শুঁয়োপোকা

রেজা হোসেন

 

পূর্বজন্মে আমি ছিলাম শুঁয়োপোকা । বেগুন গাছের পাতার নিচে ছিল আমার বাস । ঢেঁড়সে কামড় বসিয়ে আমার রসনা তৃপ্ত হতো। অতঃপর দুর-গাছ পরিক্রমায় শ্রান্ত আমি, ঢেঁড়সেরই পাতার নিচে একটু গড়িয়ে নিতাম। দুর কোন শিমের পাতায় খুঁজে পেতাম আমার প্রাণেশ্বরী। জনান্তিকে বেজে উঠত মহা-মিলনের সুর; পাতারই বাঁশী দিয়ে – “আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণ-খেলা; নিশীথ-বেলা”। বোধ করি রিপু-চক্রের বাধ্য আমি লোভ করেছিলাম অন্য কোন ফলে। ধরা যাক গন্ধমে। বিধাতা ক্ষিপ্ত হলেন বেশ। তাই এই জন্মে, পূর্বজন্মের কৃত পাপের শাস্তি দিলেন। মানুষ করে পাঠালেন – ‘যাও অশান্তি ভোগ করো’।

আমি যে জাতিস্মর জানতাম না। জানতে পারলাম বাড়ী কেনার পর হঠাৎ একদিন। নতুন বাড়ীর সাথে ছোট একটা উঠোন থাকায়, ভাবলাম সেখানেতো বেশ চাষ করা যায়। একটু দৌড়-ঝাঁপ করতে হলো। পুরো বেড়া ধরে এক মিটার জায়গা বাঁধলাম, এক বন্ধু কে সাথে নিয়ে। কোদাল দিয়ে খুঁড়লাম। সার মাটি কিনে ভরলাম। তারপর বীজ, গোবর, পানি। সিডনির মেট্রো জীবনে সবকিছু প্যাকেট-জাত। এমনকি মাটি এবং গোবরও । বীজ ফুটে বেরুল চারা, চারা থেকে গাছ। গাছে আসলো ফুল, ফুল থেকে ঢেঁড়স। এই দীর্ঘ পরিচর্যায় মনে-মনে অপেক্ষা করেছি – সখি তুই আসবি কবে! অবশেষে বেশ কয়েকটা ঢেঁড়স গুটিসুটি চোখ মেলল, যেমন করে কচ্ছপ মাথা বের করে। তখনি আমার কেমন মনে হলো- এই মর্মভেদী দৃশ্য আমি কোথায় যেন দেখেছি; বিশেষ নিবিড়তায়। মনে হতে লাগলো – এমন একটা দৃশ্যের জন্য আমি অপেক্ষা করেছি অহর্নিশ । রাত্রি-দিন এক করেছি অপেক্ষা করতে-করতে। অতঃপর কয়েকদিন পর যখন পূর্ণ ঢেঁড়স দেখা দিলো; গড়-গড় করে মনে পড়ে গেলো আমার, পূর্ব জন্মের কথা। কী করে পাতা থেকে পাতা আমি ঘুরে বেড়াতাম, কিভাবে বৃষ্টিজল ধুয়ে দিতো আমার আদ্যোপান্ত । দমকা হওয়ায় কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতাম আমি। কাঠ-ফাঁটা রোদ্দুরে কেমন আশ্রয় নিতাম গাছ পাতার ছায়ায়। রাত্তিরে সুরুয়া বাতাস কেমন খেলে যেত আমার শুঁড়ে। এবং আরও সব এই জীবনের কর্মগুলো একে একে মিলে যেতে লাগলো থরে থরে।

ছোটবেলা থেকেই আমি প্রায় নিরামিষাশী। মাছ আমি খেতে পারিনা; মাংসও বিশেষ প্রিয় না। কিন্ত সবজি ! আহা, বড্ড মুখে রুচে! ছোট বেলায় সজনা রান্না করলে, মা আমাকে আলাদা বাটিতে খেতে দিতেন। না হলে পুরো গামলাই সাবড়ে দিতাম। বড়ি দিয়ে বেগুনের তরকারী আমার প্রাণ প্রিয় খাবার। বড়ি জিনিসটা বাজারে পর্যাপ্ত পাওয়া যায়না। দেশে যাবার ‘প্ল্যান’ করলেই, মা বাজার থেকে বড়ি কিনে কিনে জমাতে থাকেন। আমাকে ফোনে জানান – “ডিব্বা প্রায় ভরে এলো বাবু, তুই কবে আসবি? “। আমি এই দূর দেশ থেকে মনে-মনে বড়ি বেগুনের স্বাদ নেই। জিভে আসে পানি। দেশে সাধারণত শীতকালে যাওয়া হয়। তখন সবজির বেশ রমরমা । অনেক রকম সবজি পাওয়া যায় তখন। মটরশুঁটি দিয়ে ফুলকপি কিম্বা সর্ষে দিয়ে সিম বা মুলা দিয়ে বেগুন। আর ‘কমন’ জিনিসটা হচ্ছে ধনে-পাতার চাটনি। গন্ধ নাক গলে পেটে গেলেই, প্রাণ আঁই-ঢাঁই করে উঠে।

খাবার কথায় আরও কিছু প্রিয় খাবারের কথা বলি। ভাতের সাথে পেঁয়াজ আমার বড় প্রিয়। অস্ট্রেলিয়ায় কামড়ে খাওয়ার পেঁয়াজ পাওয়া যায় না, সব বড়-বড় রান্নার পেঁয়াজ। কিন্তু হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম, এক চাইনিজ সবজির দোকানে। নাম ‘ওনিওন’ না, ‘স্যালোট’। দাম চড়া। সাধারণত পেঁয়াজের ১০কেজি বস্তা ৭/৮ডলার, কিন্তু স্যালোট ১ কেজিই ১২ ডলার। সেই স্যালোটের একটা-একটা কামড়ে দেশী পেঁয়াজের গন্ধ। কামড়ের সাথে সে গন্ধ ব্রহ্মতালু বেয়ে হৃদয়ে চলে যায়। শরীর চনমন করে উঠে। বেশ ভালো লাগে। আর একটা ভয়ঙ্কর খাবার হচ্ছে – গরম-ডাল। আদম-হাওয়া কে গন্ধম না বলে গরম-ডাল নিষিদ্ধ করলে ফলাফল দাঁড়াত একই। বরং সভ্যতার বিকাশ হত আরও তাড়াতাড়ি। কারণ গরম-ডাল বানাতে আগুন লাগে, ফাঁকতালে আগুনটা আবিষ্কার হয়ে যেত। গরম-ডাল থাকেতো যেকোনো তরকারিই সই। গিন্নিদের বুদ্ধি দেই- জুত মতো তরকারি না থাকলে, গরম-ডালটা যোগ করে দেন, ব্যাস আর ভাবতে হবে না। আর সাথে যদি আমের বা বরই আঁচার থাকে, তাইলে দুই পোয়া চাল বেশি।

গন্ধের মধ্যে জ্বালাময়ী একটা গন্ধ হচ্ছে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিম ভাজার গন্ধ। ও গন্ধ নাকে গেলেই কেল্লা ফতে। খেতে আপনাকে হবেই। মনে পড়ে রুনু যখন ইডেনে পড়তো। আমি থাকি বনানী। তার সাথে দেখা করে ফেরার পথে, শাহবাগ থেকে বাস ধরতাম। আর মোড়েই ভ্যানে বিক্রি হতো পরোটা ডিম। একদম ‘ডিরেক্ট ফ্যাক্টরি আউটলেট’ । ওখানেই পরোটা বানিয়ে, ডিম ভেজে, কাগজে গোল করে মুড়ে খাও। তো শাহবাগ মোড়ে এসে পৌছবেন, অমনি একঝাক ডিমভাজার গন্ধ ঢুকে যাবে আপনার নাকে। পেট মোচড় দিয়ে উঠবে খিদায়। আর আপনার প্রাণ গেয়ে উঠবে- “ওরে ও ডিমওয়ালা, তুমি যে গলার মালা, তোরে ছাড়া বাচিনা… আরে পিরিত মানেই যন্ত্রণা! ”

বছর খানিক আগে বাবা এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে। তিনি লাগিয়ে গেলেন শিম গাছ। বাবা থাকেতেই বেড়া দিলেন। গাছ বেড়ে উঠলো । বাবা ফিরে গেলেন দেশে। এরপর আসলেন রুনুর বড় আপা। তিনি যত্ন নিলেন খুব। দৈনিক পানি দিলেন। গোবর দিলেন। তিনিও ফিরে গেলেন। এখন ধরেছে শিম। একদম আঁচল ভরিয়ে । সম্প্রতি কিছু ব্যস্ত থাকায় বিশেষ জানতে পারি নাই খবরটা, হঠাৎ একদিন পেছনের উঠানে গিয়ে দেখি শিমে-শিমে, ঢলে-ঢলে, বহে কিংবা মৃদু বায়। একদম পুরো গাছ। খুব আনন্দ হলো আমার, কৃষক যেমন আনন্দিত হয় ধানে ভরা ক্ষেত দেখলে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি শিমগুলো। কি সুন্দর থোকা থোকা! সবুজ মসৃণ শরীর, রসে টইটুম্বুর। হঠাৎ চোখের সামনে একটা পর্দা উঠে গেলো। দেখতে পেলাম শুঁয়োপোকা আমি, শুঁড় নাড়ছি আনন্দে। পেড়ে আনলাম এক ঝোলা শিম। মেঝেতে রাখলাম জড়ো করে। দেখি প্রত্যূষ, আমার ছোট-ছেলে, রান্না করার অপেক্ষা করতে পারলোনা। অমনি কাঁচা শিম মুখে পুরে হাউমাউ চিবোতে লাগলো। আবার আমি দেখলাম – শুঁয়ো পোকা আমি যখন আনন্দে শুঁড় নাড়ছি, আমার পাশে আর একটা বাচ্চা শুঁয়ো, আমারই মতো আনন্দে শুঁড় নাড়ছে আমার দেখাদেখি। পূর্ব জন্মের বাছা আমার! এই জন্মেও সঙ্গ ছাড়লি না! এই বাবারই কোলে আসতে হবে তোকে আবার! আবার খেতে হবে শিম-বেগুন-মুলো-মটর সুটি।

Be the first to comment

আপনার মতামত...