সত্যব্রত ঘোষ
চলচ্চিত্রকারের নির্মিত ছবি টিকিট কিনে সাধারণ মানুষরা প্রেক্ষাগৃহে দেখতে যান বিনোদনের জন্য। রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন একটি সরল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনেকটা যেভাবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের বশে আনতে চান। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষককে উদার হতে হয় বটে। না হলে শিক্ষাগ্রহণের প্রতি ছাত্রছাত্রীর আগ্রহ কমে যাবে। কিন্তু সীমারেখা অতিক্রম করলে নিয়মনিষ্ঠ শিক্ষক ‘দোষী’কে উদাহরণযোগ্য শাস্তি দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেন সীমারেখা টানা আছে। তা সত্ত্বেও শৃঙ্খল ভাঙবার অমোঘ তাড়নাকে বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি থেকে একেবারে সরিয়ে দিতে পারেন না তিনি। একইভাবে, রাষ্ট্রের প্রত্যাশা, যে ব্যক্তি চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন, তিনি যেন সুবোধ বালকের মতো নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই নিজের ভাবনাচিন্তাকে প্রয়োগ করেন। কিন্তু সৃষ্টি কোনওদিনও কি নিয়মনিগড়ে বাঁধা পড়ে তুষ্ট থাকতে পেরেছে?
রুপোলী পর্দার নেপথ্যে যে অন্ধকার, সেখানে অসংযমী মানুষদের বাড়বৃদ্ধি। সাধারণভাবে প্রচলিত এই ধারণা ভিত্তিহীন নয়। আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোটাই যে আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য, সেখানে বাস্তব এবং কৃত্রিম জগতের মধ্যে পর্দাটি সময়বিশেষে অদৃশ্য হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। একই সঙ্গে এটাও সত্যি, অত্যন্ত কড়া এক অনুশাসনের মধ্যে দিয়েই কিন্তু অধিকাংশ সিনেমার জন্ম হয়।
কী এবং কেন? চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিটি স্তরে এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং দেওয়ার পালা চলতেই থাকে। প্রযোজকদের বুঝতে হয় চলচ্চিত্রটি নির্মাণের উদ্দেশ্য। চিত্রগ্রাহক, শব্দগ্রাহক, শিল্পনির্দেশক, এবং নির্মাণ ব্যবস্থাপককে বুঝে নিতে হয় নির্মিত চলচ্চিত্রটির প্রত্যেক দৃশ্যের বিন্যাস। অভিনেতাদের সঙ্গে আবেগের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে পরিচালককে বিস্তৃত আলোচনা করতে হয়। চিত্রসম্পাদকের অন্যতম কাজ হল, প্রতিটি গৃহীত দৃশ্যের বাড়তি অংশগুলিকে নির্মমভাবে ছেঁটে চলচ্চিত্রটিকে সুঠাম এক মেদহীন অবয়ব দেওয়া। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
কারণ, শিক্ষকরূপী অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে রাষ্ট্র এরপর চলচ্চিত্রটির গুণমান বিচার করবে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে সাধারণ দর্শকসমাজ বোধহীন এবং অপাপবিদ্ধ। দৃশ্য, এমনকি একটি শব্দ যদি ‘শালীনতা’র সীমা লঙ্ঘন করে, তবে তাতে কোপ পড়বেই পড়বে। পরিচালক এবং নির্মাতাকে জানিয়ে দেওয়া হবে, মূল ছবিটি থেকে কোন কোন অংশ কতখানি বাদ যাবে। সাথে ছবির গ্রেডও জানিয়ে দেওয়া হবে — ‘U’, ‘UA’ অথবা ‘A’। অন্যপক্ষের কোনও বক্তব্য থাকলে, তা এমনভাবে শোনা হবে, যেমনভাবে দণ্ডাদেশ দানের পর বিচারক অপরাধীর শেষ ফরিয়াদ শোনেন৷ তাঁর কাছে যা বাহুল্য মাত্র।
সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের নীতিজ্ঞদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনুরাগ কাশ্যপ, প্রকাশ ঝা সহ বেশ কয়েকজন প্রমুখ চলচ্চিত্র নির্মাতা লড়াই করেছেন। সেই লড়াইয়ের মাধ্যমে আমরা আরেকবার বুঝেছি রাষ্ট্র যে পদ্ধতির মাধ্যমে সিনেমাগুলির নৈতিক মান বিচার করছে, তা এখনও ঔপনিবেশিক সময়েই আটকে আছে। প্রতিবাদ যতই সোচ্চার হোক না কেন, সংশোধনের যতই দাবি উঠুক না কেন, ‘সার্টিফিকেশন বোর্ড’ থাকবে ১৯৪৮ সালে প্রবর্তিত এবং ১৯৫২ সালের “ইন্ডিয়ান সিনেমাটোগ্রাফিক অ্যাক্ট” দ্বারা সশস্ত্র সেই ‘সেন্সর বোর্ড’ হয়েই। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক বরাবরই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে স্বাধীন অভিব্যক্তিকে অত্যন্ত শক্ত হাতেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। তা সে যে রাজনৈতিক দলেরই কুক্ষিগত হোক না কেন।
পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের বর্তমান অধিকর্তা পরাশর পাথরাবে তো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় এক কাঠি এগিয়ে গেছেন। প্রতিষ্ঠানটির নিজেরই প্রেক্ষাগৃহে গত ৬ই সেপ্টেম্বর হরিশঙ্কর নাচিমুত্থু নামে এক ছাত্রের তৈরি ডিপ্লোমা ফিল্ম “হোরা”র প্রদর্শনই তিনি শেষ মুহূর্তে নাকচ করে দিলেন এবিভিপি-র ভয়ে। যেখানে দর্শক বলতে কোনও সাধারণ মানুষ নয়, ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং কিছু ছাত্রই শুধু উপস্থিত থাকতেন। আম্বেদকর জয়ন্তী উদযাপন নিয়ে এক বছর আগে নির্মিত ছবিটি অবশ্য ১০ সেপ্টেম্বর প্রদর্শনে বাধ্য হন অধিকর্তা দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্রদের বিক্ষোভ আন্দোলনের পর। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগের ধারাটি নিত্য বহমান। বিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকটি যেমন খেয়াল রাখেন তাঁর ছাত্ররা যাতে গণ্ডির বাইরে না যায়, তেমনই, চলচ্চিত্রকারের স্বাধীন অভিব্যক্তির চারপাশে প্রথাগত নৈতিকতার নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনেছে রাষ্ট্র। যার বাইরে পা দিলে বিপদ।
চলচ্চিত্রকারের মূল সমস্যাটি হল এই যে, তাঁর উদ্যোগটি বাস্তবায়িত করতে বিপুল এক অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে। সেন্সররূপী রাষ্ট্র যখন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুই উপায়েই জানিয়ে দেয়, তার প্রদত্ত সিদ্ধান্ত না মানলে তাঁর ছবিটি জনসমক্ষে আসবে না, তখন ব্যবসাগত দিকটি বিবেচনা করে তাঁকে আপসের পথে যেতেই হয়। কারণ, প্রযোজক এবং বিতরকও সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ইচ্ছা দ্বারা চালিত হয়।
প্রযুক্ত চাপ অগ্রাহ্য করবার জন্য চলচ্চিত্রকারের সামনে একটি উপায় আছে। পরবর্তীকালে তাঁদের ছবি জনসমাদৃত হলে, তাঁরা বাজারে সেই মূল ছবিটি আনতে পারেন, যা সেন্সর বোর্ডকে প্রথম দেখানো হয়েছিল। চলচ্চিত্রকারকে তখন প্রযোজক এবং বিতরকও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন করেন। আমেরিকায় সত্তর দশক থেকে চার্লি চ্যাপলিন সহ অনেক চিত্রপরিচালকের ছবি পুনর্মুক্তি পায় যা আগে অনেকবার ঘটেছে। তবে “ডিরেক্টর’স কাট” শব্দযুগ্মটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় যখন ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রিডলি স্কটের “ব্লেড রানার” ছবিটি ১৯৯২ সালে নতুন করে বাজারে আসে।
ভারতে যথার্থে একটি ছবির ক্ষেত্রেই শব্দযুগ্মটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করা যায়। ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রমেশ সিপ্পির “শোলে”। একবার ফিরে দেখে নেওয়া যাক জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার প্রেক্ষিতটি, যখন পরিচালক নিজের নামটি পর্যন্ত ছবিটি থেকে প্রত্যাহার করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। (গুলজার পরিচালিত “আঁধি” এবং অমৃত নাহাতা পরিচালিত “কিসসা কুর্সি কা” সহ আই এস জোহর পরিচালিত “নাশবন্দি” সেই সময়ে সেন্সর বোর্ডের কোপে পড়ে। এছাড়া চেতন আনন্দের “অফসর” ও “সাহিব বাহাদুর”, বি এস নাগির “গোল্ড মেডেল”, মনমোহন দেশাইয়ের “ধরমবীর” ছবিগুলিও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়।)
এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে বিচারপতি জগমোহনলাল সিং ১২ জুন ১৯৭৫ একটি রায় দেন। তাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অপরাধী সাব্যস্ত করে জানানো হয় আগামী ছয় বছর তিনি রায়বেরিলি বা অন্য কোনও নির্বাচনী ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারবেন না। রায়দানের ১৩ দিন পরে বিরোধী দলগুলি সম্মিলিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় সারা দেশ জুড়ে প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি তুলে বিক্ষোভ জানানো হবে। ২৫শে জুন ১৯৭৫ রাত থেকেই বিরোধী নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। তার পরদিন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ সংবিধানের ৩৫২ ধারার ১ উপধারা অনুসরণ করে ঘোষণা করেন “অন্তর্বতী গোলযোগের কারণে দেশে সুরক্ষা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় এই মুহূর্ত থেকে জরুরি অবস্থা জারি করা হল।” সেদিন থেকে আগামী একুশ মাস (২১শে মার্চ ১৯৭৭) স্বাধীনোত্তর ভারত জানল প্রতিবাদী সত্তাকে স্তব্ধ করবার জন্য রাষ্ট্র সত্যিই নির্মম এক যন্ত্রে পরিণত হতে পারে।
“শোলে”র শেষ দৃশ্যে গব্বর সিং মারা যায়। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সিপ্পি ফিল্মসের রাইটিং রুমটিতে বসে সেলিম খান এবং জাভেদ আখতার যে চিত্রনাট্যটি লেখেন, তাতে এমনটাই ছিল। ৩রা অক্টোবর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাস অবধি পরিচালক ব্যাঙ্গালোরের (বেঙ্গালুরু) রামনগরমে এই চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে “শোলে” চিত্রায়িত করেন। সেখানে রামলালের বানানো পেরেকওয়ালা নাগরাটি দিয়ে গব্বর সিংকে বিষাক্ত সাপের মতোই থেঁতলে মারে ঠাকুর বলদেব সিং। তার আক্রমণে পাথরের স্তম্ভে আটকানো তীক্ষ্ণ শলাকায় গব্বর সিং বিদ্ধ হয়। তারপর প্রৌঢ় বলদেব সিং অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। একাকিত্বের এই বিপুল ভার সে সহ্য করতে পারে না। লড়াইয়ে সে জিতল ঠিকই। কিন্তু সেই আগুনে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রতিশোধপরায়ণ মানুষকে শেষ অবধি হারতেই হয়।
সেন্সর বোর্ডের নীতিজ্ঞরা সিদ্ধান্তে এলেন ছবি এমনভাবে শেষ হতে পারে না। ব্রিটিশ প্রবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রকে যে দমনমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দায়বদ্ধ তাঁরা। বিশেষত, জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে। কোনও ছবিতে রাষ্ট্রশক্তির ঊর্ধ্বে কোনও ব্যক্তির ক্ষমতাকে গৌরবান্বিত করা চলবে না। ছবিটি দেখলে জনমানসে রাষ্ট্রকে তুচ্ছ করবার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। কোন সাহসে একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এখানে আইনকে নিজের হাতে নেয়? কোন স্পর্ধায় সে জনসমক্ষে গব্বরকে হত্যা করে? এর পাশাপাশি আরেকটি আপত্তি ছিল তাঁদের। পরিচালক রমেশ সিপ্পি হিংস্রতাকে প্রথা অনুযায়ী স্থূলভাবে চিত্রায়িত না করে, অন্য এক শৈল্পিক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। এই ছবি না আটকালে পরবর্তীকালে ছবির মাধ্যমে হিংস্রতাকে উদযাপন করবেন নিম্নমানের পরিচালকেরা। সেই কারণে “শোলে”র বিভিন্ন দৃশ্য বাদ দিতে হবে। কিন্তু সবার আগে শেষ দৃশ্যটি সম্পূর্ণ পালটাতে হবে।
যে মেধার পরিচয় দিয়ে রমেশ সিপ্পি “শোলে”র প্রত্যেকটি দৃশ্য রচনা করেছেন, সেই মেধার কারণেই তিনি এবার অপরাধী। সেন্সর বোর্ডের দাবি অন্তিম দৃশ্যে দেখানো হোক পুলিশ এসে বলদেব সিংকে আটকাচ্ছে। হাজার একটা ছবিতে এতদিন তেমনটাই তো হয়ে এসেছে। তাঁর পরিচালনায় “শোলে”তে যে শোকান্তিকার সোচ্চার উন্মোচন ঘটছে, সেন্সর বোর্ড তা কিছতেই গ্রাহ্য করবে না। জরুরি অবস্থার দিনগুলিতে মানুষের মৌলিক অধিকার অথবা শিল্পীর স্বাধীনতা যে বারবার খর্ব করা হয়েছে, এটি তার আরেকটি নিদর্শন। (সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশে “কিসসা কুর্সি কা” ছবির নেগেটিভ আগুনে জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হয়।)
বেশ কয়েকবার সেন্সর বোর্ডের কর্তাদের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করেন রমেশ সিপ্পি। তাঁদের বোঝান, শেষ দৃশ্যটিতে যদি পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে তাহলে দর্শকরা হাসাহাসি করবে। কারণ, গব্বর সিং তার ডাকাতবাহিনী নিয়ে যখন সারা ছবি জুড়ে রামগড় গ্রামের উপর দৌরাত্ম্য ফলাচ্ছিল, তখন পুলিশের টিকিও দেখা যায়নি। তাছাড়া, এমন হাস্যকর অন্তিম দৃশ্যের জন্য বাধ্য করানো হলে যে সংবেদনশীলতা এবং নৈপুণ্যে সঞ্জীব কুমার ছবিটিতে শোকস্তব্ধ এক ব্যক্তির পুঞ্জীভূত রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেন্সর বোর্ড সেই শিল্পীর দক্ষতাকেই অপমান করবে৷ কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। প্রযোজক জি পি সিপ্পি প্রভাবশালী ব্যক্তি। দিল্লিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে বিভিন্ন পদাধিকারী এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করবার পরও পাথর টলল না। প্রযোজক বাবার সঙ্গে পরিচালক ছেলের কলহ ক্রমশ অসহনীয় হতে থাকে। রমেশ সিপ্পি ঠিক করেন হয় আদালতে মামলা করবেন, নয়তো “শোলে”র পরিচালক হিসেবে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেবেন।
আইনজ্ঞ বাবা শেষ অবধি তাঁর জেদি ছেলেকে বোঝাতে সক্ষম হন যে জরুরি অবস্থায় আদালতও রাষ্ট্রীয় কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে রায় দেবে না। তাছাড়া, “শোলে”র নির্মাণে যে অভূতপূর্ব পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়েছে (তখনকার দিনে প্রায় তিন কোটি টাকা), তাতে নির্ধারিত ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে মুক্তি না পেলে সিপ্পি পরিবারকে দেনার দায়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হতে হবে। অগত্যা সেন্সর বোর্ডের দাবিমতো অন্তিম দৃশ্যটি নতুন করে চিত্রায়ন করা প্রয়োজন। ২০ জুলাই ১৯৭৫ থেকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রামনগরমে আবার ফিরে গিয়ে যা চিত্রায়িত হল, তা আমরা সবাই পর্দায় দেখেছি।
এই বৃত্তান্তের বাইরে যা রয়ে গেল, তা হল সেই ডিরেক্টর’স কাট। সেন্সর বোর্ড যতই খড়গহস্ত হোক না কেন, ছবির মূল ৩৫ মিমি কয়েকটি প্রিন্ট অবিকল অবস্থায় কিন্তু বাজারে রয়ে গেছে। Zee Movies চ্যানেলে সেই প্রিন্ট টেলিসিনে করে কয়েকবার ইতিমধ্যে দেখানোও হয়েছে। দুঃখের বিষয় একটাই। তুমুলভাবে জনপ্রিয় হওয়ার প্রায় চার দশক পরে ৩রা জুলাই ২০১৪ সালে “শোলে”র একটি 3D version মুক্তি পায় বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে। সিপ্পি পরিবারের উত্তরপুরুষরা ঘটা করে তাতে নিজেদের নাম যুক্ত করেছেন বটে। কিন্তু “ব্লেড রানার” ছবিটির ক্ষেত্রে রিডলি স্কটের মূল ছবিটি যে প্রত্যাশা পূর্ণ করে জনসমক্ষে আসে, রমেশ সিপ্পির নিয়তিতে তা ঘটল না। নতুন করে সার্টিফিকেট করানোর সময়ে কিন্তু সেন্সর বোর্ডের দাবি মেনে বানানো ছবিটিকেই অপ্রাসঙ্গিক এবং আরোপিত কারিগরি প্রযুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করা হয়, যা দর্শকদের একেবারে পছন্দ হয়নি। (অবশ্য টেলিভিশনে ইদানিং “শোলে”র এই 3D version-ই দেখানো হয়।)
বৃহত্তর প্রশ্নটি অন্যত্র। সিপ্পি পরিবার কি “শোলে”র প্রাণপুরুষ রমেশ সিপ্পির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না? “শোলে”র যে ডিরেক্টর’স কাট, তা সমাজগ্রাহ্য বলেই Zee Movies তা প্রসারিত করে ভারতে তথা সারা বিশ্বে। অথচ সরকারি স্তরে তাকে মান্যতা দেওয়ার সম্ভাবনাকে কোন কারণে ধ্বংস করা হল? সরকারি কাজকর্মে precedence-কে শিরোধার্য করে নেওয়া হয় না, এমন নজির বড় অল্পই আছে। কারণ প্রশাসন যন্ত্র যে পদ্ধতিতে কাজ করে সেখানে নতুন কোনও সিদ্ধান্তগ্রহণের পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রতিরোধ সেই ক্ষমতার অন্দরমহলেই সৃষ্টি হয়। এর নেপথ্যে আমলাদের নিয়মনিষ্ঠা সক্রিয় না তাঁদের আলস্যই প্রাধান্য পায়, সে প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক। “শোলে”র যারা অন্ধ ভক্ত, তারা সব জেনেশুনেও প্রাতিষ্ঠানিক এই পশ্চাৎগামিতাকে মেনে নিয়েছেন। যেমন মেনে নিয়েছেন স্বয়ং রমেশ সিপ্পি, যিনি এই 3D version-এর মধ্যে দিয়েই সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতাবস্থা এবং সিপ্পি ফিল্মসের বাণিজ্যিক ফায়দাকে নিজের সৃজনশীলতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
মণি রত্নমের কথা এই সূত্রে মনে আসে। তিনিও সম্ভবত তাঁর “বোম্বে” ছবিটির “ডিরেক্টর’স কাট” আর চান না।
আজকের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরী এবং তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
ভালো লেখা! সুমন মুখোপাধ্যায়ের একটি ছবি নিয়ে ও এই কান্ড ঘটেছিল!যদিও রমেশ সিপ্পি তাঁর “শোলে” তে প্রচুর বিদেশি ছবির কাট ব্যবহার করেছেন,তবুও…! রাজনৈতিক দিক টি অভিনব! সত্যব্রত কে অসংখ্য ধন্যবাদ ও সাধুবাদ ওঁর দেখার ভঙ্গিটি কে!