আর্কাদি গাইদারের ফেবুদেওয়াল থেকে

আর্কাদি গাইদার 

 

রবিবার সকাল বলতেই মনে পড়ে ধোঁয়া ওঠা গোবিন্দভোগ চালের গলা ভাত। আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ। ডিমের কুসুমটা নরম থাকতে হবে। হাসের ডিম হলে তো কথাই নেই। গরমকালে আমুলের মাখন, শীতকালে ঘি। আর সাথে দাঁত দিয়ে কাঁটার জন্যে একটা কাঁচালংকা। তবে শুরুটাই এটা দিয়ে হত না।

সকাল হলেই দাদুর সাথে হাত ধরে বাজার। সেখানে বাজারের গেটের খবরের কাগজ বিক্রেতার থেকে কেনা হত একটা নারায়ণ দেবনাথ বা ডায়মন্ড কমিক্স। তারপর সেই কমিক্স হাতে ধরিয়ে দাদু আমাকে বসিয়ে দিত মাছ কাটবার গৌতমদার চাতালের পাশের খালি জায়গায়। এরপর দাদু বাজার ঘুরত, আড্ডা মারত, চা খেত, বোর্ডে গণশক্তি লাগাত। আর আমি হাতে কমিক্স নিয়ে বসে থাকতাম আর গল্প করতাম গৌতমদার সাথে, বা উলটোদিকের মাছবিক্রি করা সুভাষকাকু, সুরেনদা (যে আমার দাদুর থেকেও বড়, কিন্তু দাদু সুরেনদা বলত তাই আমিও সুরেনদা বলতাম), মুরগীর দোকানের নাসিরকাকুদের সাথে। এবং অবশ্যই যারা বাজার করতে আসছে সেই সমস্ত অঞ্চলের লোকজনদের সাথেও। সেটা গত শতাব্দীর নয়ের দশকের প্রথম ভাগ। তখনও স্থানীয় মানুষজন একে অপরের মুখ চিনত। লোকসংখ্যাও কম ছিল। এরপর বাড়ি ফিরে মাকে দেখানোর জন্যে পড়তে বসা। মানে টুলে বই রেখে ঝিমোনো। দশটা অবধি এই নাটকটা করে যেতেই হত। দশটা বাজলেই টিভিতে জাঙ্গল বুক শুরু। জাঙ্গল বুকের সাথেই সাথেই চলে আসত ওপরে বর্ণিত ভাত, ডিম, আলুর স্বর্গীয় কম্বিনেশন। গোটা বাড়ির লোকজনই ওটা খেত। সেইসময় লোকজন লো-কার্ব, লো-কোলেস্টেরলের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল না। তখন টিভিতে মোটে দুটো চ্যানেল। তবে আমাদের মতন ছোটদের জন্যে রবিবার সকালে ওই দুটো চ্যানেলই স্বর্গরাজ্যের দ্বার। সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা ডিজনির জগত। টেল স্পিন। ডাক টেলস। এরপর সাড়ে এগারোটা থেকে পাড়ার মাঠ। সেই মাঠে একসাথে খেলতে আসত ফ্ল্যাটবাড়ি, কমপ্লেক্স, বস্তি, বিভিন্ন আর্থসামাজিক স্তরের শিশুরা। ফুটবলে খরচা কম। ক্রিকেটে খরচা বেশি। তবুও ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয় ছিল।
মোটামুটি বাড়িগুলো থেকে চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু না হওয়া অবধি খেলা চলত। এই খেলার দ্বিতীয় অধ্যায় আবার শুরু হত বিকেল চারটে থেকে। অন্ধকার নামা অবধি খেলা চলত, যতক্ষণ অবধি খালি চোখে বল দেখা যায়।

আসলে হঠাত করে cliched স্মৃতি রোমন্থন করছি কেন? আজকেও রবিবার সকালে উঠে ভাবলাম যে আমার বয়েসি একজন আজকের দিনটা ঠিক কী ভাবে কাটাবে? বাঙালী এখনও বাজারে যায়, কিন্তু বিগবাস্কেট বা ডেলিবাজারের প্রসার ফেলে দেওয়ার মতন নয়। এরপর সকালে টিভি, ফোনে ফেসবুক, ওয়াটসঅ্যাপে নিজস্ব বৃত্তের মধ্যেই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা থেকে শুরু করে প্রেম, আড্ডা, ঝগড়া চলবে। বিছানায় গড়িয়ে নিতে নিতে হয়তো স্পিকারে গান চালিয়ে কেউ কেউ খবরের কাগজ বা বই পড়বে, অনেকের হাতে থাকবে ট্যাব। এরপর দুপুরের খাওয়ার পালা। বাড়িতে রান্না হলে ভালো, না হলেও এই গরমে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, স্যুইগি, ফুডপান্ডা at your service. এরপর দুপুরটা কাটিয়েই বিকেলে একটা উবের বা ওলা বুক করে পাব, বা মল, বা সিনেমা হল, বা বন্ধুর বাড়ি, বা রেস্তোরা।

গোটা ব্যাপারটা এরকম। একটা গেটেড কমিউনিটির প্রাচীর টপকিয়ে কাঁচতোলা গাড়ির হিমশীতল অন্দরমহলে চড়ে আরেকটি প্রাচীর তোলা জায়গায় টুক করে ঢুকে পড়া। এই গোটা ব্যাবস্থাটা এতটাই মসৃণ, যে বাইরের বিশাল জগতের বাস্তবতার সাথে কোনওরকম ইন্দ্রিয়ের যোগাযোগ স্থাপন না করেও এটা করা যায়। কানে একটা হেডফোন লাগিয়ে নিন, বা ড্রাইভার কে বলুন গান চালিয়ে দিতে। চোখ বন্ধ করে সীটে দেহটা এলিয়ে দিন। দেখবেন বাইরের শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য কোনওটাই আপনাকে সহ্য করতে হচ্ছে না। একটা গোটা শহরকে বাইপাস করে আপনি নির্বিঘ্নে নিজের অস্তিত্বের খোলসের মধ্যে থাকতে পারবেন।

এরকমটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। প্রযুক্তির প্রতিশ্রুতি ছিল মানুষকে একে অপরের আরও কাছে আনবে। চ্যাপলিন সত্তর বছর আগে বলেছিলেন– The aeroplane and the radio have brought us closer together. The very nature of these inventions cries out for the goodness in men– cries out for universal brotherhood– for the unity of us all. টেলিফোন, টিভি, ইন্টারনেট– প্রযুক্তির প্রতিটা ধাপই মানুষের মধ্যে অদৃশ্য দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়বার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার জায়গায় আরও নতুন নতুন দেওয়াল খাড়া হয়েছে। প্রযুক্তির এই অধঃপতিত মডেলে বিভিন্ন আর্থসামাজিক স্তরের মানুষদের মধ্যে যে এক হওয়ার পরিসরগুলো ছিল, shared spaces, যার সূত্র ধরে একটা ভৌগোলিক অঞ্চলের সমস্তরকম মানুষের মধ্যে moral commons গড়ে ওঠবার যে সুযোগ, তা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেছে। এখন আর আমাদের কোনও সমষ্টিগত বাস্তবতা নেই, যার স্বাদ আমারা একে অপরের সাথে ভাগ করে নিতে পারি। পাড়ার খেলার মাঠে ফ্ল্যাটবাড়ির শিশু আর রিকশাওয়ালার শিশুর সাথে খেলে না। খেলার মাঠটাই আর নেই। দু’জন এখন নিজেদের আলাদা পরিসরে খেলাধুলো করে। আমাদের শপিং মলগুলোতে বস্তির লোকেদের ঢোকার বিরুদ্ধে অলিখিত নিয়ম আছে। এরজন্যে সাইনবোর্ড টাঙ্গাতে হয় না। মলের মধ্যে প্রাইস ট্যাগগুলোই সেই সাইনবোর্ডের কাজ করে। একবিংশ শতাব্দীর apartheid চামড়ার রঙ দেখে হয় না, মানিব্যাগের ওজন দেখে হয়। আর শুধু বাস্তব জগতে কেন! আপনার ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টের নামগুলো কাদের? আপনি কাদের সাথে ওয়াটসঅ্যাপে কানেক্টেড? তার মধ্যে আপনার আর্থ-সামাজিক স্তরের বাইরের কটা লোক আছে? তাহলে একটাও দেওয়াল কি সত্যিই ভাঙতে পারলেন? একবিংশ শতাব্দীর এই উপহার আমরা পেয়েছি প্রযুক্তির এই স্বীকৃত মডেলের থেকে, উন্নয়ন যেখানে রিপ্লেস করেছে empathy-কে। একে কী বলে জানেন? Alienation। এই যে সামাজিক এলিয়েনশন, যার ফলস্বরূপ আসবে মানসিক এলিয়েনেশন, এর কথা মার্ক্স বহু বছর আগে লিখে গেছিলেন। প্রযুক্তি রয়েছে, এমনকি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ অব্যাহত, কিন্তু সেই প্রবেশের শর্ত ঠিক করা হচ্ছে একমাত্র প্রফিট মোটিভের শর্ত মেনে। প্রযুক্তি তাই আর মানুষকে কাছে আনা নিয়ে ভাবিত নয়, তার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য– মুনাফা। মানুষের কায়িক শ্রমকে লঘু করবার কথা ছিল যার— অটোমেশন– সে আজ মানুষের পেটে লাথি মারতে উদ্যত। একজন শ্রমিককে ডেকে বলা হচ্ছে– তোমার শ্রমের আর প্রয়োজন নেই। You are redundant. একটা মেশিন বা একটা এলগোরিদম উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে একজন মানুষের অস্তিত্ব এক মুহূর্তে ছিন্ন করে দিচ্ছে। সে আর শ্রমিক নয়। উৎপাদন ব্যাবস্থায় তার আর কোনও ভূমিকা নেই। সে অপ্রয়োজনীয়। প্রযুক্তির এই বর্তমান মডেল আমাদের যে সারসত্য উপহার দিয়েছে—

Automation is the highest form of alienation. নীল কলার থেকে সাদা কলার, কেউই সুরক্ষিত না। প্রযুক্তি আমাদের ভিত্তি, এলিয়েনেশন আমাদের ভবিষ্যৎ।

এর মধ্যেও, এখনও, তাও কেউ কেউ লড়ে যায়। জেনে বা অজান্তে। সেদিনকে একটি মেয়ের সাথে একটি কাজ নিয়ে কথা বলছিলাম। আলোচনার শেষে বললাম, আমি অমুক তারিখের পর তোকে ফেসবুকে ইনবক্স করে জানাচ্ছি। একটু লাজুকভাবে বলল, আমি রাতে বাড়িতে গিয়ে মাঝেমধ্যে পিসি থেকে লগ ইন করি, ইনবক্সে পাঠালে হয়তো মিস করে যাব। তুমি ফোন করে জানিও।

কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে গেলাম। আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট একটি মেয়ে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এরা পরের প্রজন্ম। কী অবলীলায় সারাদিন ‘কানেক্টেড’ থাকবার এ যুগের দাবীকে অস্বীকার করে টিকে রয়েছে।

হয়তো এদের হাত ধরেই প্রযুক্তির সেই উন্নতর মডেলকে আমরা পাব, যা মানুষকে ব্রাত্য নয়, মুক্ত করবে। সত্তর বছর আগে চ্যাপলিন যেমন বলেছিলেন– More than machinery we need humanity. More than cleverness we need kindness and gentleness. Without these qualities, life will be violent and all will be lost….

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...