উত্তর-আমাইষষ্ঠী চরিত কিংবা অথ পওধা প্রেমকথা
“হাত হতে আমাইষষ্ঠীর হিমসাগরের খোসবো ক্রমেই ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেচে, আচকান ও গলবস্ত্র ধোপাবাড়ি থেকে পাট হয়ে ফিরেচেন, শান্তিপুরি ধাক্কাপেড়ে ধুতি চুনোট হয়ে পিরান-মেরজাই পরিপাটি ইস্ত্রি হয়ে আলনায় অপেক্ষা করচে্ন, বেলা পড়ে এল কিন্তু কর্ত্তামশায় বেড়াতে যাবার নাম পর্যন্ত করেন না দেকে অন্দরমহলে গিন্নি ক্রমেই অস্থির হয়ে উটচেন ও মোসায়েবকে ডেকে বাবুর পেটগরম হল কিনা জিগ্যেস করবেন এ-প্রকার ভাবচেন… ইদিকে বাবুর মেজাজ ঠিক নেই, শ্বশুরবাটী হতে ফিরে অ্যাকোয়া টাইকোটিস ও নরফ্লক্সাসিন-টিনিডাজোল খেয়ে, এবং গতকাল শেষরাত হতে আজ বেলা পূর্বাহ্ন অবধি নিদ্রা যেয়ে বাবুর গা ঢিসঢিস কর্চ্চে… অথচ এই গরমে গঙ্গার ধারে দু’দণ্ড হাওয়া খাবে তার জো নেই, হাতে বেলফুলের মালা জড়িয়ে সন্ধের ঝোঁকে ফিটন থেকে মাগ-বগলে মুক নুকিয়ে নেমেচো কি নামোনি পেচোনে অমনি দেকবে লাটসরকারের নীল-সাদা খোচড় লেগে গ্যাচে, সরবত চাইলে এগিয়ে দেবার একটা লোক নেইকো, রেললাইন টপকে নৌকোয় উটতে যাবে তো অমনি ক্যাটকেটে কমলা রঙের কী এক অনাছিষ্টি বারোয়ারি জামা পরিয়ে দেওয়ার হুকুম হয়েচে, ডুবলে তাতে নাকি তুলতে এট্টু সুবিধে হয়…”
অমিততেজা বাবু শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন সিঙ্গি মহাশয় আমাদের এ-সংখ্যার সম্পাদকীয় কলমের প্রথম প্যারাগ্রাফটি এ-পর্যন্ত লিখিবার পরই দফতরের টিকিআলা উৎকলবংশীয় প্রুফরিডার বলিল, “এদানীং এ-ধরনের নকল হুতোমি গদ্যের ফেসবুকে খুব চল হইয়াছে, সকলেই তাহাদের পাঁচ-সিক্কার ভাঙ্গা কলমে এই গদ্য টুকলি করিয়া কেমন দিলাম ভাব করিয়া উপর্যুপরি লাইক ও তদনুরূপ সংখ্যায় কমেন্ট বাগাইতেছে, ফলতঃ ইহার জাত-ধর্ম কিছু আর অবশিষ্ট নাই, পরন্তু হুতোমের কাল গিয়াছে, গদ্যে ও প্রতিপাদ্যে যদ্রূপ ব্যঙ্গোক্তি তদ্রূপ সমাজসচেতনা তথা সমকালীনতা নাই…”
তৎপর ওড্রদেশীয়টি ভ্রূকুটি করিয়া যখন জানাইল যে, “এ-প্রকার ব্যাকডেটেড কলকাত্তাই চলিত গদ্য লিখিলে বাঙ্গালা ও সংস্কৃত ভাষার বঙ্গশ্রী-বিদ্যাভূষণধারী পণ্ডিতদিগকে লইয়া গঠিত সিলেবাস সব-কমিটির সুপারিশক্রমে কালেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূত হইবার ‘চান্স’ কম, বরং আপনি সাধু গদ্যে লিখুন”, তখন সিঙ্গিমহাশয়কে এই প্রথমবারের জন্য দৃশ্যত ম্লান লাগিল… যেন সত্যই তিনি কমলারঙের লাইফ-ভেস্টো পরিয়া বিচালিঘাটের গঙ্গার ঘোলাজলে ডুবিয়া যাইতেছেন ও পাড়ে দাঁড়াইয়া ফরাসিকাট শ্মশ্রুশোভিত একখানি হুলাবিড়াল “পয়সা দিয়াছি যখন তখন মাল গনিয়া না-লইব কেন” বলিয়া যৎপরোনাস্তি লাঙ্গুলাস্ফালন করিতেছে…
এ-হেন মনোবিপর্যয়ের ঘোর ঈষৎ কাটিতে সিঙ্গিমহাশয় কী লিখি কী লিখি করিয়া উদ্ভ্রান্তের ন্যায় পায়চারি করিতেছেন, এমন সময় দফতরের আর একজন তাঁহার কানের কাছে গিয়া নিম্নস্বরে কিছু বলিল, আর মুহূর্তমধ্যে তাঁহার রক্তশূন্য গণ্ডদেশ পুনরায় লাবণ্যপ্রাপ্ত হইতে দেখিয়া অনুলেখক ছোকরা গা-ঝাড়া দিয়া কলম বাগাইয়া বসিল। মহাশয় বলিতে লাগিলেন…
“হাত হইতে আমাইষষ্ঠীর হিমসাগরের সুঘ্রাণ ক্রমেই বিলীয়মান, আচকান ও গলবস্ত্র ধোপাবাড়ি হইতে পাট হইয়া ফিরিয়াছেন, পিত্রালয় হইতে আসিয়া অবধি গৃহিণী কায়মনোবাক্যে কিছু অধিক মধুরা, এমতাবস্থায় ঘরের খাইয়া ও বনের ত্রিসীমানায় তাড়াইবার মতো মোষ না-পাইয়া বাবু বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা খুলিয়া দেখিলেন, আজি বিশ্ব পরিবেশ দিবস। তৎক্ষণাৎ তাঁহার মুখমণ্ডল আনন্দে পূর্ণ হইয়া উঠিল (ফাজিল অনুলেখক ছোঁড়া কালীপ্রসন্নের অজ্ঞাতসারে এইখানে একটি ‘স্মাইলি’ যোগ করিল ও ব্রাকেটে লিখিল “ফিলিং গ্রিন”)…”
সিঙ্গিমহাশয় বলিয়া চলিলেন, “ওই দ্যাখো বেলা বাড়িতে না-বাড়িতে জেলেপাড়ার সকলে শোভাযাত্রা করতঃ হাতে এক-একটি দেড়-আঙ্গুলে চারাগাছ ও প্রমাণ মাপের বেলচা লইয়া বাহির হইয়াছে, দেখিয়া মনে হইতেছে যেন বা বেলচাটিই আজিকার উৎসবের নায়ক, গাছবেচারা যেন কেবল টুনুটুনু সঙ্গৎ করিতে বসিয়াছে… এলাকার কৌন্সিলর সাহেব যথাবিধি চোগা-চাপকান চাপাইয়া, গলায় ডুরে গামোছা ও পায়ে একজোড়া স্নিকর পরিয়া সঙের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিতেছেন… অটোরিকশার মাথায় মোসায়েব চোঙ্গা বাঁধিয়া দিয়াছে… চোঙ্গার উভয়পার্শ্বে মেজো ও সেজো নেতা গুপিবাঘা-গুপিবাঘা করিয়া বগল বাজাইতেছেন…
“এমন সময় কোথা হইতে এক উজবুক কলমচি আসিয়া নিতান্ত রসহীনের ন্যায় শুধাইয়াছে, “এই যে আপনারা একদিকে কচি-কচি পওধা উঘাইতেছেন আর ফটাফট ফটোক খিচাইতেছেন, এদিকে বারাসতের রাস্তায় অমন পেল্লায় বৃক্ষদেবতাগণের বিগ্রহগুলি ধ্বংস পাইতেছে… লোকে বলিতেছে উন্নয়নের নামে নাকি কাঠপাচার…” সে বেচারির প্রশ্ন মাটিতে পড়িতে পাইল না, অমনি বেলচাগুলির সুপ্রয়োগ ঘটিবার ক্ষণ সম্যক উপস্থিত হইল… টেলিভিশনের সাম্বাদিক বুম বাগাইয়া এক কোণ দেখিয়া লাইব টেলিকাস্টের জন্য মোতায়েন হইয়া গেল… চালাকগোছের এক ছোঁড়া ফস করিয়া ছবি তুলিয়া ফেসবুকে পোস্ট করিয়া লিখিয়া দিল ‘গ্রিন যখন গ্যাংগ্রিন’ আর মুহূর্তেকমধ্যে সেই পোস্ট ভাইরাল হইয়া গিয়া ট্রেন্ডিংশীর্ষে অমরাবতীর ন্যায় থরোথরো শোভা পাইতে লাগিল…
“তৎপরে যাহা-যাহা হইতে হয় সকলই হইল… অকুস্থলে পুলিশ আসিল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রাকটিশ করিতে লাগিল… ডেকরেটরের লোক মাইক টেস্টিং বলিয়া চিৎকার করতঃ জনগণের ধৈর্যের বাঁধ টেস্টিং করিতে থাকিল… ডুম্বুরপত্রের পোশাক পরিয়া সুশ্রী সানি লিওন মহোদয়া আসিলেন ও সহাস্য বাইট দিতে লাগিলেন… লিওনের পশ্চাতে তাঁহার পিওন… তৎপশ্চাতে ম্যাজিশিওন… রাস্তার পরপারে সপত্র বংশদণ্ড দিয়া প্যাভিলিয়ন খাড়া করিয়া সেজো ও মেজো নেতা কৌন্সিলরের মুখে কিছু বলিবার নিমিত্ত চোঙ্গা ঠুসিয়া দিলে… সব মিলিয়া সে এক হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার সমুৎপন্ন হইয়া উঠিল…”
এ-পর্যন্ত বলিয়া সিঙ্গিমহাশয় স্মিত হাসিয়া আমাদিগের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া কহিলেন, “কী মনে হচ্চে? চলবে?” সম্পাদকীয়র ধার দেখিয়া ও তাহার সম্ভাব্য পোলিটিকল ফল-আউট কল্পনা করিয়া ততক্ষণে আমরা শিহরিত, উড়ে প্রুফরিডার বাক্রহিত, অনুলেখক ডিকটেশন-গ্রহণ থামাইয়া ঘাম মুছিবার রুমাল খুঁজিতেছে…
আমাদিগকে এ-হেন বিহ্বল দেখিয়া মহাশয় যৎপরোনাস্তি শান্তি পাইলেন, ও “আজ এটুকুর ধাক্কাই সামলাও” বলিয়া মুচকি হাসিয়া অন্তর্ধান হইলেন…
হুতুমের মুচকি হাসি ☺