শহিদুল আলম, সত্যের পথে মত প্রকাশের এই লড়াই জারি থাকুক

লিখন অনিরুদ্ধ

 

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব রসায়নে পিএইচডি করেছেন ১৯৮৩ সালে, অতঃপর বেডফোর্ড কলেজে আলোকচিত্রের বিকল্প মুদ্রণ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা। চোখ বন্ধ করে নির্ঝঞ্ঝাট একটি জীবন বেছে নিতে পারতেন। অনায়াসে হতে পারতেন একাধারে স্বনামধন্য রসায়নের শিক্ষক ও গবেষক। কে জানত, তার দু’চোখে ছিল ভিন্ন অভিপ্রায়। রসায়ন হাত ধরে নয় বরং হাতে তুলে নিয়েছেন ক্যামেরা, চোখ রেখেছেন লেন্সে। বাকিটা বাংলাদেশের আলোকচিত্রের সোনালি দিনের গল্প। বলছি একজন শহিদুল আলমের কথা…

বিলেতের পাঠ চুকিয়ে ‘৮৪তে বাংলাদেশে ফেরা। দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে নিয়েছে জেনারেল এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকার। ঢাকার রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে। ক্যামেরা হাতে শহিদুল আলম বেরিয়ে পড়েন। স্বৈরাচার বিরোধী গণমানুষের প্রতিরোধের ছবি তোলেন একজন ক্যামেরাযোদ্ধা, ‘৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম আলোকচিত্র প্রদর্শনশালা ‘দৃক গ্যালারি‘। গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকার পতনের পর আলমের তোলা ঢাকার রাস্তায় উল্লসিত জনতার ছবি প্রকাশিত হয় দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে।

সময়ের চাকা ঘুরছে, সমানতালে চলছে আলমের ক্যামেরা। কখনও ভোটকেন্দ্রের ব্যালটবাক্সের স্থিরচিত্র, কখনও প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনের আঘাতে বিধ্বস্ত উপকূলে স্বজনহারা বালিকা সুফিয়া কিংবা ইসলামী মৌলবাদীদের ফতোয়ার শিকার নূরজাহান উঠে আসছে আলমের ক্যামেরার লেন্সে। ‘৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে পুলিশ ভ্যানে আটক বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের নেতাকর্মীদের একটি ছবি দেশব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিল। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লিগ দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনে পুলিশের সাথে আওয়ামী লিগ সমর্থকদের সংঘর্ষ বাধে। রাস্তায় সাংবাদকর্মীদের উপর অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়, ছবি তোলার সময় শহিদুল আলমকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

আলম দমে যাননি, এক মুহূর্ত থামেনি তার ক্যামেরার অগ্রযাত্রা। ‘৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠশালা, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফটোগ্রাফি। পরবর্তীতে নাম বদলে রাখা হয় পাঠশালা, সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট

সেসময় ঢাকায় প্রথমবারের মতো বিশ্ব প্রেস ফটো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালে আলমের হাত ধরে ঢাকায় আয়োজন করা হয় এশিয়ার প্রথম আলোকচিত্র প্রদর্শনী “ছবিমেলা”। প্রথম ছবিমেলা’র বিষয় ছিল ‘১৯৭১, দ্য ওয়ার উই ফরগেট’। প্রদর্শনীর জন্য আলম প্রায় ছ’ বছর ধরে ‘৭১এর ছবি সংগ্রহ করেছেন। দশটি দেশের ত্রিশজন খ্যাতিমান আলোকচিত্রীদের তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবি প্রথম ছবিমেলায় স্থান পেয়েছিল।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দৃক বার্ষিক দিনপঞ্জি প্রকাশ করে আসছে। ২০০৩ সালে প্রকাশিত দিনপঞ্জিতে স্থান পায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি। এতে আলম প্রথম “থার্ড ওয়ার্ল্ড” শব্দটির পরিবর্তে “মেজরিটি ওয়ার্ল্ড” ব্যবহার করেন। ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদে ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় দিনপঞ্জি “রেজিস্টেন্স”।

দেশে কিংবা বিদেশে রাজনৈতিক টানাপোড়ন যেন থামছে না কিছুতেই। নির্বাচন আসলেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে ২০০৮ সালে দৃক গ্যালারি ও ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। পুলিশ ২০০৯ সালে দৃক গ্যালারিতে তিব্বতের স্বাধীনতাকামী ছাত্রদের “ইন টু এক্সাইল : তিব্বত ১৯৪৯-২০০৯”  আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজনে বাধা প্রদান করে। এরপর প্রথিতযশা ভারতীয় লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দৃক গ্যালারি আয়োজিত আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে ঢাকায় আসেন। পুলিশ মহাশ্বেতা দেবীকে দৃক গ্যালারিতে প্রবেশে বাধা দেয়, পরবর্তীতে আদালতে রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে দৃক গ্যালারির সামনে থেকে পুলিশ অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়।

১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ নিয়ে চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার দাবিতে ঢাকার শাহবাগে ২০১৩ সালে গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে। তৈরি হয় গণজাগরণ মঞ্চ, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল এদেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতকল্পে সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সেই সময় শহিদুল আলম যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ও চলমান অসন্তোষ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে নিবন্ধ লিখেছেন। কল্পনা চাকমার অপহরণ ও অন্তর্ধানের ১৮ বছর উপলক্ষে আলম কল্পনার ব্যবহৃত জিনিসপত্র, খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে একটি প্রদর্শনী আয়োজন করেন।

শহিদুল আলম ২০১৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আর্ট পুরস্কার শিল্পকলা পদক লাভ করেন। বৃটিশ জার্নাল অফ ফটোগ্রাফি ২০১৬ সালের জুলাই সংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রয়েল কলেজ অফ আর্ট, ইংল্যান্ড ও পাঠশালা, বাংলাদেশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২৯ জুলাই, ২০১৮ থেকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে গোটা ঢাকা। হাজার-হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। ৫ আগস্ট ছাত্রদের মিছিলে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা করে। আলোকচিত্রীদের বেধড়ক পেটানো হয়, তাদের ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। আলম সেদিন ক্যামেরা হাতে রাস্তায় ছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ করেন, আল-জাজিরা টেলিভিশনে সামগ্রিক অরাজক পরিস্থিতির জন্যে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। সে রাতেই গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) তাকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পুলিশ জানায় শহিদুল আলম তাদের হেফাজতে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশ বিরোধী অপপ্রচার ও সামাজিক মাধ্যমে সরকার বিরোধী উস্কানি প্রদানের অভিযোগে বিতর্কিত তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়। আদালত চত্বরে আলম জানিয়েছেন, তাকে পুলিশ কাস্টডিতে রক্তাক্ত করা হয়েছে, রক্তমাখা পাঞ্জাবি ধুয়ে পুনরায় পড়তে দেওয়া হয়েছে। আলমের মুক্তির দাবিতে সরব ছিল নোবেল বিজয়ী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসমূহ ও বিশ্ব গণমাধ্যম। দীর্ঘ ১০৭ দিন কারাবাসের পর গত ২০ নভেম্বর রাত ৮.৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শহিদুল আলম জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাৎক্ষণিক অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আলম বলেন, ‘মুক্তি তো প্রত্যেকের কামনা। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন নাগরিকেরা মুক্ত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীন নাগরিকেরা যদি তাদের মুক্তচিন্তা বা স্বাধীনভাবে কথা না বলতে পারে, তাহলে তারা পরাধীন।’

আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে লুসি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ‘হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড-২০১৮’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে। শহিদুল আলম, সত্যের পথে মত প্রকাশের এই লড়াই জারি থাকুক!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...