প্যাথোলজিক্যালি ইকুইভ্যালেন্ট

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

 

আমি।

রাতভর বয়ে চলা ঘুমগুলো সমাজের চকমকি পাথরে ঘষা খেয়ে আলোর ভেলকি দিয়ে ছড়িয়ে যায়, আমি জেগে থাকি…

বাইরের না-জ্বলতে-চাওয়া বদ্‌ আলো তার তীক্ষ্ণ ছায়া নিয়ে গোটা ঘরের দেওয়ালে বাসা বাঁধে, আমি চেয়ে দেখি…

নাছোড় চোখের পাতা মাথার মানুষের সাথে কুপরামর্শ করে টানটান থাকে, আমি চেয়ে জাগি…

আমি ঘুমোতে ভয় পাই। রাত্তিরে। রাতের শুনশান পরিকল্পনা আমার চিন্তায় বিরোধীপক্ষের জন্ম দেয়। বারবার মনে হয়, কে যেন দাঁড়িয়ে দরজার আড়ালে, ছুরি হাতে আমার ঘুমের অপেক্ষায়। আমার পাহারা পরাজিত হলেই যার বিষ ঢুকে যাবে আমার শরীরের স্তর-স্তর পেরিয়ে। পোকা-মাকড়, টিকটিকি এরা কেউই আমার সন্দেহতালিকার বাইরে নয়। শরীরের সবকটা মৃত্যুবিন্দুকে আমি কঠোর নজরদারিতে রাখি। মাঝে মাঝে অবশ্য চোখের পাতারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। উকুন-কৃমির মতো ঘুটঘুটে পোকাগুলো সেই সুযোগে আমার ছিদ্রগুলোর চারদিকে নাচতে নাচতে হাজির হয়। একটা টিকটকি তার জিভ লপ্‌লপিয়ে ধেয়ে আসে হত্যালীলায় অংশ নিতে। সিলিং-এ ফ্যান ঘুরতে থাকে হো-হো করে। একটা কি দুটো তীব্র কালো ছায়া তাদের হিংসাবিষে মাখানো অস্ত্রগুলো নিয়ে প্রস্তুত হয়। টিকটিকির জিভ দিয়ে জ্বলে পুড়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো লালাসমেত আমার চামড়ার ওপর ঝরে পড়ে। তার দেহের সেই কালো মেশানো রঙ সমস্ত ঘরটাকে অধিকার করে নেয়। আমি আমার শত্রুদের ঠাওর করতে পারি না। প্রচণ্ড অসহায়তায় দমবন্ধ হয়ে আসে। চেতনার রন্ধ্রগুলো যখন একে একে চাপা পড়ে যেতে থাকে, আমি গুঙিয়ে উঠি।

ঠোঁটের দু-পাশে লালার চ্যাটচ্যাটে আভাস, ঘরের হলদে হয়ে যাওয়া ছায়া— এসবের মধ্যেই আবার শুরু করি বিরোধীপক্ষের ওপর নজরদারি। আমি ঘুমকে প্রশ্রয় দিই না।

রাত সাড়ে সাতটা। সল্টলেকের বৈশাখী থেকে বাসে চড়েছি। উল্টোডাঙ্গায় নামব। রিটার্ন টিকিট কাটা আছে। তারপর ট্রেনে চেপে নৈহাটি। বাসে অসম্ভব ভিড়। দুটো ধাপ ওপরে অব্দি চড়া যাচ্ছে না। পুরোটাই স্টেশনের ভিড়। উল্টোডাঙ্গা এলেই বাস খালি। আমি একদম নিচের ধাপটায় যাহোক করে, দরজার লম্বা রডটাকে ডান হাতে জড়িয়ে, বাঁ হাতে দরজার ধারের হাতলটা ধরে সেঁধিয়ে আছি। পেছনের দিকটায় কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলে দাঁড়িয়ে আছে— আমার মন বলছে ওরা টিকিট মারার তাল করছে। ঐ ভয়ানক গরমের মধ্যেও ওরা মস্করা চালাচ্ছে আর থেকে থেকে বিচ্ছিরিভাবে হেসে উঠছে। ওরকম ভিড়ে ভেতরের অনেকেরই টিকিট কাটা থাকে না। বাস উল্টোডাঙ্গায় থামলেই কন্ডাক্টার আগে-ভাগে নেমে সবার কাছে “হয়ে গেছে?” প্রশ্ন নিয়ে দরজা আটকাবে আর টিকিটগুলো আঙুলের মাঝে নিয়ে চ্যাড়চ্যাড় শব্দে বাজাতে থাকবে। যার যার হয়নি, তারা পয়সা দিয়ে টিকিট নিয়ে নেমে যাবে। আর যার যার হয়েছে তারা ঘাড় হালকা কাত করে বিদেয় নেবে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ছ্যাঁচড়াগুলো ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্যেও চেতনার কোনও না কোনও স্তরে নিশ্চয়ই ফেঁদে ফেলেছে কীভাবে উদ্দাম বিশ্বাসের সাথে ঘাড় হেলিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। এগুলো আমাদের আত্মস্থ প্রক্রিয়া। মুখে কিছু না বলেও কীভাবে যেন চেতনার একটা বাঁধন তৈরি হয়ে যায়। বিপক্ষ মালুমও পায় না।

একটাই কাজের কাজ হয়েছে, বাসটা কোথাও থামছে না। স্টপেজ আসার আগে কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে বাসস্টপের নাম নিয়ে জানতে চাইছে কেউ নামার আছে কিনা। ভেতর থেকে বাসের শব্দমাখা একটা হাওয়া বাদে আর কিছুই ভেসে আসছে না। মাঝে মাঝে আমার পিঠে ভিড়ের চাপ তৈরি হচ্ছে যখন বাসটা প্রচণ্ড গতিতে গোলচক্করগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে।

তবে এসবের আমি কিছুই ভাবছি না। আমি ভাবছি খালি আমার সাথে, শুধু আমার সাথেই কেন সব্বাই মিলে এতটা নোংরা খেলা খেলছে। বাড়িতে দাদা চাকরির জোর খাটিয়ে বাবা-মা’কে হাত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাকে তো একরকম কোনঠাসা করেই ছেড়ে দিয়েছে। আমার সবকিছুই এখন বাজে। আমি বাড়িতে থাকি, বাজে। আমি পড়ে পড়ে ঘুমোই, বাজে। আমার কথাগুলো তাদের কথা থেকে হারিয়ে যায়, পাগল। আজ চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলাম। সল্টলেকের এক মাল্টিন্যাশনালে সিট পড়েছিল। অনলাইন পরীক্ষা। ঠিক, ঠিক আমার কম্পিউটারটাই পরীক্ষা চলাকালীন খারাপ হয়ে গেল! যারা ইনভিজিলেটর ছিলেন, সবাই অত্যন্ত অশ্রদ্ধা মেশানো সুরে আমার সাথে কথা বললেন। আমার পায়ে কম্পিউটারের তার পেঁচিয়েই নাকি এই কীর্তি। আমি ভ্যাবলাকান্ত হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাকে অন্য সিস্টেমে নতুন করে লগ ইন করতে দেওয়া হল। আগেরটা যে অবস্থায় খারাপ হয়েছিল, সেখান থেকেই ফের চালু হল পরীক্ষা। কিন্তু মাথাকে আর ফেরানো গেল না। সে নাছোড়বান্দা অর্বাচীন তত্ত্ব খাড়া করতে লাগল। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই একটা তীব্র ষড়যন্ত্র চলছে। আমার সমস্ত ভাবনা কারও না কারও কাছে নির্ঘাত নাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড করা যায় আমার চেতনাকে? এসব ভাবতে ভাবতেই টাইম-আপ। আমি হেঁটে এলাম অনেকটা। অনেক কিছু ভাবতে-ভাবতে, সাত-পাঁচ নানান কথা। বলতে ভয় হয়। বলা যায় না কে কোথায় পড়ে ফেলে আর আমার বিরুদ্ধে ছক কষে। আজকাল শত্রুদের চিহ্নিত করে উঠতে পারি না, বড় বিভ্রান্ত লাগে।

হাডকো-র মোড়ে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে বাস। সারি সারি গাড়ি। বাসস্টপে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চা ছেলেকে তার বাবা-মা বেশ গম্ভীরভাবে কী যেন বোঝাচ্ছেন। আমার মনে পড়ল ছোটবেলায় যখন বিছানায় তর্জনী পাকিয়ে আঁকিবুকি কাটতাম, সেই নরম অনুভব আমার তর্জনী হয়ে হাত বেয়ে মাথায় উঠে যেত। সেই আকৃতিগুলোর সাথে সাথে মাথার ঘিলুও তার চলন বদলাত। এক স্নিগ্ধ আরাম ছিল সেই আঙুল পাকানোয়। তবে কি ওভাবেই!

বাস ছাড়লে এবার নামার জন্য প্রস্তুত হয়ে দরজার মোটা রডটা ছেড়ে হাতলটাই শক্ত করে ধরি। কন্ডাক্টারের কালো দাঁতগুলো দেখার ভয়ে এর ফাঁকেই আমি কখন যেন টিকিট করে নিয়েছি। বাসটা ডানদিকে বেঁকে সোজা কয়েক-চাকা চলে বাঁদিকে ঘুরে আর কিছুটা গিয়ে থামবে। আমি চট করে নেমে পড়ব। ডানদিকে বাঁক নিল বাস। এবার কিছুটা গতি বাড়িয়েই বাঁদিকের বাঁকটা নিতে গেল। তিনমাথার মোড়ের ফুটব্রিজটার তলায় এসে পিছন দিক থেকে একটা অসহনীয় চাপ অনুভব করলাম আমার পিঠে। হাতের মুঠো গেল খুলে।

আমি বিহ্বল চোখে দেখলাম বাসটার চলে যাওয়া। এরই মধ্যে একটা ব্যথা যেন আমার মাথা খুঁড়ে অনেক অনেক গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। আঁধার হল চারদিক।

এতটা জোর যে আমার শরীরে আছে, আমি জানতামই না। দাঁত কিড়মিড় করে কুঁচকানো হেসে যখন খেয়াল করলাম ফুটব্রিজের তলায় কতগুলো মানুষ হাঁ-হাঁ করে ছুটে গেল, হাতে ধরা বাসের হাতলটা দুমড়ে গেছিল। কেউ কিছু বলল না, আমি নেমে গেলাম।

মৃত্যু মানুষের অস্তিত্ববোধকে নাড়িয়ে দেয়। তার জীবনে সময়ের সসীমতা আর সেই সসীমতার মধ্যে হয়ে চলা অপচয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এক অভাব তৈরি হয়, অসহায়তায়।

একটা কাদামাখা ভোর হয় সন্দিহান রাত্রিশেষে। আমি নিজের নিদ্রাহীনতা ছেড়ে, বাস্তবতাকে ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে চাই অলক্ষ্যে। তবু শরীরকে বিছানা থেকে আলাদা করা যায় না। তার হাত বাঁধা, পা বাঁধা, কোমরে বেড়ি পরানো। সে তার মাথা তুলে শয়নরত বাকিটাকে দেখে, গ্রীবায় তার উত্তেজনার খাঁজ তৈরি হয়। সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত-পা টানা-হ্যাঁচড়া করলেও পেশীর আন্দোলন বাদে আর কোনো শারীরবৃত্তীয় মুক্তিই সে ঘটাতে পারে না। কাহিল হয়ে যাওয়া স্বরে সে চিৎকার করে ওঠে। দেওয়ালের ধূসর ছায়া ফ্যানসহ সিলিং দুলিয়ে দেয়। গোটা ঘর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অসহায়তার স্বর ক্রমশ তীক্ষ্ণতর হতে থাকে। চুরচুর করে ভেঙে পড়ে ঘরের অস্তিত্ব। সে ক্লান্ত হেসে তাকায় খোলা আকাশের দিকে। তিনটে চিল বৃত্তাকার গতিতে তার দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে উড়তে থাকে। তাদের গতিপথের মধ্যবিন্দু জুড়ে অবয়বপ্রাপ্ত এক নির্ভার শূন্যতার মায়া তার আঁখিজোড়া বুজিয়ে দিয়ে যায়।

সে ঘুমিয়ে পড়ে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...