প্রিয়ক মিত্র
এই লেখা যতক্ষণে লিখতে বসছি ততক্ষণে মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুরে দুটি বাঘের শাবক ট্রেনে চাপা পড়েছে। বিশেষ বিশেষ সংবাদ ভেসে এল। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে আরও দুটি বাঘ কমল। এতে বিচলিত হব এমন অবকাশ পাচ্ছি না, কারণ আমরা ধরেই নিয়েছি এ দেশে ‘জাতীয়’ পশুর এমনই পরিণতি হবে। পশুপাখির মৃত্যুতে আর অস্বস্তি হবে না। ব্রাজিলের নবতম বিদেশমন্ত্রীর মতে ক্লাইমেট পরিবর্তন হল সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীদের আবিষ্কার, পশ্চিমি পুঁজির অগ্রগতিকে আটকানোর জন্য। এদেশের প্রধানমন্ত্রীও তেমনটা মনে করেন, ফলত এরকম ঘটতেই থাকবে। সভ্যতার ট্রেনের চাকা পিষে দিতে থাকবে অরণ্যকে, বন্যপ্রাণকে।
সবাই জানেন অবনীর মৃত্যুর কথা। মৃত্যু বলার থেকেও যথাযথ হবে হত্যা বলাটা। অবনীকে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের পান্ধারকাওড়ার জঙ্গল, যা আদতে আম্বানিদের ইজারা দেওয়া হয়েছে, সাক্ষী থাকল একটি বাঘের রাষ্ট্রীয় হত্যার। এই রাষ্ট্র ফেক এনকাউন্টারের পদ্ধতি জানে। এই রাষ্ট্রে একটি বাঘকেও রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভে বিপজ্জনক বানিয়ে তোলা যায়, তাকে মানুষখেকোর ভুয়ো তকমা দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে খুন করে ফেলা যায় সহজেই।
মহারাষ্ট্রের এই যাবৎমল জেলার পান্ধারকাওড়ার জঙ্গলে বসবাসকারী অবনী, যার পোষাকি নাম টি-১,তার হত্যা অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে। যেমন বাঘ ও মানুষের সহাবস্থানের প্রশ্নটি।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে আদিবাসীদের রোধ করা হয়েছে অরণ্যের অধিকার থেকে, কারণ বারংবার বলা হয়েছে আদিবাসীরাই ধ্বংস করছে অরণ্য। ‘আরণ্যক’ ভুলে যাইনি আমরা কেউই, যেখানে অরণ্য সংলগ্ন সমস্ত অধিবাসীদের থেকে জঙ্গল একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েছিল বেনিয়ারা, সত্যচরণের সাহায্যে। স্বাধীন ভারতেও এই সাতটি দশকজুড়ে নানান সময় খর্ব হয়েছে অরণ্যের অধিকার। অথচ সেই অধিবাসীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে দিব্যি অবনীকে মানুষখেকো সাব্যস্ত করে হত্যা করা যায়।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালের আইন মোতাবেক কিছু উপজাতিকে বনজ সম্পদ ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়, যেমন ডোংরিয়া কোনধ। এই উপজাতিগুলি জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় থাকেন। বাঘ এলাকাভিত্তিক প্রাণী, সে তার নির্ধারিত অঞ্চলের বাইরে সচরাচর বেরোয় না। উল্টে মানুষই তার এলাকায় অনুপ্রবেশ করে। যেমন খুব সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে তাড়োবার জঙ্গলে একটি বাঘ তাড়া করছে পর্যটকভর্তি একটি গাড়িকে। জঙ্গলের কোর এলাকায় ঢুকে বাঘের রাস্তা আটকে ছবি তোলার মোচ্ছব আদৌ বন্ধ হবে এরপর? উল্টে একজনও পর্যটক আহত হলে দোষী সাব্যস্ত হবে বাঘটিই।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও জঙ্গলের ভেতরে খাদ্যের অভাব হওয়া ও এজাতীয় নানান কারণে বাঘকে জঙ্গলের বহিরাংশে আস্তেই হয়। এও একধরনের অভিবাসন, যেমন লালগড়ের বাঘটির ক্ষেত্রে ঘটেছিল। উড়িষ্যা থেকে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে সে লালগড়ের জঙ্গলে এসে পৌঁছেছিল। আদিবাসীদের শিকার পরবে সেই বাঘটি মারা পড়ল। এখন এক্ষেত্রে একজাতীয় আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, বাঘের এলাকার কি আদৌ কোনও সীমাবদ্ধতা আছে? যদি থাকে, তাহলে সেই সীমাবদ্ধতা বিপন্ন নয় তো? আসামের ডিব্রুগড়ে একটি চিতাবাঘ নিহত হয়। চিতাবাঘের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে, শাবক প্রসব হলে বাঘিনীদের জঙ্গলের মূল এলাকা থেকে সরে আসতে হয়। কারণ সেসময় চিতাবাঘের রোষের শিকার হওয়ার ভয় থাকে শাবকদের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসমস্ত ক্ষেত্রে মানুষ কী করতে পারে? আমার ব্যক্তিগত মতে, সে বিষয়ে বনদফতরের তরফে একজাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। এদেশের মানুষের এবিষয়ে কোনও উপযুক্ত শিক্ষা ও সচেতনতা নেই। ফলত মাঝেমধ্যেই প্যাঙ্গোলিন বা পিপীলিকাভুক, বাঘরোল— এ জাতীয় দুর্লভ প্রাণীকে হত্যা করা হয় জনবসতিতে ঢুকলেই। সেখানে বাঘ নিয়ে তো আতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বনদফতর এ জাতীয় উদ্যোগের ধারেকাছে তো নেইই, উল্টে লালগড়ে একটিমাত্র বাঘকে তারা খুঁজেই পায়নি সন্ধান চালিয়েও। আর অবনীর ক্ষেত্রে যা ঘটল তার পর বোঝা গেল বনদফতরও বিশ্বাস করে এ জাতীয় হত্যায়।
অবনীর মৃত্যু অনেক বাঘকে হত্যার রাস্তা খুলে দিয়েছে রাষ্ট্রের কাছে। মহারাষ্ট্রের আরেক কংগ্রেস বিধায়কের দাবি, তার এলাকায় দুজন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটি বাঘ, ফলত সেই বাঘটির মৃত্যু চাই তার।
অবনীর ঘাতক রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র আম্বানির হাতে তুলে দিয়েছে পান্ধারকাওড়ার ৫০০ হেক্টর জঙ্গল, যে রাষ্ট্র মধ্যপ্রদেশের পান্না-র জঙ্গল হীরে খননের জন্য দান করে দিতে চায় বহুজাতিককে, যার ফলে এক বিশাল সংখ্যক বাঘের বাসস্থান নষ্ট হত। ব্রাজিলে নবতম রাষ্ট্রপতি বোলসানারো আমাজনের বুক চিরে রাস্তা গড়তে চান। অবনীর বংশবৃদ্ধি হলে আম্বানিদের ক্ষতি হত, কাজেই কর্পোরেটের স্বার্থে প্রাণ দিয়েছে অবনী, রাষ্ট্র তাকে বানিয়ে তুলেছে ‘বিপজ্জনক’, তার হত্যার যুক্তি হিসেবে। যেমনভাবে তারা দেশদ্রোহীর তকমা দিয়ে ফেক এনকাউন্টার ঘটায়।