর ও কষ্টকর। লাহোর চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তার প্রমাণ হিন্দি ছবির জগত থেকে বিচ্ছিন্ন, মুম্বইয়ের বন্ধমহল থেকে বিচ্ছিন্ন মন্টোর ক্রমে একা হয়ে যাওয়ায়। এবং দেশভাগ সম্বন্ধে তিক্ততা ছত্রে ছত্রে লিখতে থাকার অব্যবহিত ফল : একদিকে রক্ষণশীল মুসলমান পাকিস্তান, মূলধারার পাকিস্তানিদের আক্রমণ আর অন্যদিকে প্রগ্রেসিভ বামপন্থীদের ভুল বোঝা। এখানে মনে পড়বেই দুটি বাংলা প্রডাকশনের কথা। ব্রাত্যজনের “রুদ্ধসংগীত” নাটকটির কথা। যেখানে দেবব্রত বিশ্বাস ক্রমশ অ্যালিয়েনেটেড ও একা হয়ে যান। অন্যদিকে ঋত্বিক ঘটকের মানসিক হাসপাতালের বসবাসের গল্প নিয়ে তৈরি কমলেশ্বর–এর দেব্যু ফিল্ম “মেঘে ঢাকা তারা”। সৃষ্টিশীল মানুষের সঙ্কট সর্বত্র এক ধরনের। বিশেষত এঁদের কালখণ্ড এক। বিশেষত ঋত্বিকের বিষয়বস্তুও ছিল পার্টিশন।
কিন্তু এই জায়গায় এসে নন্দিতা দাস কিছু ক্লিশেকে বাদ দিতে পারেননি। সংযত থাকলেও, গুরু দত্তের “পিয়াসা” ছবির সেন্টিমেন্টালিজম এসেছে। ক্রমাগত মদ্যপান করতে থাকা পতনশীল মন্টো, তাঁর পরিবারকে অবহেলা, ও পরিবারের উদ্বেগ, সর্বংসহা স্ত্রী। এই অংশে সামান্য হলেও আমার মতো দর্শক অস্থির হয়ে ওঠেন। কেননা, বাংলায় অন্তত, অনন্ত সৃষ্টিশীলের সংজ্ঞাই প্রায় হয়ে গিয়েছে অপরিমিত মদ্যপান ও স্ত্রী সন্তানকে উপেক্ষা। আমরা যত না মনোযোগ দিই সৃষ্টিশীলতার দিকটায় তার চেয়ে অনেক বেশি দৈবী মাহাত্ম্য আরোপ করি মদ্যপানে আর অনিয়মিত যাপনে! এ প্রায় এক রোগের মতো।
নন্দিতা দাস অবশ্য অব্যবহিত পরেই আবার সামলে নিয়েছেন। ফলত ছবির শেষ একেবারেই দৈবী পতনের আখ্যান থাকেনি। অসামান্য জোর এক ধাক্কা দিয়ে শেষ হয়েছে প্রায় হঠাৎ করেই।
শুধু পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাছে মন্টোর কথা বলার যে ভিডিওটি নেটে দেড় বছর আগেই ঘুরছিল সেটির অনুপস্থিতি বড় প্রশ্ন জাগায়। এখানে সে বক্তৃতা দেবার উল্লেখে মন্টো বলেন যাও আগে প্রিন্সিপালের অনুমতি নিয়ে এসো আমি মদ্যপান করে বক্তৃতা দিতে পারি কিনা।
বোধহয় শেষমেশ প্রিন্সিপালের অনুমতি মেলেনি, তাই দৃশ্যটি বাদ দিতে হয়েছিল!!! এমন ভাবনার পর পর জানতে পারলাম, ইন ডিফেন্স অফ ফ্রিডম বলে শর্ট ফিল্মটি আদৌ এই ছবির অংশ হিসেবে ভাবা হয়নি। ওটা একটা আলাদা ছবি। কেয়াবাৎ!!!
ফিরাকের পর দীর্ঘ দশ বছরের বিরতি শেষে নন্দিতা দাসের ফেরাটা যে সেরকম জমকালো হয়েছে সেটা আপনার চমৎকার প্রাণবন্ত আলোচনা থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে। ওঁর প্রায় সব সিনেমাই দেখেছি। প্রথম পরিচালিত ‘ফিরাক’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম পরিচালকের পরিমিতিবোধ আর মুন্সিয়ানায়। ‘মন্টো’ দেখা হয়নি এখনো(এদিকটায় আসেনি এখনো)। নন্দিতা দাসের ভক্ত হিসেবে আর অতি সামান্য মন্টো পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আগ্রহের সাথে সিনেমাটি দেখবার অপেক্ষায় থাকছি। এই দারুণ লেখাটির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন যশোধরা। 🙂
অনেক অনেক ধন্যবাদ তৃণা