যশোধরা রায়চৌধুরী
রজার মুর, জেমস বন্ড, টিনটিন ইত্যাদি ও আমরা
১৯৭৩ সালে রজার মুর প্রথম অভিনয় করেন জেমস বন্ডের ভূমিকায়, ছবির নাম লিভ অ্যান্ড লেট ডাই। এ সেই সময় যখন সাহেবপাড়ার মধ্যবিত্তীকরণ হয়নি। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট, নিউমার্কেট অঞ্চল, মেট্রো সিনেমার আশপাশের ধর্মতলার ধর্মভাব কম, প্রতিবাদী চরিত্র কিঞ্চিৎ সীমাবদ্ধ। মূলত উঠতি ছেলেমেয়েদের লীলাক্ষেত্র। ইংরেজি সিনেমা মানেই গ্লোব নিউ এম্পায়ারে লাইন পড়বে। সিনেমাফেরত রঙ্গিন যুবকযুবতীরা বসবে সামান্য সোডার বোতল-পানীয়ের বোতল খুলে…
কিন্তু সেই যুবকযুবতীদের প্রজন্ম থেকে আমি তো ফস্কে গেছি। সেটা আমার মামা কাকাদের প্রজন্ম কারণ, আমার বয়স তখন মাত্র আট। মায়ের হাত ধরে প্রতি পুজোয় নিউ মার্কেটে বাজার করতে যাই আর চোখ গোল গোল করে দেখা অনেক পাশ্চাত্য-রীতির জামাকাপড়ের মতই, পাশ্চাত্যের হলিউডি ছবির শান-রওনক পোস্টার থেকে চুঁইয়ে পড়লে চেটেপুটে নিই।
সেভাবেই জেমস বন্ডের “অসভ্য” পোস্টার নিশ্চয়ই দেখেছিলাম।
এর পর, তিয়াত্তর থেকে পঁচাশি এই দীর্ঘ বছরে আমি ইশকুল থেকে বেরিয়ে ইলেভেন টুয়েলভে ব্রেবোর্ন কলেজে গেছি। কিন্তু দেখা হয়নি মুনরেকার, ফর ইওর আইজ ওনলী বা অক্টোপুসি। স্পাই হু লাভড মি–র নামকরণের সার্থকতা বিচার করার সুযোগ হয়নি। শুদ্ধ পবিত্র রুচির চর্চায় ব্যাপৃত আমার পরিবার আর জেমস বন্ডের ছবি? হয় না কোনও রাজযোটক।
এর পাশাপাশিই আমি দেখিনি সেইসব নরমগরম হিন্দি ছবিগুলিও, জিতেন্দ্র বা বিনোদ খান্না বা আমাদের সর্বপ্রিয় অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ‘লম্বু’ অমিতাবচ্চন অভিনীত… সেসব দেখত আমার স্কুল পালানো মামাতো দাদা, আর কন্ঠস্থ করত ডায়ালগ, পুনরাবৃত্তি হত ছাতে ছাতে, আড্ডায় আড্ডায় সেগুলো… কিশোরের গানের পাশাপাশি… দেখত আমার তখনও না দেখা হওয়া জীবন দোসর, বারাসাতের লালি বা সরমায় মামাতো দাদার সঙ্গে। ওদেরও হাতের কাছে ছিল না ইংরিজি ছবির “ক্লাস”। ওরাও ব্রাত্য তখন এসব থেকে। শুধু দীওয়ার থেকে নমকহালাল… সাত ও আটের শুরুর দিকের হিন্দি ঢিশুম ঢাশুম ছবিগুলো অব্দি ছিল ওদের দৌড়। ওরা তো জানত না এই বেজায় “পুরুষালি” মারামারির দৃশ্য, নানা প্রযুক্তির উদ্ভট প্রয়োগ, গোপন বদমাইশের ডেরার মুখের গেটগুলোর অদ্ভুত বিপজ্জনক চোরা পথ, এইসব কেমন টুকলি করা হত জেমস বন্ডের ছবিগুলো থেকেই। ওসব ছবির প্রপস ঝাঁ চকচকে আর স্মার্ট, দামি আর অথেনটিক… মূল থেকে টুকলির কাজে বড় বেশি চট, কার্ডবোর্ড আর কাগজ সাঁটানো লুক। তবু তো, অ্যাকশন!
হলিউডের থেকে হাতবদল হয়ে বলিউডের হাত ধরেই আমাদের কাছে এসেছে যাবতীয় অ্যাকশনের চিত্রকল্প। অমিতাভের হাঙর কুমিরের সঙ্গে মারপিট থেকে শুরু করে, বিশাল ট্রাক অথবা ট্যাঙ্কার নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়া জাতীয় আরও নানা সব কাণ্ডকারখানা।
শৈশবে এইসবের চুঁইয়ে পড়া গল্পকথায় বহুশ্রুত কাণ্ড একদিন চোখের সামনে আসতে শুরু করল। ততদিনে ঘরে ঘরে টিভি। তারপর, ইদানীং-এর আমি, প্রাচীনের চোখ দিয়ে আবার সুরুত সুরুত করে উপভোগ করতে শুরু করি জেমস বন্ডের গল্প। হো হো করে হাসি। গড়িয়ে পড়ি আমোদে। কেননা বড় চেনা চেনা সব কাণ্ড এগুলো।
আর, অবাক হয়ে দেখি, জেমস বন্ডের কাণ্ডগুলোর সঙ্গে কৈশোরে গিলতে থাকা টিনটিনের গল্পের খুব তফাত নেই। তফাত শুধু মহিলাবাজিতে! জেমস বন্ড এক ছবিতেই অন্তত পাঁচ থেকে ছয়জন মেয়ের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করেন। সবাই অতীব সুন্দরী। কেউ ধলা কেউ কালা কেউ রোগা কেউ চ্যাপ্টা। কেউ গ্রীক তো কেউ আফ্রিকী।
আর, সমস্ত আশৈশবের উত্তরাধিকার যেভাবে ক্রমশ জমি হারায় আমাদের কাছে। ভিন্নতার মান্যতা নেই সেসবে। হলুদ চামড়া কালো চামড়া সাদা চামড়ার কাছে অবনত থাকে সদা। পশুদের পটাপট মেরে ফেলা যায়। মহিলারা নন এন্টিটি অনেক ক্ষেত্রেই। সব কাহিনি গল্পর মতনই, এ দোষে দুষ্ট বন্ড ছবিও।
বন্ড কেন শ্বেতাঙ্গই, দীর্ঘকায়ই, এবং, বাদামি বা সোনালি চুলেরই? বন্ড কেন “অনুন্নত” দেশে গিয়ে ট্যা রা রা রা করে গুলি চালিয়ে অশ্বেতাঙ্গদের খুন করতে “লাইসেন্সড টু কিল”? বন্ড কেন কুমির মারেন, হাঙর মারেন? বন্ড কেন মেয়েদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে ছাড়া আর কোনও ভাবেই দেখতে পারেন না?
আমাদের ছোটবেলার উপেন্দ্রকিশোরের গল্প আজ পড়লে মনে হয় পশুপ্রেমীরা দৌড়ে এল বলে। বাঘ মারার গল্পগুলো বড় হিংস্র, পশু বিরোধী। আমাদের ছোটবেলার টিনটিনের গল্পগুলো, অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেকের গল্পগুলো বড় বেশি রেসিস্ট।
তেমনি বন্ডও রেসিস্ট, নারীবিরোধী, পশুবিরোধী। আমাদের ছোটবেলার সবকটা মজার আর আকর্ষণীয় জিনিসের মতোই, বন্ড একেবারেই মার্কিন মুলুকের হেজিমনিতে আক্রান্ত।
তথাপি ভারি নস্টালজিয়া আনে।