হাসপাতাল ও থানার মাঝে

সৌনক দাশগুপ্ত

 

মতিউর এক্কেবারে থম মেরে গেছে। ৩৯ ডিগ্রির দুপুরটা মাঝে মাঝে লজ্জা পাচ্ছে ওকে দেখে। অনেক চেষ্টা করে এই ভর দুপুরে খানিক গুমোট মেঘ জড়ো করেছে, গাছপালাগুলোকেও মোটামুটি ম্যানেজ করে নিয়েছে। সব্বাই মিলে বেশ চুপচাপ একটা লাশ গুম করা পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু সব বৃথা। সব। মতিউর একাই পুরো ফুটেজ খেয়ে নিয়েছে, থম মেরে গেছে।
ওর চান ঘেমো সুপারম্যান গেঞ্জি, সাদা নোনা ছাপ বসা কালো টেরিকটের প্যান্ট, ঘাম ঘামাচির সহাবস্থানে হেজে যাওয়া কপাল, সবকিছু কিরম নেতিয়ে পড়ছে ওর ওই থম মারা মুখ দেখে। নাকি আসলে ৩৯ ডিগ্রি বলেই থমথমে ভাবটা বেশি সেটা এখনও অব্দি ঠাওর করা যাচ্ছে না।
আসলে মতিউর বোঝা আর না বোঝার ঠিক মাঝের কার্নিশটায় ঝুলছে। এমনিতে সে খুব সেয়ানা ছেলে। লোকে তাকে চেনে, তার টেলারিং এর দোকান– শাহেনশাহকে চেনে, আর চেনে তার ধর্মকে। হাসপাতাল আর থানার মাঝে ৫০০ মিটারের ফিতে মাপা পথ। মাঝে দুটোই মাত্র দ্রষ্টব্য। মতিউরের দোকান আর তার ১৩ ফুট দূরে (যেহেতু পাঁচিল থেকে সাড়ে ছয় ফুট ছাড় রাখাটা নিয়ম) কোমায় চলে যাওয়া মার্কেটটা। ল্যাংটো পিলারগুলো গুটি কয়েক শ্যাওলাবাসী দেওয়াল আর ছাদ নিয়ে খাড়া আছে। এ মার্কেটের কাজ শুরু হয় ‘কমলে’ড সজল দাসের আমলে। উনি তখন এলাকার কাউন্সিলর সাথে সাথে পৌরপ্রধান (উপ)। কিন্তু পরবর্তী কালে (যখন লাল আস্তে আস্তে মাঠে ঘাটে, ঘাসে ফুলে মিশে যাচ্ছে) পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার আরও কর্মদক্ষ হয়ে ওঠায় মার্কেটের প্ল্যানে অনেক ভুল ত্রুটি ধরা পড়ল, এবং এলাকাবাসীর সাধের মার্কেট অচিরেই ছাগল, গরু ইত্যাদি গবাদি পশুর প্রাত এবং বৈকালিক ভ্রমণের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠল।
এই মার্কেট হবার আশাতেই মতিউর স্বপন বুড়োর আধা জ্যান্ত চায়ের দোকানটা কিনে নিয়ে টেলারিং খুলে বসল। তা মার্কেটের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটলেও, মতিউর কিন্তু দিব্ব ব্যবসা জমিয়ে নিয়েছিল, সেয়ানা মানুষ সে।
তো এহেন মতিউর আজ চুপ মেরে গেছে। হাসপাতালের সেজ ডাক্তার আর থানার মেজ বাবুর ট্যারা ব্যাকা চাউনি এবং প্রসঙ্গে।
“আচ্ছা ওই ঘটনার জায়গা থেকে হাসপাতাল কতদূর ছিল? তোর কী মনে হয়?”
মতিউর বুঝতে পারে না কী উত্তর দেবে মেজবাবুকে; কারণ প্রশ্নখানা মেজবাবুর পাকানো গোঁফের মাখানো হাসির ভাঁজেই ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে উত্তরটা ভুল হবে।
অতএব ডেলা ডেলা চোখে ৪৯ এর নামতা বলার মতোই বিড়বিড় করতে থাকল মতিউর।
“না আপনি একদম ঠিক বলেছেন। কতই বা দূর ছিল থানা!! ওর আগে আপনাকে খবর দেওয়া উচিত ছিল। আমি তো ভাবছি অন্য কথা। এ বেটা নিজেই…” ডাক্তারের ইঙ্গিতে মতিউরের বুকের পাঁজরগুলো আর স্থির থাকতে পারল না, দাপাদাপি শুরু করে দিল।
“আমি তো অতো কিচু ভাবিনি সার। তকন দেকলুম…”
“কি দেখলি রে পাগলাচোদা?? তুই সব দেখে শুনেও কিছু করলি না!! নাকি সব ভালভাবে মিটে যাবার পরে হাসপাতালে এলি?? ডাক্তার মিথ্যে বলেনি বলেই তো মনে হচ্ছে এখন!!”
মতিউরের বুকের পাঁজরে ভূমিকম্পের দ্বিতীয় আফটার শক, এবং ডাক্তারের সৌজন্যে অনতিবিলম্বে তৃতীয় শক, “শালা এদের জন্যে পুরো দেশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বানচোতগুলো যার খায় তারই গাঁড় মারে। এক গুজরাটে শিক্ষা হয়নি এদের।”
“তুই থানায় আগে গেলি না ক্যানো? ভয়ে? নাকি হাসপাতালে ফেলে দিয়ে ভাগবি মনে করেছিলি?”
“না মেজবাবু। আমি ভাবলুম আগে তো টিরিটমেন লাগবে। তাই হোসপিটাল চইলে এলুম। বড় পীরের দিব্বি দে বলচি।”
“তুমি আমায় পট্টি পড়াচ্চ হারামজাদা?? এরম কেস অনেক দেখেছি বুঝলি। শালা উজবুক পেয়েছ আমায়। সত্যি করে বল তো কে কে ছিল??”
“শোন মতি, আমরা ডাক্তাররাই বলি রোগীকে আগে চিকিৎসা তারপরে অন্য নিয়মকানুন। কিন্তু এ যা কেস এতে তো আগে পুলিশে খবর দেওয়া দরকার ছিল। ওরা এসে জায়গাটা ভালো করে সার্চ করে দেখত। তুই কি কি যে এভিডেন্স ঘেঁটে দিয়েছিস!!”
“বিশ্বাস করুন ডাগতারবাবু, আমি শুধু তুলে নে এখানে এনে রেকেচি। আর কিচ্ছুটি ধরিনিকো।”
“তুমি আক্কেবারে চন্দন ধোয়া তুলসী পাতা আমার! কে কে ছিল বল।” মতিউরের এবার বেশ ভালো বুদবুদ গোছের লাগল মনের মধ্যে, চিরকাল সে জেনে এসেছে তুলসী হল কবরেজদের ইস্কাবনের বিবি। তা থানার মেজবাবু তাকে তুলসী বলেছেন, সাথে চন্দনের সেন্ট!! সেই সেই দিলীপ কুমার ফিলিং এসে জুড়ল সাথে।
না, আমাদের মতিউর বরাবর হিন্দি ‘বইয়ের’ পোকা। যখন মতিউর সিনেমা দেখতে শেখে তখন মাধুরী ‘ইক দো তিন’ গুণতে গুণতে ‘সাজনের’ বুকে কাব্যির আগুন বুনে দিচ্ছে। লোকজন আবেগ মেখে নিজের বউকে ডায়লগ শোনাচ্ছে, “রিস্তে মে তো হাম তুমহারে বাপ লাগতে হ্যায়..”। অতএব মতিউরও মাদ্রাসার বৃত্তিমুলক শিক্ষা ছেড়ে, মহান ভারতীয় সিনেমার সমাজসেবামূলক শিক্ষা বেছে নিল। যেমন হাতি মেরা সাথী দেখে ও পায়রা পুষতে শুরু করল। সামান্য কাজীর ছেলের কাছে হাতি মানেই ঐরাবত, কিন্তু পায়রা মানেই পায়রাবাজি, পয়সা, বামুনচকের বড় মুখুজ্জের মেয়ে সন্ধ্যার গোল গোল ভীতু চোখের অবাক আকাশ চাউনি। হুঁ হুঁ মতিউর সেয়ানা ছেলে, বরাবর।
কিন্তু এহেন মতিউর ফেঁসে গেছে হাসপাতাল আর থানার মাঝে। মতি মিঞা বুঝতে পারছে না কতটা বেফাঁস বললে ওর লোম, ঘাম, লালা, বীর্য সব কিছু আতস কাঁচ আতস কাঁচ খেলা শুরু করবে! এই যেমন মেজবাবুর পরের প্রশ্ন,
“অত ভোরবেলা তুই কী করছিলি ওখানে?”
“রমজান মাস পড়েছে সার, ঢের রাত্তির অব্দি কাজ। রাত্তিরে তাই দোকানডাতেই ঘুম দি। আজ ভোর রাত্তিরে পেচ্ছাপ পেলি জোর।”
“ও পেচ্ছাপ পেল, আর উনি বস্তু নাচিয়ে বেরিয়ে পরল। পেচ্ছাপ না বাই শালা??”
এবার মতিউরের রাগ এসে গেল। পেচ্ছাপ, মানুষের সব থেকে স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়া, সেটারও নাকি জবাবদিহি দিতে হবে! এবার হয়তো প্রশ্ন করবে এত জায়গা থাকতে হাসপাতালের দিকে কেন পেচ্ছাপ করতে এল, থানার দিকটা কি দোষ করেছিল!! অথবা ক’ ফোঁটা পেচ্ছাপ করার পরে ও খেয়াল করল! হয়তো ওকে পেচ্ছাপ করে দেখাতেও হবে এখন, এমনকি চোখ নাক কান মুখ সব অবিকল করে! ওরা বোঝার চেষ্টা করবে কী করে ওর মাথায় থানার বদলে হাসপাতালে যাবার কথা এল! ও তো ছিল হাসপাতাল আর থানার মাঝে।
“সার আমি তো রেতে বিরেতে পেচ্ছাপ চাপলে ওই মার্কেটের ঝোপটার পেচনেই করি! রাস্তা থেকি দেকা যায় না।”
“হ্যাঁ, কিছুই তো দেখা যায় না। তা কদ্দিন ধরে চলছে এসব বানচোদ? আজ কি টান বেশি উঠেছিল?”
মতিউর থান ইটটা খুঁজছিল, লালচে কালচে রক্ত লেপ্টে যেটা ওই ঝোপের পিছনে পড়ে ছিল। খাপ খোলা দাঁতের কামড়ে ডিজাইন করা মাই, অহংকারী পুরুষাঙ্গের (বা পুরুষাঙ্গদের) দাপটে ক্লান্ত যোনি সহ হাসপাতাল আর থানার মাঝে ৫০০ মিটার রিলে রেসে হেরো সন্ধ্যা মুখুজ্জের খোসা ছাড়ানো শরীরটার পাশেই পরে ছিল ইটটা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...