রূপকার

দেবাশিষ দন্ড

 

বাউল কুম্ভকারের আটচালায় এসে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা টের পেল কনককান্তি। লক্ষীপুজোর বাজার। আনাচেকানাচে এ সময় ঘরোয়া উচ্ছলতা লেগে থাকে। দুর্গাপূজার হুল্লোড়ের শেষে এ যেন ঘরে ফেরার উৎসব। দুয়ারে দুয়ারে সেই পদচিহ্ন। প্রতিমা কিনতে এসে চেনা অচেনার জটলায় সাতরকমের কথা ওঠে। এসব আজ কিচ্ছু নেই। কিনতে আসা মানুষগুলোও নেই। দু’ একজন ছিল। একটু আগে চোয়াল ঝুলিয়ে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল।
বাউলের হাতেগড়া মূর্তি কথা বলে। ফড়িঙের ডানার মতো চোখের পলক তিরতিরিয়ে কাঁপে। অতিবড় অবিশ্বাসীও বাউলের প্রতিমার দিকে তাকিয়ে শিল্পনৈপুণ্যর প্রশংসায় ঝলর ঝলর করে।
বাউল লন্ডন আমেরিকায় যায়নি। ওর হাতেগড়া দুর্গাপ্রতিমা ফি বছর গেছে। এসব তার ভরযৌবনকালের গল্প। তখন দেহে তাকত ছিল। দৃষ্টি ছিল ঝকঝকে। বয়সে সব ফুরাই ফুরাই করে। ভাইপোদের কাজ শিখিয়েছে। বাউলের মতো ওদের যশভাগ্যি না থাকলেও পাকা শিল্পী হয়েছে বটে। এন্তার বায়না ধরে। বাউল থাকে লক্ষী সরস্বতী শীতলা মনসা নিয়ে। বড় কাজে হাত দেয় না।
বাউল এখন বায়নার টাকা ধরে না। ওর একটাই কথা, ক্ষমতায় যতগুলো কুলোয় গড়ব। যারা আগে আসবে পাবে। কথা দেওয়ার পাট নেই। গত পাঁচবছর ধরে এই চলছে। পুজোপাবনের দিনে তাই হুড়োহুড়ি লেগেই থাকে।
বাউলের মেয়ে দুটো উঠোনে বসে এঁটো বাসন মাজছে। বউ গেরস্থালীর কাজে ঘর-বার করছে। অন্য বছর আলাদা কথা। তিনজনেই বসেছে আঠার বাটি নিয়ে। পালা করে মুকুট চড়ানো, গয়না পরানো। ডাকসাজের হাজারো কাজ করে থই পেত না। আজ ওদের তাড়া নেই।
বাউল কুম্ভকার দাওয়ায় বসে একটা নিশ্চিন্তের বিড়ি ধরিয়েছে। কনককান্তি বললেন– কি হে বাউলা, আমার জন্য একটা ঠাকুর রেখেছিস তো?
বাউল বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলল– ভিদরে যান। পসন্দো ক্যরে আসেন।
কথাটা বলার সময় একবারও কনককান্তির মুখের দিকে তাকাল না। কনককান্তিও এই তাচ্ছিল্যটুকু গায়ে মাখলেন না। বাউল গুণী শিল্পী। এটুকু ওকে মানায়।
কনককান্তি ঠাকুর-ঘরে ঢুকে ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। এসব কী ছেলেমানুষি করছে বাউল? সব সুনাম জলাঞ্জলি দিয়ে কী গড়েছে সে? প্রতিটি মূর্তি অসম্ভব কুৎসিত। ছোট বড় দশ বারোটা মূর্তি। সবকটাতেই চরম অযত্নের বিভীষিকা। কৃষ্ণবর্ণ, উঁচু কপাল, ভাঙা চোয়াল, ফ্যাকাসে চোখ, অবিন্যস্ত চুল। কোথাও একটুও লক্ষীশ্রী নেই। কনককান্তি একটা একটা করে বারোটা মূর্তিই খুঁটিয়ে দেখলেন। নাহ, একটাও নেওয়ার মতো নয়।
কনককান্তি যখন মুখ ব্যাজার করে বেরিয়ে এলেন বাউলের বিড়ি নিভু নিভু। বলল– পসন্দো হ্যল?
–না রে বাউলা।
–জাইনতম হবেক নাঁয়।
–এসব কী খ্যাপামি করেছিস? মায়ের মুখ এত কদর্য হয়?
–বনালেই হয়। সব তো মানুষের হাতের খেল। দেবদেবীর মুখগুলা অত সুন্দর হয় ক্যানে? মানুষ ভালবেইসে সুন্দর ক্যরে বনায় ব্যলে ন?
–তাহলে তুই সুন্দর করে বানালি না কেন?
–ক্যানে বনাব? ভগবান গদ্দারি ক্যরেছে। ইয়ার লেগে পতিশোধ লিলম।
–এ আবার কী কথা? মাথাটা একেবারেই গেছে নাকি?
–আমার বিটি দুটর বয়স হ্যঁয়ে গেল ত্রিশের উপরে। ভগবান উয়াদের এক চলতা রূপ দিল নাঁয়। ইয়ার লেগে বিহা হ্যল নাঁয়। কেউ উয়াদের লিতে খুঁজে নাঁয়। আমিও ভগবানের রূপ দিলম নাঁয়, কেউ যেমন লিতে নাঁয় খুঁজে। দ্যাখ কেমন লাগে!

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...