ছবি দেখা — ভূপেন খকর ও তাঁর ছবি

বিষাণ বসু

 

শিল্পীর মৃত্যুর পাক্কা তেরোটি বছর বাদে, ২০১৬ সালে, লন্ডনের বিখ্যাত টেট মডার্নে প্রদর্শিত হল, স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় চিত্রকলার অন্যতম প্রধান চিত্রকর, ভূপেন খকরের জীবনভর কাজের উপর, একটি রেট্রোস্পেক্টিভ। প্রদর্শনীর নাম, You Can’t Please All. আপনি সবাইকে খুশি করতে পারবেন না।

সার্থকনামা প্রদর্শনী। গার্ডিয়ানের চিত্রসমালোচক প্রদর্শনী দেখে এমন চমৎকৃত হলেন, যে, সমালোচনা প্রায় গালমন্দের পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ক্ষোভে ফেটে পড়ে তিনি জানালেন, ডেভিড হকনি প্রমুখের রেট্রোস্পেক্টিভ যখন হচ্ছে টেট ব্রিটেন-এ, সেইখানে এমন “Incredibly unimpressive” ভূপেন খকর নামের ভারতীয় শিল্পীর রেট্রোস্পেক্টিভ খাস টেট মডার্নে? রাখঢাক না করেই জানালেন, ভূপেন খকর, কোনও পাতে দেওয়ার মতো শিল্পীই নন।

আমরা আশ্বস্ত হলাম। যাক, তাহলে, মৃত্যুর এত বছর পরেও, ভূপেন খকর প্রথাগত ভাবনাকে এমনভাবে আহত করতে পারেন? এমনকি সিকি শতাব্দী বা চার দশক আগে আঁকা কিছু ছবি দিয়েও? খাস ব্রিটিশ রক্ষণশীলতার আঁতুড়ঘরে, যদি তিনি শুধুই মুগ্ধ প্রশংসার পাত্র হতেন, ধন্দটা তো লেগে যেত আমাদেরই। আসলে, ভূপেন খকর মানুষটাই তো আস্ত এক প্রহেলিকা। শিল্পী হিসেবে তো বটেই, এমনকি বিষয়ভাবনা কিম্বা ব্যক্তিজীবনেও।

তাহলে, আজ যদি আমরা ভূপেন খকরের ছবির সামনে দাঁড়াই, তাহলে কি মাথায় রেখে দেব তাঁর ব্যতিক্রমী জীবনযাপন, তথা প্রথাভাঙা শিল্প কেরিয়ারের বিষয়সমূহ? নাকি, তাঁর হয়ে কথা বলার জন্যে তাঁর আশ্চর্য রঙিন ক্যানভাসই যথেষ্ট? তাঁর ছবির মোকাবিলা করতে হলে, অন্তত গুগল-উইকিপিডিয়ায় তাঁর জীবন বিষয়ে জেনে নেওয়া, ঠিক কতখানি, নাকি আদৌ, জরুরি?

আসুন, ভূপেনের ছবি দেখি। বিলেতের প্রদর্শনী দিয়েই যখন কথার সূত্রপাত, তাহলে, চলুন, ভূপেনের বাঁকা চোখে দেখা ব্রিটিশ জীবনযাত্রা থেকেই শুরু করি।

হয়তো কাকতালীয়, ভূপেন খকরের টেট মডার্নে রেট্রোস্পেক্টিভের ঠিক সত্তর বছর আগেই প্রকাশিত হয় জর্জ মিকেস-এর সেই অনবদ্য স্যাটায়ার, হাউ টু বি অ্যান এলিয়েন (How to be an Alien)। একেবারে শুরুতেই জর্জ মিকেস (George Mikes) অনবদ্য তির্যক ভাষায় বুঝিয়ে দেবেন, আবহাওয়া নিয়ে আলোচনা ব্রিটেনের জাতীয় অবসেশন। মিকেস থেকেই উদ্ধৃত করি, “In England, this is an ever-interesting, even thrilling topic, and you must be good at discussing the weather.” অথবা, “In England, if you do not repeat the phrase ‘Lovely day, isn’t it?’ at least two hundred times a day, you are considered a bit dull.”  যে দেশে দুজন অর্ধপরিচিত মানুষের সামাজিক সংলাপের অনিবার্য বিষয় হতে পারে, ওয়েদার, শুধুই ওয়েদার, সেইখানে ভূপেন খকরের তেরছা চোখে, বিলেতের প্রতীক হিসেবে, আবহাওয়ার খবর বলা ওয়েদারম্যান ধরা পড়বেন, তাতে তো আমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই, তাই না?

ভূপেন খকরের মতো করে, চিত্রশিল্পে এমন স্যাটায়ার, ভারতীয় চিত্রজগতে আর কেউই আনেননি। ভূপেন খকরের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করলে, পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল তারকারা, যেমন অতুল ডোডিয়া প্রমুখ, সর্বাগ্রে, এই স্যাটায়ারের কথা-ই বলেন। কিন্তু, শুধু স্যাটায়ার দিয়ে ভূপেন খকরের বিচার করলে, তা হয়ে যাবে, অন্ধের হস্তিদর্শনের মতোই, অসম্পূর্ণ।

শ্লেষ বা স্যাটায়ার, আপাতত, সরিয়ে রেখে, ছবির আর্টিস্টিক কোয়ালিটির দিকে দেখি। একবারে সামনেই, চেয়ারে বসে থাকা এক নারী, তাঁর পাশে হাত ধরে থাকা এক পুরুষ। ঘরের মধ্যে দুজন, আর কেউ নয়, তবু একটু দূরত্ব সন্তর্পণে রক্ষিত। আবার, পার্সপেক্টিভের চতুর ব্যবহারে আমাদের চোখ চলে যায়, ঘরের ঠিক বাইরে। সেইখানেও, এক পুরুষ ও নারী। এনারা দুজনেই কি? ঘরের মধ্যে এবং বাইরে? ভূপেনের ছবিতে একই সাথে চলতে থাকে দুই বা ততোধিক ন্যারেটিভ, যেমন ঘটে বাস্তবে, প্রতি মুহূর্তে, আমরা সবগুলিতে সমান মনোযোগ দিতে পারি না, এই যা। মেঝেতে বেছানো গালিচার গাঢ় নীল, সম্পর্কের নৈকট্যের পরিবর্তে শীতলতা এনে দেয়। আবার, সেই গাঢ় নীলে ভালোবাসার ফুলের নকশা, কি অদ্ভুত, প্রায় হাস্যকর, বৈপরীত্য! একদিকের দেওয়ালে আবহাওয়া-চার্ট, অপরদিকে পৃথিবীর ম্যাপ, আবহাওয়ার খবরাখবরই যে দম্পতির দুনিয়া, অনুমান করা কঠিন কি খুব?

একান্ত মুহূর্তে এই দম্পতি কি অন্তরঙ্গ হতে পারবেন? এক সাক্ষাতকারে, ভূপেন বলেন, স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকে, না, এঁরা মিলিত হতে পারবেন না, সংস্কার পিছুটান হয়ে থাকবে। সবার নিষেধ মাথায় রয়ে যাবে এঁদের।

আমরা বিস্মিত হই না, কেননা, সেই কবে, মিকেস তো বলেই গিয়েছেন, “Continental people have sex life; the English have hot-water bottles.”

ভূপেন খকর জানান, ইংল্যান্ডে থাকার সময়ে, তিনি বিস্মিত হতেন, অহর্নিশ আবহাওয়া রিপোর্ট এবং তাই দেখার ব্যাপারে মানুষের উৎসাহ দেখে। এইভাবেই, এ ছবির জন্ম।

আর, এই জীবনযাত্রা দেখতে দেখতেই, জন্ম আরেক মাস্টারপিসের। পাব-এ বসে থাকা মানুষ।

ছবির একেবারে সামনে, উঁচু বার টুলে, বসে আছেন একজন মানুষ। পেছনে, ছোট তিনটি ফ্রেমে ধরা রয়েছে, তাঁর রোজকার জীবনযাত্রা। সবক্ষেত্রেই, তিনি একা।

দৈনন্দিন রুটিন জীবনে নিঃসঙ্গতার শেষে, এমনকি মানুষের সাথে মানুষের সংযোগক্ষেত্র পাব-এ এসে সময় কাটানোর মুহূর্তেও তিনি একাকী। দৃষ্টিতে নিঃসঙ্গ উৎকণ্ঠা। এক হাতে পানীয়ের গ্লাস। অপরহাতে, খামচে থাকা দস্তানায় কি নিত্যকার খোলসকেই প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে থাকা? নাকি, ভূপেনেরই ভাষায়, খামচে ধরা গ্লাভসে ধরা পড়ল একঘেয়েমিজাত অসহায়তা, ইমপোটেন্স?

শ্লেষ, কৌতুক ছাপিয়ে, তাই, ভূপেন খকর বড্ড মানবিকও। স্বাধীনতার পর কয়েক দশক পার হওয়ার পরে এক আধা-পশ্চিমায়িত ভারতবর্ষের ছোট শহর বা মফস্বলের জীবনকে ক্যানভাসে ধরেন তিনি। উঠে আসে আটপৌরে মানুষ, সাধারণ জীবনের কথা।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সাথে দেশজ শিল্পের পুনরুত্থানের যে সূচনা বেঙ্গল স্কুলের হাত ধরে হয়, অবনীন্দ্রনাথের সুযোগ্য শিষ্য নন্দলাল তাকে পৌঁছে দেন পরের ধাপে। জলরঙে উঠে আসে প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষের প্রাত্যহিক যাপন। পাশাপাশিই, যামিনী রায়ের হাত ধরে শুরু হয়, চারুশিল্পের সাথে লোকশিল্পকে জুড়ে দেশজ চিত্রধারা অন্বেষণের প্রয়াস।

স্বাধীনতা লাভের বছরেই, বোম্বে প্রগ্রেসিভ আর্টের হাত ধরে শুরু হয় এক নতুন শিল্প আন্দোলনের। এর কিছু আগেই ছিল, ক্যালকাটা গ্রুপের প্রয়াস। কিন্তু, ব্যাপ্তিতে বা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের গুরুত্বে বোম্বে প্রগ্রেসিভ অনেক বেশি করে উল্লেখযোগ্য। আধুনিক পশ্চিমী শিল্পধারার অনুসারী হয়ে, তৈরি হয় এক নতুন দেশীয় শিল্পরীতির।

কিন্তু, ছোট শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ চিত্রভাবনার সাথে জুড়ে দেওয়ার দুঃসাহস কেউই দেখাননি। ভূপেন খকরের আগে।

ভূপেনের ছবিতে উঠে এল দরজির দোকান, ঘড়ি সারাইয়ের দোকান, পাড়ার সেলুন। এক জীবনযাত্রা, যা প্রত্যহ চোখে পড়ে আমাদের; কিন্তু, অজানা কোনও কারণে সেই জীবন অনুপস্থিত, এমনকি বাস্তবধর্মী চিত্র থেকেও। সত্যি বলতে কি, এইসব রাস্তাঘাটে হররোজ চোখে পড়া দোকানপাট, কিম্বা দোকানি, যে ছবির বিষয় হতে পারে, সেইটা আগে কেউ ভাবতেই পারেননি। কাজেই, সোরগোল উঠল। ভূপেন খকর ঠিক কী করতে চাইছেন, হোয়াট ইজ হি আপ টু, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বারবার শপ

এই পর্যায়েরই একটি ছবি, ম্যান ইটিং জালেবি। একেবারে ফোরগ্রাউন্ডে, একজন মানুষ জিলিপি খাচ্ছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে সমুদ্র। একটি রাস্তা বেঁকে গিয়েছে, কিছু বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তার উপর একটিমাত্র গাড়ি, বাড়ির পানে মুখ করে। জিলিপি খাওয়া মানুষটি একা। সমুদ্রে একটি মাত্র পালতোলা নৌকা। একজনই মাঝি সেইখানে। সৈকতে বসে আছেন দুজন। তাঁরা কেউই পরস্পরের মুখোমুখি নন, কোনও কথোপকথন, খুব সম্ভবত, চলছে না। ভূপেন কি মানুষের, সবকিছুর মাঝেও, নিঃসঙ্গতাই দেখতে, বা দেখাতে চাইলেন?

ম্যান ইটিং জালেবি

নাকি, এই প্রাত্যহিক একঘেয়েমির থেকে স্বপ্নের উড়ানের এক দিশা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে? নচেৎ, এমন স্বপ্নময় পরাবাস্তব চিত্রায়নের অর্থ কী? অথবা, এমন অসামান্য রং নির্বাচনের রহস্য?

একটু সন্ধান করলেই জানতে পারব, রং, ভূপেন খকরের ছবির এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ (একথা, হয়তো, সব সিরিয়াস শিল্পীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। আর, তিনি রঙের ব্যবহার বিষয়েও একটু বেশিমাত্রায় সচেতন। নিজেই বলেছেন, অনেক ছবির রং অন্তত চার কি পাঁচবার বদলানোর পরে পছন্দের কম্বিনেশনটি পেয়েছেন। সমকালীন ইতালীয় শিল্পী জর্জিও মোরান্দি, যাঁর ছবিতে দৈনন্দিন ধরা থাকে সীমিত দুই বা তিন রঙে, তাঁর থেকে ভূপেন সম্পূর্ণ বিপরীত পথের যাত্রী। ভূপেনের ছবি রঙীন, রংবহুল। রঙের ব্যবহার, আপাতদৃষ্টিতে, চড়া। কিন্তু, একটু গভীরভাবে দেখলে, রঙের এমন ব্যবহার, আশ্চর্য, অভাবনীয়।

এ ছবি, শুধুই, নিঃসঙ্গতার চিত্রায়ন কিনা, সেই প্রসঙ্গেও সংশয় রয়ে যায়, কেননা মানুষ ছাড়া ভূপেন আঁকতে পারতেন না। ছবির বিষয় তো বটেই, আঁকার সময়েও তা-ই। পাশে বসে অনেকের সাথে হইহই গল্পগুজবের মধ্যেই ছবি আঁকতেন তিনি। ল্যান্ডস্কেপেও দু-একটি হিউম্যান ফিগার যোগ না হলে, তাঁর কাছে ছবিটি পূর্ণতা পেত না, এ তাঁর নিজের মুখেই বলা।

অবশ্য, শিল্পীর নিঃসঙ্গতা দেখে আমাদের আশ্চর্য হওয়া মানায় না। আমাদের প্রিয় কবি তো বলে গিয়েছেন, “সকল লোকের মাঝে বসে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?/ আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?/ আমার পথেই শুধু বাধা?” সকল লোকের মাঝে বসেও, ভূপেন খকর কি ছিলেন নিঃসঙ্গ?

ছবির জগতে আলাদা হওয়ার সঙ্গত কারণ এবং সম্ভাবনা ভূপেন খকরের জীবনে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। মুম্বইয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে চার সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ভূপেন। চার বছরেই হারান বাবাকে। চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ভূপেনের উপরেই পড়ে গুরুদায়িত্ব। ভূপেন খকর নিজেই বলেন, তাঁর দাদারা তেমন মেধাবী ছিলেন না। বাকিরা পরীক্ষা দিয়ে তেমন সুযোগ না পাওয়ায়, রোজগেরে হওয়ার আশায় তাঁকেই পড়তে হয় চার্টার্ড একাউন্টেন্সি। আর্টস পড়ার ইচ্ছে থাকলেও, তিনি অঙ্কে চিরকালই ভালো আর মানবিকীবিদ্যার শাখাগুলিতে কম মার্কস পেয়ে থাকতেন। তাই, অপছন্দের একাউন্টেন্সি।

একাউন্টেন্সিকে পেশা করা নিয়ে খুব বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন ভূপেন, এমন শোনা যায় না। একেবারে শেষের বছরকয়েক বাদ দিলে, চিত্রকর হিসেবে দক্ষতার শীর্ষে থাকার মুহূর্তেও, তাঁর ছবি তেমন দারুণ বিক্রি হত, এমন নয়। ভূপেনের নিজের ভাষায়, বছরে দুটোর বেশি ছবি তাঁর, প্রায় কখনওই, বিক্রি হয়নি। (এখন অবশ্য, সেই সব ছবিরই আকাশছোঁয়া দাম)। কাজেই, বিকল্প পেশার আয় তাঁকে আর্থিক নিরাপত্তা যুগিয়েছিল। দিনে কয়েক ঘণ্টা পেশাগত দায়বদ্ধতা সামলে, ছবিতে ডুবে যেতেন তিনি। আর, হয়তো বিকল্প আয়ের সুযোগ থাকার জন্যেই, ভূপেন খকর, কখনওই, বাজারে কাটতির দিকে তাকিয়ে ছবি আঁকেননি।

দৈনন্দিনের আর পাঁচটা কাজের মধ্যেই, তাঁর কাছে, ছবি আঁকাও আরেকটা কাজ। আর পাঁচজন বন্ধুর সাথে আড্ডা মারতে মারতে, বাড়ির কাজকর্মের দেখাশোনা করতে করতেই, তাঁর ক্যানভাসে জেগে উঠত একেকখানা মাস্টারপিস। গল্পগাছার মধ্যে ছবি আঁকতে পারার এই অভ্যেসে কেউ বিস্ময় প্রকাশ করলে, ভূপেন খকর, সহজভাবেই বলতেন, ছবি আঁকাটা যদি রোজকার কাজের মতো করে দেখা যায়, তাহলে এরকমটাই তো স্বাভাবিক। ভূপেন খকরের ভাষায়, “ধরুন, আপনি লাঞ্চে বসেছেন, আর সেইসময় আমি গিয়েছি আপনার বাড়িতে। তা, আপনি তো আমার সাথে কথা বলতে বলতেই খেতে পারবেন। এর জন্যে তো আপনার কোনও একাকিত্বের প্রয়োজন হয় না, তাই না? আমার কাছে, ছবি আঁকাটাও তা-ই।” কথাটা শুনে একটু চমক লাগলেও, আমাদের চারপাশে লোকশিল্পীরা তো ঠিক এরকমভাবেই কাজ করে থাকেন। ভূপেন খকরের কাছে ছবি আঁকাটাও এমনই সহজ আর স্বাভাবিক। ছবি শুরুর আগে দু-তিন ঘন্টা বাদ দিলে, তাঁর নির্জনতার প্রয়োজন হত না।

ভূপেন খকরের জীবনে একটু পিছনে ফিরে যাই। একাউন্টেন্সি পাশের পর তিনি চাকরিতে যোগ দেন (আগেই বলেছি, চাকরি তিনি করবেন, প্রায় গোটা শিল্পীজীবন ধরেই)। পেশাগতভাবে, মোটামুটি একটু আয়ের স্থিতি এলে, একটু পারিবারিক আর্থিক স্বচ্ছলতা এলে, তিনি ছবি আঁকা নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। আলাপ হয়, শিল্পী গোলাম মহম্মদ শেখের সাথে। একমাত্র অভিভাবক মাকে বোঝানোর দায়িত্ব নেন গোলাম শেখ-ই। বরোদায় সদ্য চালু হওয়া আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আশা নিয়ে বরোদা আসেন তিনি। কিন্তু, ফাইন আর্টস নিয়ে পড়ার সুযোগ মেলে না। অবশেষে, আর্ট ক্রিটিসিজম নিয়ে মাস্টার্স করেন তিনি। কাজেই, ছবি আঁকা নিয়ে প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি।

অবশ্য, এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল না তাঁর, কোনওদিনই। বরং, তিনি মনে করতেন, তিনি সৌভাগ্যবান, কেননা, এই জন্যেই, প্রথাগত শিল্পশিক্ষাজনিত নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা চিন্তনপদ্ধতি থেকে তিনি নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন। শিল্পশিক্ষার একটি প্রয়োজনীয় ধাপ, সব ধরনের চারুশিল্পধারাকেই ভালোবাসতে শেখা। ভূপেন বলেন, এই ধাঁচের দীক্ষা, মূলগতভাবেই, ভ্রান্ত। এমন শিক্ষা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করে দেয়। সব ধরনের শিল্পকে শ্রদ্ধা বা মুগ্ধতার দৃষ্টিতে দেখা শিল্পপ্রেমী বা শিল্পসমালোচকের উপযুক্ত হতে পারে, কিন্তু, শিল্পীর দেখার চোখ ভিন্ন হওয়াটা শুধু স্বাভাবিক নয়, অবশ্যপ্রয়োজনীয়ও বটে। আর, একটি বিশেষ সময়ে, শিল্পীর একটি বিশেষ শিল্পধারাকে আলাদা ভাবে পছন্দ হবে, হতেই হবে।

আর, এইখানেই, ভূপেন খকর ছকভাঙা, হিসেবের বাইরে। যিনি অনায়াসেই বলতে পারেন, “I deny the known, trained and cultured part within me, which responds to Paul Klee” আইকনোক্লাস্ট হিসেবে এতখানিই দুঃসাহসিক তিনি যে, সমকালীন দেশজ প্রথিতযশা শিল্পীদের প্রায় গডফাদার সম্পর্কে এমন কথা উচ্চারণে তিনি এতোটুকুও কুণ্ঠিত নন।

আঙ্গিক বা ভাবনার ব্যাপারে বোম্বে প্রগ্রেসিভ গ্রুপ যদি পল ক্লী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন, তাহলে ভূপেনের উপরে অনস্বীকার্য প্রভাব সমকালীন ডেভিড হকনি-র। যদিও, এই প্রভাব অনেকটাই আঙ্গিকের ক্ষেত্রে স্পষ্ট, বিষয়ভাবনার দিকে ভূপেন খকর স্বতন্ত্র। তাঁর নিজের ভাষায়, “Hockney is concerned with physical beauty. I am much more concerned with other aspects, like warmth, pity, vulnerability, touch.”

ভূপেন খকর, যিনি অনায়াসে বলতে পারেন, অনেক সময়েই পশ্চিমী মহান আর্টের নিদর্শনের চাইতে, তাঁকে টানে দেশের ফুটপাথের কোনও সস্তা ক্যালেন্ডারের ছবি। কেননা, হয়তো, সেই বিশেষ মুহূর্তে, তাঁর শিল্পভাবনার সাথে, সেই সস্তা আর্টের থিমগত মিল রয়েছে। একেবারে রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া ক্যালেন্ডার, পোস্টার, মেলার সাধারণ মূর্তিকে চারুশিল্পে স্থান দেওয়ার ধারাটি তাঁর হাতে তৈরি। সেই হিসেবে, দেশে পপ আর্টের পথিকৃৎ তিনিই। আবার, পশ্চিম অনুপ্রাণিত পপ আর্ট থেকে সরে এসে, নিজেই খুঁজে নেবেন এক ব্যতিক্রমী শিল্পভাষা।

হ্যাঁ, ভূপেন খকর, যিনি দ্বিধাহীন হয়ে বলতে পারবেন, “Why are all my reactions to art polluted by history, culture and friends? Works of picture postcards, calenders are not part of an artistic heritage. They are pure, untouched and objective.”

আর, পথচলতি বাজারের সস্তার ঘর সাজানোর সামগ্রীর মোটিফের সাথে মিনিয়েচারের সূক্ষ্ম সৌকর্যের মিশেলে তৈরি হতে পারবে এমন কিছু ছবি, যা একান্তভাবেই ভূপেন খকরের।

আগের, বারবার শপ নামের ছবিটি লক্ষ করুন। পাড়ার সস্তা সেলুন, বেসিন, চেয়ার, মায় গায়ে জড়ানোর চাদরখানি, গুড লাক লেখা পাপোশ, দেওয়ালে ঝোলানো সস্তার ছবি, এত নিখুঁত ডিটেইলিং। কিন্তু, সবকিছু ছাপিয়ে অভাবনীয় রঙের ব্যবহার ছবিটিকে দিয়েছে এক আশ্চর্য উড়ান। রোজকার রাস্তায় যাতায়াতের পথে দেখা একটি অতি পরিচিত সেলুনের দৃশ্য, ভূপেন খকরের তুলির ছোঁয়ায়, ক্যানভাসে মাস্টারপিস হয়ে ওঠে। এই সেলুন কি আমাদের খুব চেনা? নাকি, প্রাত্যহিকের মধ্যেই অমৃতের আভাস? দৈনন্দিন থেকেই চিরায়তে পৌঁছে যাওয়া? নাকি, আমাদের একঘেয়ে জীবনযাপনের মধ্যেই সুন্দরের সন্ধান? এই তথাকথিত অনান্দনিকের মধ্যেই নান্দনিকতাকে খুঁজে নেওয়াই, ভূপেন খকরের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

একইভাবে, ঘড়ি সারাইয়ের ছোট দোকান বা দরজির দোকান বা পশরা সাজিয়ে বসে থাকা পাড়ার মনিহারী বিপণী, ভূপেনের তুলির ছোঁয়ায়, সবই আশ্চর্য জীবন্ত। অনবদ্য রঙে, সেইসব দৈনন্দিনের সঙ্গীরা নান্দনিক, কিন্তু কখনওই অপরিচিত বা সুদূরের মনে হয় না।

ভূপেন খকর আর তাঁর ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলে, যে কথাটি, অনিবার্যভাবেই, খুব বেশি করে আলোচিত হয়, সে হল তাঁর সমকামিতা। আমার মনে হয়, এবম্বিধ আলোচনায় এই বিষয়টি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। আর পাঁচজন শিল্পীর ক্ষেত্রে তাঁদের সেক্সুয়্যালিটি যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ভূপেনের ক্ষেত্রেও ততখানিই, বা ততটুকুই।

আমার মনে হয়, ভূপেনের ছবি অনুধাবনের ক্ষেত্রে, এক এবং একমাত্র আলোচ্য প্রেক্ষাপট হিসেবে যদি আমরা সমকামিতাকে দেখতে চাই, তার জন্যে দায়ী, সমকামিতার প্রতি আমাদের তেরছা চোখে তাকানোর প্রবণতা। অন্যান্য শিল্পীর কৃতিবিচারের ক্ষেত্রে যদি তাঁদের হেটেরোসেক্সুয়্যালিটি আলোচনায় না আসে, তাহলে ভূপেনের ছবি বোঝার সময় হোমোসেক্সুয়্যালিটিই কেন্দ্রবিন্দু হবে কেন?

হ্যাঁ, একথা সত্যি, যে, ভূপেন খকর সমকামের কিছু অনিবার্য চিহ্ন বা অনুষঙ্গ যেভাবে এনেছেন তাঁর ছবিতে, তা চমকপ্রদ, এবং ভারতীয় ছবিতে অভাবনীয়। ফ্রান্সিস বেকনের একই বিষয় নিয়ে আঁকা ছবির থেকে ভূপেনের ছবি, চরিত্রগতভাবেও, ভিন্ন, হয়তো অনেক বেশি মানবিকও।

প্রথম জীবনে, নিজের সমকামী আইডেন্টিটি নিয়ে তিনি ছিলেন অস্বস্তিতে। নিজেই বলেছেন, যে, একেক সময় তাঁর মনে হত, যদি বাকিরা তাঁর হোমোসেক্সুয়্যালিটির কথা জানতে পেরে যায়, তাহলে, আত্মহত্যা ভিন্ন পথ থাকবে না। আমার মনে হয়, নিজের আইডেন্টিটি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়া, বা তজ্জনিত অনিশ্চয়তা ভূপেন খকরের ছবির চরিত্রদের চোখে উৎকণ্ঠা হয়ে ফুটে উঠেছে। হ্যাঁ, ভূপেন সমকামী ছিলেন। কিন্তু, এই উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা, সমাজের আর পাঁচজনের চেয়ে ভিন্ন যাঁরা, তাঁদের সবারই নিত্যসঙ্গী। প্রথম পর্যায়ে আঁকা ছবির মধ্যে, সমকামিতার চাইতে তজ্জনিত অনিশ্চয়তা বা কুণ্ঠা অনেক বেশি করে কাজ করে।

উদাহরণ হিসেবে, প্রথম পর্যায়ে আঁকা, পার্সি পরিবারের ছবিটির কথা বলা যায়। একখানা ফ্যামিলি পোর্ট্রেট। ছবির পরিবেশ থেকে স্পষ্ট সপরিবার বেড়াতে যাওয়ার গল্পটি। কিন্তু, ছবির চরিত্রগুলির শরীরী ভাষায় যে অস্বস্তি-উৎকণ্ঠা-টেনশন, তা কি ভূপেনেরই প্রতিফলন? এমন সপরিবার বেড়ানোর মুহূর্তেও, চরিত্রগুলি কেন রিল্যাক্সড নয়, এই চোরা অস্বস্তির রেশ আমাদের মধ্যেও রয়ে যায়, ছবি দেখার অনেকক্ষণ পর পর্যন্তও।

হ্যাঁ, পরবর্তী সময়ে তিনি এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকে বেরোতে পারবেন, এবং খোলামেলাভাবেই নিজের সমকামিতা বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে পারবেন (যদিও, এই গতমাস অব্দিও, এদেশে, সমকামিতা ছিল নিষিদ্ধ)। সমকামিতার কিছু অনুষঙ্গ উঠে আসতে থাকবে তাঁর ছবিতে। জনসাধারণ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায়, মুম্বইয়ের একটি গ্যালারি, এই পর্যায়ের কিছু ছবি প্রকাশ্যে প্রদর্শনের সাহস পান না। প্রাইভেট ভিউয়িং ভিন্ন, কিছু ছবি সর্বসাধারণের সামনে প্রদর্শিত হয় না। এই প্রসঙ্গে, ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা বিশিষ্ট শিল্পী গোলাম মহম্মদ শেখ, হেসে বলেন, ভূপেনের এই ছবিগুলো, বরোদার এক রক্ষণশীল পাড়ার বাড়িতে রাখা ছিল অনেকদিন। এমন বাড়ি, যার দরজা ছিল সবার জন্যে সবসময় খোলা। সেইখানে, এই ছবি সবাই দেখলেন, তাই নিয়ে কারও সমস্যা হল না, কিন্তু, কসমোপলিটন মুম্বইয়ের ডাকসাইটে গ্যালারি এই ছবি সবার সামনে দেখাতে পারলেন না!!

নিজেকে, অকপটে, সবার সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে, সমকালীন দেশজ চিত্রকরদের মধ্যে, ভূপেন খকর অনন্য। যিনি এমন সহজ করে বলতে পারেন, “An artist must be vulnerable. His paintings should reflect all his weak points.”

টেট মডার্ন-এর রেট্রোস্পেক্টিভের নাম-ছবিটি দেখুন। আবারও, ভূপেনের ছবির প্রথমেই চোখে পড়ার মতো যে বৈশিষ্ট্য, রঙের ব্যবহার দেখুন। প্রায় অভাবনীয় রঙের ব্যবহার থেকে চোখ সরালে, একজন মানুষ। সম্পূর্ণ নগ্ন। তিনি তাঁর বারান্দা থেকে দেখছেন। পায়ের কাছে, একখানা চাদর আর বালিশ। তাঁর বিছানা, নিশ্চিতভাবেই। বারান্দার বাইরে বিভিন্ন দৃশ্য। তিনটি ভিন্ন ফ্রেমে দুজন মানুষ ও ভারবাহী গাধা।

ছবির নামকরণ বা দুজন মানুষ ও সঙ্গী গাধার অনুষঙ্গে ঈশপের একটি গল্পের রেফারেন্স, যেখানে দুজন মানুষ সবাইকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে, সবার সুপরামর্শে কান দিতে গিয়ে, গাধাটির মৃত্যুর কারণ হয়ে বসেন। ভূপেনও কি বলতে চান, তোমাকে মানুষ গ্রহণ করুন বা না করুন, সবাইকে খুশি করার নিরর্থক প্রয়াসের চাইতে, একাকিত্বও শ্রেয়?

ছবির একদিকে, একজন মানুষ আঁকশি দিয়ে গাছ থেকে ফল পাড়ছেন। অন্য আরেকদিকে, একজন প্রায় নিজের মাথাটি বনেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গাড়ি সারাচ্ছেন।

নগ্ন মানুষটি, নিজের পরিসর থেকে দেখছেন, একেবারে রোজ ঘটে যাওয়া এই সাধারণ দৃশ্যাবলি। তিনি আবৃত হওয়ার চেষ্টা করেননি। সমাজের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ খুলে দেখাতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু, সমাজ? সমাজ কি দুহাত বাড়িয়ে তাঁকে কাছে ডেকে নিতে প্রস্তুত? না, তেমন আশ্বাস মেলে না। সবাই ব্যস্ত। অন্তত, ছবিতে, কেউই যে তাঁর দিকে চেয়ে দেখছে না, একথা স্পষ্ট।

আর, আপনি? মানে দর্শক? ছবিতে, পার্স্পেক্টিভের এমন চতুর ব্যবহার, ভূপেনের মতো করে কজন করেছেন!! আপনি তো ঘরের মধ্যে বসে, নিরাপদ আশ্রয় থেকে, দেখছেন এই মানুষটিকে। অন্তত, ছবির দর্শক যিনি, তিনি তো, অবশ্যই, ঘরের অন্দরের দৃষ্টিকোণ থেকে ছবিটি দেখছেন (দর্শক রয়েছেন নগ্ন মানুষটির পেছনে, ঘরের ভেতরে)। যে মানুষ এমন একাকী, আপনি শুধু নিস্পৃহ অবলোকন ভিন্ন, তাঁর পাশে রয়েছেন তো?

বহির্দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে মূলত নীল আর সবুজ। শীতলতা স্পষ্ট সেই রঙের ব্যবহারে। এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি ছবি জুড়ে রয়েছে। গোধূলি কি? সন্ধে হয়ে আসছে?

মানুষটির আবাস ধরা হয়েছে গোলাপি আর কমলা রঙে। উষ্ণ। নিজের উষ্ণ অন্তরমহল ছেড়ে, পড়ন্ত বিকেল সন্ধ্যেবেলায়, যে মানুষটি নিজেকে উন্মুক্ত করতে চাইছেন, সবার সাথে মিলে যেতে চাইছেন, বাকি সবাই কি শুনতে পেলেন সেই অস্ফুট স্বর, দেখতে পেলেন কি সেই অলৌকিক উন্মোচন?

ভারতীয় ছবিতে, এমন স্পষ্ট করে, অকুণ্ঠে, নিজেকে দেখাতে পেরেছেন, ভূপেন খকর। শিল্পী আর শিল্পকৃতি, দুইয়ের এমন ভাবে মিলেমিশে যাওয়ার নজির, এদেশের শিল্পের ইতিহাসে খুব একটা সুলভ নয়।

এই ছবির বিচার-বিশ্লেষণে, প্রায় সবাই, টেনে এনেছেন ভূপেন খকরের সমকামিতা এবং তজ্জনিত আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। ছবির বাকি সব ছেড়ে, গাধাটির লিঙ্গ উত্থিত কেন, এমন প্রশ্নও এসেছে। জবাবে, ভূপেন খকর, পরিহাস করে বলেছিলেন, সে তো হবেই, গাধাটির পিঠে যে একসাথে, একেবারে দুজন পুরুষ। শিল্পীও কি বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন, এই ভেবে, যে, সব কিছু ছেড়ে, প্রতি মুহূর্তে, তাঁর ছবির কথায়, কেন শুধুই উঠে আসবে, শিল্পীর যৌন পছন্দের প্রশ্নটিই?

কিন্তু, একটু গভীর অন্বেষণে ব্রতী হলে, এই ছবির ভিতরের কথাটুকু অনুধাবন করতে পারার সাথে, শিল্পীর যৌন পছন্দের কি কোনও-ই যোগ রয়েছে? শিল্পীমাত্রেই হয়তো নন, কিন্তু অনেক শিল্পীই তো সকলের মাঝে থেকেও, রয়ে যান আউটসাইডার। “দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ? (খুলে গো।)/ কেন বুঝাতে পারি নে হৃদয়-বেদনা?” এ সঙ্কটের মুখোমুখি তো, শিল্পীমাত্রেই, জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে, হয়েছেন। নিজের গোপন কক্ষ ছেড়ে, বাইরের খোলস ত্যাগ করে, শিল্পী, বাইরে এসে দাঁড়ালেও, আমরা নিজেদের দৈনন্দিন যাপন নিয়ে এমনই মেতে থাকি, ফিরে তাকানোর অবকাশ থাকে কি?

আমার মনে হয়, শিল্পীমাত্রেরই জীবনে এমন কয়েকটি কাজ থাকে, যা দিয়ে তাঁর জীবনকালের কাজকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। এমন কয়েকটি কাজ, যেগুলির মধ্যে দিয়ে সবচাইতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হতে পারে, তাঁর শিল্পদর্শন। ইউ কান্ট প্লিজ অল, ভূপেন খকরের পোর্টফোলিও-তে তেমনই একটি ছবি। আর, আমার এও মনে হয়েছে, এই ছবিটির যথার্থ দর্শনগত পরিপূরক হতে পারে আরেকটি ছবি, যেটির নাম ম্যান উইথ প্লাস্টিক ফ্লাওয়ার্স।

একটা ছোট জগতের মধ্যে, আশেপাশের দুচারটে মানুষকে নিয়ে কেটে যায় আমাদের একঘেয়ে জীবন। তারই টুকরো টুকরো ছবি ধরা হয়ে থাকে কয়েকটি ফ্রেমে। ছবির মধ্যে, আরও টুকরো কিছু ফ্রেমে, আরও কিছু গল্প বলার উত্তরাধুনিক ধারাটি, এদেশে, এনেছিলেন ভূপেন খকর-ই। একজন মানুষের বেঁচে থাকা তো একমাত্রিক হতে পারে না। তার প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ক্রিয়াকলাপের মধ্যে, সে একের মধ্যেই বহু। হ্যাঁ, কোনও একটি বিশেষ মুহূর্তে, হয়তো তার কোনও একটি সত্তা-ই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু, বাকি বেঁচে-থাকাগুলো মিথ্যে বা অপ্রধান হয়ে যায় না।

অনেক টুকরো, বিচ্ছিন্ন ফ্রেমের মাঝখানে, কৃত্রিম প্লাস্টিকের ফুল নিয়ে, অর্থহীন, শূন্য দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি, কে? আমি, আপনি, চারপাশের যে কেউ-ই হতে পারেন। আমাদের ফাঁপা অস্তিত্বের সামনে, এমন করে আয়না ধরতে পারেন, হ্যাঁ, একমাত্র, ভূপেন খকরই।

শিল্পের রাজনীতি, অথবা শিল্পীর রাজনীতি নিয়ে ভূপেন খকর তেমন করে, খুব একটা, বলেননি। তাঁর বক্তব্য ছিলো, “An artist should not preach, talk philosophy, try to reform society, because he constantly revels in illogicality, sensuality or vulgarity.”

নিজের জীবন, তাঁর প্রতিদিনের পথ চলার, এমন করে, সযত্নে, ক্যানভাসে ডকুমেন্টেশন, ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে, প্রায় নজিরবিহীন। পছন্দের দৃশ্যাবলির ল্যান্ডস্কেপ, দৈনন্দিন বাজারহাটের সেলুন, দরজির দোকান বা ঘড়ি সারাইয়ের ছোট দোকান, এমন করে ক্যানভাসে অমর করে যাওয়া বিস্ময়কর।

বহুকণ্ঠ, বহুস্বরের এমন অবিরত কথোপকথন, ভূপেন খকরের মতো করে, খুব বেশি শিল্পীর ক্যানভাসে ধরা পড়েনি। তাঁর ক্যানভাসে মুগ্ধ হয়ে, সলমন রুশদি বলেছিলেন, ভাষা দিয়ে তিনি যেভাবে জীবনকে ধরার চেষ্টা করেন, ভূপেন খকর, তা-ই করেন, অনায়াসে, রঙ-তুলি দিয়ে।

সমকালীন শিল্পীদের নিয়ে প্রদর্শনীতে ভূপেন, বারবারই, হয়েছেন অবহেলিত। কেননা, জগদীশ স্বামীনাথনের মতো, অনেকেই মনে করতেন, ভূপেন খকর কোনও শিল্পীই নন, এবং তাঁর কাজ মোটা দাগের, নিম্নরুচির।

ভূপেন বলেছিলেন, শিল্পীর জীবন কখনও সম্মানের হতে পারে না। শিল্পী ভদ্রলোক হতে পারেন না। যখন একজন মানুষ শিল্পী হতে চান, তাঁর পক্ষে, আর যাই হোক, ভালোমানুষ হওয়া মানায় না।

তাহলে, ভূপেন খকরের ছবি কি রাজনীতিবিহীন?

জন বার্জার তো বলেছিলেন, “If the pursuit of profit is considered as the only means of salvation for mankind, turnover becomes the absolute priority, and, consequently, the existent has to be disregarded or ignored or suppressed.

Today, to try to paint the existent is an act of resistance instigating hope.”

ছবির স্যাটায়ারের জন্যে সুখ্যাত ভূপেন খকর হয়তো শুনে মুচকি হাসতেন, নিয়তির পরিহাস, পেশায় চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, অতএব আজীবন জমাখরচ-লাভক্ষতি-টার্নওভারের হিসেব কষে গেলেন যে মানুষটি, সেই চিত্রকরই, ছবিতে ধরে রাখলেন আমাদের প্রতি মুহূর্তের একঘেয়ে জীবনযাপন। আর, এমন করে, প্রত্যেকদিনের অতি সাধারণ বেঁচে থাকার বর্তমানকে ক্যানভাসে অমর করে দিয়ে, হয়ে উঠলেন, আমাদের প্রতিরোধেরও শিল্পী!!

আশ্চর্য সমাপতন। তাই না?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...