সৌমিত্র দস্তিদার
ইতিহাসের সঙ্গে কোথাও যেন নদীর একটা মিল আছে। নদী যেমন নিজের মর্জিমাফিক দিক বদলায়, পাড় ভাঙতে ভাঙতে সুবিধামতো নিজের চলার পথ খুঁজে নেয়, তাতে কোন গ্রাম, জনবসতি থাকল না ভেসে গেল তার তোয়াক্কা করে না, ইতিহাসের চলন খানিকটা তাই-ই। ইতিহাস নিছক প্রাচীন কোনও আখ্যানমালা নয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় উপাদান আপনি পাবেন ইতিহাসের পাতায় পাতায়। কথায় আছে– নদী তার গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সব কিছু ঠিক সময়ে কোনও না কোনওভাবে ফিরিয়ে দেয়, ইতিহাসের বিনির্মাণেও আমরাও পেয়ে যাই অনেক অজানা তথ্য। নদীর ভাঙাগড়ার মতো ইতিহাসের মহামহিম সব চরিত্র পুনর্নির্মাণের কালে নতুনভাবে, নতুন ইমেজ নিয়ে জনমনে জায়গা করে নেন। কাল যিনি নায়ক ছিলেন, আজ তিনি হন খলনায়ক। ভিলেন হয়ে যান হিরো। কোনও চরিত্রই স্রেফ সাদা বা কালোয় ভাগ করা যায় না। রাজনৈতিক প্রয়োজনে অনেক সময় আমরা তা করি বটে তবে তা প্রকৃত ইতিহাস নয়। যেমন যে লোকটি ছিলেন হিন্দু- মুসলিম ঐক্য নিয়ে সতত সোচ্চার, যিনি দাবি করতেন– ‘আমি সবার আগে ভারতীয়, তার পরে মুসলমান’, তিনিই ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন দেশভাগের জন্য দায়ী, অপরাধী। আমাদের চেনা ইতিহাসে আজ নতুন করে যে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটছে, একসময় যার পরিণতিতে ১৯৪৭-এর দেশভাগ, বলা হয় যে সেই বিষবৃক্ষের বীজ পুঁতেছিলেন একজন ও তাঁর দল। মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং মুসলিম লিগ। অদ্ভুত একতরফা ভাববাদী এই ইতিহাস নির্মাতারা সচেতনভাবেই সুকৌশলে জিন্নাহকে একমাত্র খলনায়ক করার মধ্যে দিয়ে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কেই দেশকে টুকরো করার ‘অপরাধে’ দোষী সাব্যস্ত করে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। অথচ শুধু দেশভাগ নয়, এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ স্বাধীনতার আগে থেকেই এবং আজকেও জনমনে চারিয়ে দিচ্ছেন যেসব আসল খলনায়ক, তাদের কৃতকর্ম সময় সময় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
তবে এখন সময় এসেছে আমাদের ইতিহাসের দিকে নতুন করে তাকানোর। সময় এসেছে জাতীয়তাবাদী নেতাদের চেনা আস্তরণ সরিয়ে তাদের খড়মাটি ফেলে দিয়ে প্রকৃত মূল্যায়ণ করার। কত কত কুশীলব, কত লড়াই, আন্দোলন, অগণন শহীদের মুখ, সুভাষচন্দ্র, নেহরু, প্যটেল, জিন্নাহ, মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতার বরেণ্য সব নেতৃবৃন্দ তো আছেনই, পার্শ্বচরিত্রের নেতারাও কম ওজনদার নন। সোওয়ারাবর্দি, ফজলুল হক, শরৎ বসু, যোগেন মণ্ডল এবং অবশ্যই এখন এদেশের শাসকদের গোল্ডেন বয় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি— এরকম জানা-অজানা অজস্র নাম। সময় এসেছে ফেলে আসা ইতিহাসের পোস্টমর্টেমের। তাহলেই আজকের চরম হিন্দুত্ববাদীদের শিকড় আপনি খুঁজে পাবেন, তাদের নির্মিত ইতিহাসের মিথ্যেটুকু ধরতে কোনও অসুবিধা হবে না।
আমি আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ দিয়ে ফেলেছি– বাবাসাহেব আম্বেদকর। তবে দেশভাগের পোস্টমর্টেম করলে নিঃসন্দেহে প্রথমেই আসবে জিন্নাহর নাম। কারণ আগেই বলেছি যে এদেশের অধিকাংশ লোক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জেনে আসছে উপমহাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের খলনায়ক একজনই– মহম্মদ আলি জিন্নাহ। আমাদের দেশভাগ ও জিন্নাহ কেমন যেন সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। নাটকে, ফিচার সিনেমায়, তথ্যচিত্রে, উপন্যাসে, গল্পে সর্বত্র জিন্নাহ বললেই কল্পনায় ওমরিশ পুরি, প্রান বা আমজাদ খানের মুখ ভেসে ওঠে। এ এক ভয়ঙ্কর নির্মাণ। এত শক্তিশালী এ সযত্ন নির্মাণ যা এতবছর বাদেও এদেশের অধিকাংশ লোকের, এমনকি বাংলাদেশের অনেকের মধ্যেই কায়েদ-এ-আজম রক্তচোষা ড্রাকুলা হয়েই থেকে গেলেন। আসলে একজনকে ভিলেন না বানালে তো অন্য কাউকে নায়ক বানানো যায় না। একবার কলকাতায় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আয়েশা জালাল জিন্নাহ নিয়ে যুক্তিসহকারে কিছু ইতিবাচক কথা বলায় পরেরদিন জনপ্রিয় একটি ইংরেজি দৈনিক হেডলাইন করেছিল– ভারতে বসে জিন্নাহর প্রশংসা। সেও বহু দিন আগের ঘটনা। তখনও এদেশে ফ্যাসিবাদের ছায়া এত স্পষ্ট হয়নি। এখন শুধু জিন্নাহ নয়, ভিন্ন ভাবধারার কোনও বিষয় নিয়েই লেখা বলা বড্ড কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু শুরুতেই বলেছি ইতিহাস কারও লাল চোখের তোয়াক্কা করে না। সে বিচার করে নির্মোহভাবে। সব মানুষের মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকে। জিন্নাহরও ছিল। এক জিন্নাহর মাঝে ছিল বেশ কয়েকজন কায়েদ-এ-আজম জিন্নাহ। একজন প্রবল দাম্ভিক। উন্নাসিক। কঠিন হৃদয়। পুঁজিবাদ ঘনিষ্ঠ। এই জিন্নাহ কোনওদিনই আমজনতার কাছের নেতা নন। তবু তিনিই ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে হয়ে ওঠেন একটি নবনির্মিত দেশের জননেতা– ভালোবাসার কায়েদ-এ-আজম। এই জিন্নাহ, পরমত সহ্য না করা, দাম্ভিক, পাকিস্তানের ‘জনক’-ই দেশভাগের পরপরই বাঙালি আবেগের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে তখনকার পুববাংলায় গিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
এ যদি জিন্নাহ-র একটি দিক হয়, তাহলে তাঁর চরিত্রের অন্যদিকগুলো নিয়েও আলোচনা করা দরকার। জিন্নাহ আদতে ছিলেন দাদাভাই নওরোজির পরম ভক্ত। বস্তুত তাঁরই প্রেরণায় জিন্নাহ-র রাজনীতিতে আসা। রাজনৈতিক জীবনের বড় সময়, ১৯১৩–১৯২৮ জিন্নাহ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অগ্রণী নেতা। ক্রমজাগ্রত জাতীয়তাবাদের অক্লান্ত সৈনিক। যিনি তখনও লিগের নেতা নন। তার স্বপ্নের ভারত হিন্দু-মুসলিম মিলিত, সত্যকারের এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ইতিহাসের সাধারণ তন্নিষ্ঠ ছাত্রও আজ জানে জাতীয়তাবাদী একটি লোককে কীভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দু মাতব্বর নেতারা স্রেফ জোর করে নিতান্তই একজন মুসলিম নেতা করে তুলল।
জিন্নাহ চেয়েছিলেন কংগ্রেস পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা, সরকারি চাকরি ও রাজনীতিতে সামান্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেবে। আকুল জিন্নাহ প্রশ্ন তুলেছিলেন– গরিষ্ঠ কি লঘিষ্ঠকে কিছু দিতে পারে না? বিনা যুদ্ধে যে সূচাগ্র মাটিও হিন্দুত্ববাদীরা দেবে না, জিন্নাহ তা বড় দেরিতে বুঝলেন। কংগ্রেসের প্রতি, তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের ওপর অনেক আস্থা ছিল জিন্নাহ-র। বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর জিন্নাহ দেশ ও রাজনীতি ছেড়েই চলে গেলেন বিদেশ। বহুবছর পর ফিরলেন এক্কেবারে অন্য জিন্নাহ হয়ে।
সমাজবিজ্ঞানের এক সাধারণ ছাত্র হিসেবে এটুকু বুঝি যে আজকের মনুবাদী রাজনীতির প্রবল দাপটের সূচনাপর্ব সেই বিশ শতকের গোড়ায়। ভারতীয় রাজনীতিতে সন্ধিক্ষণ বা ক্ষমতার বৃত্ত থেকে মুসলিম বিতাড়নের সূচনা ১৯২৮-এ। জিন্নাহ উপলক্ষ মাত্র। তাঁর ১৪ দফা প্রত্যাখ্যান একসঙ্গে অনেক বার্তা দিল দেশের জনসাধারণ ও বৃটিশ প্রভুদেরও। নিমেষে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মিথ ও সম্ভাবনা। জিন্নাহর প্রস্তাবিত ১৪ দফার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। অপরদিকে কংগ্রেস ও তার ভিতরে থাকা দক্ষিণপন্থীদের দাবি ছিল অতিকেন্দ্রায়ণ। এখন শাসকবিরোধী জোটরাজনীতির যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের স্লোগান, সেটি সর্বপ্রথম তুলেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহই। এ দাবির পিছনে নিশ্চয়ই কোনও সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি ছিল না। পাঠক, মনে রাখবেন যে ১৯২৮ সালে ধর্মীয় মেরুকরণ যখন স্পষ্ট হচ্ছে তার তিনবছর আগে ১৯২৫-এ জন্ম নিয়েছে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।
জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস ‘হিন্দু ভারত’-এর ডাক দিয়েছিল। ফলে মুসলিমদের একছটাক জমি দিতেও তারা নারাজ ছিল। কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার লড়াই তখনও জারি ছিল। আজও যেমন আছে। বস্তুত ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ রদের সময় থেকে যে স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা তা ক্রমেই হিন্দুত্ববাদীদের হাতে চলে গেল। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর ও আরও অন্যান্য গোষ্ঠীর বিপ্লবীদের কর্মধারা গভীরভাবে লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়।
জিন্নাহর মতো দক্ষ রাজনীতিবিদ, আইনজীবীও দীর্ঘ সময় এই হিন্দুত্ববাদের ছায়া ধীরে ধীরে যে স্পষ্ট হচ্ছে তা টের পাননি। সত্যি বলতে কি, দেশভাগের পূর্ব মুহূর্তেও তিনি দ্বিধায় ছিলেন হিন্দুত্ববাদীদের মুখোশের আড়ালে থাকা আসল মুখটা কেমন তা নিয়ে। ১৯৩৭-৪৬-এও জিন্নাহর সঙ্গে একধরনের তঞ্চকতা করা হয়েছে। কিভাবে তা ধীরে ধীরে বলব, এই লেখারই পরবর্তী পর্যায়ে। তখনই স্পষ্ট হয়ে যাবে জিন্নাহ নায়ক না হতে পারেন, কিন্ত শুধুমাত্র খলনায়ক নিশ্চিত নন।
(ক্রমশ)