ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি
১৪ই এপ্রিল আর ১৩ই নভেম্বর। মাঝে সাত মাসের ব্যবধান। বাঘঘোরা আর খাসজঙ্গলের মাঝে দূরত্বও তেমন কিছু নয়। আর ওই দুই দিন প্রকাশিত অস্বস্তিকর মৃত্যুর দুটি খবর যাদের নিয়ে তাদের দূরত্ব বোধহয় আরও কম। লালগড়ের বাঘ আর লালগড়ের শবররা উভয়েই প্রান্তিক। তাদের মৃত্যু নিয়ে মূলধারার খবরের কাগজে, ফেসবুকে দু-এক দিন বিশ্লেষণ, বিতর্ক আর পাসিং দ্য বাক চলবে বড়জোর, তারপর জঙ্গলের মানুষ আর জঙ্গলের বাঘ উভয়কেই ভুলে যাবে রাষ্ট্র আর বৃহত্তর সমাজ। একটু একটু করে মুছে যাওয়ার পথে এটাই তাদের নিয়তি।
‘অনাহারে মৃত্যু’ রাজনৈতিকভাবে একটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর শব্দবন্ধ। দেড়শো কোটি জনসংখ্যা যে দেশের সেখানে মানুষ নানা কারণেই মারা যেতে পারে, কিন্তু স্রেফ না খেতে পেয়ে কেউ মরে গেলে ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু ঠেকে। বিশেষ করে যে দেশে বাম-ডান নির্বিশেষে সব দলই জনকল্যাণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটা প্রথম হাড়ে হাড়ে টের পায় ২০০৪ সালে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার যখন কৈলাশ মুড়া নামে পঞ্চায়েত সমিতির এক সদস্য এক চাঞ্চল্যকর তথ্য জনসমক্ষে আনেন— ঐ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাশোল গ্রামে শুধু না খেতে পাওয়ার কারণে মারা গেছে আদিবাসী শবর সম্প্রদায়ের পাঁচ জন মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সততার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে আমলাশোল কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ না, রাজ্যের বহু জায়গার মানুষই দারিদ্র আর ক্ষুধা পীড়িত। কিন্তু সরকারি প্রতিক্রিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর সততা প্রতিফলিত হয়নি। ইন্ডিয়া টুডে-তে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি বয়ান ছিল মৃত শবরদের তিনজন জন্ডিসে আর দুজন যক্ষ্মায় মারা যায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলাশাসক চন্দন সিনহা বলেন মৃত সনাতন মুড়ার স্ত্রী নিজের মুখে জানিয়েছেন যে তাঁর স্বামী জন্ডিসে ভুগছিলেন। “I have this on tape.” অর্থাৎ, ঠোস সবুত। যা দিয়ে স্পষ্ট প্রমাণ করা যায় অনাহার না, অসুস্থতাই ছিল শবরদের মৃত্যুর মূল কারণ।
২০০৫ সালে ঐ আমলাশোল থেকেই আরও বেশ কয়েকটি অনাহারে মৃত্যুর খবর বেরোয়। বিশে এপ্রিল টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এমনই একটি খবর প্রকাশিত হয়। বেয়াল্লিশ বছর বয়সী লুলা শবর মারা গেছে অনাহারে। বাড়িতে একদানা খাবারও না থাকায় বৌ মুগি ছোট মেয়ে লেদিকে নিয়ে চলে গিয়েছিল বড় মেয়ে জবার কাছে, ধোবাকাছা গ্রামে। পনেরো বছরের জবা মাত্র কয়েকদিন আগেই অনাহারের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গিয়েছিল ধোবাকাছার বুধু শবরের সঙ্গে। যাই হোক, বৌ-মেয়ে ছেড়ে চলে যাওয়া একলা লুলু শবর পরের দিনই বিকেলবেলা মারা যায়। ভাইপো রতু শবরের কথায়, মারা যাওয়ার আগে তিন দিন ধরে লুলা ক্ষিদের জ্বালায় বারবার ‘ভাত দে, ভাত দে’ বলে চিৎকার করেছে। কিন্তু বাড়তি ভাত আর কার ঘরে আছে? তাও মরার আগের দিন ভাইপো রতু এক বাটি ফেন খাইয়েছিল লুলাকে। অশক্ত এবং অসুস্থ লুলার কাজ করার ক্ষমতা ছিল না, তাই র্যা শনের সস্তা চাল-ডাল কেনার মতো টাকাও ছিল না তার ঘরে। এবারও ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক গণেশ চৌধুরী বলেন মৃত্যুর আসল কারণ ছিল যক্ষ্মা।
ওপরের দুটো খবরের পাশাপাশি গত কয়েকদিনে প্রকাশিত খবরগুলো পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে দেড় দশকে জঙ্গলমহল আর তার বাসিন্দাদের অবস্থা আসলে কিছুই বদলায়নি। বদলায়নি সরকারের তরফে সাফাই দেওয়ার চেনা ছকও। এখনও ‘অনাহার নয়, অসুস্থতা’র পুরনো কার্ডই খেলা হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, তাহলে আগের দশকের মাঝামাঝি চালু হওয়া MGNREGA প্রকল্প কি জঙ্গলমহলের প্রান্তিক, আদিবাসী মানুষদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে? দু টাকা কেজি দরে পরিবারপিছু পনেরো কেজি চাল পাওয়ার পরেও কেন অনাহারে মরতে হচ্ছে খাসজঙ্গলের লোধা শবরদের? কেন বেশিরভাগ শবরের মাথার ওপর এখনও কোনও বলার মতো ছাদ নেই? এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া খুব কঠিন, কারণ যথেষ্ট তথ্য নেই। তবে আন্দাজ করা যায় যে এইসব প্রকল্পের সুফল টার্গেট পপুলেশনের কাছে পৌঁছয়নি। MGNREGA প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। দিনে একশো বিরানব্বই টাকা হিসেবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে একটি পরিবার বছরে উনিশ হাজার দুশো টাকা রোজগার করতে পারে। এটা থিওরি। কিন্তু যদি ঐ পরিবারের হাতে যৎসামান্য অর্থ ধরিয়ে দিয়ে জবকার্ডগুলি ভুয়ো কাজের হিসেব তৈরির জন্য ব্যবহার হয়, তাহলে? শবররা আদিবাসী, এবং ব্রিটিশ আমল থেকে অপরাধপ্রবণতার কলঙ্ক বহন করে তারা সমাজের মূলস্রোত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। এরকম কিছু মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা খুব সোজা, কারণ তারা রাজনৈতিকভাবেও প্রান্তবাসী। তাদের কোনও কণ্ঠস্বর নেই।
লোধা এবং খেড়িয়া শবরদের উন্নতির জন্য একসময় নিরলস খেটে চলা মহাশ্বেতা দেবীর লেখা একটি গল্প ইংরেজি অনুবাদে পড়েছিলাম। ইংরেজিতে গল্পটির শিরোনাম ছিল Salt। সেখানে দল থেকে বিতাড়িত এক দাঁতাল হাতি আর কিছু আদিবাসী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে নুনচাটির অধিকার নিয়ে। গ্রামের মানুষ হাতিদের জন্য বানানো নুনচাটি থেকে নুন চুরি করতে বাধ্য হচ্ছে কারণ মহাজন উত্তমচাঁদ তাদের নুন বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা আর উত্তমচাঁদের কাছে মাগনা খাটতে যায় না, সেই বেইমানির শোধ তুলতে। এদিকে সেইসব মানুষের পক্ষে ডাল্টনগঞ্জ গিয়ে নুন কিনে আনা সম্ভব নয়— শহরের থেকে তারা আসলে আলোকবর্ষ দূরত্বে বাস করে। অতএব একসময় প্রতিহিংসাকামী দাঁতালটা নুন চুরি করতে যাওয়া আদিবাসীদের পেটে পা তুলে দিয়ে তাদের থেঁতলে মারে। সরকারি খাতায় হাতিটাকে ‘রোগ’ বলে ঘোষণা করা হয়, শহর থেকে শিকারী এসে তাকে মেরে ফেলে। মরা হাতিটা দেখতে আসা গাঁয়ের মোড়লের বারবার মনে হতে থাকে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা সাংঘাতিক অবিচার আছে। যারা মরল তারা কেউ দোষী ছিল না। কিন্তু কিছুই গুছিয়ে বলতে না পেরে সে শুধু মাথা নাড়তে নাড়তে গাঁয়ের দিকে রওনা দেয়।
অবিচারের এই মূক অনুভূতি লালগড়ের মৃত বাঘ আর লালগড়ের মৃত এবং এখনও বেঁচে থাকা মানুষদের একান্ত। তাদের কণ্ঠস্বর পত্রিকার পাতায় বা রাজনৈতিক তরজায় উঠে আসবে না কোনওদিনই। জঙ্গলমহলের হাসির আড়ালেই গুমরোতে থাকবে তা, সুযোগ খুঁজতে থাকবে ফেটে পড়ার।