দুর্বার-দুর্গা — আত্মশক্তির বিজয়, মানবতার জয়

প্রতিভা সরকার

 

দুর্বারের দুর্গা সর্বজনীন হয়েছেন মাত্র দু বছর। এবারেরটা তার দ্বিতীয় আবাহন। কিন্তু ঠিক এরকমটা তামা-তুলসী-তিল গ্রাহ্য সত্য হলে আরেকটি সত্যকেও এড়ানো যায় না। সেটি সোনাগাছির মেয়েদের প্রবল ইচ্ছা। ভেতরে ভেতরে দেবী আবাহনের ইচ্ছা তাদের এত প্রবল ছিল যে নীলমণি মিত্র লেনের ঐটুকু অফিসেই বেশ কয়েকবছর পূজার আয়োজন হয়েছে। সমস্ত নিয়ম মেনে এবং দর্শকদের জন্য দরজা খোলা রেখে নিজেরা চাঁদা তুলে এই পুজোর আয়োজন করে এসেছে তারা।

আসলে দুমুখো সমাজ-সভ্যতার দগদগে ঘা কারও কাছেই অত প্রকাশিত নয়, যতটা এই মেয়েদের কাছে। শরীরী প্রয়োজন মিটলেই এরা অস্পৃশ্যা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সমস্ত উপকরণ থেকে এদের কীভাবে বঞ্চিত করা হয়, তা ওদের গলি ও বাসগৃহ দেখলেই খানিকটা মালুম হয়। সেইখানে দাঁড়িয়ে দুর্গোৎসবের অনুমতি পাওয়া এদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। যৌনকর্মীও যে আর পাঁচজনের মতো মানুষ, সে-কথা প্রমাণের জন্যই যেন এতখানি জেদ এই মেয়েদের।

আমরা যারা দুর্বারের কাজকর্ম সম্পর্কে কোনও খোঁজই রাখি না, রাখবার প্রয়োজনও বোধ করি না, তারা ভাবি এটি যৌনকর্মীদের সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য একটি এনজিও মাত্র। দুর্বার শুধুমাত্র তা নয়। সুযোগসুবিধের সঙ্গে সঙ্গে যৌনকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষা প্রসারের জন্যও এর অবদান বিশাল। দুর্বার প্রকাশনীর মাধ্যমে সমাজসচেতনতামূলক নারীকেন্দ্রিক বই এরা ছাপান। অসাধারণ ছাপা এবং প্রচ্ছদ অলংকরণ। নিয়মিত সমস্ত বইমেলায় স্টল করেন এবং দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির প্রতিটি অনুষ্ঠানে এইসব বই বিক্রি হয়। নীলমণি মিত্র লেনের ডাক্তারখানায় নিয়মিত রক্তপরীক্ষা এবং চিকিৎসার অন্যান্য প্রাথমিক সুযোগ পাওয়া যায়। বারুইপুরে রাহুল বিদ্যাপীঠ নামে যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য কয়েক একর জায়গায় বিশাল একটি আবাসিক বিদ্যালয় চালায় দুর্বার। সেখানে গিয়ে একেবারে তিন চার বছরের শিশু থেকে বারো ক্লাসের পরীক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। বিশাল দুটি জলাশয়, খেলার মাঠ, দুধের জন্য পালিত গরু — সব সুবিধাই আছে সেখানে। জিজ্ঞাসা করে জেনেছি, শুরুতে স্থানীয় স্কুলে যৌনকর্মীর সন্তান বলে হেনস্থা করা হলেও এখন সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা কমে এসেছে। রাহুলের আবাসিকরা পড়াশুনো, খেলাধুলো সবেতেই স্বচ্ছন্দ। একজন প্রাক্তন আবাসিক মেয়ে বারুইপুর কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছেন বলে শুনেছি, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

এই সবকিছুর মূলে কিছু মানুষের দৃঢ় মানসিকতা ও কর্মক্ষমতা, যাদের নেতৃত্বে আছেন ড. সুরজিৎ জানা। সেই ১৯৯২ সালে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নিযুক্ত কিছু যৌনকর্মী প্রথম ঘুরে দাঁড়ান, এবং পাহাড়প্রমাণ বাধা ডিঙিয়ে পালটে দেন নিজেদের লাঞ্ছিত অবস্থান। সেই পরিবর্তনের দিকে অগুনতি পদক্ষেপ আজ একটি প্রতীকে সংহত হয়েছে — তা হল দুর্বারের দুর্গোৎসব।

নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের সংকীর্ণ অফিসঘর থেকে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের খোলা রাস্তায় এই যে দুর্বার-দুর্গার উল্লম্ফন, তার পেছনের ইতিহাসও নানা প্রত্যাখ্যান, ষড়যন্ত্র, অপমান এবং কলকাঠি নাড়ায় পরিপূর্ণ। গতবার, মানে ২০১৭-র যে পুজো, তা হবে কি হবে না সেই নিয়ে দোলাচল ছিল পুজোর ঠিক আগেও। সমাজপতিরা তো বটেই, এমনকি পুলিশ-প্রশাসনও চায়নি এ পুজো হোক। তাদের যুক্তি ছিল অত্যন্ত হাস্যকর। নাকি রাস্তা আটকে দুর্বারের পুজো হলে যৌনকর্মীদের দেখবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। সেন্ট্রাল এভিনিউ জুড়ে এমন যানজট হবে যে কলকাতার পুজোর দফারফা। ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’ দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে তবেই সাফল্য পায় এবং ২০১৭-র পুজো অনুষ্ঠিত হয়। অথচ এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু। কারণ, গত বছরই কলকাতা পুলিশ ‘আসান’ (aasan) প্রোজেক্টে অনলাইনে দেদার পুজো পারমিট বিলিয়েছে।

এবারের উদ্বোধন

এবারে অবশ্য তেমন অসুবিধে হয়নি। বলটা এখন গড়াতে শুরু করেছে। তাই এবার উদ্বোধনে জাঁক বেশি। এসেছিলেন মন্ত্রী, কাউন্সিলর, চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। আরও এসেছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার ও বিশিষ্ট নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। গতবারের মতো এবারও হয়েছে তিথি মিলিয়ে পূজার্চনা, বিসর্জনের দিন হবে তুমুল সিঁদুরখেলা। যৌনকর্মীদের দুর্গোৎসব আসলে আত্মশক্তির বিজয়োৎসব। এরাও যে এতটা পারে তা নিজেরাই জানত না। আর জেনে ফেলেছে যখন তখন এদের অবস্থা রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘিনীর মতন। কোনও স্বীকৃত সামাজিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না এই অন্তেবাসিনীদের। সভ্যতার প্রাক্কাল থেকে আজ অব্দি যত কাদা মাখানো হয়েছে ওদের সব ধুয়ে ফেলে এই কদিন ওরা গেরস্তের মেয়ে। সুশীলা, কর্মপটু, ভক্তিমতী।

এবারের দুর্বার দুর্গোৎসবের সবচেয়ে উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সকলকে নিয়ে চলবার প্রয়াস (inclusiveness)। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীদের তাই নিজেদের আনন্দে সামিল করে নিয়েছে দুর্বার। এদের পোস্টারে এক রূপান্তরকামী দুর্গাবেশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার নাম শিন্টু বাগুই, নিজেও এক যৌনকর্মীর সন্তান। হিন্দু পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শিন্টু জানিয়েছে শরীর ও মনের বিপরীতমুখীনতার ফলে কীভাবে তাকে প্রত্যহ হেনস্থা হতে হয়। কিন্তু ছবিটা দেখলে বোঝা যায় দেবী ভূমিকায় অবতীর্ণ শিন্টুর হাস্যময় মুখে সব মালিন্য উধাও। ঐশ্বরিক মহিমায় মুখ যেন শুকতারার মতো উজ্জ্বল।

ফলে নাস্তিক, বিশ্বাসী সবার জন্যই এই দুর্বার-দুর্গা। যাদের মণ্ডপের ধারেকাছে দেখলে দূর দূর করে তাড়ানো হত, তারা নিজেরাই দেবী অর্চনায় ব্রতী — মানবতার এত বড় জয় কমই ঘটে থাকে। শবরীমালাতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও নারী অস্পৃশ্য থেকে যায় আইয়াপ্পা মন্দিরে। আর এখানে আপাত-অস্পৃশ্য নারী ছিনিয়ে নেয় পুজোর অধিকার। চাঁদার উৎপাত, মাইকের গর্জন, অকথ্য ট্রাফিক জ্যাম, অকারণ অর্থবর্ষার মধ্যে ‘শরৎ আলোর কমল’ হয়ে বিরাজ করেন আমাদের দুর্বার-দুর্গা। অজস্র প্রণাম তাকে।

এবং বিসর্জন

পুনশ্চ — এইমাত্র খবর পেলাম যে, আজ, বিজয়া দশমীর দিন, বেলা একটায়, প্রথমবার একসাথে সিঁদুর খেলেছে যৌনকর্মী ও সমকামীরা। আবারও প্রণাম দুর্বার-দুর্গাকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...