অরুণাভ গাঙ্গুলির ফেবুদেওয়াল থেকে

অরুণাভ গাঙ্গুলি

আ ডেথ ইন দা গাঞ্জ

 

পিঠ ঠেকে যাওয়ার জন্য একটি দেওয়াল জোটাও কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেকের সেই দেওয়ালটুকুও জোটে না। তারা অনন্ত পিছোতে থাকে শুধু। আর পিছোতে পিছোতে…

পিছোতে পিছোতে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একজন করে ‘শুটু’-র জন্ম হয়। ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের মতো একটু একটু করে যাদের জীবনে জমা হতে থাকে প্রত্যাখ্যান এবং ব্যঙ্গ। এবং সেই ডিপোজিট ম্যাচিওর করার সময় এলে…

তখনই নীল রঙের একা অ্যাম্বাস্যাডারটা ডিকি বন্ধ করে, সন্ধে নেমে আসার মুখে সাক্ষাৎ বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের জঙ্গল ঢাকা রাস্তা পেরিয়ে ফিরে চলে কলকাতা পানে… আর গাড়ির পিছনের সিটে বসে থাকে শুটু। তাকিয়ে থাকে সামনে বসা দুজন মানুষের দিকে। তারা গাড়ি চালাচ্ছে, সিগারেট খেতে খেতে। তাদের মুখে চিন্তার ছাপ। খুব শিগগিরই তাদের জীবনে আসতে চলা একটা উটকো ঝামেলার হাত থেকে তারা কীভাবে মুক্তি পাবে, এই নিয়েই হয়তো তাদের চিন্তা। কিন্তু তাদের মুখে কোনও মনখারাপের আঁক নেই। নেই কোনও শোক। এতদিন এদেরই তার নিজের লোক বলে জানত শুটু! শুটু তাকিয়ে থাকে সামনে বসা এই দুজন মানুষের পানে; অবাক চোখে। তার চোখের তলায় কালশিটে। কোণটা চিকচিক করে… শুটু ফিরে যায়, অনন্ত পিছিয়ে যায় অন্ধকারে। … আজ থেকে ঠিক ৩৬ বছর আগে, নিঃসঙ্গ রাতের কলকাতায়, পিছনে ধাওয়া করে আসা এক নেড়ি কুকুরের মুখের সামনে তাঁর প্রিয় মানুষের জন্যে বানানো কেকটা ধরে দিয়ে যেভাবে শহরের অনন্ত অন্ধকার রাস্তায় এগিয়ে পড়েছিলেন এক বৃদ্ধা– তখন যেভাবে গলায় একটা পাথর এসে আটকেছিল, ঠিক একইভাবে ঐ নীল অ্যাম্বাসাডার ডিকি বন্ধ করে যখন শুটুকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যায়… ম্যাকলাস্কিগঞ্জের রুক্ষ পাথর ধুলো সবকিছুই কণ্ঠনালী আগলে দাঁড়ায়।

ধন্যবাদ কঙ্কণা, ছবিটা বানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি পরিবারের একত্র হওয়া, এবং তারপর ধীরে ধীরে প্রত্যেক সদস্যের চরিত্রের পরত উন্মোচন– বাংলাতেই এমন ধারার ছবির দুটি অন্যতম উদাহরণ হল সত্যজিৎ রায়ের “কাঞ্চনজঙ্ঘা” এবং “অরণ্যের দিনরাত্রি”। ঋতুপর্ণ ঘোষের “উৎসব”-ও এই গোত্রেরই ছবি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কঙ্কণার এই ছবির গোত্র নতুন নয় একেবারেই। তবে আলাদা কীসে? একেবারে তুলনায় না গিয়েই বলছি, আলাদা এখানেই– আগের তিনটি ছবিতেই শেষে আমরা ‘আলো’ দেখতে পাই, কিন্তু এখানে– শেষের পরেও অন্ধকার মালভূমি বিছানো মনখারাপে মাথায় ঝিঁঝিঁ ডাকতে থাকে। তাই আঘাত হানে বেশি। আর সেটাই তো হওয়ার কথা, সবে কুড়ি পেরোনো একটি ছেলে, সদ্য পিতৃহীন, পরীক্ষায় ফেল করে মাকে মিথ্যে বলে বেড়াতে এসে দেখে প্রত্যেকের কাছেই সে আসলে একটা খেলনা, বেগার খাটানোর যন্ত্র, আপাতভাবে কেউ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না কিন্তু রাখে সেই ‘এলেবেলে’-র দলেই, কারও যৌন খিদে মেটানোর ‘বস্তু’… আর এসব কেন? কি তার অপরাধ? অপরাধ হল সে যথেষ্ট ‘পুরুষালি’ নয়। ইন্ট্রোভার্ট। সহজেই সে কাঁদতে পারে। তাই সহজেই তাকে নিশানা করা যায়। তার পরিজনেরা নিদান হাঁকে তাকে শক্ত হতে হবে, তাই এভাবে তাকে ‘বুলি’ করাটা কতকটা তার উপকারই করছে, এমনভাবেই দেখে তারা। তাকে নিয়ে চলে এক নিরন্তর ধর্ষকামী পৌরুষের উদযাপন!

আর এই উদযাপন দেখাতে গিয়ে অসম্ভব স্মার্ট এবং ক্রিস্প একটি চিত্রনাট্য লিখেছেন কঙ্কণা, যা কিনা তাঁর পিতা মুকুল শর্মার একটি ছোটগল্পকে আধার করে রচিত। সেই গল্পের আধার আবার বাস্তব জীবনেরই কিছু খুচরো পকেট ঘটনা। চিত্রনাট্যে শুটুর ব্যাকগ্রাউন্ড খুব খোলসা করে বলা নেই, সেই জন্যে এক জায়গায় বেড়াতে এসে কেবলমাত্র এক সপ্তাহ অন্য লোকের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুনে কেন তার অমন ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে চিত্রনাট্য তো, ইতিহাস তো নয়, কোনও চরিত্রের জন্মের পর তার জীবনের একটি বিশেষ সময়ে এসে যখন সে দাঁড়ায় তখনই কেবল সে চিত্রনাট্যে স্থান পায়, তার অতীত-ভবিষ্যৎ প্রায় অজানা রয়ে যায়, আমরা তাকে বর্তমানেই রক্তমাংসে পাই, তাই শুটুর জীবনে অতীতেও তাকে কেমন বুলিং-এর শিকার হতে হত সেটা না জানা গেলেও, দর্শকের ভাবনার জন্য এক বিস্তৃত ক্ষেত্র রচিত হয় যা চরিত্রটির গায়ে রহস্যের চাদরটিকেই আরও ভালোভাবে জড়িয়ে দেয়। শুটু তো রূপক মাত্র! আমরা বুঝি ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এই সাতদিন আসলে তার অপমান সহ্য করার শেষ সীমা।

সারা ছবি জুড়ে অদ্ভুত এক গন্ধ! ভীষণ ‘রাস্কিন বন্ড রাস্কিন বন্ড’ গন্ধ! ঝিঁঝিঁ ডাকা সন্ধে পেরোনো রাস্তায়, রাত মেখে শুয়ে পড়া ছোট্ট টাউন, লোডশেডিং-এর বাংলোয় প্লাঁশেতে, জঙ্গলের গা ছমছমে মরবিড আবহে, চরিত্রদের অম্ল-কষায় আচরণে… কেন জানি না মনে হচ্ছিল ভীষণভাবে একটুকরো কসৌলি যেন তুষার কণায় চেপে উড়ে এসে মিশে গেছে ম্যাকলাস্কির লাল কাঁকরে! আর এই আবহকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রগ্রাহক শীর্ষ রায়। জঙ্গুলে এলাকা দিনে রাতে তার দুইরকম চরিত্র নিয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর ক্যামেরায়। এ ছবির “mise en scène” অসাধারণ। বেশিরভাগ দৃশ্যই ঘটেছে রাতের অন্ধকারে, কখনও মোমের আলোয়। ‘থ্রিলার ছবি’ না হয়েও থ্রিলের পরত আর এক পোঁচ বেশি চাপার পাশাপাশি চরিত্রদের মনের অন্ধকার বোঝাতেও যা সাহায্য করেছে। এছাড়াও ছবির একটি বিশেষ চরিত্র যে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু অভিমুখে তা বোঝাতে বহু দৃশ্যে এবং অবজেক্টে ছড়ানো রয়েছে এমন কিছু দারুণ মৃত্যু মেটাফর। আর্ট ডিরেকশন দারুণ এ ছবির, দুর্ভাগ্যক্রমে শিল্প নির্দেশকের নাম মনে নেই। সাগর দেশাইয়ের আবহ সঙ্গীতে মনখারাপের সুর বাজে। পোশাক কিংবা রঙ মিশ্রণ যথাযথ।

অভিনয়? রণবীর শোরে এখানে ম্যাসোচিজ্‌ম-এর প্রতিভূ, এক কথায় দুর্দান্ত করেছেন। এর পরেই যাঁর নাম করতে হয় তিনি কাল্কি কেকলাঁ, পুরুষ নিয়ে খেলতে ভালোবাসে এমন এক নারী, যে শেষে শুটুকে হেলায় বলতে পারে “আমাকে নিয়ে ভাবার চাইতে পড়াশোনায় মন দিলে ভালো করবে তুমি”– বলে শুটুর মুখের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়… অসামান্য! গুলশন দেবাইয়াও ভালো। তুলনামূলক ভাবে তিলোত্তমা সোমের চরিত্রটি একমাত্রিক, তবে তিনিও চমৎকার। ওম পুরি কিংবা জিম সারভের সেরকম কিছু করার না থাকলেও ভালো করেছেন। ওম পুরিকে দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। নিজের শেষ কাজটা পর্দায় দেখে যেতে পারলেন না ভদ্রলোক! বহুদিন বাদে তনুজা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘ একটি চরিত্রে, এবং যথারীতি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এবং তানি, বাচ্চা মেয়েটি, আরিয়া শর্মা, চমৎকার।

কঙ্কণা যখন প্রথম অভিনয় করতে আসেন, তখনই ওঁর মা বলেছিলেন– “কাঁকন আমার থেকে অনেক ভালো অভিনেত্রী।” তখন আমরা এই কথার আড়ালে অপত্যস্নেহকে লুকিয়ে থাকতে দেখলেও, যত দিন গেছে এ কথার সত্যতা আমাদের কাছে প্রকট হয়েছে। তবে কাঁকনের মা তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি দিয়ে আমাদের তো সত্যিই চমকে দিয়েছিলেন! একাকীত্ব নিয়ে ঐভাবে কবিতা আঁকা… কঙ্কণাও কিন্তু চমকেই দিলেন আমাদের। এবারে আমরা অপেক্ষা করব তিনি তাঁর মায়ের থেকেও উচ্চমানের পরিচালক হয়ে উঠতে পারেন কিনা তা দেখার জন্য। ওহ্‌ ভালো কথা, কাঁকনের মাও কিন্তু এই ছবিতে আছেন, শুটুর মায়ের কন্ঠ হিসেবে। আর শুটু…

অনন্ত অপমানের মহাশূন্যে ভাসতে থাকা একটা মানুষ, যে তার প্রতি করা অপমানগুলোর প্রতিবাদ করতে চেয়েও পারে না, প্রতিবাদ বলতে কাবাডি খেলায় প্রতিপক্ষকে একবার কেবল লাথি মারা। আপাত পৌরুষহীন একটা মানুষ, তার পৌরুষের পরিচয় কেবল মেলে পরিত্যক্ত কবরখানায় দুঃসাহসিক হয়ে, যে নারী তাকে ব্যবহার করেছিল তাকেই জাপটে ধরে চুমু খাওয়ার মধ্যে। এবং বন্ধুহীন একটা মানুষ, সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি যখন সে খুঁজে পায় একটি শিশুর মধ্যে, আর সেই শিশুটিই যখন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাকে বেড়াতে না নিয়ে যাওয়ার ‘অপরাধে’… তখন পিছোতে পিছোতে আচমকাই গর্তে পড়ে যায় শুটু। আর গর্তের কিনারে এসে দাঁড়ায় মাংসাশী নেকড়ে। আর ঠিক তখনই নীল রঙের একা অ্যাম্বাস্যাডারটা ডিকি বন্ধ করে লাল ধুলো উড়িয়ে ফিরে চলে শহর পানে… আর গাড়ির পিছনের সিটে বসে থাকে শুটু। চোখে জল আর ফর্সা মুখে দগদগে ক্ষত নিয়ে সে বসে থাকে চুপচাপ। আর ঠিক এইখানেই জন্ম হয় বিক্রান্ত মাসে নামক অকল্পনীয় এবং অনন্য এক অভিনেতার! সেলাম!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...