কুণাল বিশ্বাস
পিচকালো বলরামপুর-বাঘমুন্ডি সড়কের গা ঘেঁষে সোনকুপি কাফে। ট্যুরিস্টবাহী অধিকাংশ ফোর-হুইলারই এখানে দাঁড়ায়। কাছেই একাধিক ছড়ানো টিলার অনুচ্চ যৌথতা। সামান্য দূরেই দেখা যায়, পথের উপর্যুপরি বাঁক ছোবল মারে দিগন্তে। এই বাহ্যিক প্রকরণ থেকে মুখ লুকিয়ে আরও ভিতরে ঢুকে আছে একটি ছোট গ্রাম— ছায়ামারীচের মতো। বাঘমুন্ডি থেকে সাত-আট কিলোমিটার ব্যবধানে ছৌ-এর মুখোশ তৈরির আঁতুরঘর ‘চড়িদা’, কোলকাতা সহ বাকি বাংলার কাছে যার পরিচিতি ‘মুখোশের গ্রাম’ বলে।
আপাতত ‘ছৌ-নাচ’ বিষয়ে খানিক ভণিতা অপরিহার্য।
আদিম সমাজে মানুষ শিকারে বেরোবার আগে উদ্দীপনা সঞ্চয় করত বিভিন্ন নাচের মাধ্যমে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ করে। পশুপাখির গলার স্বর-আওয়াজ-ধ্বনি-অঙ্গভঙ্গি নকল করে এই নৃত্যশৈলী বৈচিত্র্যময় করার ঝোঁক ছিল। শত্রুকে ঘায়েল করে আত্মরক্ষার নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কারে সচেষ্ট মানুষ ক্রমে জন্ম দেয় বিভিন্ন যুদ্ধপদ্ধতি। এই কৌশলগুলি আস্তে আস্তে তাদের নৃত্যরীতির মধ্যেও প্রভাব ফেলে। ছৌ নাচের পুরোধা পুরুষ, পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত গম্ভীর সিং মুড়ার কথা এখানে স্মর্তব্য—
‘‘আমার কনহ গুরু টুরু নাই আইজ্ঞা। বনের পশুপাখিই আমার মাস্টর। উয়াদের দিকে ভাইল্যে থাকতি দিনরাইত। আর দেইখে দেইখে মনের ভিতর তুইলে রাখতি উয়াদের চাইলচলন। আর ছিল একট কালো রঙের ভিড়কা গরু, উ শিং উঁচায়ে দমে লাফঝাঁপ কইরত। লেতাড়ে আইসত। আমিও উয়ার সঙ্গে লাফঝাঁপ দিথি। উলফা দিতি। এমনি করেই আমার ছো লাচের হাতেখড়ি।’’
‘ছৌ’ ভারতবর্ষের এক প্রাচীন লোকনৃত্য। সাঁওতাল, মুন্ডা, কুর্মী, ওরাওঁ, হো, ডোম উপজাতির মানুষই ছৌ নাচের মূল ঐতিহ্য ও পরম্পরার ধারক-বাহক। নাচের ছন্দে এবং গানবাজনায় এই উপজাতিগুলির প্রভাব খুবই স্পষ্ট। বিবর্তনের ফলে ছৌ নাচ তার আদিবাসী ঘরানার সাথে অনেকরকম লৌকিক উপাদানের সংমিশ্রণ করে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। নাচের বিষয়বস্তুর মধ্যে মহাভারত, রামায়ণ সহ বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যানের পাশাপাশি অসংখ্য লৌকিক বিষয় আর লোকগাঁথারও অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। এই নাচ একই সাথে আনুষ্ঠানিক এবং লৌকিক। প্রাসঙ্গিক তথ্য অনুসারে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাহারবা, দাদরা, একতাল, ত্রিতাল ইত্যাদির প্রয়োগও ছৌ নাচে পাওয়া যায়।
ছৌ একাধারে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ, রাঁচি জেলার পাঁচ পরগনা, সিংভূম জেলার ধলভূম এবং সরাইকেলা মহকুমায় প্রচলিত, আবার উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, কেঁওনঝড় অঞ্চলেও চর্চিত। তবে ছৌ নাচের সর্বাধিক প্রচলন এবং প্রসার আমাদের পুরুলিয়া জেলায়। পুরুলিয়ার ছৌ-এর প্রসিদ্ধি এবং মৌলিকতার পিছনে অসামান্য নৃত্যশৈলী ও দক্ষতার পাশাপাশি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল নৃত্যশিল্পীর মুখোশ এবং জমকালো পোশাক, যেটা অন্য জায়গার ছৌ নাচে দৃশ্যত অনুপস্থিত। ঠিক এই কারণেই চড়িদা তাৎপর্যময়, স্বতন্ত্র।
তাড়কা রাক্ষসী
মা দুর্গার মুখ— স্থানিক প্রভাব লক্ষণীয়
তাড়কাসুর
জোড়া হিসাবে তৈরি কিরাত-কিরাতী
চড়িদায় সফরসঙ্গী ছিল এক স্থানীয় বন্ধু, নাম উজ্জ্বল মাহাতো, যিনি এক দক্ষ ছৌ-নৃত্যশিল্পী! গ্রামে ঢুকলেই দৃশ্যের ভিতর চলে আসে সারি দিয়ে ছোট-বড়-মাঝারি দোকান আর দোকান সংলগ্ন বাড়ি।
প্রথমে বসা যাক শিল্পী জগদীশ সূত্রধরের দাওয়ায়।
জগদীশ সূত্রধর
জগদীশ সূত্রধর, বয়স ৫৩। বাবার নাম সতীশ চন্দ্র সূত্রধর, ঠাকুরদার নাম ক্ষেতু মিস্ত্রি।
“ঠাকুরদা ‘মিস্ত্রি’, অথচ আপনার বাবা বা আপনি ‘সূত্রধর’ হলেন কীভাবে?’’… উত্তরে বললেন, “এখানে মিস্ত্রি, রায়, দত্ত, সূতার সবাই আসলে সূত্রধর বংশের। কেউ আলাদা না। প্রায় দু’শো পরিবারের বসবাস এই চড়িদা গ্রামে।” জগদীশবাবুরা পাঁচ ভাই। ফ্যামিলিতে স্ত্রী এবং এক ছেলে, এক মেয়ে। “পূর্বপুরুষের প্রায় একশো বিঘা ধানজমি ছিল। বিপদে পড়ে বেচতে বেচতে এখন সব শেষ। তখন ৬০ খানা গ্রাম নিয়ে ছিল একটা মৌজা আর সাত-আটখানা মৌজার দায়িত্বে ছিল একজন সর্দার”… পাশ থেকে এক বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বললেন, “রাজা মানকি থিকে ফকির হয়ে গেছে!”… ওঁর দিকে তাকাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললেন, “আমি গঙ্গাধর রায়। বন থেকে কাঠ কেটে বিক্রি করি। এছাড়া চালও বেচি মাঝেমাঝে।”
জগদীশবাবুর দোকান থেকে উঠে এবার গৌতম সূত্রধরের কাছে।
গৌতম সূত্রধর, বয়স ৩৬। বাবার নাম নিমাই চন্দ্র সূত্রধর, ঠাকুরদার নাম ছুটুলাল সূত্রধর। ওঁর দোকানে একটি দশ-এগারো বছরের বাচ্চা এবং ষোলো-সতেরো বছরের কিশোর স্বাভাবিক দক্ষতায় মুখোশের চক্ষুদান করছে রং-তুলির স্বচ্ছন্দ টানে। এরা যথাক্রমে গৌতমবাবুর ছেলে এবং ভাইপো— অভিজিৎ সূত্রধর (ক্লাস সেভেন) এবং প্রসেনজিৎ সূত্রধর (ক্লাস ইলেভেন)!
প্রসেনজিৎ ও অভিজিৎ
গৌতম সূত্রধরের ডান পাশে হরেন চন্দ্র সূত্রধরের আস্তানা। বয়স ৬০। বাবার নাম ছুটুলাল সূত্রধর, ঠাকুরদা সৃষ্টিধর সূত্রধর। “আমি গৌতমের কাকা। আমার ডান পাশে আমার আরেক ভাইয়ের দোকান। ওর নাম ফাল্গুনী।”
হরেন চন্দ্র সূত্রধর
ফাল্গুনী সূত্রধর
ফাল্গুনী সূত্রধর। বয়স ৪৭। ১২-১৩ বছর বয়স থেকে মুখোশ তৈরি করছেন। “২০১৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ প্রথমবার ভারতের মধ্যে নাম্বার ওয়ান হয় আমাদের বানানো ছৌ-এর একটা ট্যাবলোর জন্য। আমি ছাড়াও আরও অনেকে ছিল ট্যাবলো বানানোর সময়। ওটা এখন দিল্লিতে রাখা আছে। সব রাজ্যকে আমরা হারিয়ে দিই। অথচ আমরা এক পয়সাও পেনশন পাই না। পেনশন যা পায় নাচের শিল্পীরাই পায়। তাও সবাই না। আমরা আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করি। এ গ্রামে কর্মরত শিল্পীর সংখ্যা প্রায় ছ’শো। সিজনে একটু বেশি বিক্রি হয়। আমাদের জন্মেঞ্জয় সূত্রধরকে কয়েক বছর আগে নেদারল্যান্ডে নিয়ে গেছিল মুখোশ তৈরির ওয়ার্কশপ করাতে। এখন দু-একজন দুর্গাপুজোর সিজনে মূর্তি তৈরির ডাক পায়। অন্য সময় মাসিক আয় বড়জোর ছয়-সাত হাজার টাকা। চার-পাঁচজনের সংসারে এ দিয়ে কিছু হয়! অথচ, আমাদের কাছ থেকে ১০০ টাকায় কেনা মুখোশ কোলকাতায় গিয়ে ১০০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।”
এরপর একে একে রাজেন সূত্রধর (বয়স ২০) এবং দিলীপ সূত্রধরের (বয়স ৬২) সঙ্গে খানিকক্ষণ। রাজেনের বাবা বছর পঁয়তাল্লিশের মিহির সূত্রধর বর্তমানে ঠিকাদারি করেন। দিলীপবাবু কথাপ্রসঙ্গে বললেন ১৯৭৪-এর আকালের (দুর্ভিক্ষ) কথা। সরকার থেকে ত্রাণস্বরূপ নামমাত্র গমসেদ্ধ, মাইলোকাঁটা (বাজরাসদৃশ) পাঠানো হত। দিলীপবাবুর এক ছেলে (রাজেশ সূত্রধর) এবং তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে রাজ্যস্তর এবং কেন্দ্রীয়স্তরে পুরস্কৃত। এবার এইচ.এস. দেবে। “আমাদের জন্মের আগে শুধু চড়কেই ছৌ নাচ হত। পরে বছরের অন্যান্য সময়েও নাচ শুরু হয়। জানেন, আমি নিজে গম্ভীর সিং মুড়ার একটা দেড় ফুট সাইজের মূর্তি বানিয়েছিলাম। এক স্কুলের হেডমাস্টার নিয়ে গেছিল। গম্ভীর সিং মুড়া সবার উপরে। উনি ভগবান!”
চারপাশে ঝোলানো ষণ্ডাসুর, তাড়কাসুর, মহিষাসুর, শিব-পার্বতী, কার্তিক, গণেশ, তাড়কা রাক্ষসীর মুখগুলো থেকে থেকে অভিব্যক্ত আর অভিনীত হতে চাইছে। উল্লেখ্য, এখানকার বিখ্যাত আদিবাসী পুরুষ-নারীর মুখাবয়বগুলি কিরাত-কিরাতীর আদলে নির্মিত। এক নির্মাণ-শিল্পীর মুখে শোনা গেল এর মহাভারতীয় যোগসূত্র। বিরাট পর্বে স্বয়ং শিব-পার্বতী নাকি এই রূপে অর্জুনের সম্মুখস্থ হয়েছিলেন।
ছোট হোক বা বড়, ডাইসের ছাঁচে হোক বা আগাগোড়া হস্তনির্মিত— একেকটা মুখোশ সম্পূর্ণভাবে তৈরি করতে ন্যূনতম পাঁচ দিন লাগে। ফাল্গুনী সূত্রধর বললেন, “পারলে আমাদের কথাগুলো কাগজে জানাবেন।”… গৌতম সূত্রধর এক সপ্তাহের একটা মুখোশ তৈরির ওয়ার্কশপ অ্যারেঞ্জ করতে বার বার অনুরোধ করলেন।
ফেরার সময় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চড়িদার সীমানা পেরোতেই কানে এল গম্ভীর সিং মুড়ার সিংহনাদ—
‘‘সেরাইকেল্লা, মণিপুরের দল এমন লাচ কইরে দেখাল্য, সে আর কী বইলব? লাচ দেইখ্যে আশুবাবু চুপ। ভয়ে কাঠকাপাস। মুহে রাস ইরছে নাই। আমি বইললম, আমাকে কিছু বইলবেন নাই। আপনাদের কথা শুইনব নাই। আসরে ঢুকেই একুশবার ভোল্ট দিয়ে যখন দাঁড়ালি চড়চড় কইরে, চাইরদিকে শুধু হাততালি আর হাততালি!’’