সোহম দাস
অধমের জানা নেই, আইসিসির কোনও মিটিংয়ে ‘উইমেন’স ক্রিকেট’ এই টার্মটা নিয়ে কখনও কেউ বিরোধিতা করেছেন কিনা! পুরুষের ক্ষেত্রে শুধু ক্রিকেট, আর মেয়েদেরক্ষেত্রে আলাদা করে ‘মেয়ে’ ট্যাগলাইনটা যখনই আসে, সেখানে একটা প্রচ্ছন্ন ডিস্ক্রিমেনেশন থাকে না কি? হ্যাঁ, বোদ্ধারা প্রশ্ন তুলতে পারেন, সেক্ষেত্রে দুই লিঙ্গকে আলাদা করবেন কীভাবে। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়, তাহলে ‘মেন’স ক্রিকেট’ এই টার্মটাও চালু করা হলেই সে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এক্ষুণি আমাকে ‘ফেমিনিস্ট’ ট্যাগ লাগাবেন বলে যারা ভাবছেন, তাঁদেরকে একবার অন্যান্য ইন্ডোর গেমসের খেলাগুলিরদিকে দৃষ্টি দিতে বলব। সেখানে কিন্তু পরিষ্কার ছেলেদের টুর্নামেন্ট কোনটা বা মেয়েদের টুর্নামেন্ট কোনটা, সেটা বলা থাকে। যেমন, টেনিস বা ব্যাডমিন্টন।
আপাতত ফোকাসটা ক্রিকেটেই রাখব। এ লেখা যখন লিখছি, তখন ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে। এবং আবারও সেই শক্ত গাঁট ইংল্যান্ড। ২০১৭ বিশ্বকাপের গোটা টুর্নামেন্ট দাপটের সাথে খেলে আসার পরও এই একখানা দলের কাছেই কেন যে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে দল, তা নিছকই তাৎক্ষণিক ক্রিকেটীয় ভুল নাকি অন্য কোনও মানসিক জুজুর কারণে, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে এটা অনস্বীকার্য, যে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার উঠে আসায় বর্তমান ভারতীয় দলটি এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা দল।
গতবছর বিশ্বকাপের ফাইনালে খুব কাছাকাছি এসে হারতে হয়েছিল। এখন মিডিয়াতে প্রচার অনেক বেড়েছে। ফলে দ্বিদেশীয় বা ত্রিদেশীয় সিরিজের কভারেজ হয়। সেখানেও ভারতের পারফরম্যান্স বেশ দাপুটে। ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টি দুটোতেই। কিন্তু এখানে অবধারিত ভাবে একটা প্রশ্ন আসে, টেস্টে অবস্থা তাহলে কীরকম? সেখানেই ধাক্কা খেতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেট দল শেষ টেস্ট খেলেছে চার বছর আগে। যতই টি-টোয়েন্টি এসে ক্রিকেটের জৌলুস বাড়াক, কর্পোরেট দুনিয়া লাফালাফি করুক, প্রাক্তনরা পিঠ বাঁচাতে বলুন যে টি-টোয়েন্টি আসার ফলে ক্রিকেট কঠিন হয়েছে, এই কাঁচা সত্যিটা তাঁরাও জানেন যে, টেস্ট ক্রিকেট না খেললে ক্রিকেটার হওয়াই যায় না! সেখানেই বড় ধরনের ঘাটতি থেকে গেছে মহিলা ক্রিকেটের বেলায়। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের মহিলা কমিটির প্রধান ক্লেয়ার কোনর বলেছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটের ভাগ্য এখন সুতোয় ঝুলছে। ২০০৫ সাল থেকে আইসিসি দায়িত্ব নিয়েছে মহিলা ক্রিকেটের। তারপর থেকে সারা বিশ্বের ক্রিকেটখেলিয়ে দেশগুলো সব মিলিয়ে কটা টেস্ট খেলেছে, জানেন? পনেরোটা!
মিতালি রাজ ভারতীয় তথা বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় অনায়াসে চলে আসবেন। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষেই বলছি। টেস্টে ৫১ ব্যাটিং গড়, মাত্র উনিশ বছর বয়সে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানো ক্রিকেটার। ওয়ান ডে-তে সাড়ে ছ’হাজারের ওপর রান-সহ বিশ্বে সর্বাধিক রানসংগ্রহকারী ক্রিকেটার (নট টু মেনশন, প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে ছ’হাজার রানের গণ্ডি পেরিয়েছেন)। সচিন তেন্ডুলকরের সাথে তাঁর অবধারিত তুলনাটা এমনি এমনি তো হয় না। সেই মিতালিও তাঁর প্রায় কুড়ি বছরের ক্রিকেটজীবনে টেস্ট খেলেছেন মাত্র দশটি। ওয়ান ডে খেলেছেন ১৯৭টি, সেটিও যথেষ্টই কম। মিতালির নাহয় ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা, যা ধরবেন তাতেই সোনা। তাই দশটি টেস্ট ম্যাচেই চিনিয়ে দিয়েছেন জাত। কিন্তু সকলে তো তা হয় না। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই আস্তে আস্তে নিজেকে মেলে ধরেন। ঘষেমেজে তৈরি হন। সেখানে এত কম সুযোগে তাঁদের নষ্ট হয়ে যাওয়াই ভবিতব্য বলে ধরে নিতে হয়।
ঠিক এই একই কথা উঠে এসেছে এক দিল্লির এক প্রাক্তন রাজ্যস্তরের খেলোয়াড় অনুপ্রিয়া দেবীর মুখে। ভারতে মহিলা ক্রিকেটের চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে অনুপ্রিয়া এই যথেষ্ট সুযোগ না পাওয়াকে তুলে ধরেছেন। যেবছর আইসিসি মহিলা ক্রিকেটের দায়িত্ব নিল, তার পরের বছরই ভারতের মহিলা ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রক সংস্থা উইমেনস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার (ডব্লিউসিএআই) সাথে গাঁটছড়া বাঁধল বিসিসিআই। তাতে বহু ক্রিকেটারই আশার আলো দেখেছিলেন যে এবার হয়ত পর্যাপ্ত সুযোগ মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, তাতে ফল হল উল্টো। ডব্লিউসিএআইয়ের সময়ে অর্থ বা পরিকাঠামোর অভাব ছিল, কিন্তু স্কুলস্তরে, কলেজস্তরে এবং রাজ্যস্তরে জুনিয়র লেভেল টুর্নামেন্টগুলি ঠিকমতো হত। দুটি সংস্থার জুড়ে যাওয়ার পর হঠাৎই আন্ডার-সিক্সটিন এবং ইন্টার-জোনাল টুর্নামেন্টগুলি বন্ধ হয়ে গেল। ফলে, ঠিকমতো সাপ্লাই লাইনটাই বন্ধ।
অতীতের শান্তা রঙ্গস্বামী ছিলেন। সাম্প্রতিক অতীতে আঞ্জুম চোপড়া, অঞ্জু জৈনরা সোনার ইতিহাস লিখে গেছেন। এখন মিতালি রাজ আর ঝুলন গোস্বামী ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপন। কিন্তু দুজনেরই বয়স পঁয়ত্রিশ পার হয়ে গেছে। এই বয়সেও তাঁরা এখনও সেরা ফর্মে খেলে যাচ্ছেন, সেটা আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু এরপর এমন নাম উঠে আসবে তো? হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মান্ধানা, শিখা পাণ্ডেরা প্রতিভাবান অবশ্যই, কিন্তু এখনই লম্বা রেসের ঘোড়া কিনা সেটা বলে দেওয়া কঠিন। ফলে ভালো প্লেয়ারের জোগান আর তাঁদের পর্যাপ্ত সুযোগের এই মুহূর্তে বড্ড দরকার। অবশ্য যে দেশে অন্তত ষাট শতাংশ অঞ্চলে মেয়েদের স্বপ্ন দেখাকে পাপ বলে মনে করা হয় এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই একই মনোভাব দেখা যায় বেশিরভাগ ক্রিকেট কোচদের ক্ষেত্রেও যারা চট করে কোচিং ক্যাম্পে উৎসাহী কোনও মেয়েকে দেখলেই নেতিবাচকতার জায়গায় চলে যান, সেই মনোভাবের বড়রকম বদল না আনলে কিছুই করা সম্ভব নয়, সে বিসিসিআই যার সাথেই গাঁটছড়া বাঁধুক।
শুধু ভারতকেই বা দোষ দিই কী করে! আইসিসিই কিনা যেখানে দশবছরে মাত্র পনেরোটা টেস্ট খেলায়!
অথচ চিত্রটা এমন হওয়ার কথা কিন্তু নয়। ক্রিকেটে বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে মেয়েদের খেলাতেই। ১৯৭৩-এ ইন্টারন্যাশনাল উইমেন ক্রিকেট কাউন্সিলের আয়োজনে। আরও একটি রেকর্ডে মেয়েরা এগিয়ে ছেলেদের থেকে। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ান ডে-তে ডাবল সেঞ্চুরি কিন্তু কোনও পুরুষ করেননি। সচিনের কীর্তির তেরো বছরও আগে করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার ও মহিলা দলকে দুবার বিশ্বকাপ জেতানো ক্যাপ্টেন বেলিন্দা ক্লার্ক। ১৯৯৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ডেনমার্ক দলের বিরুদ্ধে ২২৯ রান করে অপরাজিত থেকে গিয়েছিলেন তিনি। এরকম পরিসংখ্যান অন্তত এই বিশ্বাসটুকু তো দেয়, যে, যেভাবে ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে এত মাতামাতি, এত হুজুগ, তার সিকিভাগও যদি মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে হয়, তাঁরাও যদি পর্যাপ্ত সুযোগটা পান, তাহলে এরকম অনেক ক্রিকেটার উঠে আসতে পারেন।
ইক্যুয়ালিটির এত গলাবাজি অথচ চোখের সামনেই অসাম্য এমন প্রকট হয়ে দাঁড়িয়ে! কীসের ভয়? পিতৃতন্ত্রের গদি যদি টাল খায়?
তথ্যসূত্র:
Anupriya. “The problem isn’t the India women’s team, it’s the board.” Espncricinfo, 2014.
Nicholson, Raf. “The case for women’s tests.” The Cricket Monthly, 2016.
Wikipedia.