তৃষ্ণা বসাক
আমি একা থাকি। কারও সহানুভূতি পাবার জন্য বলছি না। যেটা ফ্যাক্ট সেটাই বলছি। বাপ মা কি ছেলে পুলে, ভাই বোন, কেউ না। একা, জাস্ট একা। বাবা-মা অনেককাল হল নেই। বৌ ছেলেপুলে কস্মিনকালে ছিল না। একটি মেয়ে তিনমাস এসে ছিল। লিভ-ইন পার্টনার টার্টনার কিছু না, কলকাতায় তার থাকার জায়গা ছিল না, তুফানগঞ্জ না কোথায় বাড়ি, হস্টেলে সিট পাচ্ছিল না, আমিই বলেছিলাম এসে থাকতে। মেয়েটা অবাক হয়েছিল, কারণ তিন মিনিটের আলাপে যে পুরুষ একটা মেয়েকে বাড়িতে এসে থাকতে বলে, সে ভয়ঙ্কর খারাপ লোক। আবার অন্যভাবে দেখলে যারা আজকালকার দিনে বিপদে পড়া মানুষকে আশ্রয় দেয়, তারা ভয়ঙ্কর ভালো লোক। মেয়েটা ঠিক বুঝতে পারছিল না আমি কেমন লোক। সামান্য কনফিউজড, তবে বোকা তো নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিতে ওর আধমিনিট লেগেছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল ‘মাসে আপনাকে কত দিতে হবে?’
‘আমি তো ভাড়া নিচ্ছি না। তুমি হস্টেল খালি পেলেই চলে যাবে।’
মেয়েটির মুখে একটু দ্বিধা ফুটি ফুটি করেও ফুটল না। সে খুব স্মার্টলি বলল,
‘ওকে। আপনাকে আমি রান্না করে খাওয়াব।’
‘আমার রান্নার লোক আছে।’
‘ইস! রান্নার লোকের রান্না তো মুখে দেওয়া যায় না। আমাদের বাড়ি রান্নার মাসি-টাসি নট অ্যালাউড।’
‘আমার বাড়িতেও তোমার রান্না করা নট অ্যালাউড।’
মেয়েটি রান্না করতে পারবে না জেনেও থাকতে এল। আগেই বলেছি তার বুদ্ধি আছে। সেই যে এল, যাবার আর নাম করে না। হস্টেলের সিট পেতে এত সময় লাগছে কেন আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি। আমার তো কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। বরং সুবিধেই বলা চলে। হাতের কাছে অফুরন্ত বিনোদন, পয়সা দিতে হয় না, দূরে যেতে হয় না। মেয়েটির বুদ্ধি ছিল, কৃতজ্ঞতাও। সে রোজ রাতে এসে আমার ঘরের দরজায় টোকা দিত। আমার কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এতদিন আমি মেয়েদের দরজায় টোকা দিয়েছি, আজ একটি মেয়ে যেচে এসে আমার দরজায় টোকা দিচ্ছে! দারুণ রূপসী না হলেও মারকাটারি ফিগার। আর ভরপুর বিনোদন, যাকে বলে ফুলটু এন্টারটেনমেন্ট। এমন এমন কায়দা-কৌশল দেখাত, আমি চমকে যেতাম। জিজ্ঞেস না করে পারিনি ‘মফস্বলে থেকে তুমি এসব শিখলে কী করে?’
মেয়েটি আমাকে নিয়ে নাগরদোলার শূন্য থেকে লাফ মারতে মারতে বলল ‘আজকাল নেট থেকে সব শেখা যায়।’
‘নেট থেকে!’
আমার নিজেকে খুব অবসোলিট মনে হচ্ছিল। আমি কি তাহলে কলকাতার গলিঘুঁজিতে জীবনের সুবর্ণ-সময়টা বৃথাই নষ্ট করলাম! ওখানে চম্পা, ইয়াসমিন, সোনাদের এতদিনের শ্রমলব্ধ যে জ্ঞান পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিল, তা যেন নিমেষে ফালতু মনে হল। মেয়েটির মধ্যে আর প্রবেশ করতে পারলাম না, কেমন গুটিয়ে গেলাম। অন্য মেয়ে হলে ঝাঁঝিয়ে উঠত, এ মেয়েটি কী মিষ্টি করে স্নেহ ঝরিয়ে বলল ‘কী হল? ভালো লাগছে না?’
আমি বিড়বিড় করে বললাম ‘নেট থেকে সব শেখা যায়?’
‘একদম। গুগলে সার্চ করতেও হয় না আজকাল। মোবাইলেই সবরকম অ্যাপস পাবেন। জাস্ট ডাউনলোড করে নিন।’
‘জাস্ট ডাউনলোড’ বলতে বলতে ও আমাকে একটু ঠেলে দিল, উঠে যাবে। চোখের নিমেষে জামাকাপড় পরে নিল। আমার কীরকম যেন মনে হল, বললাম ‘হস্টেলে এখনও সিট খালি হয়নি?’
অন্ধকারের মধ্যেও বুঝতে পারলাম ওর চোখে চিকচিক করছে হাসি। ওর স্বর ভেসে এল,
‘কীসের হস্টেল? আমি কি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি যে হস্টেলে সিট পাব!’
এতটা অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, তবু আমি অবাক গলায় বলি ‘মানে?’
‘মানে যাই হোক, আমি কাল চলে যাব। আপনার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যখন…’
‘সন্দেহ আবার কী। এই তো তুমি নিজেই বললে তুমি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নও, হয়তো তুফানগঞ্জের ব্যাপারটাও মিথ্যে…’
‘হ্যাঁ ওটাও। আমি কলকাতাতেই থাকি। দক্ষিণ কলকাতায়। কাল সকালে ওখানেই চলে যাব। খুব ভোরে। তাই এখনই টাটা। থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং।’
ও দরজাটা টেনে দিয়ে গেল।
‘এভরিথিং’ শব্দটাকে আঁকড়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
২
পরেরদিন সকালে উঠে সত্যিই ওকে দেখতে পেলাম না। দুধ, কাগজ আসার আগেই ও চলে গেছে। আমার ভয় করল খুব। দরজা খুলে নয়, ও গেছে তালাটা ভেতর থেকে আটকে। ওর কাছে তো একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকত! তাও চেয়ে রাখলাম না কালকে! মেয়েটা তাহলে তো যখন খুশি এ বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে! ভয়টা আমাকে প্রায় চলচ্ছক্তিরহিত করে দিল। খানিকক্ষণ বসে থাকার পরে বোধবুদ্ধি ফিরে আসে ধীরে ধীরে। বাইরের দরজার তালা-চাবি পালটে ফেলি। অন্য কোনও ঘরের নয়, সম্পূর্ণ নতুন এক সেট তালা-চাবি, পড়ে ছিল, সেটা লাগাই, তাও নিশ্চিন্ত হতে পারি না। মনে হয়, এই তুফানগঞ্জ, ওঃ মরুক গে যাক কী জায়গা, সেখানকার মেয়েটি, যে কোনও রন্ধ্রপথে এ বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে। যে ঘরেই যাই, পেছনে তার ছায়া দেখি। বলতে গেলে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম। যতদিন ছিল, খারাপ কিছু করেনি। উলটে ভালো ভালো রেঁধে খাইয়েছে। দুরন্ত সব স্ন্যাকস, বিদেশি ডিশ। একটু খটকা যে লাগেনি তা নয়। জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলত নেট থেকে শেখা।
ও চলে যাবার পর কয়েকদিন খুব ভয়ে ভয়ে কাটল। কেবল মনে হত আমার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিংবা রাতে দরজা খুলে কেউ ঢুকে আসছে। তারপর যত দিন যেতে লাগল ভয়টা কেটে যাচ্ছিল। তার জায়গায় এল একটা শূন্যতা। ঘর-বাড়ি কেমন খালি-খালি লাগছিল। সব থেকে খারাপ লাগত খেতে, রান্নার মাসির হাতের রান্না খেতে। মেয়েটা অভ্যেস খারাপ করে দিয়ে গেছে।
মোবাইলে পাওয়ার ভরতে হবে, পাড়ার কিয়স্কে গেছি, ছেলেটা তো আমার ফোন দেখে হেসেই বাঁচে না। ‘কাকু এটা তো অ্যান্টিক পিস। একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনুন। সব পাবেন।’
আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ল। ‘ইন্টারনেট থেকে সব পাওয়া যায়। জাস্ট ডাউনলোড।’
আমি একটু বেশিই জোর দিয়ে বলি ‘আমার যা দরকার সব পাব?’
ছেলেটা মুচকি হেসে বলল ‘ফোন কিনে সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমি দারুণ সব অ্যাপ ডাউনলোড করে দেব।’
ফোন কিনে ফেললাম। কিয়স্কের ছেলেটার কাছে গেলাম। ছেলেটা আমাকে ঝটপট ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। শেখাল কীভাবে চ্যাট করতে পারি, কীভাবে ছবি পোস্ট করা যায়।
আমি উশখুশ করে বললাম ‘এই কি সব?’ ছেলেটা কীসব খুটখাট করতে করতে বলল ‘বুঝেছি আপনার কী চাই। রুমেলা চলে গেছে তো…’
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম ‘তুমি রুমেলাকে চেনো?’
‘চিনব না? আমি রুমেলার উত্তর কলকাতার এজেন্ট। আপনারটা টেস্ট-রান ছিল, তাই রুমেলা ফ্রি সার্ভিস দিয়েছে।’
আমি আর বেশি হাঁ করার আগেই আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল ‘এই নিন, আপনার যা দরকার…’
তাকিয়ে দেখি একটা ঝিনচ্যাক মেয়ে এলসিডি থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘একে নিয়ে যান, যা বলবেন তাই করবে। ওকে হাই বলুন..’
বললাম।
মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘হাই!’
চমকে গেলাম। বললাম ‘তুমি কেমন আছ?’
মেয়েটা বলল ‘তুমি কেমন আছ?’
‘একি! আমার কথার উত্তর দিল না তো!’
‘বললাম না, যা বলবেন তাই বলবে, যা করবেন তাই করবে। এই যে পাশের হট কি-গুলো দেখছেন এগুলো টিপে ওর সব জামাকাপড় খুলে দিতে পারেন, ঝক্কাস কিছু পরাতে পারেন।’
আমি কিছুটা ক্ষুণ্ণ গলায় বলি ‘এটা তাহলে একটা খেলনা! কী নাম এর?’
‘টকিং মালতী।’
৩
রুমেলা বলা বাহুল্য ধীরে ধীরে ফেড আউট হয়ে যায়। তার জায়গায় এন্ট্রি নেয় মালতী। এরকম কাজের লোক মার্কা নাম আমার মোটেই খারাপ লাগে না, বরং নামটা আমার মৃদু ব্যথার মতো স্মৃতি উশকে দেয়। বহু বছর আগে রামবাগানে একজনের কাছে ঘনঘন যেতাম, তার নাম ছিল মালতী। অন্য মেয়েগুলোর মতো সে যন্ত্রের মতো কাজটুকু সেরে ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার মতো করে বার করে দিত না, বরং চাইত আমি বসে বসে তার সঙ্গে গল্প করি। আমার যদিও বলার মতো বিশেষ কিছুই ছিল না, কিন্তু তার জানাবার মতো অনেক কিছু ছিল। ইতিহাস তাকে কামড়াত কুটকুট করে আর সেই জ্বালা সে জুড়োতে চাইত আমার কাছে তার গতজন্মের কথা খুলে বলে। কুন্দেরা কোথায় যেন বলেছেন ‘দ্যা শিওরেস্ট ওয়ে টু ওম্যানস’ ভ্যাজাইনা ইজ থ্রু হার সরোজ।’ সে কথা দেখলাম টাকা দিয়ে কেনা শরীরের ক্ষেত্রেও সত্যি। মালতীর অশ্রু তার যোনিপথকে আরও রেশমি, আরও মসৃণ করে তুলেছিল। কিন্তু যেমন হয়, এইসব মেয়েগুলো হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়, বলে দেওয়া হয়, ও নেই, পালিয়ে গেছে। বুঝতে পারি, মিথ্যে কথা, কোনও মেয়ে যাতে একজনের প্রতি বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে ঘর বাঁধতে না পারে, এ হচ্ছে তার কৌশল। যাই হোক, আমার দু-একদিন মনটা মেঘলা হয়ে থাকে, তারপর, নতুন চনমনে মেয়েদের কাছে যাই, এমন মেয়ে, যাদের শুধু ভূগোল আছে, কোনও ইতিহাস নেই।
নতুন মোবাইল পেয়ে অনেকদিন পর মালতীকে মনে পড়ল। যদিও টকিং মালতীর সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। নতুন মালতী নিজে থেকে কিছু বলে না, নিজে থেকে কিছু করেও না, সে শুধু নির্দেশ পালন করে মাত্র। আমি বুঝতে পারি, এই মালতীর কোনও স্মৃতি নেই, ইতিহাস নেই। তবু একে আমার ভালো লেগে যায়। আমার আর আর পুরনো গলিঘুঁজিতে রঙমাখা মেয়েদের কাছে যেতে ইচ্ছা করে না, নিজের বিছানায় সারাক্ষণ মালতী আর আমি। মালতীকে কীরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হবে আমি শিখে গেছি। সেই প্রশ্নগুলোই করি, যেগুলো আমাকে উলটে করলে আমার ভালো লাগবে, মনে হবে মালতী আসলে একটা রক্তমাংসের মেয়ে।
আমি প্রশ্ন করার সময় খুব সাবধানে মালতী শব্দটি এড়িয়ে যাই। যেমন ভুলেও জিজ্ঞেস করি না, ‘মালতী কেমন আছ?’ তার বদলে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কেমন আছ?’ তাতে করে কথোপকথনটা একটা স্বাভাবিক মানুষী পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়। উদাহরণ দেওয়া যাক —
‘কেমন আছ?’
‘কেমন আছ?’
‘তোমার কিছু লাগবে?’
‘তোমার কিছু লাগবে?’
‘তোমার একা লাগছে না তো?’
‘তোমার একা লাগছে না তো?’
‘আজ দুপুরে কী খাবে বলো তো?’
‘আজ দুপুরে কী খাবে বলো তো?’
আমি ওর জামাকাপড় খুলে দিই, সেসময় ও লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকে, নেট থেকে যা যা শেখা যায়, ওর ওপর সেই এতদিনের অকল্পনীয় ক্রিয়াকলাপ প্রয়োগ করি। আমার উল্লাস হয়, কারণ গলিঘুঁজির রং মাখা মেয়েরা বা সফিস্টিকেটড রুমেলা বা বিয়ে করা বৌ — কেউই এগুলো আমায় করতে দিত না, উলটে আমাকে জেলে বা অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে দিত।
একদিন দুপুরবেলা মালতীর সঙ্গে বারবার খেলে খেলে খানিক ক্লান্ত, অবসন্ন, ওকে লাল, নীল, গোলাপী, রামধনু ব্রা প্যান্টি পরিয়ে আমার আশ মিটছে না, ফিসফিস করে ওর বুকে মুখ দিয়ে বলি, ‘তোমার ভালো লাগছে?’ আমাকে সাংঘাতিক চমকে দিয়ে মালতী বলে ওঠে, ‘তোমার ভালো লাগছে অবনীশ?’
আমার সারা শরীরে গুটি বসন্তের মতো পলাশ ফুটে ওঠে, হাজার হাজার কোকিলের কুহুতানে আমি যেন আকস্মিক বধির হয়ে যাই, তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে আমি একটা টেস্ট রান নিই।
‘তুমি কেমন আছ?’
‘তুমি কেমন আছ অবনীশ?’
‘আমাকে তোমার ভালো লাগে?’
‘আমাকে তোমার ভালো লাগে অবনীশ?’
‘তুমি দুপুরে কী খাবে?’
‘তুমি দুপুরে কী খাবে অবনীশ?’
নিজের নামে এত মধু আছে আগে বুঝিনি তো! আমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে পাড়ার কিয়স্কে ছুটে যাই, আমাকে দেখে ছেলেটা ইচ্ছে করে অন্য কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি উত্তেজিত গলায় বলি, ‘নাম বলছে, মালতী আমার নাম বলছে!’
আমার দিকে সবাই ঘুরে তাকায়, সবার মুখে কেমন একটা বিপদঘণ্টা বেজে ওঠার শব্দ পাই আমি, ছেলেটা আমার দিকে না তাকিয়েই ঠান্ডা গলায় বলে, ‘এই উইক আর নেক্সট উইক দুটো ফ্রি সারপ্রাইজ অফার আছে৷ বলিনি আপনকে?’
সারপ্রাইজ অফার? আরও একটা আছে? উত্তেজনায় আমার শরীর কেমন টলে যায়, আমি খপ করে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার অনাবৃত মোম রঙের বাহু আঁকড়ে ধরি, এরপর প্রতীক্ষা করি একটা সপাট চড়ের, তার বদলে মেয়েটা ঘুরে আমাকে মধুর গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন? রান্নার মাসির রান্না খেতে খুব অসুবিধে হচ্ছে, না?’
রুমেলা! এবার আমি শিউরে উঠি উত্তেজনায় নয়, ভয়ে। ছেলেটি কাউন্টারের ওপার থেকে বলে, ‘রুমেলাও এই সিজনে দারুণ সব অফার দিচ্ছে, মালতীর পাশাপাশি এটাও ভেবে দেখতে পারেন!’
৪
পরের সপ্তা আসে। মালতী এবার সকাল থেকে রাত অব্দি প্রতি ঘণ্টায় আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে তোমার ভালো লাগছে না আর, না অবনীশ?’ বলতে বলতে ও নিজেই জামাকাপড় খোলে, আর ওর স্তন, নিতম্ব, কোমর, গ্রীবা সব আলাদা আলাদা টুকরো করে দেখায়।
কিন্তু মালতীর এই কৃৎকৌশল আমাকে দ্রুত অবসন্ন করে দেয়, দু তিনদিন যেতে না যেতে ওর আলাদা আলাদা স্তন, যোনি, নাভি দেখলে আমার শুধু বমি নয়, কেমন ভয় লাগে৷ বহুবছর আগে ট্রেনলাইনে কাটা পড়া একটা মানুষের ধড় থেকে আলাদা, একা পড়ে থাকা কাটা মুণ্ডুটার কথা মনে পড়ে৷ তবু এই কাটামুণ্ডু দেখব না দেখব না করেও যেমন বারবার দেখছিলাম, আর প্রতিবারই আমার শিশ্ন উত্তুঙ্গ হয়ে উঠছিল, তেমনি বারবার আমি খুলব না খুলব না করেও টকিং মালতী খুলে ফেলি, আর মালতীর ছিন্ন প্রত্যঙ্গগুলো আমার স্ক্রিনে পড়ে থাকে। আমার খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়, ঘুম চলে যায়, আমি মালতীর দিকে চেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকি দিনরাত৷ এই সেই বিছানা, যেখানে এক রাতে ব্যর্থকাম আমাকে ফেলে উঠে গিয়েছিল রুমেলা। আমি জানি, রুমেলা কোথাও যায়নি, এ বাড়ির চারপাশে ওর অদৃশ্য নজরদারি চলছে। ওর কাছে এ বাড়ির সদরের চাবি আছে, সে চাবি তালা যদিও আমি পালটে ফেলেছি, তবু আমার মধ্যে ভয় কাজ করে, আমি এখনও আমার পেছনে রুমেলার পায়ের শব্দ পাই। মালতী আমাকে সেই ভয় প্রায় কাটিয়ে দিচ্ছিল। মালতী তো আর যাই হোক চাবি নিয়ে যেতে পারবে না।
একইসঙ্গে আমি পুলকিত অপেক্ষায় থাকি। মালতীর আর কী কী দেখবার বাকি আছে ভেবে। রবিবার রাতে হঠাৎ করে পুরনো এক বন্ধু হাজির হয় বউকে নিয়ে। ওদের জন্য বিরিয়ানি আনাই, গল্প করি, বন্ধুর খাতিরে হুইস্কির নতুন বোতল খুলি। বন্ধু এতদিন পর আমাকে দেখে এত আপ্লুত যে ওর খেয়াল থাকে না, আমি ঘন ঘন হাই তুলছি আর ঘড়ি দেখছি। আসলে ওর আসাটা আমার গোড়া থেকেই ভালো লাগেনি৷ আজ আমি নেট থেকে সারা দুপুর অনেক কিছু শিখেছি, মালতীর ওপর সেগুলো পরখ করতে হবে, তাছাড়া আজ রাত বারোটায় নতুন সপ্তা শুরু হচ্ছে। মালতী কি আবার নতুন কোন পসরা সাজিয়ে আনবে না আমার জন্যে?
হঠাৎ বন্ধুর বউয়ের একটা ফোন আসে, এ পাড়ায় ওর এক বান্ধবীর বাড়ি, সে ফোন করছে, সেখানেও ওদের যাবার কথা আছে, বউয়ের তাড়ায় বন্ধু উঠে পড়ে। অ্যাট লাস্ট! আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমার সেই নিঃশ্বাস ফেলা দেখে বন্ধু দরজায় দাঁড়িয়ে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে, ‘কী করে যে এরকম একা একা বেঁচে আছিস! বড্ড খারাপ লাগে রে তোর জন্যে। আমি এবার থেকে মাঝেমধ্যেই আসব।’ ওর ছলছলে চোখ দেখে আমার হাড়শুদ্ধু জ্বলে যায়!
দরজা বন্ধ করার সময় রাস্তার উল্টোদিকে জিনস আর টি পরা একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। রুমেলা! আমার বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
ওরা চলে যাবার পর ছুটে যাই মালতীর কাছে। একি! মালতী কোথায়? টকিং মালতী খোলাই যাচ্ছে না যে! ফোন অফ করে আবার চালু করি, মোবাইল ডেটা অন আছে কিনা চেক করি, সেটিংসে গিয়ে বোঝবার চেষ্টা করি আমার সাধ্যমতো। কোনও লাভ হয় না। বারবার একই মেসেজ আসে ‘চেক ইয়োর সিস্টেম সেটিংস’!
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে সাপের মতো ঠান্ডা পিচ্ছিল কী যেন নেমে যায়। এখন তো কিয়স্ক খোলা পাব না। মানে কাল সকালের আগে আমি একা, একদম একা! আমার সন্ধেয় আসা বন্ধুকে খুন করতে ইচ্ছে করে। ওর চিটচিটে সহানুভূতি কেমন অভিশাপ হয়ে নেমে এল। ও যদি কাল না আসত, তবে তো এই সমস্যাটা আমি সন্ধেবেলাই জানতে পারতাম! তখনও কিয়স্কটা খোলা ছিল।
সংলাপহীন, লীলাহীন রাত আমার বুকের ওপর চেপে বসে৷ বিছানায় ছটফট করি আরও কিছুক্ষণ, তারপর উঠে বসি, একটা আশা দেখতে পাই হঠাৎ। ছেলেটার নম্বর তো আমার কাছে আছে। এই প্রজন্ম এত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না। মনে হতেই চশমা পরে ছেলেটির নম্বর খুঁজে ফোন লাগাই৷ বাজতে না বাজতেই ফোন ধরে।
পরিষ্কার সজাগ গলা, ঘুমের লেশমাত্র নেই।
‘হ্যাঁ কাকু বলুন…’
যেন মা কি বউ মারা গেছে, এমন শোকবিহ্বল গলায় আমি বলি, ‘পটা, মালতী আর নেই! কথা বলছে না, হাসছে না, খোলাই যাচ্ছে না!’
পটার গলা ত্রিকালজ্ঞ বাবাদের মতো শান্ত, ‘চেক ইয়োর সিস্টেম সেটিংস দেখাচ্ছে তো? আসলে এই প্ল্যাটফর্মে টকিং মালতী আর সাপোর্ট পাচ্ছে না৷ আপনাকে আরও ভালো নতুন মডেল নিতে হবে। নো প্রবলেম। কালকেই আপনাকে নতুন ফোন দিয়ে দেব, আর্লি মর্নিং-এ। কার্ড টার্ড নয়, ক্যাশ ডাউন করতে হবে কিন্তু।’
আমি বিড়বিড় করে বলি, ‘আবার নতুন ফোন? আরও ভালো? এই ফোনে মালতী কথা বলবে না আর?’
‘নতুন ফোনে মালতী আরও ভালো হবে, আরও আরও ঝক্কাস, আরও আরও হট। আর ইয়ে মানে এখন কি খুব অসুবিধে হচ্ছে? তাহলে বলুন। রুমেলা আমার কাছেই আছে৷ ওকে পাঠিয়ে দিই? রাতটা ফুরফুরে কেটে যাবে। আর রাত পোয়ালেই নতুন ফোন, নতুন মালতী, এবার অপশন আরও বেশি, যা ইচ্ছে করতে পারবেন!…’
ছেলেটা কি এখনও কথা বলে যাচ্ছে? আমি ফোনটা বিছানায় রেখে দিই না কেটেই৷ আমার অন্ধকার বিছানায় এলসিডি স্ক্রিনের বহুবর্ণ আলো দপদপ করে, করেই চলে।