কৌশিক লাহিড়ী
[বিধিসম্পর্কহীন সতর্কীকরণ : লেখাটি দীর্ঘ এবং মুক্তমনা প্রাপ্তমনস্কদের জন্য]
শবরীমালা প্রথম নয়, শেষও নয়!
লিঙ্গ-নির্বিশেষে ধর্মাচরণের সমানাধিকার নিয়ে বিতর্ক কিন্তু বিশ্বজুড়েই আছে!
কারণটা সহজ, প্রায় সব ধর্মেই ধর্মস্থানে মেয়েদের প্রবেশ নিয়ে, পূজার অধিকার নিয়ে বিধিনিষেধের ব্যাধিটি রয়েছে স্মরণাতীত কাল থেকেই।
মক্কা-মদিনায় মেয়েরা মসজিদে প্রার্থনা করতে পারলেও মেয়েরা কাজী কিংবা ইমাম হলে গেল-গেল রব ওঠে।
একসঙ্গে প্রার্থনার অধিকার অনেক জায়গাতেই আজও নেই!
আর ঋতুমতীর পক্ষে নামাজ পড়া ও রোজা রাখা হারাম, তাদের নামাজ-রোজা শুদ্ধ নয়।
খ্রিস্টানদের মধ্যেও রোমান ক্যাথলিক বা আরও গোঁড়া সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মেরী মাতাকে নিয়ে ভক্তিগদগদ ভাবের অভাব না থাকলেও পোপ কিন্তু সবসময়েই পুরুষ!
কারণটা খুব সহজ!
মেয়েরা সন্ন্যাসিনী (nun) হতেই পারেন কিন্তু পূজার অধিকারী নন!
মানে যাজক বা পূজারী (priest) হতে পারেন না! আর পূজারী না হলে পোপ হবেন কী করে?
কারণ পোপ হতে পারেন কেবলমাত্র একজন যাজক বা পূজারী (priest)-ই!
অতএব নারী বাদ!
কী চমৎকার সিস্টেম, তাই না?
কিন্তু এই নিয়ম কি কখনওই ভাঙা হয়নি?
হয়েছিল, তবে সেটাও একজন পুরুষের জন্য!
ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে ১৪৫৫ সালে যিনি পোপ হন সেই তৃতীয় ক্যালিক্সিটাস ভদ্রলোক কোনওদিনই কিন্তু যাজক ছিলেন না, তার মানে নিয়ম ভাঙা হয়েছিল এবং নিয়মভঙ্গের অধিকার কেবলমাত্র পুরুষেরই!
মুম্বইয়ের বিখ্যাত হাজি আলি দরগার গর্ভগৃহে, সেখানে মেয়েদের যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন ভারতীয় মুসলিম নারী আন্দোলনের (বি এম এম এ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নুরজাহান নিয়াজ। ১৪৩১ সাল নাগাদ এই হাজি আলি দরগা তৈরির পর গত ২০১২ সালের নভেম্বর অবধি মেয়েদের প্রবেশের অধিকার ছিল। তার পর সেখানেও ঋতুমতী মহিলাদের প্রবেশ নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল এবং বন্ধ করা হয়েছিল নারীদের প্রবেশাধিকার! ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ ও প্রার্থনা করতে পারবেন। অবশেষে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ করছেন।
সম্প্রতি বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের আদেশে মেয়েরা আমেদনগরের শনিসিংনাপুর মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পেয়েছেন।
সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় শবরীমালার আয়াপ্পার মন্দিরে কেন সব মেয়েরা প্রবেশের অধিকার পাবেন না এই প্রশ্ন তুলে শবরীমালা মন্দির পরিচালন সমিতিকে কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ সেই ব্যবস্থা দেশের সংবিধানের পরিপন্থী।
এই শবরীমালা মন্দিরটি বেশ দুর্গম, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার প্রায় হাজার চারেক ফুট ওপরে, পেরিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভেতর দিয়ে ষোলোটি পাহাড়ে ঘেরা ঘন জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়!
প্রতিবছর দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকে বহু পুরুষ ভক্ত ও পর্যটক এই মন্দিরে যান। কিন্তু ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী ঋতুমতী মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকী, মন্দিরে ঢুকতে গেলে মহিলাদের বয়সের প্রমাণপত্র পর্যন্ত দেখাতে হয় মন্দির কর্তৃপক্ষকে।
এই প্রথাকেই চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা দায়ের হয়। সব মামলা একত্রিত করে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠিত হয়। প্রধান বিচারপতি ছাড়াও বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি আর এফ নরিম্যান, বিচারপতি এ এম খানউইলকার এবং বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রা।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে আট দিনের শুনানি শেষ হয় পয়লা অগস্ট। সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এক ঐতিহাসিক রায়দানের মাধ্যমে জানিয়ে দেন, ধর্মাচরণে সবার সমানাধিকার রয়েছে। সব মন্দিরে ঢোকার ক্ষেত্রে সবার সমানাধিকার রয়েছে। ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য চলে না। সব বয়সের মহিলাদেরই প্রবেশাধিকার দিতে হবে শবরীমালা মন্দিরে। মন্দির কর্তৃপক্ষ আর কাউকেই মন্দিরে প্রবেশে বাধা দিতে পারবে না।
শোনা যাচ্ছে এটা নাকি প্রাচীন ও পবিত্র ধর্মাচরণে ভয়ঙ্কর এবং অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ!
আদালতের সব রায়কেই যে বিশ্বসংসারের সকলের পরমাকাঙ্খিত হতেই হবে এরকম কোনও আইনের ধারা বা ধর্মীয় নেতার ফতোয়া আছে নাকি?
জেনে নেওয়া ভালো কত প্রাচীন এই ধর্মাচরণ।
শবরীমালা মন্দিরটি দ্বাদশ শতকের কিছু আগের, তাহলে কি সাতশো কি হাজার খানেক বছরের ইতিহাস এর পেছনে?
না!
মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতা আয়াপ্পান হলেন শিব আর বিষ্ণুর (আসলে বিষ্ণুর একমাত্র নারী অবতার মোহিনীর) সংশ্লেষিত পুত্র।
তাহলে কি এই পরম্পরার উৎস প্রাগিতিহাসে?
তাও না!
১৯৯১ সালে কেরল হাইকোর্টের একটি রায়ে ঋতুবতী মহিলাদের (অর্থাৎ ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের) শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়!
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ‘প্রাচীন’ এই প্রথাটি সাতাশ বছরের পুরনো!
হতাশ হলেন বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন!
সাতশো নয়!
সাতাশ!
তার আগে?
মানে, এই যে সাতাশ বছরের সুপ্রাচীন প্রথা তার আগে দেবতার পবিত্রতা কী করে রক্ষিত হত?
১৯৪০ সালের ১৩ মে ত্রিবাঙ্কুরের মহারানি এসেছিলেন শবরীমালা মন্দিরে, তখন দেবতা অপবিত্র হননি কেন? মহিলা মহারানি বলে?
১৯৮৬ সালে নাম্বিনোর কেদুবাত্থিল্লাই নামে একটি তামিল চলচ্চিত্র শুটিং হয় এই শবরীমালা মন্দির চত্বরে! আর শুধু তাই নয়, শুটিং চলাকালীন সিনেমার একটি দৃশ্যের প্রয়োজনে জয়শ্রী, সুধা চন্দ্রন (নাচে ময়ূরী মনে আছে?), অনু, ভাদিভুক্কারাসি এবং মনোরমা নামের পাঁচ–পাঁচজন অভিনেত্রী আয়াপ্পান মূর্তির কাছে মন্দিরের পাতিনেত্তম পাডি বা এইটিন স্টেপস অংশে নাচও করেন!
কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
রীতিমত ১০০০ টাকা জরিমানা নিয়ে দেবতার ব্রহ্মচর্য ভঙ্গের এই ঘৃণ্য অপচেষ্টার মতো ক্ষমাহীন অপরাধকে সেবারের মতো ক্ষমা করা হয়!
মন্ত্রী জয়মালা সেই বছরই মন্দিরে যান এবং আয়াপ্পানকে স্পর্শও করেন, তাঁকে কোনওরকম জরিমানা করা হয়েছিল বলে শোনা যায়নি!
যাবে কী করে? মন্ত্রী বলে কথা! তাঁদের আবার অপবিত্র–পবিত্রের বাছ–বিচার!
এর বছর চারেক পরে ১৯৯০ সালে বহু মহিলা আত্মীয়ার উপস্থিতিতে দেবোত্তর (কেরলে বলে দেবস্যম) সম্পত্তির প্রাক্তন কমিশনারের নাতনির অন্নপ্রাশন হয় এই শবরীমালা মন্দিরেই!
দেবতা অপবিত্র হয়েছিলেন বলে শোনা যায়নি কিন্তু!
তবে কেনই বা এই প্রথা?
পিপল ফর ধর্মের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দিয়েছিলেন—
“…the “primary objective” of the religious practice is to “preserve the celibate form of the deity and not exclusion of menstruating women” and the “impugned religious practice is based on observance of Naishtika Brahmacharya by the Deity at the Ayyappa Temple, and not on notions of menstrual impurity/ and (b) given the form of the Deity at the Temple and its celibate nature, the… religious practice is an essential part of the Temple’s fundamental charter of faith and constitution.”
অকাট্য যুক্তি!
বটেই তো!
অধিষ্ঠাতা দেবতা নিজে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য পালন করেন তাই জননক্ষম মহিলাদের থেকে নিজের ব্রহ্মচর্যাকে বাঁচাতেই…
না হলে এর সঙ্গে ঋতুমতী হওয়া বা নারীর ঋতুকালীন অপবিত্রতার কী সম্পর্ক?
ঠিক, ঠিক!
উপনিষদ না পড়েও ব্রহ্মচর্য সম্বন্ধে একটা ধারণা আমাদের আছে। সত্যাগ্রহ, তপস্যা, প্রকৃত জ্ঞানের সাধনা এই সবই ব্রহ্মচর্যের অঙ্গ!
শুধু নারীসংসর্গ নৈব নৈব চ!
মুণ্ডক উপনিষদে (মুণ্ডকোপনিষৎ) বলা হয়েছে—
सत्येन लभ्यस्तपसा ह्येष आत्मा सम्यग्ज्ञानेन ब्रह्मचर्येण नित्यम्।
কিন্তু এই নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য বস্তুটা কী?
জৈন, প্রাকৃত বা মারাঠি পুঁথিতে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যান থাকলেও সহজ ভাষায় এক কথায় এই উত্তরটা নারদকে দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা!
শ্রীকৃষ্ণ, যিনি এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং গোকুল আর বৃন্দাবনে লীলা করেন, তিনিই প্রকৃত নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী!
নারদের তো শুনে চক্ষু ছানাবড়া!
গেলেন দুর্বাসা মুনির কাছে।
তিনি তো আরও সোজাসাপ্টা বলে দিলেন—
One who lives where there are no women observing celibacy is not the real one. The one who lives amidst women and not caught in the desire is in reality vairagya bramhachari.
Krishna who sings and dances with ten thousand Gopis without a sense of ownership remains Parabrahman. His love and grace are the property of all. He regards both cows and Gopis in Brindavan alike, irrespective of gender. He remains like water droplets on lotus. Others think of him as son, father, mother, friend, lover, guru, deity etc., for their own bliss.
He lives without carnal desires both in mind, word and deed, although he is the subject of love and attachment of everyone! He is the real Naishtika Brahmachari!
এই যদি হয়, নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য, তবে তো ল্যাঠা চুকেই গেল!
কেষ্ট ঠাকুরের লীলাকেই যদি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্যার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, সেক্ষেত্রে বরং নারীদের অবাধ প্রবেশাধিকারেই তো রক্ষিত হবে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য!
কিন্তু কয়েকটা গোলমেলে প্রশ্ন কেন যে মাথায় ভনভন করছে!
১. পার্থিব ঋতুবতী নারীর সঙ্গে অপার্থিব দেবতার ব্রহ্মচর্যের কী সম্পর্ক?
২. যদি সম্পর্ক নাই থাকে তবে বয়স বিশেষের নারীর কেন শবরীমালা (এবং অন্য বহু ধর্মের বহু ধর্মস্থলে) প্রবেশ নিষিদ্ধ?
৩. আচ্ছা মেনে নেওয়া গেল এই নিয়মের সঙ্গে মহিলাদের ঋতুচক্রের সম্পর্ক নেই, জননক্ষম বয়সের আছে। কিন্তু অপার্থিব দেবতাটির নিজের ব্যক্তিগত ব্রহ্মচর্যের দোহাই দিয়ে মানবসমাজের একটা গোটা অংশের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি? পিপল ফর ধর্মের আইনজীবী কী বলেন?
৪. ব্রহ্মচর্যা কি এতই ভঙ্গুর, ঠুনকো? বিশেষত দেবতাদের ক্ষেত্রে? মানে ওই বয়সী মহিলা দেখলেই ব্রহ্মচর্য স্খলিত হবার ভয় থাকে নাকি?
কেষ্ট ঠাকুরও তো দেখা যাচ্ছে অনেক লীলাই করেছেন হাজার হাজার গোপিনীর সঙ্গে, সেটা নাকি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্যের পরাকাষ্ঠা! তবে আয়াপ্পানের ক্ষেত্রে ভয়টা কোথায়?
৫. ঋতুবতীদের নয়, যৌন-সক্রিয় (sexually active) মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল মাত্র— পিপল ফর ধর্মের আইনজীবীদের এই যুক্তি যদি মেনে নিতে হয়, তবে তো, আর একটা প্রশ্ন এসে যায়, মহিলাদের ক্ষেত্রে সক্রিয় যৌনতার বয়স কী?
কে ঠিক করে দেবে? পিপল ফর ধর্মের আইনজীবী? কোনও ধর্ম? না দেবতা? যিনি নিজে ব্রহ্মচারী?
৬. এই যুক্তিটা কি ঘোরতর অপমানজনক নয়? বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে?
৭. যৌনতা ধর্মের মতোই ব্যক্তিগত অনুভূতির ব্যাপার। যতক্ষণ সেটা ব্যক্তির সীমায় থাকে ও অন্যকে আঘাত করে না, ততক্ষণ সেটা নিয়ে মন্তব্য বা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার অন্য কারও থাকে কি? দুঃখের কথা হল আজকের সংবাদমাধ্যম বাহিত আলোচনায় এই কথাও উঠে আসে যে—
It is an unfortunate instance of judicial interference in the relationship between the devotee and the deity that is defined by faith. The act of introducing notions of rationality and gender justice in the relationship and bringing it up to speed with modern social and legal standards is fraught with danger. That is so because once the practices that stem from this relationship are tested on the altar of constitutional morality, there is no stopping anyone from questioning the very basis of that faith.
এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে!
প্রশ্ন করবে? তাও আবার ধর্ম নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে?
আপনি বলেন কী গো!
মূল আপত্তিটা এখানেই, বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত! ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত!
আচ্ছা, কেউ যুক্তির মূলে আঘাত কথাটা কোথাও বলেন না তো!
ধর্মীয় ভাবাবেগে যদি আঘাত লাগতে পারে, পাথরের দেবমূর্তির ব্রহ্মচর্য যদি স্খলিত হতে পারে তবে যুক্তির কষ্টিপাথরে আঘাত লাগতে পারে না?
নাকি সেটা এলেবেলে?
৮. কোনও ধর্মের কোনও রীতি যদি অগণতান্ত্রিক, অমানবিক, দমনমূলক অথবা বৈষম্যমূলক হয়, যদি গণতান্ত্রিক মানবাধিকারের পরিপন্থী হয় তবে নির্বাচিত আইনসভার এবং বিচারব্যবস্থার অবশ্যই অধিকার আছে সেটাকে পরিবর্তন করার!
৯. যদি না থাকত তবে আজও জিওর্দানো ব্রুনো অথবা জোয়ান অফ আর্ককে পুড়িয়ে মারা যেত, গ্যালিলিওকে কারাগারে নিক্ষেপ করা যেত, সতীদাহ প্রথা, কুলীনের বহুবিবাহ, তিন তালাক, বাল্যবিবাহ অথবা কন্যাভ্রূণ হত্যা রমরমিয়ে চলত! (শেষের দুটি যে চলে না এটা অবশ্য বলা যায় না!), বিধবা বিবাহের কথা কেউ মুখে আনত না।
১০. রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরদের নাম আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কেন? কারণ, তাঁরা ধর্মের এই সব গোঁড়ামি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন! বাংলা তথা ভারতবর্ষে রেনেসাঁ এনেছিলেন, নবজাগরণ!
১১. ঋতু নিয়ে এই কুসংস্কার, অপরিচ্ছন্নতাবোধ, এই সময়ে মন্দিরে তো দূরস্থান, বাড়ির ঠাকুরঘরেও ঢোকা যাবে না এটা মেয়েদের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়! কুমারী পূজায় যে বালিকাটিকে নির্বাচিত করা হয়, তাকে শুধু কুমারী হলেই চলবে না, প্রাক-ঋতুমতী হতে হবে, কারণ ঋতু মানেই অপবিত্রতা!
১২. আর ঋতুমতীর পক্ষে নামাজ পড়া ও রোজা রাখা হারাম, তাদের নামাজ-রোজা যে শুদ্ধ নয় সে কথা তো আগেই বলেছি!
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের ঐতিহাসিক রায়দানের পর কতগুলি ঘটনা ঘটল।
খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু কথা বলা হতে লাগল—
- ১২ অক্টোবর মালয়ালাম অভিনেতা কোল্লাম তুলসী এনডিএর এক সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন। সেখানেই তিনি বলেন, শবরীমালা মন্দিরে যেসব মহিলা যাবেন তাদের কেটে দু টুকরো করে ফেলা উচিত। একভাগ ফেলা উচিত দিল্লিতে অন্য অংশটি ফেলা উচিত মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে।
- ১৩ অক্টোবর দেবস্যম সম্পত্তির প্রাক্তন কমিশনার গোপালকৃষ্ণণ বলেন, শবরীমালায় মেয়েরা ঢুকলে বাঘ আর পুরুষেরা তাদের ছিঁড়ে খাবে! মন্দির চত্বর থাইল্যান্ড হয়ে যাবে! হুমকিটা অশালীন আর ভয়ঙ্কর!
- ১৯ অক্টোবর সাংবাদিক কবিতা জাক্কাল আর নারী অধিকার কর্মী রেহানা ফতিমাকে মন্দিরের সেই পাতিনেত্তম পাডি বা এইটিন স্টেপস অংশের পাঁচশো মিটার আগে আটকে দেওয়া হয়! সুপ্রিম কোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এই কাজ করে।
- ২০ অক্টোবর অভিনেতা থেকে নেতা হওয়া রজনীকান্ত বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছি আমি৷ আমাদের মন্দিরের সুপ্রাচীন রীতিনীতির প্রতি সম্মান জানানো উচিত৷’
- ২২ তারিখ রেহানা ফাতিমাকে মুরতাদ ঘোষণা করে রাজ্যের প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠন ‘দ্য কেরালা মুসলিম জামাত কাউন্সিল‘! এই ঘোষণার অর্থ রেহানা ফাতিমা নামে ওই নারীর মুসলিম নাম ব্যবহার করার আর কোনও অধিকার থাকবে না। ‘লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভক্তর ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার জন্যই’ কাউন্সিল রেহানা ফাতিমার বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় বা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হল ভারতের সর্বোচ্চ বিচারবিভাগীয় অধিকরণ ও ভারতের সংবিধানের অধীনে সর্বোচ্চ আপিল আদালত এবং সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত। ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সাংবিধানিক পর্যালোচনার অধিকারপ্রাপ্ত।
সুপ্রিম কোর্টের অধিকারের আওতা নিয়ে এমন বিতর্ক, তার সর্বোচ্চতাকে এমনভাবে অমান্য/অগ্রাহ্য করা, সর্বোচ্চ আদালতের কোনও রায়দানকে বলবৎ করতে এমন প্রশাসনিক ব্যর্থতা অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় সঙ্কটের অশনিসংকেতের বার্তাবাহী!
দেবীপক্ষে নারীর এমন অপমানে বন্ধুবর আর্যতীর্থর কলম ঝলসে উঠল–
পক্ষ নাকি দেবীর তবু দক্ষযজ্ঞ দক্ষিণে
ও নারী তুই ভক্ত হলে বন্ধ ঋতুর ঝক্কি নে।
ঋতু হলে ভগবানও ভয় পান তোর দর্শনেই
ব্রহ্মচর্য ভাঙতে পারে ভক্তিভাবে স্পর্শতেই।খুব ছোঁয়াচে কামের রিপু, ভগবানও মুক্ত নন
ভক্তরা সেই আশংকাতে নারী এলেই ক্ষুব্ধ হন।
মারতে পারেন নারীকে তাই গালিও দেন অশ্রাব্য
পক্ষ নাকি দেবীর এটা, নারী তোমার কী ভাগ্য।রুষ্ট যতেক ভক্তসকল আদালতের দুষ্টতায়,
নারীর ছুঁলেই লাগবে কালি ভক্তিরসের পুষ্টতায়।
পরমপুরুষ পুরুষই হয় আইনে নেই স্বীকার যে
পক্ষ দেবীর হলেও নারী ভগবানের কী কার্যে?হিসেব মতন বিশ্বটাকে নেন চালানোর ভার যিনি
এতই কেন কষ্ট যে তাঁর থাকতে হলে ভার্জিনই?
সামনে নারী এলেই যদি ব্রহ্মচারীর দম কমে,
সন্দেহ তো জাগবে তবে রিপুদমন সংযমে।ঈশ্বরকে রাখতে অটুট ভক্ত করেন রক্তপাত
পক্ষ দেবীর, ভগবানের তবু পুরুষ পক্ষপাত।
যেই দেশে শ্রী ভগবানও এড়ান ঋতুচক্রকে
কী লাভ মেনে সে দেশ জুড়ে বলো দেবীপক্ষকে।