সোমা মুখোপাধ্যায়
আদিকাল থেকেই প্রকৃতিলগ্ন বা প্রকৃতিনির্ভর মানুষের কাছে ঋতুপরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা যারা শহুরে মানুষ, তারা অনুভব করতে পারি না যে প্রকৃতি আজও সরাসরি গ্রামীণ মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে কত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। লীনা চাকী সম্পাদিত 'হৃদয়' পত্রিকার একটি পুরনো সংখ্যা (বার্ষিক সংকলন, জানুয়ারি ২০১১), যার মূল বিষয়ভাবনা ছিল 'ধান', তার অনন্য সম্ভার থেকে এবারের স্টিম ইঞ্জিনের জন্য বেছে নেওয়া হল বাংলার নবান্নের ভাবনা ও উদযাপন নিয়ে একটি লেখা। এই হেমন্তে খানিক নতুন ধানের গন্ধ লেগে থাকুক আমাদের পাঠকদের হৃদয়ে।
হেমন্ত আমন ধানের বিশেষ উৎসব নবান্ন। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে মাঠ থেকে পাকা ধান ঘরে তোলে কৃষক। নতুন শস্যে পরিপূর্ণ হয় তার গোলা। শুভদিনে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে পাকা ধান থেকে সযত্নে চাল তৈরি করে বাড়ির বউ-মেয়েরা। নতুন এই চাল গৃহস্থের ব্যবহারের আগে নিবেদন করতে হয় পিতৃপুরুষ, দেবদেবী, আত্মীয়স্বজন এমনকি পশুপাখিকেও। এভাবেই সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে নতুন ধানের উৎসব, ‘নবান্ন’।
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁর ‘নবান্ন’ প্রবন্ধে বিষয়টিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ধান্যলক্ষ্মী ভগবানের কৃপা। উহা আমার নহে। ভগবতীর বাৎসল্যধারা মূর্তিমতী হইয়া ধান্য-সম্পদ রূপে আমার ক্ষুধা নিবৃত্ত করিতেছে। লক্ষ্মীকে লক্ষ্মীরূপেই বরণ করিতে হয়, আর যাঁহার করুণা ধান্যের স্বর্ণাবরণের অন্তরালে
শস্য-রূপে প্রাণপ্রদ, তাঁহারও পূজা করিতে হয়। তবে ইহার মহিমা থাকে, আমার জীবনেরও সার্থকতা হয়। নবান্ন এই ভাবটিরই অভিব্যঞ্জনা।
তাই নবান্নের দিনে শুদ্ধ-স্নাত হইয়া দেবতাকে উৎসর্গ করিয়া আত্মীয়স্বজন পরিবারের সহিত এবং পাড়া-প্রতিবেশীকে ডাকিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া নবান্ন পার্বণ পালন করিতে হয়। রসাল, সুগন্ধী নতুন অন্ন যখন গ্রহণ করিব, তখন সেই বিশাল রসসিন্ধুতে মিলিয়া যাইব, তবে তো অন্নের মহিমা রহিবে! কেবল শুধু ক্ষুধার বস্তু বলিয়া গ্রহণ করিলে রসের হ্রাস হয়, মিষ্টত্ব লোপ পায়, অমৃত-আস্বাদ থাকে না। সেখানে কেবল অনিবার্য অতৃপ্তি, জ্বালাময় ভোগ-লালসা।
নবান্নের অন্ন আমরা একা গ্রহণ করি না আত্মীয়-স্বজনকে দিই, পাড়া-প্রতিবেশীকে বিলাই, গ্রামের সকলকে সাধিয়া বিতরণ করি। পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ সকলকে অর্পণ করি। কেন? না করিলে আমি পশু হইয়া যাইব। ধারাচ্যুত হইয়া পঙ্কিল পল্বলে পরিণত হইব। বিরাটত্বে ব্রহ্মত্বে আমার চরম পরিণতি। আমার অনুভূতিও বিরাট হওয়া চাই, তাই ঐ অন্নদানের ব্যাপকতা। আমার যে ক্ষুধা বিশ্বেরও ক্ষুধা। ইহাই নবান্ন তত্ত্ব।’ [[১]]
নবান্নের মধ্যে প্রাচীন গ্রামসংগঠনের যৌথ-সংস্কৃতির অবশেষ লক্ষ করা যায়৷ পরিবার থেকে সমাজে এই উৎসবের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে এই উৎসব। সেখানে গৃহস্থ নিজে যেমন থাকেন তেমনই থাকেন তাঁর বাড়ির কাজের লোক। জমি থেকে ধান কাটা থেকে শুরু করে উৎসবের জোগাড় পর্যন্ত, প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাদের কোনও না-কোনওভাবে অংশগ্রহণ থাকে। তাই যেদিন নবান্ন হয় সেদিন হয়ে যায় অলিখিত ছুটি৷ এই জন্য নবান্নকে অনেকে ‘সমবায়মূলক উৎসব’ বলে মনে করেন।
শস্যোৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়কে কেন্দ্র করে কৃষিজীবি সমাজে যে নানা ধরনের আচার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে নবান্ন নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম। এখনকার মতো সেকালে তো সারাবছরব্যাপী ধান চাষের এতো বাড়বাড়ন্ত ছিল না। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফসল উঠতো। আমন ধানই ছিল বছরের প্রধান ফসল। তাই তাকে কেন্দ্র করেই এই নবান্নের আয়োজন ছিল। এই বিষয়টি এতোই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে একটা সময় অগ্রহায়ণ মাসেই বছরের শুভারম্ভ হত। অগ্রহায়ণ নামটাই সেই ইঙ্গিতবাহী।
দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর ‘পল্লীবৈচিত্র’ বইটিতে নবান্ন বিষয়ে একটি সুন্দর প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি নবান্নের খুঁটিনাটি পাঠকদের কাছে পেশ করেছেন। গোবিন্দপুর গ্রামের মজুমদার পরিবারের নবান্ন তাঁর কথনের মূল প্রতিপাদ্য, – ‘আজ অগ্রহায়ন মাসের পাঁচুই তারিখ। গ্রামের পণ্ডিত সার্বভৌম মহাশয় পঞ্জিকা দেখিয়া বলিয়াছেন, নবান্নের আজ অতি প্রশস্ত দিন, তাই আজ গোবিন্দপুরের ঘরে ঘরে নবান্নের ধূম পড়িয়া গিয়াছে। হিন্দু পল্লীতে আজ আনন্দ কলরবের বিরাম নাই৷ আজ পাঠশালা বন্ধ। গুরুমহাশয় ভিন্ন গ্রামে যজমানবাড়ি নবান্ন করিতে যাইবেন। পাঠশালার ‘পড়ো’ আজ মনের আনন্দ চাপিতে না পারিয়া বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সকল বাড়িতেই নবান্নের উদ্যোগ চলিতেছে৷ কিন্তু মজুমদার-বাড়ির আয়োজনই কিছু অতিরিক্ত। নবান্ন করিবার জম্য বড়কর্ত্তা ও মেজকর্ত্তা চাকরীস্থান হইতে বাড়ি আসিয়াছেন।’ [[২]]
নবান্ন লৌকিক উৎসব। তাই একসময় হয়তো ফসল গোলাজাত করার পর থেকে যে কোনও দিনেই তা পালন করা হত। কৃষকের জীবনে সমগ্র অগ্রহায়ণ মাসই তো শুভ, কেননা, এই মাসেই তো আমন ধান পাকার সময়। কিন্তু যখন কৌম সমাজ আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে শুরু করল, তখন ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিও আত্মসাৎ করতে চেষ্টা করল লোকায়ত সংস্কৃতিকে। তাই পাঁজি দেখে নবান্নে বরাত দেওয়ার দায়িত্ব বর্তাল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ওপর।
নবান্নে পিতৃশ্রাদ্ধের অংশটুকু ছাড়া যাবতীয় কাজ করে মেয়েরা। কেন এই পিতৃশ্রাদ্ধ? ‘প্রাচীন শাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও করণীয় কর্তব্যের নির্দেশ রয়েছে৷ কথিত আছে, বর্ষোপক্রম, নবোদক, গৃহ-প্রচ্ছাদন ও নূতন ধান্যোৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষেরা অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। নবান্নে পার্বণ বিধি দ্বারা পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ করা বিধেয়। শাস্ত্রে আছে নবান্ন-শাস্ত্র না করে নূতন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়।’ [[৩]] কিন্তু এত গেল শাস্ত্রবাক্য, যা অবশ্যই পরবর্তীকালের। তাহলে মূল বিষয়ভাবনাটা কী? এখানেও কিন্তু বিশেষ লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের ইঙ্গিত আমরা পাই যা একান্তই ব্রাত্যসংস্কৃতি লালিত। ‘শাঁখ বাজিয়ে পূর্বপুরুষদের আত্মাকে আহ্বান করা বা তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত অন্ন কাকের রূপ ধরে তিনি গ্রহণ করেন – এই বিশ্বাসের মূলে আছে আদিম কৌমসমাজের প্রেতপুজো বা টোটেমভাবনার অনুষঙ্গ।’ [[৪]]
বাংলার নবান্নের মতো নতুন শস্যকে বরণ করার মতো এমন উৎসব বিশ্বের খুব অল্প দেশেই দেখতে পাওয়া যায়৷ কৃষকের ঘরের আঙিনা পার হয়ে এই উৎসব সামাজিক জীবনে পারস্পরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্য রক্ষায় এক নির্মল আনন্দানুষ্ঠান হয়ে যায়। হেমন্তলক্ষ্মীকে গৃহস্থ স্বাগত জানায় নবান্নের মধ্য দিয়ে। আমন ধানের নতুন চাল, নতুন গুড় আর দুধ দিয়ে তৈরি হয় নবান্ন। স্নান সেরে শুচি হয়ে একে স্পর্শ করতে হয়। নবান্ন মাখেন পরিবারের মেয়েরা। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের বইতে একসময় নবান্নের আয়োজন কীভাবে হত তার একটি সুন্দর বিবরণ দেওয়া রয়েছে। পূর্বকথিত মজুমদারবাড়ির বিধবা কন্যা কাত্যায়নী নামের চরিত্রটির সাহায্যে তা পাঠকদের জন্য উপস্থাপিত করেছেন:
…..অবশেষে নবান্নের আয়োজন আরম্ভ হইল। আচার্য্য-কত্তির্ত কলার পেটকোগুলিতে তিনি নবান্নের জন্য গৃহে প্রস্তুত আতপ চাউল এক মুষ্টি রাখিয়া, একটা বড় পাত্রে কতকগুলি ফলমূল-আখ, শাঁকালু, কলা, মূলো, নারকেল চাকা চাকা করিয়া কাটিয়া রাখিলেন এবং একটা বড় পাথরের খোরায় এক খোরা কাঁচা দুধ একটা ‘খেত্তুরে’ বাটিতে এক বাটি নতুন খেজুরে গুড় ও বড় পিতলের রেকাবীতে বাতাসা, কাঁচাগোল্লা, গুড়ে মোণ্ডা প্রভৃতি মিষ্টান্ন রাখিয়া দিলেন; ছেলেমেয়েরা অদূরে বসিয়া সদ্যস্নাতা সিক্তকেশ শুভ্রবসনা পিসিমার কাণ্ড দেখিতে লাগিল।’ [[৫]]
নবান্নের আয়োজন মেয়েরা করলেও শাস্ত্রোক্ত আচারটি পরিবারের পুরুষরাই করেন। এক্ষেত্রেও মজুমদার পরিবারের জৈষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণধন স্নান সেরে পট্টবস্ত্র পরে সারা শরীরে চাদর আবৃত করে নবান্নের পিতৃশ্রাদ্ধ করতে বসলেন। তাঁর সামনে কুশের আসনে উপবিষ্ট পরিবারের পুরোহিত।
‘…প্রথমে দেবগণ ও স্বর্গগত পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশে সেই নতুন আতপান্ন ভক্তিভরে উৎসর্গ করিয়া দিয়া, অবশেষে তিনি চাউল, দুধ, গুড়, ফলমূল, সমস্ত সেই প্রকাণ্ড পাথরের ‘খোরাটা’তে ঢালিয়া মাখিয়া লইলেন…।’ এরপর চলল সমস্ত পরিবার পরিজনবর্গ ও ইতরপ্রাণী বিশেষকে নবান্ন বিতরণ। লিখছেন, ‘…তখন ছেলেরা কলাপাতে অল্প পরিমাণ নবান্ন লইয়া চারদিকে ছুটিয়া চলিল, কেহ ছাদের উপর কাক শালিখ প্রভৃতি পাখীর জন্য তাহা রাখিয়া আসিল, কেহ ঢেঁকির ঘরে গিয়া ইঁদুরের গর্ত্তে খানিক ঢালিয়া দিল; মাছকে নবান্ন খাওয়াইতে একটি ছেলে নদীতে চলিল; একটি ছেলে খানিকটা নবান্ন গরু বাছুরের জন্য গোয়ালঘরে লইয়া গেল; কেহ শৃগালের জন্য চাট্টি চাউল, খানদুয়েক শাঁকালু ও একটুকরো পাকা কলা লইয়া বাঁশবনে কিংবা আঁশশ্যাওড়ার জঙ্গলে ফেলিয়া আসিল। সকল প্রাণীর জন্য নবান্ন বিতরিত হইলে, গৃহস্থ পরিবারবর্গ একত্র সমবেত হইয়া, দুধ গুড় ও নানাবিধ ফলমূলমিশ্রিত নবান্ন খাইতে আরম্ভ করিল। বাড়ির বৌ-ঝিরাও এক এক বাটি চাউল লইয়া রান্নাঘরের বারান্দায় উনুনের ধোঁয়ায় ভিজে চুলে পা মেলিয়া বসিয়া, নতমুখে সিক্ত তণ্ডুলরাশি চর্বণ করিতে লাগিল। রাখাল, কৃষাণ ও পরিবারস্থ অনুগত ব্যক্তিগণ সকলেরই নবান্ন হইয়া গেল, এমনকী গ্রাম্য ভিখারীগণ ছোট ছোট ছেলে মেয়ে কোলে লইয়া ভিক্ষা করিতে আসিয়াও এই আনন্দরস আস্বাদনে বঞ্চিত হইল না। যে সকল ছেলে মেয়ে জ্বর প্লীহায় ভুগিতেছে দুধ বার্লি ভিন্ন ডাক্তার যাহাদিগের জন্য অন্য পথ্যের ব্যবস্থা করেন নাই, তাহারা পর্যন্ত দুটি চাউল মুখে দিয়া আজ নিয়মরক্ষা করিতেছে।’ [[৬]]
সব বাড়িতেই সেদিন নবান্নের আয়োজন থাকে। না পারলে কোনও বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়, নতুবা গ্রাম্যদেবতার সামনে নিবেদিত প্রাসাদটুকু পাওয়ার অধিকার তার থাকে। দারিদ্রের জন্য এই ব্যবস্থাটুকু থাকে।
এদিক দিয়ে বিচার করলে নবান্ন সমাজের সকল বাধা ডিঙিয়ে পরস্পরকে নিকটে আনার এক মিলন-উৎসব। সমাজের ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সকলেই নিজের মতো করে এই উৎসবে সামিল হয়। যার সামর্থ্য থাকে না এই উৎসবের আয়োজন করা সমাজ অলক্ষে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। কখনও গ্রামদেবতার মন্দিররূপে, কখনও বা মহাজন বা মনিববাড়ির মাধ্যমে।
গ্রামবাংলায় নবান্নকে ঘিরে যে উৎসব তার রেশ এখনও আছে, কিন্তু প্রাবল্য হয়তো ততটা নেই। নগরায়নের চাপে তার অনেকটাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু কেমন ছিল সেই উৎসব, তার আয়োজনই বা কেমন ছিল এ বিষয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষকদের লেখাই সে প্রমাণ বহন করে চলেছে।
অগ্রহায়ণ বাংলার অষ্টম মাস। কিন্তু এককালে এই মাসকেই প্রথম মাস বলে ধরা হত। এ সম্পর্কে কামিনীকুমার রায় বলেছেন, ‘একদিন হয়তো ‘আগন মাসে রাঙ্গা ধানে জমীনে ফলে সোনা’ এই দৃশ্যই সাধারণ মানুষকে অগ্রহায়ণ হইতে বৎসর গণিতে প্রণোদিত করিয়াছিল। কারণ চন্দ্র সূর্যের গতি লক্ষ্য করিয়া বৎসর গণনা তাহাদের পক্ষে সম্ভব নয়। স্বভাবের বিশেষ লক্ষণ দর্শণ করিয়াই সাধারণ মানুষ এক সময়ে বৎসর গণনা আরম্ভ করিত। অগ্রহায়নের এক অর্থ – শ্রেষ্ঠ ধান্য। বৎসরের শ্রেষ্ঠ ধান্য সেসময় উৎপন্ন হয়। সেই অগ্রহায়ণ মাস হইতে তাই তাহাদের পক্ষে বৎসর গণনা আকস্মিক নয়। অগ্রহায়নের এই শস্য প্রাধান্যই হয়তো তাহাকে মাসসমূহের মধ্যে প্রথম স্থান দিয়াছিল।’ [[৭]]
অগ্রহায়ণ মাসের আমন ধানের সুবাসে ভরা নবান্ন উৎসব, প্রকৃতিও এই সময় তার রূপ বদলায়। গ্রামবাংলায় ধান কাটার পর গৃহস্থের যে অবকাশ মেলে নবান্নের সঙ্গে কোথায় যেন তার একাত্মতা হয়ে যায়। একটা দিনের জন্য যে অবসর মেলে তাকে উপভোগ করে মানুষ।
সাধারণ মানুষ নবান্ন উপলক্ষে যে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিক পরিবেশন করে এমন নজির পাওয়া যায় নানা গানে, ছড়ায়। এমনই একটি আলকাপ গান—
গান করি পুকুরপাড়ে
নবান খেলাম বাবুর ঘরে
পাতা পুরে পেট পুরে
লাঠি হাতে খানসামা
নতুন ধানে হবে নবান
রঙ পাঁচালি আলকাপের গান
চুন-সুপারি মিঠা পান
নতুন বউয়ের ভানা ধান।(সৌজন্যে করুণাকান্ত হাজরা, মুর্শিদাবাদ)
এই যে নবান্ন-উৎসব, এ শহরসংস্কৃতির ধারে কাছে নেই। আগে হয়ত ছিল, কিন্তু শহুরে কালচার বিনোদনের নানা উপকরণ অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে নবান্নকে। আসলে এখানে তো ধান চাল নিয়ে কোনও কৃষকপরিবার থাকে না। তাই তাদের কাছে আজও এই উৎসব ঠিক যতটা গুরুত্বপূর্ণ, শহরে তা নয়। এখনও গ্মেহ্রী গ্রামে নবান্ন আলোড়ন আনে, ঘরে ঘরে নবান্নের নিমন্ত্রণ, রান্না-খাওয়া আর ধর্মীয় রীতি পালনের মধ্যে রয়ে গেছে আমাদের বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির জরুরি একটা রূপ।
[[১]] নবান্ন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, সন্ধ্যা, অমরেন্দ্র রায় সম্পাদিত বাঙালীর পূজাপার্বণ, পৃষ্ঠা ৭২
[[২]] পল্লীবৈচিত্র, দীনেন্দ্রকুমার রায়, পৃষ্ঠা ৪১
[[৩]] নবান্ন, বাংলা লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, সম্পাদনা দুলাল চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৩২২