পীযূষ ভট্টাচার্য
প্রথম পর্বের পর
একটা দিনে যতরকমের তুচ্ছ ঘটনা ঘটে তার মধ্যে যে ঘটনাকে অতিতুচ্ছ বলে মনে হয়, তা-ই লিখে রাখি। নিজের ধারণায় যা ঘটে আমাকে ঘিরে তা তুচ্ছাতিতুচ্ছ। সেজন্য বেশি কিছু লিখি না। এক লাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবার চেষ্টা থাকে সবসময়। যখন জীবনই তুচ্ছ তখন বেশি কিছু লিখবার প্রচেষ্টা একধরনের আহাম্মকি ভিন্ন কিছু নয়। তবে, এক লাইনের লেখাগুলিতে কোনও যতিচিহ্ন ব্যবাহার করতাম না। তার ফলে সে লেখাটি হয়ে উঠত একটিমাত্র সরলরেখা — যেন নিঃসঙ্গ, নির্জন পথ।
কোথায় তার শেষ জানা না থাকায় সেই সরলরেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েই চলেছে এরকম ধারণার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে পরিবারের অনেকেই। সেই পূর্বপুরুষ জমিদারির সেরেস্তাদার হয়ে অসমে গিয়ে এক তান্ত্রিকের কাছে শিষ্যত্ব নিয়ে ধ্যানরত অবস্থায় ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় ভেসে যাবার পরিবর্তে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে এ নদী সে নদী হয়ে উত্তরবঙ্গে চলে এসেছিলেন কি না সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা বংশের ইতিহাসে না থাকায় বিষয়টি এমনভাবে শেষ হয় — তা ছিল তার ভবিতব্য। যা একান্ত নিজস্ব। এ নিয়ে কোনও তর্ক করা উচিত নয়। কিন্তু যখন আত্রাই নদীতে বন্যা হয় জলবন্দি আমাকে দেখতে চলে আসেন। সেই জল থেকে গণ্ডুষে জল নিয়ে সেই জলে নিক্ষেপ করে বলে ওঠেন — ‘এই তো জীবন!’
ধীরে ধীরে জল স্থির হয়ে গেলে তিনি মিলিয়ে যেতেন। বদ্ধ জলাশয় ঘরের ভিতর — নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবার জন্য চৌকির উপর একটা চেয়ার তুলে সিংহাসন গড়ে বসে থাকতাম। কেননা সেই সময় মাথার ভিতর ক্রিয়াশীল, সিংহাসন সর্বদাই নিরাপদ। কিন্তু যে বসে সে নিরাপদ না হলেও কিচ্ছু আসে যায় না। কেননা, এটিও একটি তুচ্ছ ঘটনা।
তাই হয়তো এইভাবে বেঁচে থাকবার মধ্যে খুঁজবার চেষ্টা করি আদিম মানুষের ভয়ভীতি কোনও না কোনওভাবে আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল। তা পূর্বপুরুষের হাত ধরে আসতে পারে আবার নাও হতে পারে। কোনও সাহায্য ছাড়াই উঠে আসে প্রস্তর যুগের কথা। অজন্তার চিত্রকথা তো একদিনে গড়ে ওঠেনি ভুঁইফোঁড়ের মতন। একদিন সকালে উঠে দেখা গেল ছবি হাতের মুদ্রায় আমাকে ডাকছে। হাত, আঙুলের মাধ্যমে শিল্পী যেন কথা বলছেন। কী বলতে চাইছেন সেটির গুরুত্ব নেই, অতি তুচ্ছ, তবুও তা কালজয়ী। কালকে অতিক্রম করে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। স্তব্ধতায় ভরে আছে চতুর্দিক। আখ্যান থাকা সত্ত্বেও আখ্যানহীন। আবার গ্রোটো অব লাসকাউক্স — বাইসনের ছবিটি যখন দেখি তখন মনে হয় রক্ত হিম করা বাইসনের ডাকের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে অতীতের অন্ধকার। অন্ধকারের হাত থেকে যেন কোনও পরিত্রাণ নেই। সেজন্য বারবার পূর্বপুরুষদের প্রসঙ্গ উঠে আসছে।
এক সময় এই অন্ধকারও তুচ্ছ বলে প্রমাণিত হয়, কেননা ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে রাত্রিতে গর্ভের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসি। সেটা তিন তারিখ হতে পারে আবার তেরো তারিখও হতে পারে। তিন তেরো নিয়ে মতৈক্যে আসতে পারেনি মা বাবারা। বাবা তেরো তারিখের পক্ষে বলে সেই তারিখে জাতকের জন্ম হলে তার ভবিষ্যৎ কী সে নিয়ে একটা জন্মপত্রিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার ফলে কিছুই হয়নি। স্বাধীনতার দাপটের সামনে কীভাবে দাঁড়ানো যায় সে প্রশ্নই ছিল মুখ্য। কেননা খুচরো বা সংঘবদ্ধ হিংসার সামনে বড্ড বেশি অসহায় ছিলাম আমরা। বলা ভালো, অনেকের মতন আত্মিক স্বাধীনতা খুইয়ে ক্রমাগত উদ্বাস্তু হয়ে যাবার যে প্রক্রিয়া চলছিল সেদিকেই ঠেলে দিচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। পাকে পাকেই নির্বল ও অগণ্য হয়ে যাবার অস্বাভাবিকতা কীভাবে রপ্ত হয় সেটিই এখন প্রতিনিয়ত ভাবায়।
এরকম তো হবার কথা ছিল না এবং থাকেও না। যা থাকে তা হচ্ছে অতীত খুঁচিয়ে দেখে নেওয়া, ছাই চাপা আগুনের স্বর্গীয় আভা। সেখানেই আছে — হিংসা ও ক্ষয়। ঘৃণা ও সহনশীলতা, বিবেক বিচ্যুতি থেকে বিবেক জাগরণের এক সসীম প্রান্তর।
তবে কি কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনও তুচ্ছ ঘটনা মাত্র! কেননা বাস্তবে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ভুলতে বাধ্য করেছিল বাইশজন শহীদদের কথা। যে গ্রাম্য শহরে অর্থাৎ বালুরঘাটে, যা আমার মামাবাড়ি, তার মাইল দশেক দূরে খাঁপুর বলে গ্রাম ছিল। সেই নির্জনতর গ্রামের লড়াই আছড়ে পড়েছিল শহরের লাশকাটা ঘরে। হাসপাতালের তিন চারজন ডাক্তার হাসপাতালে রোগীর শুশ্রূষা বন্ধ রেখে একের পর এক লাশ পরীক্ষা করে দেখছিল বুলেট শরীরের ভিতর খুঁজে নিয়েছে কোন নির্জনতর স্থান। ডাক্তারকে নির্ণয় করতে হবে এই নির্জনতা থেকে লাশের মৃত্যু ঘটেছে।
মৃত ও হন্তারক কেউ কিন্তু জানে না নির্জনতা বলে আদৌ কিছু থাকে কি? এর উত্তর সঠিক না জানা সত্ত্বেও — বালুরঘাটের ইতিহাসে মিশে গিয়েও একটু ভিন্ন রকমের হয়ে আছে। যদিও এ ঘটনা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন।
আমার জন্মের সময় মা এসব মনে করেছিল কিনা জানা নেই। তবে মিস রায় হাসপাতালের মিডওয়াইফ এসব জানতেন বলে খ্রিস্টের নামে শপথ নিয়ে বলে চলছিলেন, শহীদদের একজন জন্ম নিল। তখন বেঙ্গল টাইম রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিট, কলকাতা টাইম রাত্রি ১০টা ৫৯ মিনিট।
(ক্রমশ)