অনির্বাণ ভট্টাচার্য
কল্যাণীয়েষু খোকা,
আশা করি কুশলে আছ। আজ সন্ধ্যায় পাশের একটি মাঠে খেলা দেখিতে গিয়াছিলাম। বৃষ্টি হইয়াছিল বোধকরি কিয়দকাল পূর্বে। কাদায় মাটিতে শনাক্ত করিবার দায় রহিয়া যায়। বালকগুলির যেন অবিকল তোমারই মুখ। বোধকরি বহুদিন কথা না হওয়ায় আজকাল সকলকেই তোমারই মতো দেখিতে লাগিতেছে। ইহাকে অসুখ হিসেবে ধরিতে পারো, তবে বৌমাকে কহিও না। বলটি হাঁটুতে আঘাত করিয়াছিল। হাঁটিতে অসুবিধা হইতেছে। তবে যন্ত্রণাবোধ নাই। ইদানীং যন্ত্রণা বোধ করি পার্থিব কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গে হয় না। টুবলুকে দেখিলাম। কমলার সহিত আসিতেছে। দেখিলেই ছুটিয়া আসিত। ইচ্ছা হইল না। কী জানি, না বুঝিয়া বালকের কিছু অনিষ্ট করিতেছি কিনা। আজ দিনটি প্রফুল্ল হইয়া থাকিত। তোমার মা যতদিন ছিলেন, অথবা তাহার পরেও, তোমাকে গৃহে সবার অলক্ষ্যেই দেখিতাম, একমনে পড়িতেছ। তোমার সহিত বাক্যবিনিময় কত আর হইত, সমীহ করিতে, আমিও স্বভাবজাত পৌরুষে মা-সন্তানের চৌহদ্দিতে পা রাখিতে সচেষ্ট হইনি। পড়িয়াছ কি? ‘মন কি আজও লালন চায়? মনকে বলো না, বলো না।’ না পড়িলে পড়িও। সংগ্রহ করিয়াই দায় সারিয়া উঠিয়া পড়িও না। বউমা, টুবলুকেও পড়াইও। আমার মনও লালন চাহিত। মাসিক বসুমতী, বারান্দা, ছাদ লাগোয়া অশ্বত্থের ভ্রূকুঞ্চন আমার ভারি ভালো লাগিত খোকা। কুন্তলীনের ঘ্রাণ। তোমাকে বিস্তৃত বলিতে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইতেছি। বিরক্ত হইতে পারো। তবে, মৃত্যুর পরেও ওই নারী, তোমার মা, ওই ঘ্রাণ ছাড়িয়া বাহির হইতে পারেন নাই। তোরঙ্গের বাম পার্শ্বে তাঁহার আলতা পায়ের ছবি রাখা। খোকা, গৃহ বিক্রি করিবে শুনিতেছি। আমার সহিত আলোচনা করো নাই। তবু অযাচিত হইয়াই কহিতেছি, বাকি সমস্ত যাক। ওই চিহ্নদুটি কোথাও তুলিয়া রাখো। নতুবা, কষ্ট হইবে। একদিন ভাত ফেলিয়া দিয়াছিলাম ক্রোধে। তখন হইত খোকা। ক্রোধ। রিপু। সামলানো দুষ্কর হইত। রন্ধনের সামান্যতম তারতম্যে। নিভৃতে কাঁদিয়াছিল। আমি আপিস গিয়াছি। জলস্পর্শ করি নাই। অনুতাপে। পরের দিন স্থৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিল। আর তুমি আসিলে। বীজ। সেই রাত্রেই। ইদানীং কষ্টটা বাড়িতেছে বাবা। নিঃশ্বাসে। বুকে বল কমিয়া আসিতেছে। তোমাদের কবি লিখিয়াছিলেন প্রহর জোড়া ত্রিতাল। আমিও পাই। তালজ্ঞান নাই। তবে রাত্রের আঁধারে বোধকরি জলের হদিশ কোথায় ঠাহর করিতে না পারিয়া শব্দ করি। তুমি কি অতদূর হইতে কোনওকিছু শুনিতে পাও খোকা? শুনিয়াছি রাত্রে, শীতে শব্দ তীব্র হয়। তুমি তো লেখো শুনিয়াছি। পড়াও না যদিও। প্রত্যেক কবির নিজস্ব রাত্রির অধিকার থাকে। কে যেন কহিয়াছিল খোকা? আমার স্মৃতি, ভারসাম্য কিছুই কর্মক্ষম নয়। যন্ত্রণা হয়। তবে, চিন্তা করিও না খোকা। আজ জন্মদিন ছিল। আমার। তোমার মা মনে রাখিয়া পায়েসান্ন রাঁধিতেন। নিজের দিনটি ভুলিয়া যাইতেন। আমিও জানিতাম না, কবে। আহারটি সারিয়া চুপি চুপি উঠিয়া পড়িতাম। আজও উঠিলাম। বিড়বিড় করিলাম। নিজের কানেও পৌঁছাইল না। জনান্তিকে হইবে বোধ করি। চিঠিটা পোস্ট করিলাম না। পিওন হাসিবে। লোকলজ্জা। টুবলুকে বলিয়াছি চিঠি আছে বাবার, তোমার ডায়েরির ভিতর রাখিয়া আসিবে সে। ওখানে থাকিলে একান্তই তোমার হইবে। শুনিলাম, তুমি আমার ঘরে আসিয়াছিলে। কী আর বলিবে? অর্থ হয়ত। বৌমাকেই সময় করিয়া পাঠাইয়া দিও। লেনদেনের সম্পর্ক ভালো লাগে না। আর তাছাড়া, এখন আর অর্থের প্রয়োজনই বা কী? কদিন আর আছি? তুমি ‘বীজ’ পড়িয়াছ খোকা? রমাপদবাবুর? পড়ো। ‘মরিবার হল তার সাধ’। তোমাদের অন্ধকারের কবির লেখা না? অথবা এক অকুলান হারাইয়া যাওয়া। কাল সকালে ঘরের সমস্ত কাগজপত্র পরিষ্কার করিব। পিছুটান। টেবিল জুড়িয়া পুরাতন বই, ছবি, আরও কত কী। কিছু কি ছিল? দেখিতে হইত শেষবার? তোমার মা’র কোনও কিছু? কু ডাকিবে হয়ত। থাক। আর দেখিবার কিছু নাই। কমলাকে ডাকিয়া সব ফেলিয়া দিব। তুমি, তোমরা, কুশলেই থেকো।
শ্রীচরণেষু বাবা,
তোমাকে যখন চিঠিটা লিখছি, আজ তালগাছের সারির ফাঁক দিয়ে সন্ধে নামার দৃশ্য চোখে ভাসছে। তালগাছ। বাইপাসের কাছে আছে না? তুমি তো হাঁটতে যাও প্রায়ই। দেখেছ কোনওদিন? সন্ধে বলতে ছোটবেলা মনে পড়ে। মা’কে না বলে ওবাড়ির লাল্টুর সঙ্গে মিলিদির বাড়ি গেছিলাম। মিলিদি সন্ধে নামাত। ছাদের ঘরে। ঠিক যখন বিকেল পড়ত। চুল খুলে দিত। লাল্টু আর আমি। মিলিদি বলত, ‘আয়, অন্ধকার’। আসত। সেদিন ফিরে এলাম গায়ে জ্বর নিয়ে। ভাবলাম কেউ জানবে না। তবু, আমি তো জানি। ছাদের ঘরের জানলা খোলা ছিল। পাশের বাড়ির লাগোয়া চোখ। মা’র কাছে খবর গেল। ভয়। তোমাকে না, মা’কে। তবু, বলেনি কিছু। একদিন পড়ছি। পাশ থেকে শাঁখা পলার গন্ধ পেলাম। ‘হ্যাঁ রে, মিলির কীসের কষ্ট? আইবুড়ো, মা-মরা মেয়ে। একদিন আসতে বলিস। চোখে জল দেখলাম।’ এই নারী কে? আমি তো চিনি না। তোমাকে এসব কথা বলতাম না বাবা। কিন্তু ওই, সন্ধে…। সন্ধের কথা উঠল। তাই…। গলির ক্রিকেট মনে আছে বাবা? তিনটে বাঁশের টুকরো। মাঝে কতটা ফাঁক। গলে গেলে বোঝাই যেত না। তবু, আমরা আউট হতাম। একদিন পড়া ফেলে খেলছি। হাফ ইয়ারলি পরের দিন শুরু। তুমি ফিরলে। এত তাড়াতাড়ি? কিছু বললে না। ব্যাটটা নিলে। ভোম্বল দৌড়ল ভয়ে। বিলু, তনু, পিকলু সরে গেল। আমি পিঠ পাতলাম। আজ পড়বে। অপেক্ষা। আমার দীর্ঘতম মুহূর্ত। বিজ্ঞান। আপেক্ষিকতা। কিছু হল না কেন? নাকি, আমি নিঃসাড় হয়ে গেছি? পেছন ফিরলাম। তুমি স্টান্স নিচ্ছ। ওদিকে দেখি ভোম্বল ফিরছে। হাতে বল। চোখে আশ্চর্যময়তা। একটা পুল। ঈশান কোণের সরকারদের ছাদের লাগোয়া ট্যাঙ্কের দেওয়ালে বল। এখনও গেলে দাগটা পাব হয়ত। ওইটুকুই। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চলে এলে। কিছু বললে না। আমি, তারপর থেকে পড়া ফেলে আর কিছুই করিনি। গলির ক্রিকেট ওদিনই শেষ। আমার কাছে। এখনও টুবলু ক্রিকেট খেলছে দেখলে তোমার ওই পুলটা মনে পড়ে। বাবা তুমি আমার গ্রিনিজ, আমার ভিভ ছিলে। ছেলেটার কথা উঠলে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ওর মা। ভালোবাসা। সেই নিঃশ্বাস। কেউ কারওটা পাই না। শুধু ছাদটুকু আছে। দোষ কারও না। দোষ ছেলেটার। কেন জন্মাল? মাঝে মাঝে ওকে পাথরের মতো ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হয়। তারপর রাতের অন্ধকারে ঘুমের ভেতর হেসে ওঠা আমার অপত্য। পাথরটা ফিরে আসে আমার দিকে। মুখটা ভেঙে দেয়। একদিন আয়না ভেঙে দিলাম বাথরুমের। রিপেয়ারিং। তখন ওরা বাইরে ছিল কদিনের জন্য। তুমি শব্দ পেয়েছিলে কি? শয়তান, আশ্চর্য এক শয়তানকে দেখেছিলাম। আমায় বলল, খুন কর, রক্ত খা নিজের। বাবা, আমি রক্তস্রোত বুঝি। পচা, ভ্যাপসা। একেকদিন জানলা খুলতে ইচ্ছে হয়। একেকদিন এয়ার কুলারের ভেতর নিজের মাথাটা গলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। তারপর সরে আসি। ডাউন পেমেন্টটা করা আছে। এবাড়ি আমায় আটকে রাখবে। কিছু করতে দেবে না। মা’র গন্ধ, ওই অলক্তরাগ আমায় পা ফেলতে দেওয়ার আগেই জাপটে ধরবে। তাই, এবাড়ি ছাড়তে হবে। টুবলু ছোট। ওর মা। নতুন ফ্ল্যাটে ওরা দুজন থাকবে। তুমিও। ও তোমাকে ভারি ভালোবাসে বাবা। ভালোবাসবে। ভালো রাখবেও। শুধু আমি ওর জীবনটা ছিনিয়ে নিলাম বলে যা কিছু সমস্যা। তোমারই রক্ত পেয়েছি তো। তাই, তোমার ওপরও অভিমান। আমি যেতাম না। থাকতাম। এই অবসাদকে মারতে চাইছি। আয়নাটাকে, ওই ভেতরের শয়তানটাকে মারতে চাইছি। ঘটনাচক্রে ওরা আমারই ভেতর। তাই …। চিঠিটা দিয়ে গেলাম বাবা। আটকাবে না জানি। সে বাঁধন কোথায়? আর তাছাড়া কদিন তো আছি। কথা বলবে? মারবে একদম ছোটবেলার মতো? যা খুশি করো, সেদিনের ক্রিকেট গলির ভেতর ওই পুলটার পর যেভাবে তাকিয়েছিলে, ওভাবে চেও না। কে জানে, মৃত্যু শব্দটা হয়ত আজীবন বৈরিতা তৈরি করবে। বাকি কটা দিন আর লিখব না কিছু। লেখা আসছে না আর। লেখা বড় বিষাক্ত। নীলকণ্ঠ জীবন তলিয়ে নিয়ে যায়। ডায়েরিটা ফেলে দেব কাল। পাতা, ভেতরের চিঠি, কবিতা, খুলব না কিছুই। অনেক না পাঠানো লেখা ছিল। থাক। এ’কটা দিন টুবলু, ওর মা— জীবন ভরে থাকুক। তুমিও… ভালো থেকো বাবা।
পুনশ্চ — শুভ জন্মদিন। শঙ্খবাবুর ‘ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’ কিনেছি। তোমার জন্য। দিলাম তোমায়। সুভাষ, বুদ্ধদেব, শম্ভু মিত্র। কত সব ঘটনা। পড়ো বাবা। আসি।
গল্পটা মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। সম্পর্কের মাঝে এমন দেয়ালগুলো কত প্রিয় দৃশ্যপট দেখা থেকে বঞ্চিত করে। একদার প্রিয়জন কাছে থেকেও চলে যায় যোজনদূরত্বে। উদ্ভিদ কিংবা ইতর প্রাণীকূলের মধ্যে এমনটা হয় কিনা জানা নেই.. মানুষের মধ্যেই মনে হয় এমনটা ঘটে..পাথর সময় ঠেলে একের কাছে অন্যের আর পৌঁছানোই হয় না