প্রতিভা সরকার
তার সঙ্গে আমার দেখা মানভূমে। পলাশের কাল তখন। আমাদের গাড়িটা ফেরার পথে পুরুলিয়া শহর থেকে অনেক দূরে পশু আবাসের সামনের মাঠে থামল। সেখানে তখন স্টেজ বাঁধা সারা। ঝালমুড়ি, সিঙারা বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। লোক জমতে শুরু করেছে সবে। দুর্বারের সহযোগিতায় মানভূমের নাচনি সম্প্রদায়ের নৃত্যানুষ্ঠান।
অনেক লোকের মধ্যখানে আলাদা করে নজরে পড়ে তাকে তখনও, যদিও যৌবন সেইরকম চোখ পুড়িয়ে দেওয়া নয় আর। বরং অল্প বয়সের চড়া রঙ ফিকে হয়ে আরও ঘরণীসুলভ করেছে তাকে, কোঁকড়াচুলে লম্বা সিঁদুর পরা এক স্বাস্থ্যবতী। মধ্যবয়সী আর প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী। তার নাম পস্তু(পোস্ত)বালা কর্মকার। দুহাজার আঠারো সালের পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত লালন পুরস্কারপ্রাপ্ত নাচনি। ১৯৯৩ সালে এই পুরস্কারের আলো প্রথম পড়ে আর এক নাচনির কপালে, তিনি ঝুমুর বিশেষজ্ঞ সিন্ধুবালা দেবী।
এই মানভূম বড় বিচিত্র জায়গা। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য এত বিস্তারিত ও শক্তিশালী ছিল যে পরেশনাথের পাহাড় থেকে নগ্নপদে ও শরীরে স্বয়ং মহাবীর নেমে এলে তাঁকে খেদাবার জন্য কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। সমস্ত জৈন মন্দিরগুলিকে কালক্রমে সিঁদুর চড়িয়ে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করবার পালা এখনও চলছে।
বর্ণবাদী জাতিবিদ্বেষ যদি একদিকে, আর একদিকে এর অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি আর সরল মানুষেরা। সাবেক মানভূমের ভরকেন্দ্র বর্তমানের পুরুল্যে, পুরুলিয়া জেলা। এখানে আর সব কিছুর সঙ্গে আছে হাওয়ার শনশন, ঝড়ের গর্জন, সিংহের মুখব্যাদান, মার্জারের লঘু সন্তর্পণ পদচারণা— এক কথায় প্রকৃতির সমস্ত পদক্ষেপ আর আলোড়নকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠা ছৌ নাচ আর করুণ বাঁশির মতো আশ্চর্য সুরেলা অথচ বিষণ্ণ ঝুমুর গান। পলাশের গৈরিকের সঙ্গে দুর্মূল্য আকরিক আর অজস্র বনজ সম্পদ। আর আছে ঝুমুরের অগাধ সুরসমুদ্রে সাঁতার কাটা নাচনির দল, যারা সবাই জানে নাচনি হওয়া সহজ নয়কো মোটেই।
–লালাবাবুর সংসার ছাড়েছুড়ে দিবার মতো বুকের ভেতর সে ডাক এসে না পৌঁছলে লাচনী হয়ে ওঠা হয় না গ্য। সংসার হলো গ্যে রীতিনীতির গুলাম! তাতে কীটস্য কীট মানুষ, আর বিটিছেলা হলে তো কথাই নাই! তার বুকের পাটা এমনিতেই কাঁপে, কন সাহসে সে এমনটা করবেক বলো দিকি! উ কি কেবল ঐ রসিকের জন্যে করবেক? রসিকের সংসারে সেই মানময্যাদা সে কি পায়!
উঁহু লয় গো লয়, তা লয়।
একাধিক নাচনির কাছে এই একই বক্তব্য শুনেছি যে, যে ডাক না শুনলে নাচনি হওয়া যায় না, সে ডাক আসে স্বয়ং পরমাত্মার কাছ থেকে।
অথচ পস্তুবালা বলেন, এই নাচনি হয়ে ওঠা আমাদের জীবন সংগ্রাম আমাদের শিল্পীসত্তার জয়।
হয়তো কথা ক’টি পস্তুর শিখে নেওয়া, কোথাও শুনে থাকতে পারেন, কিন্তু বলার সময় গভীর বিশ্বাসে জ্বলজ্বল করে ঘামেভেজা মুখ, দৃঢ় হয় নাকের পাটা।
ঠিক এইখানে দৃষ্টিভঙ্গির যে ফারাকটি প্রতীয়মান হয় সেটিই পস্তুবালা কর্মকারকে পস্তুবালা কর্মকার করেছে। রসিকের নাম জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগ নাচনি আজও সলজ্জ হেসে উত্তর দেয়, উয়ার লাম বুলবো! স্বামীজ্ঞানে, রসিকজ্ঞানে, গুরুজ্ঞানে যাকে দেখা, গ্রহণ করা, তার নাম জিহ্বাগ্রে আনা পাপ। পস্তু কোনও জড়তা ছাড়াই ঘোষণা করেন তার রসিকের নাম বিজয় কর্মকার, যে কারণে তিনি নিজেও পস্তুবালা কর্মকার।
এই সংগ্রামটিই কি সহজে মেটার! রসিকের পদবী ব্যবহারের অধিকারও নাচনিকে ছিনিয়ে নিতে হয়। পদবী তো দূরস্থান, এক পাত্রে খাবার অধিকারও ছিল না পস্তুর। তখন রসিকের বাড়ি তার আগমনে প্রবল আলোড়িত। সবাই হাত ঠোঁট উলটে রসিককে শুধোয়, লাচ জানে না, গান জানে না, এটাকে লিয়ে কইরবে কী! লাদে কি মারুনি দিবে হে!
তাকে খেতে দেওয়া হত উঠোনের এক কোণে, শালপাতায়। খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো জায়গা গোবর দিয়ে নিকিয়ে দিতে হত। এইখান থেকে সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা লাগাতার সংগ্রাম ছাড়া অর্জন করা যায় কি? নাকি আধার কার্ডে স্বামীর নামের জায়গায় বিজয় কর্মকার লেখা যায়!
এখন সব নাচনিরাই যে কোনও ডকুমেন্টে স্বামীর নাম দিতে হলে রসিকের নাম বসান। রসিকের পরিবারের জ্ঞাতসারেই। সমাজের কাঠিন্য কিছুটা হলেও কোমল হয়েছে তার প্রমাণ মৃত্যুর পর নাচনির তথাকথিত সদগতি। গত শতকেও নাচনি এমন পাপিষ্ঠা আর অস্পৃশ্য ছিল যে তার মৃতদেহকে আগুনের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত করাই ছিল রেওয়াজ। কাঁধে চড়ে শ্মশানে যাবার স্বপ্নও দেখেনি কোনও প্রবীণ নাচনি, কারণ সে ভালোই জানত তার ভবিতব্য, মরার পর অস্পৃশ্য তার পায়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে ফেলে দিয়ে আসা হবে শ্মশান পেরিয়ে ভাগাড়ে। যেমন করা হয় একটা পিটিয়ে মারা কুকুরের সঙ্গে। খরচও বাঁচল, সামাজিক শুদ্ধতারও কোনও হানি ঘটল না। আর পিটিয়ে মারা? সে তো আকছারই হয়ে থাকে, হয় শেষ বয়সের রোগশোকে পেটাচ্ছে, নয়তো রসিকের নির্দয় সংসার অথবা খোদ রসিকেরই পালটে যাওয়া। আরো মর্মান্তিক কণ্ঠ, কলা এবং জীবিকা হারিয়ে অথর্ব হয়ে পড়া। ভাগ্যের হাতে মার, সে তো নাচনিদের অঙ্গের ভূষণ।
সময় আর সংগ্রাম এই অমানবিক প্রথার শেষ দেখিয়েছে। তবু কি অনর্থের শেষ আছে। এখনও অনেক বর্বরতা, অনেক বাঁকা কথার ফেরে ঘুরে মরে নাচনিকুল। কেউ দ্যাখে না তার মনের অন্য চলন, তার কন্ঠের অন্য সুর, শরীরের ভেতরে যে শরীর তার অন্য বিভঙ্গ। হাজার লোক উপচে পড়া অনুষ্ঠানে সিটি পড়ে ঘন ঘন, নাচনির মেয়ে নাচনিই হবে এইটে ঠিক করে ফেলা সমাজের উৎকট উল্লাস যেন। কে ভালো করে শোনে ঝুমুর গানের প্রথম কলি, হরি হে, কী ফুলে পূজিব তোমায়!
রাত যত ঘন হয়, উদ্দাম হয় হারমোনিয়াম, তবলার সঙ্গত। যত চকচকে হয় জোড়া জোড়া চোখ, তত সাধনা ভুলে লাস্যে মাতে নাচনি। ছৌ-এর সমান উৎকৃষ্ট মুদ্রার বদলে পেট কাঁপায় মৃগীরোগীর মতো। ম্লান আলোয় তাকে লাগে যেন মিশরীয় বেলি ড্যান্সের অক্ষম অনুকারক।
অথচ নাচনিবিদ্যা আয়ত্ত করতে ক্রোশের পর ক্রোশ রসিকের সঙ্গে হাঁটতে হয়েছে যুবতী পস্তুকে। গড়গড়িয়ে মুখে নেয় সে শতেক প্রাচীন নাচনিনাম— সিন্ধুবালা, বিমলা, কমলা, আরও কত। শরীরে লাস্য আনতে ন’ কিলোমিটার হেঁটে সিনেমা দেখা। গুরুদের প্রতিটি নড়াচড়া, ভঙ্গিমার ওপর পস্তুর শিকারীদৃষ্টি। নিজের কণ্ঠে ও শরীরে তুলে নেবার মরিয়া চেষ্টায় পায়ের নিচে শালপাতা ভাঙে মরমর শব্দ ক’রে। সাধনসঙ্গী কেবল রসিক আর তার চড়াসুরে বাঁধা প্রাচীন হারমোনিয়াম। পেছনে যেন ঢিমিকি ঢিমিকি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, লাদে কি মারুনি দিবি, লাদে কি মারুনি দিবি! শেষ অবদি জিতেছে একাগ্র শিল্পী সত্তা— ‘লইক্ষ করতাম গুরুজনদের ছাতি, কমর, হাতের কাজ। শিখে লিলাম অল্প দিনে।’
ওড়িশি নাচের পোশাকে যেমন কোমরবেষ্টনী থাকতেই হবে, নাচনিদের নৃত্যভূষণেও তেমনি একটি বড়সড় রুপোলি কোমরজোড়া অলংকারের উপস্থিতি থাকতেই হবে। সেই বন্ধনী ধারণের উপযুক্ত হবার পেছনে পস্তুর এই এক জীবনভরা গল্প।
লাদে মারুনি হবার দুর্ভাগ্য থেকে বেরিয়ে পস্তু আজ লালনবিজেতা। শুধু তাই নয়, অশিক্ষা অপুষ্টির অন্ধকারে পড়ে থাকা সংখ্যাগুরু নাচনির কাছে তিনিই সংগ্রামলক্ষ্মী। তার অনুপ্রেরণা তাদের পথ দেখায়। তার উপস্থিতি সঠিক পথনির্দেশ দেয়। আদ্যন্ত আধুনিক মনের অধিকারী পস্তুর গলাতেও শুনি রসিকের বাঁধা আধুনিক ঝুমুর— নাচনিরা কি পইরবে জলে / ও সমাজসেবী, ও বুদ্ধিজীবী দাও না বলে!
কণ্ঠ আজকাল সাথ দেয় না। শুধু বয়স নয়, কচিবেলার অনাচারও দায়ী তার জন্য।
পস্তুবালার মা— নাচনি যখন দলের বাজনদার রসিকের হাত ধরে দল ছাড়ে তখন সে জানত না পেটে দুমাসের পস্তুবালাকে ফেলে তার রসিক জন্মের মতো চোখ বুজবে। ফলে পস্তুর ছোটবেলা কেটেছে চরম কষ্টে। মা ছেড়ে চলে গেলে সে ভিক্ষা করেছে, ঝিগিরি, গরুর বাগালি কিছুই বাদ ছিল না।
সেই মা ফিরে এসে পস্তুর বিয়ের ব্যবস্থা করে তার ঠাকুর্দার বয়সী এক অসুস্থ মানুষের সঙ্গে। তখন তার বয়স দশ কি বারো। আগের স্ত্রী রুষ্ট হবে তাই অই কচি মেয়েকে মানবাজারে নিয়ে গিয়ে জরায়ু খালাস করিয়ে আসা, যাতে বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে কোনও হ্যাপা না থাকে।
‘সম্পত্তি ভাগ কইত্তে হত যে!’ পস্তুবালা মৃদু হাসে, ‘রইতে রইতে নিজেই ঠিক কল্লাম নাচনি হব।’ রসিক হয়ে এলেন বিজয় কর্মকার। তারও বৌ ছেলে আছে নাচনি হবার পর জানতে পারে পস্তু।
আমি শুধোই, তোমায় মিথ্যে বলেছিল তার মানে!
প্রৌঢ় মুখের রেখা নরম হয় প্রেমের ছটায়। পস্তু বলে, না উয়ার মাসি মিছা বইলেছিল।
নাটক নভেলে পুরুলিয়ার নাচনিকে জানা কিছু কঠিন কাজ নয়। তবে সে এক কথা, আর নারী দিবসের ঠিক আগে তাদের এক আইকনকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার কেশের নারিকেল তেলের সুবাস নেওয়া, তার জীবনের নানা তোলপাড়ে ভেসে যাওয়া, আর এক।
ছবি তুলেছিল আমার ছাত্রী শাল্মলী, সতেরোর নারী দিবসের ঠিক আগের দিন। আমার বাহুবন্ধনে পস্তুবালা দেবী কর্মকার। নিজে নাচনি, আবার নির্যাতিত নাচনি সম্প্রদায়ের লড়াকু নেত্রী, পোস্তদানার মতোই মহার্ঘ এই নারী। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি এবং নাচনি সম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রাণনারী পোস্তবালার সঙ্গে নাচনিদের সাজঘরে বসে ওপরের কথাগুলি বলাবলি হয়েছিল। তারপর আন্তর্জালে ছবি ও লেখা। পর পরই পুরস্কারপ্রাপ্তি। ফোনে পস্তুকে তৃপ্ত লেগেছিল সেদিন। নিজস্ব সংগ্রামে জয়ী হওয়া নয় শুধু, দুর্বারের সহযোগিতায় সাথীদের সে পথে টেনে আনার কাজেও তিনি সমান সফল। তাই সমগ্র মানভূমে পস্তুবালার খ্যাতি আজ শুধু অনন্য শিল্পী হিসেবে নয়, স্বাধিকার অর্জনের লড়াকু নেত্রী হিসেবেও।
তবে পস্তু মহান শিল্পী টিল্পি কিছু নয় আমার কাছে। সে আমার সই। সে আমায় নিমন্ত্রণ করেছে বর্ষার দমকবাঁধা দিনে তার গ্রামের বাড়ি গিয়ে থাকতে। দুজনে ভিজব আর বড় শালপাতার নিচে বসা ভেজা চুপ্পুস ছাতারে পাখিটির দিকে আঙুল তুলে দেখাবে পস্তু। গোটা দুপুর প্রাণের কথা কইব, আর তার রসিক ধান রুয়ে ঘরে ফিরলে অনেক রাত অব্দি মহুয়াভেজা গান শুনব। রাতে শুয়ে পস্তু চুপি চুপি বলবে,
–হামদের জীবন যেরম কাটে তাতে তুমি যাইই পাও, আর যাইই ন পাও কেনে, কুন ফারক নাই। শিল্পীমনের হতাশা ঠিক যেমন কুয়াশার মতনই ঘেরে থাকে। যে গাড়াকে সে গাড়াকেই পড়ি থাকি। সংসারটা তো জুয়াল বটে। গরুর মতো বাধ্য হঁয়ে ঘাড়টা গতাতে হয়। খুলবার জো নাই একটুকু। আমি যেন ঠিক কানা কাত্তিক, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। গটা জম্মের কম্ম ওই একবারই করেছি, ওই পুরস্কার পাওয়াটা!
আমি বুঝি, শিল্পীমন আবার উড়াল দিতে চায় সুরের সমুদ্রে, নৃত্যের অনাবিষ্কৃত মুদ্রায়। সংসার পিছু টানে, বয়স পিছু টানে, কখনও পুরস্কারও পিছু টানে।
তবে আমাদের না-ঘটা বর্ষা বসবাসের ওপর লেখা এর চাইতে ঢের বড় হবে। কারণ আমাদের পরস্পরকে অনেক কিছু বলার আছে।
“এই নাচনি হয়ে ওঠা আমাদের জীবন সংগ্রাম আমাদের শিল্পীসত্তার জয়।” – নৃত্যশিল্পী পস্তবালার এই অকপট উক্তি শক্তিশেলের মত বুকে বেঁধে গেল। স্বাধিকার অর্জনের লড়াকু নেত্রীকে স্যালুট।
লেখাটা খুব খুব ভাল লাগল দিদি। লেখার গুণে একদম ছবির মত তাঁকে দেখতে পারছিলাম। মানভূমে যাওয়া হয়নি তো কী, ওখানকার সঙ্গে একটা আত্মিক মিল তৈরী করে দিলেন আপনি।
অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ। বিষয়বস্তুটিই মনকাড়া। এদের আরো ভালো করে জানতে সবারই মন চাইবে।