রিমি মুৎসুদ্দি
মেরিলিন মনরোর রাতপোশাক পরা প্রচ্ছদের ওপর তেরছাভাবে সূর্যের আলো এসে পড়ছে। গলিটা বড় সরু। সূর্যের আলো অপ্রতুল এখানে। গলির দুদিক দিয়েই সরু নদীর স্রোতের মতো বইয়ের সারি। হাটবারের মতো রবিবার এখানে বইবার। অর্থাৎ বইবাজারের দিন। কোনও দোকান নয়, রাস্তার ওপর হাটে বসা সব্জিবিক্রেতাদের মতো অজস্র বইয়ের দোকান। কোথাও ২০০ টাকা প্রতি কেজি কোথাও ৩০০ টাকা প্রতি কেজি।
প্রথমবার দরিয়াগঞ্জে এসে হকচকিয়ে গিয়েছিল আর্য। কিলোদরে বই বিক্রি ও আগে দেখেনি কোথাও। শেয়ালদায় কিলোদরে খাতা বিক্রি হতে দেখেছে। কিন্তু বই? তাও আবার ইংরাজি নভেল? একটু পুরনো ক্ষতি নেই। কিন্তু টলস্তয়, দস্তভয়েস্কি, কাফকা, কামু, মার্কেজ, হেমিংওয়ে, সল বেলো কী নেই এই বইবাজারে! ঋষভের থেকে টাকা ধার নিয়ে বেশ কয়েকটা বই সেবার ও কিনেছিল।
আর্যর ইউনিভার্সিটির বন্ধু ঋষভ এখানকার স্থানীয় ছেলে। মাঝেমাঝে হোস্টেলে এসে ওর সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। এই এত বইয়ের পাহাড়ে ওকে ভেবলে যেতে দেখে ঋষভ খুব হেসেছিল। বলেছিল,
–ইয়ার ইয়ে দিল্লি হ্যায়। হিঁয়াকে সব চিজো কামাল হ্যায়। থোড়া দিন জানে দো খুদ বা খুদ সমঝ যাও গে।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের ছাত্র আর্যনীল বন্দ্যোপাধ্যায় এই বোঝার বিষয়টা টের পেয়েছিল খুব শীঘ্রই। জেএনইউ-র মধ্যে একটা দিল্লি আর জেএনইউ-র বাইরে আরেকটা দিল্লি। এটা ও বুঝেছিল। এই দুটো দিল্লি সম্পূর্ণ আলাদা মনে হত ওর।
গাঢ় লাল লিপস্টিকের তলায় লেখা ‘মেময়ারস অফ অ্যা গ্যেইশ্যা’। লেখকের নাম পরিচিত নয়। কিন্তু প্রচ্ছদটা খুব আকর্ষণীয়। বইটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শুনতে পেল ‘কিনেই নাও। বেশি দাম নয়। বইটা পড়ে দেখো।’
কথাটি যে বলল সে আর্যর পরিচিত নয়। সম্ভবত ওর সমবয়সী বা ওর থেকে একটু বড়ই হবে। একটা লম্বা ছিপছিপে মেয়ে। উত্তর ভারতের জাঠ, পাঞ্জাবী বা হরিয়ানভি মনে হয়। আর্য মেয়েটার দিকে তাকাতে সে বলল, ‘আমার নাম শিখা। তুমি জেএনউতে পড়ো তো? তুমি করেই বললাম। আমার থেকে জুনিয়ার তুমি। মাঝেমাঝে দেখি তোমায় বইবাজারে। বই পড়তে খুব ভালোবাসো নিশ্চয়ই? তাই অতদূর থেকে এখানে আসো।’
ওহ! তাহলে জেএনইউ-র সিনিয়র কেউ। কিন্তু আর্য তো সবে এসেছে। বোধহয় ফ্রেশার্স পার্টিতে দেখেছে। আর্য মনে করার চেষ্টা করল। হোস্টেলের ক্যান্টিনে ওদের কজন প্রথম বর্ষের ছাত্রকে সিনিয়াররা এমফিলের সিনিয়ার দিদিদের গোলাপ ফুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করতে বলেছিল সেদিন। আর্য স্মৃতিকণাদিকে সেই গ্রাজুয়েশনের সময় থেকেই চেনে। প্রচুর নোটস রেফারেন্স পেয়েছে ওর কাছে। তাই সেফ জোনেই খেলাটা খেলে। স্মৃতিকণাকেই গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিল। পরে দুজনেই খুব হেসেছিল। আর্য মনে করতে পারল না এই মেয়েটাকে কোথাও দেখেছে কি না?
–কোন ডিপার্টমেন্ট?
–সোশিও।
–ও, আচ্ছা। এম ফিল?
–কেন এম ফিলের মেয়েদের প্রপোজ করেছিলে তাই?
–ওহ! আপনি তাহলে সেদিন…
দুজনেই হেসে ফেলে।
–র্যাগিং-এর মজাটা কিন্তু খুবই ইনোসেন্ট। যদি অবশ্য মাত্রাটা ঠিক থাকে। আর অত আপনি আপনি না করলেও চলবে। আমাদের হিন্দিতে ‘আপ’-শব্দটা শুনতে যতটা ভালো লাগে, বাংলায় কিন্তু তুমি বা তুই শব্দটা বেশি ভালো লাগে। হিন্দিতে তু অর্থে অসম্মান বোঝায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু বাংলায় তুই মানে বেশ একটা কাছের মনে হয়।
–তুমি তো খুব ভাল বাংলা বলতে পারো! একদম ঝরঝরে।
–এত বছর জেএনইউ-তে আছি। আর সব বন্ধুই তো বাঙালি। তাই শিখে গেছি।
–তুমি বইবাজারে সকালে এসে ভাল করেছ। এখানে রাত্রে একা এসো না। দিল্লিকে আগে ভালো করে জানো, তারপর একা ঘুরো।
–তোমার নিশ্চয়ই দিল্লি শহরটা খুব ভালো করে চেনা। তোমার বাড়ি কি দিল্লিতে?
শিখা হঠাৎ চুপ করে গেল। এতক্ষণ একটা হাসির আভা ছিল ওর মুখে। অথচ এই প্রশ্নটার পর কেমন যেন ম্লান মনে হচ্ছে ওকে।
কোনও উত্তর কিন্তু শিখা ওকে দিল না। চুপচাপ ওরা দুজনে হাঁটতে থাকে। বাল্লিমারান পর্যন্ত পৌঁছে আর্যই আবার কথা বলে।
–দিদি তুমি গালিবের বাড়ি নিশ্চয়ই বহুবার দেখেছ? এতদূর এলাম। দেখেই যাই কবিতার তীর্থক্ষেত্র।
–হ্যাঁ চলো। আমিও যাচ্ছি। গালিবের বাড়িতে তো প্রতিদিনিই যাই। জেএনইউ ছাড়ার পর থেকে এখন এখানেই থাকি। কাছাকাছি।
কথাটা শুনে আর্য অবাক হল। ও ভেবেছিল এমফিলের সিনিয়র। অথচ জেএনইউ ছেড়ে দিয়েছে? তাহলে এখানে থাকে? এই কাছাকাছিই কোথাও বাড়ি? বইবাজার থেকে প্রচুর বই কিনেছে ও। দুহাত ভরা বইয়ের প্যাকেট। কিন্তু শিখার হাতে কোনও বই নেই। তার মানে এখানেই বাড়ি। প্রায়ই আসে হয়ত। আজও ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছে?
গালিবের বাড়ি দেখে আর্য মেট্রোর পথ ধরে। অনেকটা পথ ফিরতে হবে ওকে। শিখাকে বিদায় জানিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়ে ও। স্মৃতিকণাদি অথবা ঋষভকে জিজ্ঞেস করবে ভাবে। শিখা বলে কেউ আমাদের ডিপার্টমেন্টের এমফিলের ছাত্রী ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে মাঝপথে? কোর্স কমপ্লিট না করে?
এরকম তো কতজন এমফিল মাঝপথে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এই মেয়েটার মুখচোখ বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই কেমন ম্লান হয়ে গেল! হাতে বইয়ের প্যাকেটের দিকে চোখ পড়তে ওর মনে হল, শুধু ইতিহাস নয় মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা আনন্দ বেদনার সব গল্পেরা এই কিলোদরে বিকানো উপন্যাসেই নয়, শাহিদিল্লির কালিধুলোময় রুখু বাতাসেও মিশে আছে।
সেদিন রাত্রে হোস্টেলের ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে শোনে ওর একটা ফোন এসেছিল। একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করছিল, ও ফিরেছে কিনা? রিসপেশনে বলেছিল, হ্যাঁ ফিরেছে। লাইনটা ধরতে বলেছিল মেয়েটাকে। ডেকে দিচ্ছে আর্যকে। কিন্তু মেয়েটা বলল, তার প্রয়োজন নেই।
আর্য অবাক হয়ে যায়। কে ওকে হোস্টেলের রিসপেশনে ফোন করবে? ওর কাছেই তো মোবাইল আছে। যার প্রয়োজন সে তো মোবাইলেই ফোন করতে পারে।
এর দুদিন পরে আর্য রাতে ডিনার সেরে একটা বই নিয়ে বসেছিল। অশোক আর ঋষভ বলল, চল সিগারেট খেয়ে আসি। একটু হেঁটেও আসি চল।
বন্ধুদের সাথে যাবে বলে ও নিচে এসেছে আর রিসপেশনের ছেলেটা বলল, আপকা ফোন।
–কেমন আছ আর্য? চিনতে পারছ গলা শুনে?
আর্য বেশ অবাক হয়।
–আরে আমি। শিখা। শিখা মিঙ্গলানি। তোমার হরিয়ানভি দিদি। সেদিন দরিয়াগঞ্জে দেখা হল। গালিবের বাড়ি। এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই? অবশ্য তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়াই মানুষের স্বভাব।
–না না দিদি। চিনতে পারছি। মনে আছে সব। কেমন আছ তুমি?
–বঢ়িয়া। তুম?
–আমিও বঢ়িয়া আছি দিদি। তুমি জেএনইউ-তে আসলে জানিও? দেখা করব।
–পুরানা দিল্লি দেখবে তো এই রোববার আবার বইবাজারে চলে এসো। আমি এখানেই থাকি। খুব ভালো করে ঘুরে দেখিয়ে দেব। মনে হবে টাইমট্রাভেল। পুরানা দিল্লিতে এলে মানুষের শতচ্ছিন্ন ইতিহাস অথবা কিসসারা কত শতাব্দী পিছিয়ে যায় দেখবে এসো।
ফোন রেখে দিল শিখা। আশ্চর্য! সময় তো বলল না? শুধু বলল বইবাজার। আর্য বন্ধুদের সাথে পায়চারি করতে বেরিয়ে পড়ল।
কদিন পড়াশোনায় মন বসাতে পারল না ও। আর কোনও ফোন আসেনি। কিন্তু রোববার যাবে কিনা ভেবেছে ও। কাউকে বলা হয়নি শিখার কথা। একজন সিনিয়ার এমফিল পড়তে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে হয়ত। সঠিক কিছুই জানে না। দিল্লিতে এরকম পথে আলাপ হওয়া কারও সাথে কি দেখা করা উচিত হবে? স্মৃতিকণাদি ওকে বলেছে দিল্লি মেয়েদের জন্য খুব একটা সেফ নয়। বিশেষ করে রাতের দিল্লি। শুধু মেয়ে কেন নতুন আসা কারও জন্যই দিল্লি খুব একটা সেফ নয়। স্মৃতিকণাদিকে বলে দেখবে শিখা মিঙ্গলানি বলে কাউকে চেনে কিনা?
সেদিন আবার ফোন এসেছিল।
–তাহলে আসছ তো? আর অত সকাল সকাল এসো না। সূর্যের ঝলমলে আলোয় তো একবার দেখেইছ চাঁদনি চক। এবার আলোর রোশনাইতে শাহাজাহানাবাদ দেখবে তো চলে এসো? ঠিক বিকেল পাঁচটায়।
–কিন্তু আমাকে তো এতটা পথ ফিরতেও হবে।
–সে তো মেট্রোতে ফিরবে তুমি। কোনও অসুবিধা হবে না তোমার।
ক’দিন আর্যর বেশ ছটফট করেই কেটে গেল। রোববার যত কাছে এগিয়ে এল ও যাওয়ার তাগিদ প্রবলভাবে অনুভব করল। বিকেল পাঁচটার মধ্যে দরিয়াগঞ্জ বইবাজারে পৌঁছে গেল ও। কিন্তু ঠিক কোথায় অপেক্ষা করবে? মনে পড়ল একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে ও ‘মেমোয়ারস অফ গেইশ্যা’ বইটা নেড়েচেড়ে দেখছিল। সেখানেই শিখা নিজে এসে ওর সাথে কথা বলেছিল।
আর্য সেই ল্যাম্পপোস্টের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না অবশ্য ওকে। সবুজ একটা সালোয়ার পড়েছে আজ শিখা। বেশ ঝলমলে লাগছে ওকে।
–চলো ঈশ্বরের আবাসন জামা মসজিদ দিয়েই শুরু করি।
মসজিদের কাছেই যে সরু গলিটা সেখানে থেকে ভেসে আসছে গজলের সুর। সুর শুনেই মনে হয় সুফি-সাধকদের গলার স্বর। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের শব্দও ভেসে আসছে। ব্যাবসায়ী কারবারিদের হাঁকাহাঁকি, কাবাবের দোকানগুলো থেকে মাংস পোড়ার গন্ধ, লস্যি, হালুওয়াই-এর দোকানে উপচে পড়া ভিড়। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। এর মাঝে পড়ন্ত রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে আর্য। সঙ্গে প্রায় অচেনা একটা মেয়ে। সবুজ সালোয়ারে শিখাকে শুধু সুন্দরই লাগছে না, মনে হচ্ছে জন্ম জন্ম যেন পুরানা দিল্লিতেই ওর ঘর। এখানকার হইহল্লা, ব্যাবসা, আল্লাহর সাধনা — এসব নিয়েই শিখার অস্তিত্ব।
এতটা পথ কখনও রিকশা কখনও ই-রিকশায় চেপে ওরা ঘোরাঘুরি করতে করতে আবার যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানেই ফিরে আসে। সেই ল্যাম্পপোস্টের তলায়। ঝুপ করে রাত নেমে পড়ে এখানে। বইবাজারে বিক্রেতারা দোকান গুটিয়ে ফেলার তোড়জোড় করছে। ল্যাম্পপোস্টের তলাটা ফাঁকা। আলোও জ্বলেনি এখনও। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আর্য মনে মনে ভাবে, আবার কেন এখানে ফিরে এল শিখা?
–যেখান থেকে শুরু সেখানেই শেষ হওয়া ভালো।
আর্যর মনের কথা শুনে শিখা উত্তর দিল কি? কিন্তু কীসের শুরু কীসের শেষ?
–কিসসা। এই শহরে তো হরবখত কিসসা জন্ম নেয়। এই যে তোমার সাথে পরিচয় হল এটাও তো একটা কিসসাই। হয়ত শুরু।
আর্য বুঝতে পারে না কী বলতে চাইছে শিখা? ওর চোখে চোখ রেখে সবুজবসনা অপরূপ সুন্দরী বলে ওঠে, ‘চিন্তা নেই। কিসসা শেষও হতে পারে।’
আর্য কেমন একটা হকচকিয়ে যায় কথাগুলো শুনে। শুরু শেষ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ও। আর তখনই বোধহয় আর্যর এই ভাবটা খেয়াল করেই শিখা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলে, ‘এটা একটা এতিমখানা। দিল্লিতে কত এতিম যে পথেঘাটে পড়ে আছে! শুধু এতিম? সারা পৃথিবীর কত কোণা থেকে মানুষ আসে এই শহরে। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এখন। এই জায়গা, এই এতিমখানা, এগুলো তো ছিলই না আগে। এখানে ট্রাম চলত। অথচ পাঞ্জাব পাকিস্তান থেকে এত লোকের চাপে এ শহরে জায়গার খুব অভাব হচ্ছিল। তাই ট্রাম লাইন উঠে গেল। ট্রামগুলো সব কোথায় গেল কে জানে? রেলমিউজিয়ামে ভারতের সবথেকে বড় ডায়নোসরের মতো উঁচু স্টিম ইঞ্জিন রাখা আছে অথচ একটাও পুরনো ট্রাম রাখা নেই।’
–তুমি ট্রাম দেখতে চাও? আমার কলকাতায় ট্রাম চলে এখনও। তোমাকে ট্রামের ছবি দেখাব।
শিখা সামান্য হাসল যেন।
–এখানে কিছুই স্থায়ী নয়। ইতিহাস ছাড়া। কতবার যে ধর্ষিতা হয়েছে দিল্লি? কেউ মনে রাখে সেকথা? কত লাশ আর রক্তের ওপর শহরটা দাঁড়িয়ে আছে! কেউ মনে রাখেনি সেকথা।
শিখার কথায় আর্যর মনও বিষণ্ণ হয়ে গেল। এই কোলাহলের মধ্যেও কিরকম একটা চাপা দুঃখ যেন ও টের পেতে থাকল। সেটা বোধহয় শিখার বলা কথাগুলোর জন্যই।
–তোমার জেএনইউও কিছুই মনে রাখে না। সব ভুলে যায় দ্রুত।
–জেএনইউ তো তোমারও। এখন না পড়লেও একসময় তো তুমিও ছাত্রী ছিলে বললে।
একটু যেন হাসল আবার শিখা।
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছ তুমি। রাত বাড়ার আগে ফিরে যাও। রাত বাড়লে অচেনা শহর আরও অচেনা হয়ে যায় আর দিশেহারা করে দেয় নতুন মানুষকে।
একটা রিকশা থামিয়ে আর্যকে উঠে যেতে বলে শিখা। আবার দেখা হবে কিনা সে বিষয়ে কোনও কথা হয় না ওদের।
ফিরে এসে একটা ভালো লাগা আর বিষাদ দুটোই যেন ওর মনে খেলা করছিল। পরদিন সকালে ক্লাসে যেতে ইচ্ছে হল না ওর। লাইব্রেরিতে এসে বসল। একটা বই খুবই আনমনাভাবে হাতে তুলে নিয়ে বসেছে ও। বইটার নাম Dead Souls, Nikolai Gogol.
–কিরে ক্লাস নেই তোর? ফার্স্ট হাফেই লাইব্রেরিতে?
একগাদা খবরের কাগজ নিয়ে স্মৃতিকণাদি এসে বসল আর্যর ঠিক সামনের চেয়ারটাতে।
–এই এতগুলো খবরের কাগজ কি রিসার্চের প্রয়োজনে? এগুলো তো পুরনো। দেখি কবেকার ডেট?
–হ্যাঁ পুরনো। আমার রিসার্চ সাবজেক্ট জেন্ডার। Oppressed and Persecuted Woman at Delhi. আপাতত, ডেলহির রেপ এন্ড মার্ডারের ওপর একটা ডেটাবেস তৈরি করছি। বেশ কয়েকটা মিস করে গেছি।
আর্যর বইটার দিকে তাকিয়ে স্মৃতিকণা বলে, তুই এই সাতসকালে মৃত আত্মাদের নিয়ে বসেছিস কেন?
হালকা হাসির আবহে আর্যর এখন একটু ভালো লাগছে। কেমন যেন গুমোট লাগছিল ওর। অথচ কোনও কারণ তো খুঁজে পাচ্ছেও না?
মে মাসের দিল্লিতে গরম খুবই। বাইরের চওড়া রোদ জানলার কাচ ভেদ করেই টেবিলের ওপর রাখা বইপত্তরে এসে পড়ছে। স্মৃতিকণা ব্যস্ত নিজের কাজ নিয়ে। ল্যাপটপে কী একটা কাজ করতে করতে নিজের মনেই বলল, এই এত বড় খবরটা মিস করে গেলাম?
–কী মিস করলে আবার? তুমি দেখছি শুধু মিসই করছ।
আর্য আসলে কথা বলতে চাইছিল স্মৃতিকণাদির সাথে।
–আরে এই তো বছরকয়েক আগে আমাদের এমফিলের ছাত্রী ফিল্ম ফেস্টিভাল দেখে ফিরছিল। একটা শেয়ারড গাড়িতে। দরিয়াগঞ্জের কাছে কোথায় যেন গাড়ির ভেতরেই নৃশংসভাবে রেপ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় জীবন্ত মেয়েটাকে। আর সারারাত ওখানেই ধিকধিক করে বেঁচেছিল মেয়েটা। পরদিন পুলিশ একটা ছেঁড়াখোঁড়া মৃতদেহ পায়। মিডিয়ায় খুব হইচই হয়েছিল। অ্যারেস্টও হয়েছে কয়েকজন। তুই পড়িসনি খবরটা?… একজন মন্ত্রী আবার বলেছিলেন জেএনইউ-এর মেয়েরা নাকি খারাপ! এতে তো আরও তুলকালাম বেঁধে গিয়েছিল পার্লামেন্টে। মিডিয়াতেও কেউ কেউ বলেছিল, অত রাত্রে মেয়েটার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখতে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?
–কী বলছ? রেপকে জাস্টিফাই?
–হ্যাঁ, এভাবেই তো চলছে। শাস্তি দেওয়াও তো অনেকসময়ই নাটক। শুধু দিল্লি কেন গোটা দেশেই। সেইসময়ে জেএনইউতে কয়েকদিন খুব হইচই হল। রোমিলা থাপার একদিন এসে ভাষণ দিলেন। তারপর সম্পূর্ণ অন্য একটা রাজনৈতিক কারণে ছাত্রনেতা গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিষয়টা জাস্ট সবাই ভুলেই গেল। শুধুমাত্র জেএনইউ ছাত্রছাত্রীদের ওপর অন্যায় বললে তো এই খবরটা বোঝায় না? দেশের সর্বত্রই মেয়েদের ওপর এই অত্যাচার হচ্ছে।
–পড়েছিলাম খবরটা। ভয়ঙ্কর বীভৎস!
–হ্যাঁ, শিখা মিঙ্গলানির খবরটা আজও মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়!
–কী! কার খবর?
–শিখা মিঙ্গলানি। আমাদের সোশিও এমফিলের ছাত্রী ছিল। যার লাশ দরিয়াগঞ্জ বাজারে একটা ল্যাম্পপোস্টের তলায় পাওয়া গিয়েছিল।