সৌমিত দেব
ছানাবেলা
১
আশ্বিনের শারদপ্রাতে উঠিল ঘণ্টা বাজি
হাফ-ইয়ার্লি চুকে যাবে আজই
তড়িঘড়ি অঙ্ক খাতা, সাবমিটিয়ে ছাতার মাথা
বাড়ির পথে ছানায় দেখো ছুট্টে যেতেও রাজি
২
কই কই কই…
কই গেল সবক’টা পুজো মাখা বই?
দুই দিন আগে এল, খবরের সাথে
না না বড় ধাড়িরা তা দেয়নিকো হাতে
বলে আগে — ‘এক্সামে হয়ে নাও কাবু
তারপরে হাতে পাবে তুমি কাকাবাবু’
৩
মিষ্টি ছানা ছোট্ট ছানা
বছরভরের তানানানায়, ওয়েটিং-এ খুব থাকে
তারায়, মেলায়, পুজোয় বেলা উঠবে এসে তাকে
কবে উঠবে বইয়ের তাকে
৪
এক তাতে শঙ্কুতে কঙ্গোর কাজে
বুরুণের আঁক কষে দেয় ভূতে মাঝে
ডায়ানাকে তুলে আনা ভিলেনের জ’তে
কিটদার বাপে দেয় ছাপ খুলি মতে
সন্তুর স্ল্যাপকিক, বদলার কোপে
কলাবতী ডাইভিয়ে স্লিপে ক্যাচ লোপে
তার সাথে খেলাধুলো, পোস্টারে গুরু
বিজ্ঞানে, অভিযানে, পুজো হল শুরু
৫
অন্যটাতে পাঁচ পাঁচা পাঁচ, পাঁচটি মন-তুফান
পাঁচজনে যায় পঞ্চু সমেত কত্ত অভিযান
বন্দুকেরও সামনে বাঁটুল বুক চিতিয়ে লড়ে
ভোঁদার পরে পিসের গুঁতো হাঁদার পিঠে পড়ে
বিল্লি চলে আপন তালে, ন্যাজটা পিঠোপিঠি
সব সওয়ালের জবাব আছে, দাদুমণির চিঠি
টিনেজবেলা
এরপর এল ছানার টিনেজবেলা। বাহাদুরের লেজখানা বড়রা বেশ দেখতে পাচ্ছে তার পেছনে দুলদুল করছে। সে অবিশ্যি অতদিকে মাথা ঘামায় না। ছড়াও তার ভাল্লাগেনা আর। ক্লাস এইটের সিনিয়র সে এখন। ‘বাচ্চারা’ ‘দাদা’ ‘তুমি’ও বলছে। দু’একটা গালাগাল শিখে ফেলেছে, সঙ্গে কিছু অসভ্য কথা। লুকিয়ে বলতে হয় এমন। কাছের বন্ধু হওয়ার প্রথম শর্ত হল সে কী জানে আর কতটা জানে। তোমার জানা কথা যতটা লুকিয়ে রাখতে পারবে, ততটাই তুমি আমার কাছের বন্ধু হয়ে উঠবে। বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে যতটা লম্বা হাইট পাওয়া যায়। দারুণ সমস্ত বদল। শুধু হাফ-ইয়ার্লি একই আছে। একদম পুজো নিয়ে যেমন আসত তেমন। অবশ্যি পুজোর আগেই ‘পুজো আসছে’ নিয়ে আসত পাতাজোড়া খবরের বিজ্ঞাপন। দ্বিতীয় পাতার বাঁদিকের একদম নিচে গোয়েন্দা রিপ থেকে অরণ্যদেব যারা পড়ার ভাগ্য পেল না, তারা অবশ্য ও জিনিস বুঝবে না। আর ছিল সেই মহার্ঘ্য বস্তু! শারদীয়া পত্রিকা।
তা টিনেজার বড় না হলে কী হবে, বুদ্ধি তো তার কম নেই! সে বেশ মনোযোগ দিয়ে বুঝতে পারছে বাহাদুরের লেজ আসলে তার পেছনে নেই। রয়েছে এই পত্রিকাদের পেছনে। না হলে এত এগিয়ে আসবে কেন? আরে তোর পাতা খুলে প্রথম গন্ধটা পেলেই যে আমার নতুন জামা পরতে ইচ্ছে করে সেইটে তুই বুঝবি না কেন? কে তোকে বলে একমাস আগে বেরুতে? তা যাই হোক, ছোটবেলায় একবার বাজ পড়লে ভয় আর ক্ষমাধর্ম শরীরে ঢুকে গেলে সে সহজে বেরোয় না। এমনকি যখন সে দামড়া হবে, তখন প্রেমিকার পাশে কানে হাত দিয়ে হাঁটবে। ফলে ক্ষমা করতেই হবে। এ ছাড়া নো উপায়। আর ক্ষমা করবে না নাই বা কেন? তার জীবনে টুপুর এসেছে না!
খুবই কষে হিসেব করে সে দেখে নিয়েছে টুপুর প্রায় তারই সমবয়সি। মিতিন মাসিকেও একবার ভাল লাগছিল, কিন্তু সে সব তো ও বয়সে নিষিদ্ধ! তাই মাপ করে দিল। কিন্তু খচখচানিটা শুরু হয়েছিল আগেই।
ওই যেবার এদিকে শঙ্কুর কমিক্স আর ওদিকে ভজাগজার বাঁদরামি বন্ধ হয়ে গেল। শঙ্কুর কমিক্স শেষে না হয় ফেলুদা শুরু হল। ঠিকাছে। ফেলুদা কি আর কম! যেতে হবে না ভ্যাঙ্কুভার। কলকাতার ফেলুদা কলকাতাতেই ভালো। আর কী দারুণ যে আঁকা ফেলুদাকে। আহ! মনটা জুড়িয়ে যেত একদম। কিন্তু ভজাগজা বাঁটুলের অনুগত হয়ে গেলে সে জিনিস মেনে নেওয়া যায়? কী ম্যাদামারা রে বাবা কী ম্যাদামারা! এদিকে বাঁটুল সারাদিন জঙ্গিদমন করছে, ওদিকে ওরা দুজনায় সাব্বাশ বাঁটুলদা বলছে। আরে ওরাই যদি শাব্বাশ বলে তো আমি কী বলব? ওই হাত জোড় করে বসে থাকা অসুর দেখলেই যেমন গা জ্বলে যায়, তেমন। অসুর যদি মা দুগগার সাথে নাই লড়ে, তবে কীসের অসুর হে! এমনিতেই প্রতিবার বরণের শেষে ওকেও ভালোটালোবেসে সন্দেশ খাওয়ানো হয়। যুদ্দুটাও করবি না? নাহ, এ এক্কেবারে অন্যায়। দাদুমণির চিঠি তাই বেশিদিন রোচেনি আর। টুপুরও না।
ঝিনুক এসে গেছিল না! একটু বয়সে বড়, কিন্তু ঝিনুকের জন্যে সব পাপ করতে রাজি। সঅব। উফফ ক্যারাটেও জানে, গাড়ি চালাতেও! আর দেখতে তো, পুরো প্রীতি জিন্টা!
এরপরের দু’বার লেজটা যেন আরও লম্বা হল। টিনেজারেরও, শারদ বইয়েরও। ধুস ধুস, ভূতগুলো এক্কেবারে হাসির না। আগে তো দু’পাতা যেতে না যেতেই বিষম। পটাশপুরে এলিয়েন নামানোর দরকারটা কী? আর নামালেও রামরাহা নামা, বা নিদেনপক্ষে খ্রাচখ্রাচ! যা ইচ্ছে তাই নাকি! ন্যাহ, ওই দীপকাকু আছে, তাই। টিনেজার সবাইকে বলে সে এখন ‘পোলাও কালিয়া’ নামে একটা লেখকের একটা হেব্বি শক্ত ইংরেজি বই পড়ে, ‘অ্যালচেমিস্ট’। ‘বাংলা তো সব শেষ করে ফেলেছে কিনা’। ক্লাস নাইনের গোড়া বলে কথা! এরপর তো সুপার সিনিয়ার। এখন সে মোটের ওপর সব বোঝে, সব জানে। সিডি ফিডি এনে দেখেও লুকিয়ে। সে জানে সে বড়।
কিন্তু পুজো আসার আগে আগে ওই ফিলিংটা কাটাতে পারছে না কিছুতেই। শারদবইও কেনা থামাতে পারছে না। এখন তো বাকিগুলোও পড়ে, কিন্তু আগেরগুলো… মন খারাপ হয়ে যায় দেখলে। তাও পড়ে। কীরম যেন দায়সারা মনে হয়, কিন্তু মানতে মন চায় না। কোথায় ফেলুদার সেই সুপারম্যান মার্কা স্কেচ? মিতিনমাসিটাও… তাহলে কী বড় হলে অ্যাডভেঞ্চারে বেরোনো নিষেধ? কে জানে? কিছু জানে না। সে কি আর কাকাবাবু! কাকাবাবু সব জানে। কোনও থ্রিলই হচ্ছে না। একটু পড়লেই মনে হচ্ছে এই তো শেষে বদলা নেবে। কিন্তু সে তো সত্যিই কিছু জানে না। খালি জানে ভাল লাগছে না। আর বিজ্ঞাপন! উফফ! আগে বেশ লাগত দেখতে, মিথ্যা নয়। কিন্তু এখন… ধুস পরের বার থেকে আর কিনব না… নাহ, ঠিকাছে পরেরবার কিনব, কিন্তু সেবারও এমন হলে আর না। প্রমিস।
বর্তমান
গতবছর নিজের লেখা বেরোল এক শারদীয়া পত্রিকায়। ক’দিন বেশ তামঝাম হরির নাম হল। তারপর বুঝলাম, দুনিয়া ওয়াসেপুর হ্যায়। সবাই শালা আমার মতো। আমিও ব্র্যান্ড না হলে পড়ি? আমারটাই বা পড়বে কেন? পড়েনিও কেউ। বেশ করেছে। তা সেইবার বহুবছর পর মনে হল কটা ছানাবেলা কিনে পড়ি। দেখি এখন কী কী বেরোয়। তা সে কিনব বলে দোকানে যেতে গিয়ে মনে পড়ল, তা আজ তো মহালয়া। এখন পাব? সেই উলটো রথ গড়াতে গড়াতেই বেরিয়ে গেসল। এখনও আছে? তা ছিল বটে। পেলাম। পড়লাম। বুঝলাম, ঠিকই করছি এদ্দিন। প্রথমত যতই গালমন্দ করি, পাতা খুলে কাকাবাবু না দেখলেই মনটা ছ্যাঁত করে ওঠে। তারপর এখন তো মিতিনমাসিকে পাওয়া যায় সমগ্রে আর ছোটবেলাটা মাল খাওয়ার পর তেমন তেমন লোকজন পেলে তখন।
না পড়েই রেখে দিলাম। এবার পরের বারের অপেক্ষা। না না আমায় যদি আবার কেউ লিখতে বলে তার অপেক্ষা। আগে পাঠক অপেক্ষা করত, এখন লেখক অপেক্ষা করে।
এখন ওই, রাপ্পা রায়টা পেলে, অন্য কারও কাছ থেকে নিয়ে পাতা উলটে দেখি। মন্দ লাগে না। আর এখন তো ইক্যুয়েশনটাই বদলে গ্যাছে। প্রায় সমস্ত কিছুর। হ্যাঁ অনেকে বলবেন পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় সকলের ছোটবেলাটা একরকমই হয়, আর একইরকম হবেও। এতে কখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি, কখনও কোনও পরিবর্তন হবেও না। কিন্তু সেটা হয়তো হয় বুলি ফোটার আগে পর্যন্ত। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাকি সবটা আলাদা। কারণ ওইটাই সভ্যতার শর্ত। আমাদের ছোটবেলায় বা টিনেজারি চালাচালিটার প্রায় গোটাটা আলাদা। আমাদের সাথে যে কোনও বয়সের লোক সামান্য সেনসেবল হলেই কথা বলতে পারত। আমি কিন্তু জানি না এখন এক তের বা চোদ্দ বছরের কিশোরী সাইকেল নিয়ে বেরোয় কিনা, যাকে পছন্দ করে একবার তাকে চোখের দেখা দেখবে কিনা বলে। বা কোনও কিশোর জানলার ধারে বসে ডুবে থাকে কিনা অ্যাডভেঞ্চারে মুখ গুঁজে, বা উল্টোটা। কারণ আমাদের সঙ্গে ওদের একটা বিরাট পার্থক্য আছে। আমাদের সঙ্গে আমাদের আগের জেনারেশনেরও ছিল এমন পার্থক্য। জেনারেশন থেকে জেনারেশনে এই পার্থক্য বহমান।
সেইখানা হল, আমাদের যে অপেক্ষাটা ছিল, সেটা এদের নেই।
ফলে ওদের জীবনে এখনও ‘পুজো আসছে’ আছে কিনা, আমি জানি না। শারদবই তো চলেই আসে জুলাইতেই আর অরণ্যদেব তো বাংলায় ‘জাস্ট আ ক্লিক অ্যাওয়ে’। ‘বড়দের’ শারদীয়া নিয়ে কিছু বললাম না কারণ সেইটে পড়ার মতো বড় যেন আমি কোনওদিনও না হই মা দুগগা, আমায় দেখো।
কে জানে, ছোটোবেলায় এত বোকা ছিলাম বলেই হয়তো
এখনও
‘এভাবেও গল্প হয়, আমাদের রূপকথায়’।
পুজো দারুণ কাটান।