সুদীপ বসু
আগে ছড়িয়েছিটিয়ে টুকরোটাকরা করলেও ২০০৯ সালে আমি প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজ করি। পূর্ণাঙ্গ বলতে একটি গোটা বই অর্থে পূর্ণাঙ্গ। প্রবাদপ্রতিম প্যালেস্তানীয় কবি মাহমুদ দরবিশের অজস্র লেখার থেকে সযত্নে বাছাই করা কবিতার একটি সংকলন। নাতিদীর্ঘ। যদ্দুর সম্ভব সহজসরল ঝরঝরে উচ্চারণে। বইটির একটি তথ্যসমৃদ্ধ মেদবিহীন ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন অগ্রজ কবি শ্রী অনীক রুদ্র। কথাটা তা নয়। কথাটা হল এই বইটির শুরুতে একটি ছোট্ট লেখা লিখেছিলাম আমি — ‘তর্জমাকারীর বয়ানে’ — এই শিরোনামে। আজ থেকে ন’ বছর আগেকার বোধবুদ্ধিতে, ন’ বছর আগেকার অনুভূতিতে, বিচারে লিখেছিলাম “…মূলানুগ অনুবাদ মানে অনুবাদ মূল ভাষার কতটা কাছাকাছি পৌঁছল এমন চিন্তা অনাধুনিক ও অবান্তর। অনুবাদ এমনই এক তামাশাতাড়িত শিল্প যে মরিয়ার মতো তাকেই ছুঁতে চায়, যাকে কোনওদিনই নাগালের মধ্যে পাবে না সে। অনুবাদ এক একরোখা গরীব মেয়েমানুষ যার একমাত্র পুঁজি হল স্বপ্ন দেখা। আর স্বপ্নকে তো পেরিয়ে যেতেই হবে কত ছোট ছোট অন্ধকার মহল্লা — ব্যর্থতার, শীতের — এক চোখে মরে গিয়ে অন্য চোখের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে কতবার।…”
সব শিল্পেরই মূলে থাকে স্বপ্ন। সব সৃষ্টিরই মূলে থাকে স্বপ্ন। কিন্তু অনুবাদ এমনই এক শিল্প যার মূলে রয়েছে স্বপ্নের অলীক মরীচিকা। যেখানে জল নেই, সেখানে জলের স্বপ্ন দেখা স্বপ্ন। যেখানে জল হবে না কোনওদিন সেখানে জলের স্বপ্ন দেখা স্বপ্নের মরীচিকা। অনুবাদ সে কারণেই এক তামাশাতাড়িত শিল্প। এখানেই ছুঁতে চাওয়া এবং ছুঁতে না পারার প্রশ্ন। এই ব্যর্থতা কোনও সম্ভাবনার ব্যাপার মোটেই নয়। এই ব্যর্থতা একেবারে অনিবার্য। ‘মাহমুদ দরবেশের কবিতা’ (২০০৯) থেকে হালের (২০১৮) ‘আজব লাইব্রেরি’ (হারুকি মুরাকামি) — সর্বমোট ছ’টি বইয়ের ভাষান্তর করতে করতে এই ন’ বছরে অন্তত এটাই আমার সর্বশেষ (এবং সর্বপ্রথম) সিদ্ধান্ত।
এটা কোনও কষ্টকল্পনা নয়। কাউকে চমকে দেওয়ার জন্য বল্য তাকলাগানো তত্ত্বকথা নয়। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। তার কারণ অনুবাদ-কর্মের পুরো বিষয়টাই পূর্বনির্মিত, প্রি-প্ল্যানড। এর প্রত্যেকটা চলা, থমকে দাঁড়ানো, টানটান হওয়া, শিথিল হওয়া প্রত্যেকটা হাসি-কান্না-মোড়-বাঁক অনুবাদকের আগে থেকেই জানা, বোঝা। আমি জানি আগে কী হয়েছে, আমি জানি এখন এই নিমেষে কী হয়ে চলেছে, ঠিক যেমন জানি শেষে পৌঁছে কী হবে। তাহলে অনির্ণেয়তা কোথায়? অনিশ্চয়তা কোথায়? উন্মাদনা কোথায়? একটা নিছক শিল্পিত কেরানির কাজ।
মূল সৃষ্টিও প্রি-প্ল্যানড। এমন নয় সেটা (কবিতা, গল্প বা উপন্যাস) রাতের অন্ধকারে কার্নিশ থেকে ঝপ করে ভূতের মতন লেখকের ঘাড়ে এসে পড়ে। তা নয়। কিন্তু শেষাবধি সেখানে একটা অন্য ব্যাপার আছে। প্ল্যানমাফিক লিখতে লিখতে বা ছবি আঁকতে আঁকতে এমন একটা কালমুহূর্ত আসবে, আসবেই, যখন আকস্মিকভাবেই মানুষের কত সাধে গড়ে তোলা সব রুটিন প্ল্যান এক লহমায় ভণ্ডুল হয়ে যাবে। নষ্টভ্রষ্ট হয়ে যাবে। একটা পর্যায়ের পর শিল্পী আর টেরই পাবে না এরপর কী হবে, বা হতে চলেছে। কেননা ততক্ষণে লেখার সব রাশ তার হাত থেকে চলে গেছে অনির্ণেয়তার, নিয়তির হাতে। তখন এমন কিছু ঘটনা ঘটবে যা সে দেখতে পাবে কিন্তু বুঝতে পারবে না, শুনতে পাবে কিন্তু কার্যকারণ খুঁজে পাবে না। কারও আদেশে সে লিখে যাবে শুধু পাতার পর পাতা। সে তখন আর লেখক নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ শাদা পাতা কালিতে ভরানোর ক্রীতদাসমাত্র। এখানেই মূল সৃষ্টির উন্মাদনা, উদ্দীপনা, তাণ্ডব। অনুবাদে তা নেই। দুটো কাজেই ভালোবাসা আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু বাড়ির কাছে কাঠের ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নরম নদীটিকে ভালোবাসা এক কথা, আর শেষ রাত্তিরের দরজাজানলা লোপাট করা চালচুলোহীন উন্মত্ত কালবৈশাখীকে ভালোবাসা সম্পূর্ণ অন্য আরেক কথা।
তবুও তো অনুবাদকর্ম হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। মূলত ভিনদেশি ভাষায় যা আনন্দ, ভিনদেশি ভাষায় যা বিষণ্ণতা, যা শোক, রাগ বা রিরংসা তাকেই নিজের ভাষায় রূপান্তরিত করে নিজের চারপাশের সমভাষাভাষী মানুষের পড়বার সুযোগ ও পরিসর করে দিতেই এই উদ্যোগ।
এবার তাহলে সৌন্দর্য ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। তর্জমা কতটা মূলানুগ হল, খুব বাড়াবাড়ি রকমের মূলভিত্তিক হলে সৌন্দর্য অটুট রইল তো? এখানে একটা খুব প্রচলিত মজার গল্পের কথা মনে এল। একটি ডাকসাইটে মার্কিন কোম্পানির প্রেসিডেন্টের ভাষণ সরাসরি ইন্টারপ্রিট করছিলেন এক তরুণ দক্ষিণ কোরীয় সাংবাদিক। অনুবাদ তো যথাযথই হচ্ছিল, হঠাৎ প্রেসিডেন্ট সাহেব একটি তরল রসিকতা করে বসেন। কোরীয় সাংবাদিক মুহূর্তে বুঝে যান এটি আদ্যন্ত একটি মার্কিন রসিকতা এবং এর কোরীয় ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে রসিকতাটির রসই মাটি হয়ে যাবে। সাংবাদিকটি শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন ‘প্রেসিডেন্ট যা বললেন সেটি একটি দারুণ রসিকতা কিন্তু আমাদের ভাষায় এর সঠিক অনুবাদ হয় না। যাইহোক, আপনারা খুব জোরে হেসে উঠুন।’ একথায় গোটা হল হাসি ও হাততালিতে ফেটে পড়ল। প্রেসিডেন্ট সাহেব তো আহ্লাদে আটখানা।
এক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা তো কিছুই রইল না, কেননা অনুবাদের কাজটাই তো হয়নি। কিন্তু উপস্থাপনার সৌন্দর্য রইল। আর তাই মূলের সুর বা চরিত্র বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরেও শ্রোতা আনন্দ পেল।
এ লেখার একদম শুরুতে বলেছিলাম ‘অনুবাদ এক একরোখা গরীব মেয়েমানুষ যার একমাত্র পুঁজি হল স্বপ্ন দেখা।’ কেন মেয়েমানুষ বলেছিলাম নিজেও জানি না। আবার আসছে নারীপ্রসঙ্গ। তবে নিজে বলছি না, এবার অন্যের ঘাড়ে বন্দুক চাপিয়ে দিয়েছি। বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত রুশ কবি ইয়েভগনি ইয়েভতুশেঙ্কো লিখেছিলেন “Translation is like a woman. If it is beautiful, it is not faithful. If it is faithful, it is most certainly not beautiful.” এটাকে একটু দৈর্ঘ্যে ও বহরে বাড়িয়ে বলা হয়ে থাকে “Translations are like either a wife or a mistress : faithful, but not beautiful, or beautiful, but not faithful.” এই উচ্চারণে পুরুষতান্ত্রিকতার ব্যাপারটা আলাদা প্রসঙ্গ। ওটিকে এখন বাদ রাখছি। ওটি তো চিরকালীন এক সমস্যা, যা ইয়েভতুশেঙ্কোও এড়াতে পারেননি, সিলি মিসটেক হয়ে গেছে। পিটার নিউমার্ক, বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ, মনে করেছেন অনুবাদ ‘আক্ষরিক’ হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন কট্টর ‘literalist’। মূল পাঠ থেকে সরে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকা দরকার বলে তাঁর মনে হয়েছে, এবং যে কারণগুলি হবে ‘বিশেষভাবে যুক্তিসম্মত’। এইজন্য দুটি ভাষার ওপরেই প্রবল দখল থাকা জরুরি। শুধু দুটি ভাষাই না, ভাষা তো বাহ্যিক প্রকাশমাত্র, দুটি সংস্কৃতির ওপরেই সামগ্রিকভাবে দখল থাকা জরুরি। এই আক্ষরিক অনুবাদের প্রবক্তা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে, তাঁর ‘আ টেক্সটবুক অফ ট্রান্সলেশন’ বইয়ে, আলোচনা যত গড়িয়েছে অন্য কথার দিকে সরে সরে গেছেন। ‘absolute primacy of the word’-এর তত্ত্বে তখন আর তাঁর বিশ্বাস নেই। বলছেন মূল পাঠ থেকে যখনই প্রয়োজন পড়বে সরে যাওয়াই যায়, যদি পরিস্থিতি দাবি করে। শব্দ নয়, শব্দের অর্থকেই (ব্যাপক অর্থে) অনুবাদ করতে হবে। তা যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় তবে তাই-ই করতে হবে।
এসব তো গেল গূঢ় তত্ত্বকথা। সামান্য কিছু অনুবাদের কাজ করার জায়গা থেকে আমার মনে হয় ভাষান্তর কখনওই আক্ষরিক (literal) হবে না, ভাষান্তর হবে সমবেদী (sympathetic)। চোখের অনুবাদ নয়, আমরা অনুবাদ করব চোখের জলের। আমরা অনুবাদ করব ভিনভাষার আত্মাকে। তাই মূল পাঠের আত্মাকে আঘাত করে জাগাতে হবে। আত্মার আর্তনাদ যেন অনুবাদকের কানে এসে পৌঁছয়। সেই আর্তনাদকেই তো অনুবাদ করবে সে। আত্মাই তো অনূদিত হয়ে চলে আসবে এক ভাষাদেশের ঠিকানা থেকে অন্য ভাষাদেশের নতুন ঠিকানায়। এবং এখানে আবার সেই ব্যর্থতার প্রশ্ন বড় হয়ে এসে দাঁড়াবে। আত্মা তো চিরপলাতক। প্রাণপণ চেষ্টা করে যেটুকু হয় তা হল এই আত্মার আভাসটুকুকে ছুঁতে পারা এবং তারই ভাশান্তর করে ধরে রাখা নিজের ভাষায়।
এবার একটা গল্পাংশ তুলে দিয়ে লেখাটিকে শেষের পথে নিয়ে যাই। বিদেশি নয়, একটি আধুনিক বাংলা ছোটগল্প। একটি বাচ্চা ছেলে আর তার মা-বাবার গল্প। দীর্ঘদিন ধরে যৌথ পরিবারে হিংসা ও অপমান সহ্য করে আসছেন বাচ্চা ছেলেটির মা। পরিবারের নিরন্তর অত্যাচারে এবং স্বামীর নিস্পৃহতায় অভিমানে একদিন গভীর রাতে তিনি বাড়ির কাছেই সন্ন্যাসীপুকুরে কালবোস মাছ হয়ে গেলেন। স্বামীপুত্রের হাজার অনুরোধেও আর ফিরলেন না। মুশকিল হল যখন সেই পুকুর ভরাট করে কারখানা গড়ে উঠল। তিনি চিরতরে হারিয়ে গেলেন অন্য মাছেদের সঙ্গে।
ঘটনাটি তার বেশ কিছু বছর পরের। ছেলেটি একটি ইংরেজি প্যাসেজ বাংলায় তর্জমা করছে। প্যাসেজটি একটি ভিনদেশি রূপকথার গল্পের অংশ। একটি মৎস্যকন্যার গল্প। অনেক নদীনালা বেয়ে সে হঠাৎ ইতালির সমুদ্রে এসে পড়েছে। সেখানে অন্যান্য হিংস্র মাছেরা তাকে টিকতে দিচ্ছে না। ঠুকরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। এই প্যাসেজটা অনুবাদ করতে করতে বাচ্চা ছেলেটির খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছে নিজের মায়ের কথা। এবার গল্পাংশটি হুবহু তুলে দিচ্ছি। বাচ্চা ছেলেটির বয়ানে।
“মনে পড়ল সেই দৃশ্য। আমি আপন মনে কাঁদছি। বাবা হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলছেন ‘কাঁদছিস কেন? ও বিনু কাঁদছিস কেন অমন করে?’ ‘এই প্যাসেজটা বড্ড কষ্টের’ আমি বলছি।
‘কী আছে প্যাসেজে?’
আমি প্যাসেজের গল্পটা বাবাকে বুঝিয়ে বলছি। বাবা বলছেন ‘কাঁদে না। বোকা কোথাকার। অনুবাদ কর। অনুবাদের সময় এত কাঁদতে নেই। এতে দুটো ভাষা অভিমান করে দুদিকে চলে যায়।’”
গল্পটার অবতারণা এই জন্যই করা। ভাষার প্রাণ আছে। অভিমান আছে। তাই দুটো ভাষা যত অভিমান ভুলে একে অপরের কাছে আসবে অনুবাদ ততটাই সফল হবে, জ্যান্ত হবে। কে না মানে স্বাস্থ্যবান মৃত শিশু প্রসব করার চেয়ে রোগারুগ্ন জ্যান্ত শিশু প্রসব করা অনেক ভালো।
এবার ওই গল্পটির শেষ অংশ। আবার ওই বাচ্চা ছেলেটির বয়ানে। প্রসঙ্গত গল্পটির নাম ‘মা ও তাঁর রুপোলি বন্ধুরা’।
“’কিন্তু বাবা আমার চোখ যে ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’ আমি বলছি।
বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলছেন ‘কেঁদে কিছু হয় না বিনু। কেঁদে কেউ বড় হতে পারে না। অনুবাদ কর। অনুবাদ করতে করতেই মানুষ একদিন বড় হয়ে ওঠে।’”
সত্যিই তো, আমাদের এই গড় জীবন, তাকে যাপন করা, আমাদের বড় হয়ে ওঠা, জীবনের ডালপালা ছড়ানো, তাকে একটা গড় পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া, এসবই তো আসলে চারপাশকে অনুবাদ করতে করতে যাওয়া। মৌলিক সৃষ্টির কাজ এখানে প্রায় কিছুই নেই। সবটাই জীবনের চারপাশকে দেখা। পছন্দসই খুঁজে নেওয়া এবং নিজের জীবনে তর্জমা করা। তবে সেটা অবশ্য একটা আলাদা বিষয়। একটি গভীর নির্জন প্রশ্ন। তা নিয়ে একটি আলাদা লেখা হতে পারে।
লেখাটা বড় ভালো লাগল । তত্ত্বকে এইভাবে সংবেদের কলাপাতায় মুড়ে দেবভোগ্য পাতুরি বানানো-যার স্বাদ জিভে লেগে থাকে বহুক্ষণ, সকলের কম্ম নয় ।