চার নম্বর নিউজডেস্ক
‘বিলুপ্ত প্রজাতি’ শব্দবন্ধটি শুনলে অনেকেরই স্কুলপাঠ্য বইয়ের একটি বিষণ্ণ দেখতে পাখির ছবি মনে পড়ে — ডোডো। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে ডাচ নাবিকরা মরিশাসে পা রাখার কয়েক বছরের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এরা। শ্বেতাঙ্গ ইওরোপীয়দের পৃথিবী জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের সেই ঘোরলাগা সময়ে একটি বোকাসোকা পাখির এই বিলুপ্তি প্রথমে কারও চোখেই পড়েনি। ঊনবিংশ শতকে তাই অনেক জীববিজ্ঞানীও মনে করতেন গল্পকথার বাইরে ডোডোদের কোনও অস্তিত্ব নেই, কোনওদিন ছিলও না। এরকম সময়ে খোঁজ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতকে ইওরোপে আসা কয়েকটি স্পেসিমেনের, যার মাঝে ছিল একটি ডোডোর মুণ্ডু। অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন জীববিজ্ঞানীরা, এবং এরপর মরিশাস থেকে আবিষ্কৃত হতে থাকে ডোডোরা যে একসময় ছিল তার অকাট্য প্রমাণস্বরূপ একাধিক সাব-ফসিল অবশেষ। অতএব গল্পকথার জগৎ থেকে টেক্সটবুকে উঠে আসে তারা, তাদের বিষণ্ণ, বোকাসোকা চেহারা নিয়ে। মানুষের সীমাহীন লোভ কিভাবে একশ বছরের কম সময়ে একটি গোটা প্রজাতিকে ফৌত করে দিতে পারে এবং সে কথা মসৃণভাবে ভুলে যেতে পারে, তার প্রতীক হয়ে উঠল ডোডো।
ডোডোদের মতো নাটকীয়ভাবে না হলেও পৃথিবীতে মানুষের একাধিপত্য কায়েমের চাপে পড়ে রোজ বিলুপ্ত হচ্ছে অথবা বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি। ২০১২-তে প্রকাশিত IUCN Red List অনুযায়ী পৃথিবীর পঁচিশ শতাংশ স্তন্যপায়ী, তেরো শতাংশ পাখি আর একচল্লিশ শতাংশ উভচর প্রজাতি কমবেশি বিপন্ন। নিজেদের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যাদের খুব বেশি Red List-এ তাদের শনাক্ত করা হয় CR (Critically Endangered) মার্কা দিয়ে। ২০১২-র তালিকায় প্রায় চারহাজার প্রজাতিকে এই মার্কা দেওয়া হয়েছে, যার মাঝে ভারতে পাওয়া যায় এমন প্রজাতির সংখ্যা ১৩২। তাদের মধ্যে একটি হল ঘড়িয়াল, আর আজকের আলোচনা তাদের নিয়েই।
ভারতে যে তিন জাতের কুমীর পাওয়া যায় ঘড়িয়াল তাদের মধ্যে একটি। বাকি দুটি হল মগর আর লোনাজলের কুমীর। লোনাজলের কুমীর, যাদের দেখা পাওয়া যায় সুন্দরবন আর ভিতরকণিকার বাদাবনে, বেশ আক্রমণাত্মক মেজাজের। মগর আর ঘড়িয়াল দুইই মূলত মিষ্টিজল পছন্দ করে, তাই ভারতের নদীগুলিতে একসময় এই দুই প্রজাতি প্রচুর দেখা যেত। IUCN লিস্টে Vulnerable (VU) বলে চিহ্নিত মগরও কিন্তু বেশ আক্রমণাত্মক, যদিও তারা চট করে মানুষকে শিকার বানাতে যায় না। এই তিন প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ হল ঘড়িয়াল। কিছু কিছু পুরুষ ঘড়িয়ালের লম্বা নাকের ডগায় বসানো ঘড়ার মতো ওঁচানো অংশটির থেকেই এদের এমন নাম। লম্বাটে চোয়াল আর দুর্বল দাঁতের কারণে এদের প্রধান খাদ্য হল মাছ। অবশ্য তার জন্য মানুষী আক্রমণ থেকে যে খুব বেশি ছাড় মেলে তা নয়। চাষিরা একসময় বন্যার জলে ভেসে আসা, খালে-জলায় আটকে পড়া বহু ঘড়িয়ালকে পিটিয়ে মেরেছে। জেলেরা মেরেছে চামড়ার জন্য আর মাম্বোজাম্বো ওষুধ বানানোর জন্য। ঘড়িয়ালের ডিমও উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় খাদ্য হিসেবে গণ্য হয়। তবে আধুনিক ভারতে ঘড়িয়ালদের আসল বিপদটা এসেছে অন্য দিক থেকে — মাছ ধরার জন্য জিল নেটের ব্যবহার, আর বিভিন্ন নদীপ্রকল্পের অংশ হিসেবে ব্যারেজ, ক্যানাল সিস্টেম ও কৃত্রিম বাঁধের নির্মাণ। আছে দেশজুড়ে নির্মাণকাজের চাহিদা মেটাবার জন্য নদীর চড়া থেকে যথেচ্ছ বালি তুলে নেওয়া। এর ফলে ধ্বংস হয়েছে ঘড়িয়ালদের স্বাভাবিক বাসভূমি, আর কমে গেছে তাদের খাবারের যোগান। নদীদূষণও একটা বড় কারণ হতে পারে।
স্বাধীনতার আশপাশ সময়ে উত্তর ভারতে ঘড়িয়ালের সংখ্যা ছিল আনুমানিক পাঁচ থেকে দশ হাজারের মধ্যে। পশ্চিমে সিন্ধু থেকে নেপাল এবং গাঙ্গেয় সমভূমি জুড়ে পূর্বে ইরাবতী অবধি প্রায় সব নদীতে একসময় পাওয়া যেত এদের। অথচ ১৯৭৬-এর সুমারি অনুযায়ী প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকা ঘড়িয়ালের সংখ্যা ছিল ২৫০-এর কম। এরপর ঘড়িয়ালদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনা হয় এবং শুরু হয় প্রজেক্ট ক্রোকোডাইলের কাজ। ১৯৯৭-এর হিসেব অনুযায়ী বন্য ঘড়িয়ালের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল প্রায় ৪৫০। কিন্তু পরের এক দশকে এই সংখ্যা আবার কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র শ’দুয়েকে। ফলে, ঘড়িয়ালের জায়গা হয় রেড লিস্টে।
ঘড়িয়ালদের একদা বিস্তৃত বাসভূমির ৯৮ শতাংশেই আজ আর তাদের দেখা যায় না। ওদিকে নেপালে নারায়ণী-রাপ্তি আর কর্নালি নদী এলাকা, এদিকে ভারতে চম্বল, শোন আর মহানদীর সাতকোশিয়া অভয়ারণ্য ছাড়া সেভাবে আর কোথাও ঘড়িয়ালদের উপস্থিতির কথা জানা ছিল না গত দশকের মাঝামাঝি সময় অব্দিও।
যদিও প্রোজেক্ট ক্রোকোডাইল শুরুই হয়েছিল নেপালের নারায়ণী নদীর (শালগ্রামশিলার জন্য খ্যাত) ঘড়িয়ালদের ডিম দিয়ে, ভারতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নারায়ণীর নিম্নধারা গণ্ডকীতে তাদের পাওয়া যেতে পারে একথা ভাবা হত না সেসময়। কিন্তু ২০১০ সালে গণ্ডকীতে সুমারি চালিয়ে পনেরোটি ঘড়িয়ালের উপস্থিতির কথা জানা যায়। এরপর ২০১৪-১৫-তে ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া ও বিহার সরকারের যৌথ উদ্যোগে পাটনা চিড়িয়াখানা থেকে ত্রিশটি ঘড়িয়াল গণ্ডকী নদীতে ছাড়া হয়। গত চার পাঁচ বছরে গণ্ডকীর গতিপথ জুড়ে ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের চালানো সমীক্ষার ফল বেশ আশাব্যঞ্জক। খোঁজ পাওয়া গেছে আটটি ‘নেস্টিং সাইট’-এর। এর অর্থ, গণ্ডকীর ঘড়িয়ালরা বংশবিস্তার করছে। ২০১৮-র মার্চ মাসে করা সুমারি অনুযায়ী গণ্ডকী নদীতে এখন ঘড়িয়ালের সংখ্যা ২০০-র কাছাকাছি, যার মাঝে প্রায় পঞ্চাশটি পূর্ণবয়স্ক। সারা ভারতে চম্বলের পর এই মুহূর্তে গণ্ডকী নদীতেই ঘড়িয়ালের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
এই সুখবরটি অবশ্য নিষ্কণ্টক নয়। গণ্ডকী নদীর ওপর বাল্মীকিনগরের ব্যারেজটি তো আছেই, তার সাথে সংরক্ষণকর্মীদের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হল ২০১৬ সালে পাস হওয়া ন্যাশনাল ওয়াটারওয়েজ অ্যাক্ট। এই নতুন আইনে মোট একশ ছটি জাতীয় জলপথকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মাঝে বাল্মীকিনগর থেকে হাজিপুরে গঙ্গা-গণ্ডকী মোহনা পর্যন্ত গণ্ডকীর প্রবাহ আছে সাঁইত্রিশ নম্বরে। ওয়াটারওয়েজ অ্যাক্ট অনুযায়ী ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’-এ চিহ্নিত জলপথগুলিকে নদীপরিবহনের জন্য যথেচ্ছ ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিবেশবিদরা মনে করছেন এর ফলে গণ্ডকী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঘড়িয়ালরা। বিপন্ন হবে এখনও অবধি টিকে থাকা তাদের অন্যান্য বাসভূমিগুলিও। হয়তো পরের প্রজন্ম ঘড়িয়াল চিনবে শুধুমাত্র চিড়িয়াখানায় গিয়ে। IUCN তালিকায় CR না, তাদের নামের পাশে লেখা থাকবে EW — Extinct in the Wild।