সুশোভন ধর
উৎসব-টুৎসবের পরে চারিদিকে বেশ একটা খুশির আমেজ। সোজা কথায় যাকে বলে পার্টি টাইম। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো করজোড়ে জনগণের দোরে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মিজোরাম, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা— পাঁচ রাজ্যে ভোট যে! এই ভোটটাই আবার সামনের বছরের লোকসভা ভোটের ড্রেস রিহার্সালও বটে! খুশি উত্তেজনা উৎসাহ স্বাভাবিক।
কিন্তু ঐ, যেমন বলা হয়ে থাকে, সবাই তো একই সঙ্গে খুশি হতে পারে না! যেমন ধরুন হুকুমচাঁদ মীনার পরিবারের কথা। হুকুমচাঁদ মীনা, ২৮ বছর বয়স, রাজস্থানে কোটার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ব্রিজনগর গ্রামে থাকতেন। রসুন চাষ করেছিলেন ধারকর্জ করে, তারপর দাম না পেয়ে গত মে মাসে আত্মহত্যা করলেন। ২৫ লাখ টাকা ধার ছিল, আর তার রসুন বিকোচ্ছিল ৫ টাকা কিলো দরে। ফসল কিন্তু দারুণ ফলেছিল! ২০ বিঘাতে ২,৫০০ টন! না না, ২০ বিঘা জমি তাঁর নিজের নয়, বেশিটাই বর্গা নেওয়া। তাহলে চক্রটা কী দাঁড়াল? চমৎকার উৎপাদন, সেখান থেকে দামে ধ্বস, সেখান থেকে আত্মহত্যা।
মীনা একা নন, দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানের হাদোতি অঞ্চলের আরও চারজন রসুন চাষি এ বছর আত্মহত্যা করেছেন। শুধু রসুন চাষিরাই নন, কোটা, বারান, ঝালওয়ার এবং বুন্দি জেলাতে যে সব চাষিরা পেঁয়াজ, সোয়াবিন, সরষে, মসুর চাষ করেছিলেন তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন রসুনের এই দাম পড়ে যাওয়া রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের ভোটে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বিশেষত রাজস্থানে, কৃষকদের এই সঙ্গীন অবস্থায় সরকারের কাছ থেকে কোনও মদত না পাওয়া ক্ষমতাসীন বিজেপি’র জন্য ক্ষমতায় ফের ফিরে আসার রাস্তায় যথেষ্ট কাঁটা বিছিয়ে দেবে। এই সেদিন পর্যন্তও পশ্চিম মধ্যপ্রদেশের মালওয়া অঞ্চল এবং তার লাগোয়া পূর্ব রাজস্থানের হাদোতি অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল ছিল রসুন। ভারতের মোট রসুন উৎপাদনের ৪৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় এই অঞ্চলে। সরকারের মূল্য সংক্রান্ত তথ্যের নেটওয়ার্ক অ্যাগমার্কনেট (Agmarknet) থেকে জানা যাচ্ছে, বছর দুই আগেও রসুন চাষিরা কিলো প্রতি ১০০ টাকা দাম পেতেন। অনেকেরই মতে, রসুন ছিল এই অঞ্চলের সোনার ফসল। একটু উন্নতমানের রসুন কুইন্টাল প্রতি ১৩,০০০ টাকা (১৩০ টাকা কিলো)তেও বিকোত। কুইন্টাল প্রতি রসুন উৎপাদনে খরচ প্রায় ৩,০০০ টাকা। তাই বহু চাষিই অন্যান্য ফসলে যা ক্ষতি হত, রসুন দিয়ে তা পুষিয়ে নিতেন।
নোটবন্দির রামঘুষি
কিন্তু ২০১৬’র নভেম্বরের পর পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে গেল। নোটবন্দির ফলে রসুনসহ সমস্ত ফসলের দামই হু হু করে পড়ে যায়। এবং রসুন সেই ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ২০১৭’র মার্চে যখন রসুন বাজারে এল, তখন এক প্রধান পাইকারি বাজার মন্দসৌর মান্ডিতে দেখা গেল রসুন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কিলো দরে, যা আগের বছরেই ছিল ১০০ টাকা। জুনে সেটা আরও নেমে ৩০ টাকায় দাঁড়াল। রাজস্থানের কোটায়— রসুনের আরেক বিরাট পাইকারি বাজার— সেখানে জুলাইতে রসুন বিকোল ২৫ টাকা কিলো দরে। সেপ্টেম্বরে দাম নেমে গেল ২০ টাকা কিলোয়, যার ফলে উৎপাদন খরচ তোলাটাই কৃষকদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। পরিস্থিতি আরও খারাপ হল। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮, দু বছরই দেখা গেল মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থান এই দুই রাজ্যেই রসুন চাষের এলাকা বৃদ্ধি পেল। মধ্যপ্রদেশে ৯২,০০০ হেক্টর থেকে ১.২৮ লাখ হেক্টরে এবং রাজস্থানে তো ৬৯,০০০ থেকে ১.৩২ লাখ হেক্টরে। ফলে ফলন বাড়ল হু হু করে। দামও পড়ল পাল্লা দিয়ে। ২০১৮-র মে মাসে মন্দসৌরে রসুনের দাম দাঁড়িয়েছিল ১ টাকা কিলো। মার্চে যখন নতুন ফসল বাজারে আসে তখন কিলোতে ২০ টাকা দাম পাওয়া গেছিল। এখানে একটু জোরেসোরে পাঠকদের মনে করিয়ে দিই, ২০১৬-র জুনে এই মন্দসৌরেই ফসলের বেশি দামের এবং ঋণমকুবের দাবিতে বিক্ষোভরত কৃষকদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়ে পাঁচজন কৃষককে হত্যা করে।
শাঁখের করাত
ঋণ এবং কম বর্ষায় ফলন মার খাওয়ায় গত দু’মাসে গুজরাটে ৬ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। চীনাবাদাম চাষের জন্য চারদফা বৃষ্টি লাগে, কিন্তু এই মরশুমে গুজরাটে কেবলমাত্র একদফা বৃষ্টি হয়েছে, ফলে ফলন মার খেয়েছে ব্যাপকভাবে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাদাম চাষে আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। এক্ষেত্রে কৃষকের ক্ষতি কিন্তু মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানের মতো অধিক ফলনের জন্য নয়, বরং ফলন না হবার কারণে। এর ফলে ঋণের চাপও বেড়েছে, বেড়েছে সরকারবিরোধী ক্ষোভও। দেবভূমি দ্বারকা জেলার খামভালিয়া তালুকার প্রচুর গ্রামেই যতক্ষণ না দুর্ভিক্ষপীড়িত ঘোষণা করা হচ্ছে ততক্ষণ অবধি কোনও বিজেপি নেতার এলাকায় ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। বিজেপি সরকার যথারীতি বিভাজনের নীতি নিয়েছে। যে সমস্ত গ্রামে তাদের বিরুদ্ধে বেশি ভোট পড়েছিল, তাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত ঘোষণা করা হচ্ছে না। কৃষকদের আরও দাবি, বাদাম তেল রপ্তানির জন্য সরকার ইনসেনটিভ চালু করুক। কিন্তু এ বছরের বাদাম চাষে বিপর্যয় রাজ্যে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা আরও বাড়াবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঋণ সংকট
এই ঘটনাগুলি ভারতের কৃষি ব্যবস্থার এক মহামারীর ইঙ্গিত। NSSO যে অল ইন্ডিয়া ডেব্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সার্ভে করে, ২০১২ সালের ৩০শে জুন তার ৭০তম রাউন্ড থেকে জানা যায়, ভারতের কৃষি পরিবারগুলির ৩৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। আরেকটি সমীক্ষা— অল ইন্ডিয়া রুরাল ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন সার্ভে (NAFIS) থেকে জানা যায়, ২০১৫-১৬’র কৃষিবর্ষে ভারতের ৪৭ শতাংশ কৃষি পরিবারই ঋণগ্রস্ত। প্রসঙ্গত, ভারতে কৃষিবর্ষ জুলাই থেকে জুন। সমীক্ষা দুটির নমুনা আলাদা হলেও এটুকু স্পষ্ট, ভারতের কৃষকরা ক্রমশই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে যখন জানা যায়, ২০০১ থেকে ’১১-র মধ্যে ৯০ লক্ষ কৃষক তাদের বাড়ি ভিটে ছেড়ে শহরগুলিতে এসে মাথা গুঁজেছেন, বা প্রতিদিন ২০০০-এরও বেশি কৃষক শহরগুলিতে এসে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে সস্তা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, তখন অবাক হওয়ার বিশেষ অবকাশ থাকে না।
১৯৯৮ সালে বাজপেয়ি সরকার বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (KCC) চালু করেছিল। কার্ডগুলিতে একটা ঋণসীমা ধার্য করে দেওয়া হত, এবং সেই সীমার মধ্যে কৃষক তার বীজ, সার, ডিজেল ইত্যাদি কিনতে পারতেন মাত্র ৪ শতাংশ সুদের হারে। ঐ সীমার মধ্যে একজন কৃষক নগদ টাকাও নিতে পারতেন, যতবার তাঁর প্রয়োজন, এবং যত তাঁর প্রয়োজন সেই অনুযায়ী। এর ফলে আর প্রতিটা ফলনের সময় তাঁকে কোঅপারেটিভ বা ব্যাঙ্কে ঋণের জন্য দৌড়তে হত না। কিন্তু এই কার্ড মাত্র ১০.৫ শতাংশ কৃষি পরিবারের কাছে পৌঁছতে পেরেছে।
কার্ডটি সুবিধাজনক নিঃসন্দেহে, কারণ এতে ফসলের সময় ঋণ পাওয়ার ঝক্কি অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে অল্পসংখ্যক কৃষকের কাছে এই কার্ড রয়েছে, গড় ঋণসীমা ১.৩৯ লক্ষ টাকা হলেও তাঁরা গড়ে ৯১,০০০ টাকা তুলেছেন মাত্র। এর থেকে একটাই সিদ্ধান্ত টানা যায়, যথেষ্ট লাভ হবে এবং তাঁরা সময়সীমার মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে পারবেন, এ বিষয়ে কৃষকরা মোটেই নিশ্চিত নন।
সমীক্ষার থেকে ঋণ সম্পর্কে আরও একটি ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসে। ভারতের ৩০.৩ শতাংশ কৃষি পরিবার মহাজন, আত্মীয়স্বজন, সার-বীজ বিক্রেতা ইত্যাদিদের মতো অ-প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে এখনও ধার নেন। ৯ শতাংশ কৃষি পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অ-প্রাতিষ্ঠানিক, দুরকম ঋণই রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির ঋণ দেওয়ার জন্য দীর্ঘ পদ্ধতি, জামিন বা কৃষিঋণের ক্ষেত্রে স্বল্প সময়সীমাকেই এর কারণ বলা যায়।
সমীক্ষায় আরও দেখা যাচ্ছে জমির পরিমাণ বেশি থাকার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ঋণগ্রস্ততার নিরিখে প্রথম তিনটি রাজ্য হল তেলেঙ্গানা (৭৯%), অন্ধ্রপ্রদেশ (৭৬%) এবং কর্নাটক (৭৫%)। ফলে ঋণের সঙ্গে আত্মহত্যার সংখ্যা যে সমানুপাতিক, সেটাও আর অস্পষ্ট থাকে না।
এটা মর্মান্তিক যে, ভারতের মতো একটা কৃষিপ্রধান দেশে কোনও জাতীয় কৃষিনীতি নেই। গত আড়াই দশক ধরে একের পর এক সরকার নয়া-উদারনৈতিক পলিসি রূপায়ণ করেছে এবং বাজারকে বল্গাহীনভাবে খুলে দিয়েছে। যার ফলে কৃষি এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, এবং আমাদের দেশীয় কৃষিব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ রূপে সম্পর্কিত হয়ে গেছে বিশ্ববাজারের সঙ্গে। ফল ভুগছেন কৃষকরা। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁদের এখন আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকছে না।