শতাব্দী দাশ
ঘটনা এক :
মেয়ে বাড়ি ফিরে গম্ভীর। কী হয়েছে? ‘আজ ম্যাম আবার একই কথা বলেছে।’ কী বলেছে? ‘অনুভবকে বলেছে— মেয়েদের মতো কেঁদো না৷ আমার এসব ভালো লাগে না।’
ছোট মেয়েটি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে৷ বয়স পাঁচ-ছয়। সে স্কুলে ভর্তির সময়েই, অধ্যক্ষা অভিভাবক-সভা ডেকে আশ্বস্ত করেছিলেন : ‘বাচ্চাদের জন্য মনোরঞ্জক নানা সামগ্রী আছে প্লেরুমে, যেমন ছেলেদের জন্য গাড়ি আর মেয়েদের জন্য পুতুল।’ মেয়েটি অবশ্য বাড়িতে শিখেছে, পুতুল বা গাড়ি সব কিছু নিয়েই খেলার অধিকার তার আছে৷ তেমনই শিখেছে যে ছেলেরা কাঁদলে আকাশ ভেঙে পড়ে না এবং মেয়ে-মাত্রই ছিঁচকাঁদুনি নয়। এইসব না শিখলে হ্যাপা ছিল না৷ কিন্তু যেহেতু সে তেমনটা শিখেছে, তাই স্কুলে বিপরীত কিছু শেখালে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তার মনে। শিক্ষিকারাও তো তার কাছে, মায়ের মতোই, ‘ইনফলিবল’। দুঃখের বিষয়, শিক্ষিকা ভেবে দেখেননি যে তাঁর এইসব ছোটখাটো উপমায় বাচ্চা মেয়েগুলি নিজেদের দুর্বল ভাবতে শিখবে, ছোট ছেলেগুলি কান্না চেপে জোর করে অতিমানবিক হতে চাইবে। অনবধানে তিনি বৈষম্যের ফাটলে আরেকবার গাঁইতি চালিয়েছেন৷
ঘটনা দুই :
আবারও একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুলের কথা। প্রথম শ্রেণিরও পূর্ববর্তী একটি শ্রেণিতে ইংরাজি ভাষাশিক্ষার জন্য আছে খানপাঁচেক বই। ভাষাশিক্ষা দান করা হচ্ছে মনোগ্রাহী বৈজ্ঞানিক উপায়ে। কিন্তু কনটেন্ট দেখলে অবাক হতে হয়।
‘-o-‘ family-র শব্দাবলির কথাই ধরা যাক। এমন সব শব্দাবলি শেখানো হচ্ছে, যার মূল vowel-টি হল o. O-র আগেপিছে consonant বসে শব্দ তৈরি হচ্ছে, সেই শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। কীরকম বাক্যে? অনেকটা এরকম—
Mom likes to mop.
Mom has a big job.
She spins like a top.
Dad likes to jog.
I like to hop.
Mom says, ‘Stop!
Sit on the spot.
Let me mop.’
We stop.
We sit on the spot.
Mom mops.
She spins like a top.
চ্যাপ্টারের নাম ‘My Mom’। মায়ের কাঙ্খিত আচরণ সম্বলিত এক অধ্যায়। শিশুদের মনে জেন্ডার-স্পেসিফিক ডিভিশন অফ লেইবার (লিঙ্গের ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন)-এর ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হল প্রথম শ্রেণিরও আগে থেকে। নতুন কিছু নয় অবশ্য। ‘সহজ পাঠ’-এ অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লিখেছিলেন— ‘ডাক পাড়ে ও ঔ/ভাত আনো বড় বৌ’।
প্রতি শ্রেণিতে নানাভাবে এই সব শিখতে শিখতে এবং সামাজিক আদানপ্রদানের মাধ্যমেও একই হেজিমনির সংস্পর্শে আসতে আসতে, এই শিশু কিশোর হবে। মেঝে নোংরা দেখলে বা রান্নায় নুন কম হলে মায়ের উপর চোটপাট করবে। সে পুরুষ হলে মায়ের পর স্ত্রীর থেকেও একই সাংসারিক ভূমিকা প্রত্যাশা করবে। সে নারী হলে একইরকম সামাজিক ভূমিকার ছাঁচে নিজেকে গড়ে তোলার সাধনা করবে। স্বাভাবিক নয়?
ঘটনা তিন :
একটি বাচ্চা মেয়ে শারীরিক কিছু অসুবিধে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এল। চিকিৎসক জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝলেন, মেয়েটি গৃহশিক্ষকের দ্বারা যৌনভাবে নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিদিন৷ মেয়েটির বয়স বছর দশ। চিকিৎসক সে কথা জানালেন তার বাবা-মাকে। তাঁরা গৃহশিক্ষককে ছাড়িয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ৷ কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিলেন না৷ বেমালুম চেপে গেলেন ঘটনাটি৷ নাহলে নাকি মেয়েটির বদনাম হবে৷ মেয়েটি নিজেকে ‘সস্তা’ ভাবতে শিখল, শিখল তার অপমান নিয়ে মুখর হওয়ার প্রয়োজন নেই। শিখল, তার নির্যাতন তার জন্যই লজ্জার, নির্যাতকের জন্য নয়। এরপর বড় হয়ে সে আকছার নির্যাতিত হবে বাসে-ট্রামে-স্কুলে-কলেজে-অফিসে। তার চুপ করে থাকার অভ্যাস তার নির্যাতকদের সুবিধা করে দেবে। বাবা-মাকেও সে হয়ত আর জানাবে না কিছু। তাদের উপর সে আস্থা হারিয়েছে। জেনেছে, এই নির্দিষ্ট বিষয়ে বাবা-মা অসহায় ও ঠুঁটো৷
*********
বৈষম্যের পাঠ
এ’কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের সমাজ মূলগতভাবে লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক। সেই বৈষম্যের বিষের মধ্যেই আমাদের শিশুরা শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের তা থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই। নিজেরাই একই বিষবাষ্প শুঁকেছি আশৈশব, তাই তা থেকে মুক্তির উপায় অনেক ক্ষেত্রেই অজানা। বলা বাহুল্য, উপরের তিনটি ঘটনাতে যথাক্রমে শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা ও বাবামার ভূমিকা সামাজিক লিঙ্গবৈষম্যকে চিরস্থায়ী করতে সাহায্য করছে। প্রকারান্তরে, আমরাই আমাদের শিশুদের হয় নির্যাতক নয় মূক নির্যাতিত হিসেবে গড়ে তুলছি। একে কি সমষ্টিগত অসচতেনতা তথা সমষ্টিগত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বলা যায় না? এই আগামীই কি আমরা চাই?
লিঙ্গবৈষম্যের কথাই যখন উঠল, তখন এক্ষেত্রে ‘লিঙ্গ’ বলতে আমরা ঠিক কী বোঝাতে চাইছি তা প্রথমে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। জেন্ডার স্টাডিজের পাঠ শুরু হয় ‘sex vs. gender’ পার্থক্যের শিক্ষা দিয়ে৷ শারীরিকভাবে শিশুটি যে লিঙ্গচিহ্ন নিয়ে জন্মেছে, তাকে তার ‘sex’ বলা চলে। বার্থ সার্টিফিকেটেও যেমন ‘মেল’, ‘ফিমেল’ বা ‘আদার’ উল্লিখিত থাকে ‘সেক্স’ হিসেবে। কিন্তু উক্ত ‘সেক্স’-এর প্রতিটি মানুষের থেকে যে সামাজিক প্রত্যাশা, যে গুণাবলী তার উপর তার ‘সেক্স’-এর ভিত্তিতে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, উক্ত ‘সেক্স’-এর কারণে তার থেকে যে ধরনের আচরণ, স্বভাব, আগ্রহ, কর্মদক্ষতা ইত্যাদি আশা করা হয়— সেসবের যোগফল, জেন্ডার স্টাডিজের পরিভষায়, তার ‘gender’ নির্মাণ করে। বাংলাভাষায় যখন প্রথম লিঙ্গ-রাজনীতি নিয়ে লিখতে শুরু করি, তখন ‘সেক্স’ ও ‘জেন্ডার’-এর জন্য পৃথক বাংলা প্রতিশব্দ হাতড়াতে হয়েছিল। আপাতত এদের যথাক্রমে ‘জৈবিক/জন্মগত লিঙ্গ’ ও ‘সামাজিক লিঙ্গ’ বললেও চলে। সুবিধার্থে, ইংরেজি ‘সেক্স’ ও ‘জেন্ডার’ টার্ম দুটিও ব্যবহার করা যায়। শিশুকে বড় করে তোলার পথে লক্ষ্য হওয়া উচিত তার ‘জন্মগত লিঙ্গপরিচয়ের’ সঙ্গে তাকে পরিচিত করা, কিন্তু সেই পরিচয়কে তার সামগ্রিক অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র না হতে দেওয়া। তাই যদি হয় পাখির চোখ, তবে প্রতি মুহূর্তে তার ‘সমাজ-নির্মিত লিঙ্গ’ বা ‘জেন্ডার’-কে চ্যালেঞ্জ করা ছাড়া গতি নেই।
সমাজ ‘জন্মগত লিঙ্গের’ ভিত্তিতে শিশুর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে একেবারে তার জন্মের সময় থেকে। পুরুষ ও কন্যা শিশুর জন্য থাকে জামাকাপড়, চুলের বিন্যাসের পৃথক নিদান। তারপর বৈষম্য আসে তাদের ব্যবহৃত খেলনায়, তাদের জন্য নির্দিষ্ট ‘অ্যাক্টিভিটিজ’-এ। শিশুর সঙ্গে বড়রা যে ভাষায় কথা বলেন বা বড়রা নিজেরা যে ভাষায় ভাব বিনিময় করেন, তার মাধ্যমেও ঘনায় বৈষম্য, কারণ কে না জানে ‘শব্দই ব্রহ্ম’! মেয়েটিকে আমরা ‘সুন্দর, মিষ্টি’ বলে প্রশংসা করি। ছেলেটিকে বলি ‘বীর, বুদ্ধিমান, চৌকস’। অতঃপর একে একে আসে রূপকথার গল্প, পুরাণ, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সিরিয়াল, অ্যানিমেশন, বিজ্ঞাপন, এমনকি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ডিসকোর্স— যাদের অনেক উপাদানই পিতৃতান্ত্রিক।
**********
যা কিছু আমাদের ঐতিহ্যগত, আশৈশব
আমাদের শিশুপাঠে আছে—
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল তিন কন্যা দান।
এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন এক কন্যা খান,
এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান।’
এতই নিরীহ এই উপস্থাপনা যে মনে হয় শিবঠাকুরের তিন কন্যাই প্রাপ্য ছিল। অতঃপর শিশুকন্যার মনে ছড়ায়-ছড়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় ‘বর আসবে এখুনি’ স্বপ্ন। বস্তুত, ‘বিয়ে’ বিষয়টি দিয়েই ‘সিন্ডারেলা’ বা ‘স্নোহোয়াইট’ ঘরানার সব গপ্প শেষ হয়, যাদের শেষ লাইনটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরকম ‘..and they lived happily ever after’. অর্থাৎ বিবাহকে মোক্ষ ভাবার অভ্যাস তৈরি করে দেওয়া হয় শিশুকন্যার মনে, সেই শৈশব থেকেই৷ পুরনো আমলে না হয় বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ সিদ্ধ ছিল, কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে বাল্যশিক্ষায় তা এত অনায়াসে স্থান পায় কেন? শিশুপাঠ্য ছড়ায় যখন চাঁদের আলোয় খুকুমণির বিয়েতে হাতি-ঘোড়া নৃত্য করে, শিশুতোষ গল্পে যখন পঙ্খীরাজে চেপে উড়ে আসে রাজপুত্র আর রাজকন্যাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় দূর দেশে, তখন বিবাহ-পরবর্তী নির্যাতন-সম্ভাবনা বা গৃহহিংসার বাস্তবতার উপর একখানি কালো চাদর সন্তর্পনে টেনে দেওয়া হয়৷ কন্যাশিশুকে শেখানো হয় না, বিয়ে একটি চয়েজ মাত্র, এ’ ছাড়া তার হাতে সম্পর্ক-বিষয়ক আরও কিছু চয়েজ আছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, কোনওমতেই বিয়ে একটি ‘কেরিয়ার’ নয়। শেখানো হয় না, বিবাহ সততই সুখের নাও হতে পারে। পুং শিশুকেও শেখানো হয় না, রাজকন্যারা নানা শারীরিক আকার-আকৃতির অধিকারিণী হতে পারে; তাদের ইচ্ছে, স্বভাব ও আগ্রহ হতে পারে নানা কিসিমের৷ কোনও রাজকন্যা ফুটবল খেলতে ভালোবাসতে পারে, কোনও রাজকন্যা পাহাড় ডিঙোতে৷ শেখানো হয় না যে বিয়ে করে ফেলা নয়, বরং সম্পর্ক ও সঙ্গীকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়াই জীবনের লক্ষ্য বলে পরিগণিত হতে পারে।
পশ্চিম বাংলায় শিশুদের মধ্যে এককালে প্রচলিত ছিল ‘এলাটিং বেলাটিং সই লো’ নামক খেলার ছড়া, যেখানে ‘রাজা একটি বালিকা চাইলো’ আর অমনি সেই বালিকাকে ‘নিয়ে যাও, নিয়ে যাও’ বলে সমর্পণ করাই ছিল দস্তুর।
শৈশবের সঙ্গে জড়িত সবকিছুই, সুতরাং, সহজ-সরল নয়৷
‘তাই তাই তাই’ ছড়ায় সেই যে ‘মামী এল লাঠি নিয়ে, পালাই পালাই’ পড়া গেছিল, সেই মামীই হলেন আধুনিক হিন্দি-বাংলা সোপ সিরিয়ালের দজ্জাল কুটিলাদের পূর্বসূরি। অবশ্য সেই মামীরও আগে আমরা নারীচরিত্র সৃষ্টিতে বাইনারি পাই রূপকথায়। রূপকথা এমনিতেই নিপাট সাদা-কালোর জগত, ধূসর চরিত্রের সেখানে ঠাঁই নেই৷ উপরন্তু, ভালো ও মন্দ মহিলা-চরিত্রদের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে কিছু বৈশিষ্ট্য। ভালো মেয়েরা হবেন অসহায় ও নিষ্ক্রিয়। হবেন বশ্য, কোমল, সুন্দরী ও পুত্রসন্তানধারণে সক্ষম। কর্মদক্ষতা, বুদ্ধি, উচ্চাকাঙ্খার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে আছে, তারা নেহাতই মন্দ মেয়ে— কুচুটে সৎ মা, ষড়যন্ত্রী সুয়োরানি, রাক্ষসী, খোক্কসী বা ডাইনি।
লেভি-স্ট্রস স্ট্রাকচারালিস্ট পদ্ধতিতে মিথ পড়তে চেয়েছিলেন। যদি আমরা তাঁর গঠনবাদী পদ্ধতির সঙ্গে নারীবাদী তত্ত্বের চলনসই একটা সংশ্লেষ ঘটাই ও সেই নিক্তিতে রূপকথা পাঠ করি, তাহলে দেখা যাবে একইরকম সংকট, সংকটমোচন ও পুরস্কারপ্রাপ্তির স্ট্রাকচার কম-বেশি সব গল্পে। সংকট মূলত এক ভালো মেয়েকে ঘিরে, যে হল ‘ডেইমজেল ইন ডিস্ট্রেস’। সেই সঙ্গে পুরুষ নিজেও কোনও সংকটে থাকতে পারে অবশ্য। কিন্তু সংকটমোচন করবে পুরুষই, গল্পের নায়কই। অসহায় ভালো মেয়েরা শুধু পুরুষের হাতের জিয়নকাঠির ছোঁয়ার জেগে উঠবে। পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়টিও মনোগ্রাহী। কলাবতী রাজকন্যার গল্পে ঢোল-ডগর যার, রাজকন্যা তার। ‘পাতালকন্যা মণিমালা’ গল্পে নির্দিষ্ট অ্যাডভেঞ্চার শেষে রাজকন্যা লাভ করা যাবে। ‘শীত-বসন্ত’ গল্পে গজমোতি আনতে পারলে রাজকন্যা মিলবে, ‘লালকমল আর নীলকমল’ গল্পে খোক্কস মারতে পারলে রাজকন্যা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, সব গল্পেই মেয়েটি নিষ্ক্রিয় অথচ মূল্যবান একটি বস্তু। সে স্বয়ং গাজরের মতো বীর নায়কের সামনে ঝোলানো, সুকর্মের মাধ্যমে যাকে ভোগদখলের অধিকার পাওয়া যায়।
উপরিউক্ত চারটি উদাহরণ দেওয়া হল বাংলা শিশুসাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রাচীন রূপকথার বই, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার কর্তৃক সংকলিত ও সংগৃহীত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ থেকে, যা ১৯০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়া, বিদেশি রূপকথায় হোক, বা অধুনা ‘গুগাবাবা’-তেই হোক, নারীকে পুরস্কার রূপে প্রাপ্তির স্ট্রাকচার সর্বত্র বিদ্যমান।
সাম্প্রতিক মনোগবেষণা বলছে, ডিজনি-চলচ্চিত্র দেখা ও বার্বি নিয়ে খেলার ফলে সৃষ্ট ‘প্রিন্সেস ইফেক্ট’ শিশুকন্যাদের জন্য খুব সুখকর নয়। শিশুপুত্র বা শিশুকন্যাকে যখন এইসব গল্প শোনানো বা দেখানো হয়, তখন কল্পনাতে তারা নিজেদের সত্যিকারের রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা ভাবতে শুরু করে। মেয়ে-শিশুদের মধ্যে এর প্রভাবকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘প্রিন্সেস ইফেক্ট’।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিংহাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সারাহ কোয়েন ১৯৮ জন শিশুর (যাদের গড় বয়স ৫ বছর) ওপর একটি গবেষণা চালান এক বছর ধরে। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব মেয়ে-শিশুর নিজের দেহ নিয়ে অসন্তোষ আছে, তাদের বেশিরভাগই ডিজনি-রাজকুমারীদের চলচ্চিত্র দেখে বড় হয়েছে। সুন্দরী এবং নিখুঁত দেহের এই রাজকুমারীদের দেখে তারা এখন থেকেই ছিপছিপে গড়নের শরীর চাইছে। এই প্রবণতা বড় হওয়ার পর মারাত্মক বডি-ইমেজ-প্রব্লেমের সৃষ্টি করতে পারে। জেসমিন, এলসা, স্নো হোয়াইট, সিন্ডারেলা, এরিয়েল কিংবা বেল— জনপ্রিয় এই ডিজনি-কন্যাদের সরু কোমর, বড় বড় চোখ আর টুকটুকে গাল দেখে বড় হওয়া মেয়েরা সময়ের আগেই নিজেদের মূলত ‘মেয়ে’ ভাবতে শিখছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা গ্রিম ভাইদের সংগৃহীত ১৬৮টি রূপকথার গল্প পর্যালোচনা করে দেখান যে শতকরা ৯৪ ভাগ কাহিনিতেই নারীর নমনীয় শারীরিক সৌন্দর্যের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে। এমনকি, একটা গল্পে ১১৪ বার নারীর সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ এসেছে। ছোট ছেলেদের মনেও এই বয়সেই একই ধরনের জিনিস পড়ে, শুনে বা দেখে ‘নারীসৌন্দর্য’ সম্পর্কে গতে-বাঁধা ধারণা বদ্ধমূল হয়।
এ তো গেল রূপকথা, শিশুসাহিত্য ও তা থেকে নির্মিত কার্টুন-ছবির কথা৷ প্রতিনিয়ত শিশুর চোখে পড়ছে যেসব বিজ্ঞাপন-চলচ্চিত্র ইত্যাদি, তাদেরই বা কী ভূমিকা? আশির দশকে প্রেশার কুকার-এর বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘জরুরত হ্যায়…এক শ্রীমতী কি, কলাবতী কি, সেবা করে জো পতি কি’। এখন ভাষ্য খানিক বদলেছে। ‘যো বিবি সে করে প্যার, ও প্রেস্টিজ সে ক্যায়সে করে ইনকার?’ উপস্থাপনা বদলালেও সংসারে স্ত্রীর ভূমিকার তেমন পরিবর্তন হয়নি। সে হতেই পারে পেশাগত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু গৃহলক্ষ্মী হিসেবে তার পরিচয়ই প্রাথমিক ও মূলগত৷ স্ত্রীকে ভালোবাসলে তাকে ‘প্রেস্টিজ’-এর নানা হোম অ্যাপ্লায়েন্সে ভরিয়ে দিতে হবে, যাতে সে আরও দক্ষতার সঙ্গে ঘরবার সামলাতে পারে— এই হল মূল উপজীব্য। এসবও শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গী। ছায়াছবিতে দেখানো হয়, নায়িকা অসম্মত হলে তাকে সন্ত্রস্ত করে পিছু নেওয়া নায়কের অবশ্যকর্তব্য। শেখানো হয়, নায়িকার ‘না’ মানে অবশ্যই ‘হ্যাঁ’। কৈশোরে এসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে বড় হতে থাকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম৷ ‘মেয়েলি’ ও ‘পুরুষালি’-র ধারণা দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় তাদের মনে। অপরাধকে ‘নর্মালাইজ’ করতে শেখে তারা।
ইনডক্ট্রিনেশনের পথে অতঃপর আসে ধর্ম। প্রথাগত ধর্ম তো সমাজবিচ্ছিন্ন কোনও প্রতিষ্ঠান নয়। লোক-ইতিহাস আর সমাজবাস্তবতা তার পরতে পরতে। নারীকে কেন্দ্র করে বাইনারি সেখানেও। একদিকে নারী দেবী, অন্যদিকে ‘কামিনী-কাঞ্চন’ ত্যাগই সাধনার অন্যতম শর্ত। আবার খ্রিস্ট ধর্মে নারী প্রত্যক্ষভাবেই ‘নরকের দ্বার’। এহেন সমাজে নারীর রজঃস্রাবকে যে অশুচি ধরা হবে, রজঃস্বলা নারী যে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা পাবে, ব্রহ্মচারী ঈশ্বর আয়াপ্পার সাধনায় ব্যাঘাত এড়াতে গায়ের জোরে ঢুকতে দেওয়া হবে না মহিলা ভক্তদের, সে আর আশ্চর্য কী? রামায়ণ-মহাভারত তথা পুরাণও নারীর তৎকালীন সামাজিক অবস্থানকেই মাথায় রেখে রচিত। তাই আধুনিক লিঙ্গ-রাজনীতির সঙ্গে তাদের বিরোধ স্বাভাবিক।
কতটা প্রাকৃতিক, কতটাই বা সমাজনির্মাণ যাবতীয় লিঙ্গভিত্তিক তফাত? ‘Pink Brain, Blue Brain’ বইতে নিউরোসায়েন্টিস্ট লিজ এলিয়ট পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্কের সামান্য তারতম্য কীভাবে বিশালাকার ব্যবধানে পরিণত হয় সামাজিক প্রশিক্ষণ তথা ইনডক্ট্রিনেশনের ফলে, তা বর্ণনা করার চেষ্টা করছেন। এতে ভূমিকা নেয় বাবা-মা, শিক্ষক, পরিবার, প্রতিবেশী, বান্ধবমহল, সমাজ-সংস্কৃতি— সকলেই ও সবকিছুই। এরা যে যার মতো করে লৈঙ্গিক স্টিরিওটাইপকে শিশুমনে চিরস্থায়ীরূপে গেঁথে দেয়।
এলিয়ট বলেন, ছেলেদের ‘অঙ্ক করার ক্ষমতা’ বেশি ভালো নয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তাদের মগজ ‘স্পেশিয়াল রিজনিং’-এ বেশি দক্ষ। ‘মেয়েরা স্বভাবতই আবেগপ্রবণ’ নয়, কিন্তু ‘আবেগ প্রকাশের সুযোগ ও স্বাধীনতা’ মেয়েদের অনেক বেশি।
জিন ও হরমোন অবশ্যই কিছু বিভেদ সৃষ্টি করে, কিন্তু সেগুলি অমোঘ নয়৷ যেমন, যে কোনও পুরুষের স্পেশিয়াল রিজনিং বা শারীরিক ক্ষমতা যে কোনও মেয়ের থেকে বেশি— এমন ধরে নেওয়ার কারণ নেই৷ তফাত কিছু থাকলেও তা ভবিষ্যতের বিরাট ব্যবধানের সূচনা-বিন্দু মাত্র৷ এরপর মূল বিভাজনরেখা টানার কাজটি করে শিশুর সঙ্গে সমাজের মিথোষ্ক্রিয়া। শিশুর প্রতি বড়দের সামাজিক আচরণ কীরকম, কীভাবে আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলি, কীভাবে তাদের শ্রম, অ্যাডভেঞ্চার, অ্যাক্টিভিটিজ, বুদ্ধিমত্তায় প্রতিক্রিয়া জানাই, সে’সবের গুরুত্ব অসীম। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে বিচার করলে কিছু ফারাক পাওয়া যায় গড় পুরুষ ও গড় নারী মস্তিষ্কে। কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে বিচার করলে আমাদের সকলের মধ্যেই আছে মিশ্র বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনা। সেই অমিত-সম্ভাবনার অপমৃত্যু হয় বৈষম্যমূলক সামাজিক শিক্ষার দ্বারা।
*********
উত্তরণের পথ
একটি নির্দিষ্ট বই-এর প্রচারার্থে নির্মিত একটি ভিডিও মনে পড়ছে, যা হয়ত আমরা অনেকেই দেখেছি। সেটি ‘সিণ্ডারেলা’-র পুরুষায়নের উপর নির্মিত, বলা যায়। গল্পে নায়কের নাম সিন্ডারফেলা। সে সৎ বাপ ও ভাইদের দ্বারা অত্যাচারিত। মূল গল্পে যা যা আমাদের স্বাভাবিক মনে হয়েছিল— বল-নাচের জন্য আদেখলাপনা, কুমড়ো-ইঁদুর-গডমাদারের অনস্বীকার্য ভূমিকা, রাত বারোটার পর রাস্তায় মেয়েদের বেরোনোয় কারফিউ, জুতোর সূত্র ধরে বাগদত্তা খোঁজা— সেসবই, ‘সিন্ডারেলা’-র বদলে ‘সিন্ডারফেলা’ আবির্ভূত হওয়ায় হাস্যকর ঠেকে৷ একটা মজার সংলাপ আছে এই ভিডিওতে, অনেকটা এরকম :
সিন্ডারফেলা : ‘কাচের জুতো? কাচ কি বিপজ্জনক নয়?’
বামন : ‘সুন্দর হওয়ার মানেই যন্ত্রণা সহ্য করা, সেটাও জানো না?’
কার্টুন-শেষে ভেসে ওঠে একটি প্রশ্ন : ‘আমাদের ছেলেদের যদি আমরা এমন রূপকথা পড়ে না শোনাই, তবে মেয়েদের পড়ে শোনাব কেন?’ এরপরে পর্দায় উদয় হন এলেনা ফাভিলি ও ফ্রাঞ্চেস্কা কাভালো। তাঁদের রচিত বইটি পেশ করেন : ‘গুড নাইট স্টোরিজ ফর রেবেল গার্লস’।
বইতে ১০০ জন মহিয়সী নারীর কীর্তি-কাহিনি বর্ণিত আছে, ছবিসহ। এদের মধ্যে আছেন রেস্টুরেন্টের শেফ, চিত্রকর, বিচারক, টেনিস খেলোয়াড়, সব পেশার মহিলা৷ লেখিকাদ্বয় বলেন, তাঁরা তাঁদের মেয়েবেলায় যত গল্পকাহিনী শুনেছেন বা পড়েছেন, তার কোনওটিতেই একটি মেয়ে তার নিজের ভাগ্য নিজের হাতে গড়েনি। সবসময়েই কোনও রাজপুত্র বা ভাই কিংবা নিদেনপক্ষে কোনও নেংটি ইঁদুর তাদের সহায় হয়েছে৷ বিবিসি-র একটি সমীক্ষার সূত্র ধরে তাঁরা আরও বলেন, এসবের ফলেই এলিমেন্টারি স্কুলে পৌঁছানোর আগেই মেয়েদের আত্মবিশ্বাস ছেলেদের চেয়ে কমে যায়। তাই তাঁদের নতুন রূপকথা-নির্মাণের এই প্রচেষ্টা।
রূপকথা বা শিশুপাঠ্য সাহিত্যের মাধ্যমে সরল উপায়ে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভর নৈতিক ধারণা শিশুর মনে সহজে গেঁথে দেওয়া যায়। অশুভর বিরুদ্ধে শুভর জয়লাভ একটি কমন মোটিফ, যা শিশুকে সচ্চরিত্র হতে অনুপ্রাণিত করতে পারত৷ কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের ভালো-মন্দ বা শুভ-অশুভর ধারণা সবসময় রাজনীতিবিহীন, নিরীহ নয়, কালোত্তীর্ণ তো নয়ই৷ কল্পনার বিস্তারে রূপকথার ইতিবাচক কিছু ভূমিকা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তা পড়ার বয়সে শিশুমনে সমালোচনামূলক প্রশ্ন জাগে না। ঘটনার ঘনঘটায় মুগ্ধ শিশুকে প্রশ্ন করতে শেখাতে হবে। রাজার কেন সাত রানি? রাজকন্যা কেন শুধু ঘুমন্ত আর অধীন? সৎমায়েরা কেন কুটিল আর হিংসুটে? রানিকে কেন পুত্রসন্তান জন্ম দিতেই হবে? রূপকথাকে এককথায় নিষিদ্ধ করা হলে ‘নিষিদ্ধ’-র প্রতি শিশুর আকর্ষণ বাড়তে পারে। সুতরাং আপাতত রূপকথা-পাঠের সঙ্গে সঙ্গে, শিশুসাহিত্য পাঠের সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে এইসব প্রশ্ন করতে শেখানোও দরকারি।
একই কথা প্রযোজ্য যেকোনও পাঠ্য বই বা যেকোনও দর্শ-শ্রাব্য বিনোদনের জন্য।
পশ্চিমে এখন অনেক রূপকথা লেখা হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে, চরিত্রগুলোর লৈঙ্গিক পরিচয় পাল্টে দিয়ে। সুইডেনের ‘অলিকা পাব্লিকেশন’ এমনই ছক ভাঙা বই প্রকাশের চেষ্টা করছে অনেক দিন ধরে। ‘ফুটবল স্টার’ সিরিজের বইগুলোর প্রচ্ছদে দেখা যায়, ফুটবল পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে মেয়ে, ল্যাবরেটরিতে কাজ করছে আবিষ্কারক জোহানা নামের চশমা পরা গম্ভীর এক বালিকা, এমনকি জলদস্যুর গল্পগুলোতেও সমুদ্রে জাহাজ হাঁকিয়ে চোখে কালো পট্টি বেঁধে মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে মেয়েরা। ‘পুরুষেরা কখনও কাঁদে না’, এমন ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে লেখা বইয়ের নাম ‘বাবা কেন কাঁদেন?’ ডিজনি-ও কিন্তু নিজেদের প্রোডাকশনের খোলনলচে বদলের দিকে মন দিয়েছে বহুদিন। এসেছে ‘Brave’ বা ‘Frozen’ বা ‘The Princess and the Frog’ বা ‘Moana’-র কিঞ্চিৎ অন্যরকম মেয়েরা।
সামাজিকভাবে, আমরা জানি, ‘নারীসুলভ’ এবং ‘পুরুষালি’ গুণাবলীর দুটি পৃথক সেট আছে। দুটি সেটের মধ্যেই আছে কিছু কিছু অর্জনীয় গুণ, কিছু কিছু বর্জনীয় দোষ। ছেলেকে যেমন শেখাতে হবে কান্না লজ্জার নয়, মেয়েকেও শেখাতে হবে রাগ ক্ষোভ গিলে ফেলে সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি হওয়ার দায় তার একার নয়। ‘পুরুষসুলভ’ সাহস, শৌর্য ও ‘নারীসুলভ’ আবেগপ্রবণতা, স্নেহ, সমমর্মিতা— এ’সবের সমন্বয়েই আদর্শ মানুষ গড়ে ওঠে। পুতুলখেলা বা ফুটবলখেলা— উভয়েরই নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে শিশুর জীবনে। প্রথমটি শিশুর সামাজিক-প্রাক্ষোভিক বিকাশে সাহায্য করে, দ্বিতীয়টি তার সাইকোমোটর বা শারীরিক দক্ষতা বাড়ায়, পাসিং, কিকিং ইত্যাদি তাদের স্থানিক বুদ্ধিমত্তা বা স্পেশিয়াল রিজনিং বৃদ্ধি করে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে আমরা তো চাইবই এমন ছেলে, যার ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স তাকে কঠিন সময়ে টিকে থাকতে সাহায্য করবে, চাইব এমন মেয়ে যে প্রযুক্তিগতভাবে স্বনির্ভর (টেক-স্যাভি) এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তা করতে গেলেও জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভাঙার ইতিবাচক তৎপরতা প্রয়োজন।
আবার অতি-তৎপরতাও বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুইডেনে পুং/স্ত্রীবাচক সুইডিশ সর্বনাম (he/she যেমন ইংরেজিতে)-এর বদলে জেন্ডার-নিউট্রাল সর্বনাম ‘হেন’ ব্যবহৃত হয় এমনকি নার্সারি স্কুলেও। ইউটিউব-এ সার্চ করলে সহজেই জানতে পারা যায় সেই সুইডিশ দম্পতির কথা, যারা এখনও পর্যন্ত সন্তানদের জানতে দেননি তারা ছেলে না মেয়ে। এ’ যেন একরকম চরমপন্থী ব্যবস্থাকে জব্দ করতে আরেকরকম চরমপন্থী ব্যবস্থা। ইম্পেরিয়াল স্কুল অফ লন্ডনে গবেষণারত পার্সোনালিটি সাইকোলোজিস্ট স্টেলা মাভ্রোভেলি বলছেন, এতে শিশুর মনে আরও সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। সে যদি পরবর্তীকালে ট্রান্সসেক্সুয়ালও হয়, তবে তার রূপান্তরকামিতা নিশ্চয় প্রথমত তার জন্মগত ‘sex’-কে জেনে তবেই তাকে বদলে ফেলার একটি চেষ্টা হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাচ্চার কাছে ‘সেক্স’ লুকিয়ে রাখার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তার ‘জেন্ডার’ এবং তজ্জনিত স্টিরিওটাইপকে কাঁটাছেঁড়া করা এবং প্রয়োজনে বিসর্জন দেওয়া।
তথাকথিত ‘পুরুষালি’ বৈশিষ্ট্যের সবটাই যদিও বর্জনীয় নয়, তবু ছেলেদের লৈঙ্গিক পরিচয়ে দীক্ষিত হওয়ার পন্থাটি অনেকক্ষেত্রেই বিষাক্ত, তার নিজের ও অন্যের পক্ষে ক্ষতিকর৷ ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’-র শিক্ষাও তারা খেলাচ্ছলেই পায়। ছেলেদের বড় হয়ে ওঠার অঙ্গই হল সেই সব পুরুষালি আড্ডা যেখানে নারীকে যৌনবস্তু ভাবতে শেখানো হয়। পর্ন দেখা বা ব্যক্তিগত যৌন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেই শেখা আটকে থাকে না৷ রাস্তা-ঘাটে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে শুধুমাত্র যৌনবস্তু হিসেবে মেয়েদের মাপতে মাপতেই সে যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে নির্ভয়া কাণ্ডের কিশোরটির মতো। প্রথাগত প্রশিক্ষণের ফলে বিবাহিত স্ত্রীকে সে রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমেই ব্যক্তিগত যৌন-খেলনা হিসেবে দেখতে শেখে। অথবা দেখতে শেখে গৃহশ্রমিক হিসেবে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে। এইসব সমাজ-নির্মিত প্রত্যাশার ব্যত্যয় ঘটলে শুরু হয় অশান্তি, নির্যাতন। বস্তুত, নারীবাদী মেয়ে গড়ে তোলার চেয়ে নারীবাদী ছেলে গড়ে তোলা ঢের কঠিন। তাই শুধু মেয়েদের পুরুষালি গুণের অধিকারী হলে চলবে না। শুধু মেয়েদের শিক্ষা, প্রতিষ্ঠা, স্বনির্ভরতার গুরুত্ব বোঝালে জেন্ডার-নিউট্রাল সমাজ গঠন করা যাবে না। ছেলেদেরও শেখাতে হবে ঘরকন্না, শেখাতে হবে প্রতিপালনের মাধুর্য, শেখাতে হবে সহমর্মিতা, প্রেম, করুণা এবং আরও যত কোমল স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। গ্লোরিয়া স্তেইনেম বহুপূর্বেই বলে গেছেন, ‘We’ve started to raise our daughters like sons, now we must be brave enough to raise our sons like daughters.’
অন্যদিকে মেয়েরা নিজেরাও নিজেদের যৌনবস্তু ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে শেখেনি বলেই যৌন অপরাধ নিয়ে সরব হতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত। শুরুতে বর্ণিত তিনটি ঘটনার মধ্যে তৃতীয় ঘটনার কন্যাশিশুটির মতোই, তারা শিখেছে যে একটি যৌন নির্যাতনের ঘটনা নির্যাতকের চেয়ে নির্যাতিতর জন্য বেশি লজ্জার৷ তারা শেখে, যৌন নির্যাতন হল তাদেরই বেশ্যাসুলভ পোষাক, আচরণের ফল। কৈশোর থেকেই মা-মাসির কাছে তারা এসব শেখে। তাই বহু বছরের অবদমিত ক্ষোভের উদগীরণের জন্য #মিটু আন্দোলন প্রয়োজন হয়।
শিশুদের যৌন-সুরক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে তাদের ‘গুড টাচ/ব্যাড টাচ’-এর বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন অবশ্যই৷ কিন্তু সেখানেই শিক্ষার শেষ নয়। মেয়েটি যেন না শেখে যে তার শরীরে যে কোনও ‘ব্যাড টাচ’-এর জন্য সে-ই দায়ী। যেন শেখে, শুধু যৌন অত্যাচার নয়, কোনওরকম অত্যাচারই তার প্রাপ্য নয়। ‘এশিয়ান প্যাসিফিক ইন্সটিউট ফর জেন্ডার বেসড ভায়োলেন্স’ ২০০২ সালের সামিটে একটি স্পাইরালের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল, কীভাবে নারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি হিংসাত্মক কুণ্ডলীতে আবর্তিত হয়। এই নির্যাতন প্রকৃতিগতভাবে হতে পারে, হতে পারে যৌন, শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা বৌদ্ধিক। এই মরণ-কুণ্ডলীতে শিশুকন্যার প্রবেশ আটকাতে গেলে তার বাবা-মা-শিক্ষককে, তার পারিপার্শ্বিককে আগাপাশতলা বদলে ফেলতে হবে ইনডক্ট্রিনেশনের ছিরিছাঁদ৷
শরীর নিয়ে অসীম হীনম্মন্যতার প্রতিষেধক হিসেব মেয়ে-শিশুকে ছোট থেকেই শেখানো যায় যে সুন্দর আসলে নানারকম; তা নির্ভর করে দেখার চোখের উপর৷ তাকে বোঝানো যায় যে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ অনুষ্ঠানে সব সময়ই রাজকন্যা সাজতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। বরং কোদাল হাতে কৃষক কিংবা একতারা হাতে বাউল বা হাঁটুতে নি-গার্ড বাঁধা ক্রিকেটার– যেকোনও কিছুই সে সাজতে পারে। ছেলেরা মেয়েলি পোষাকে সাজতে চাইলেও উৎসাহ জোগানোই কর্তব্য৷
শিশুর খেলনা বা অ্যাক্টিভিটিজে বৈষম্য আনা চলবে না যেমন, লিঙ্গের ভিত্তিতে তাকে বিশেষ হেয়ারস্টাইল বা জামার রং-এ বাধ্য করা যেমন চলবে না, তেমনই নিজেদের ভাষা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ‘এইতো ব্যাটাছেলের মতো কাজ!’ বা ‘ওমা, তোমার বর রাঁধতেও পারে!’ ধরনের আপাত-নিরীহ বিস্ময়-প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন। ‘কপাল ভালো যে তুমি মেয়ের মা! মেয়েরা তো শান্ত হয়!’ ধরনের শুভেচ্ছাও না জানালেই মঙ্গল। ‘মেয়ে তোমার একদম ছেলেদের মতো চৌকশ’-ও ততটা মনোগ্রাহী প্রশংসা নয়। আবার, ১৬-২৪ বছর বয়সী ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দেখে সন্দেহাতীতভাবেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ‘ছেলেরা কাঁদে না’ এখুনি একটি নিষিদ্ধ বাক্য হওয়া বাঞ্ছনীয়, তার উচ্চারণ আশু বন্ধ করা প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে বাচ্চা ছেলেদের নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলায় উৎসাহিত করা দরকার।
শুধু শিশুর প্রতি আচরণের সময়েই নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাবা-মা নিজেরা পরস্পরের প্রতি কীরকম আচরণ করছেন, কীভাবে যৌথ সম্পর্কে আছেন, সেই সম্পর্কে নির্যাতন আছে কিনা, বাবা বাড়ি ফিরে গেরস্থালি বিষয়ে মায়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নাকি নিজেও তৎপর, তিনি বাড়ির কাজে হাত লাগান না শুধু হুকুম করেন, বাড়িতে বাবার মর্যাদা মায়ের চেয়ে বেশি কিনা— এইরকম নানা ছোট-বড় বিষয় থেকে শিশু তার সামাজিক প্রশিক্ষণের সূত্রগুলি চটপট ধরে নেয়। সুতরাং সচেতন শিক্ষাদানকে লিঙ্গবৈষম্যে-মুক্ত করলেও, অসচেতন আচরণেও থাকতে পারে বৈষম্যের বীজ। সংযত ও সতর্ক হতে হবে সে’সব বিষয়েও৷
পড়াশোনায় সময় হোক বা খেলাধূলার সময়, একসাথে বেড়ে উঠতে দিতে হবে শিশুদের। পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে উঠতে দিতে হবে। লিঙ্গগত ঠিক/ভুল তাদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে তাদের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের দিকে বরং এগিয়ে দেওয়া যাক কয়েক ধাপ। কেউ নিজের লিঙ্গ-পরিচিতির ছক ভেঙে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে চাইলে তাকে শর্তহীন সমর্থন জানানো যাক। ভাবনার স্তরে যতটা, প্রায়োগিক স্তরে তার চেয়েও বেশি কঠিন এইসব প্রচেষ্টা৷ কিন্তু বৈষম্যহীন আগামী চাইলে বাবা-মা-শিক্ষক-পরিবার-শিক্ষাব্যবস্থা-রাষ্ট্র— সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চেষ্টা না করে উপায় কী? বৈষম্যের মেইজে বারবার বিভ্রান্ত হচ্ছে যে শিশু, তাকে আঙুল ধরে সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্ব বড়দেরই নিতে হবে৷ চেষ্টাটা অন্তত শুরু করা যাক।
অসাধারণ প্রবন্ধ। যেমন অনন্য বিশ্লেষণ, তেমনি সুন্দর উপস্থাপনা।