“সিনেমা আসলে অ্যাসপিরেশনেরই ছবি”

নাসিরুদ্দিন শাহ

 

গত শতাব্দীর সাতের দশকে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার জন্মলগ্ন থেকে নাসিরুদ্দিন শাহ ছিলেন পোস্টার বয়। পরবর্তীকালে বাণিজ্যধর্মী চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর সুপ্রশিক্ষিত এবং স্বাভাবিক অভিনয়ের প্রভাব সুদূর বিস্তৃত। যা আরও গুরুত্বপূর্ণ, যে আদর্শের প্রতি তাঁর আস্থা, তা শুধু পর্দাতেই নয় ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি অনুসরণ করেন। সেই সততা এবং স্বতঃস্ফূর্ততাই তাঁর অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্বর চাবিকাঠি। তিনি যে স্পষ্টবাদী তা আমরা জানি। গত ৪ঠা অক্টোবর ২০১৮ মুম্বাইয়ে নিজের বাড়িতে তিনি সাংবাদিক লোকমিত্র গৌতমের সঙ্গে রাজনীতি, সমাজ এবং সমান্তরাল সিনেমা বিষয়ে অকপট আলোচনা করলেন।। ‘জনচৌক’ নামে হিন্দি ওয়েবপত্রিকায় গত ৭ এবং ৮ তারিখে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের ভাষান্তর ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য।

লোকমিত্র : নাসির সাব, বলা হয় সমাজে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত সবার আগে বোঝা যায় রাজনৈতিক বক্তব্যগুলি শুনে। তারপরে তা শিল্প অভিব্যক্তির অংশ হয়ে ওঠে। মোদি যুগে এই যে রাজনৈতিক বক্তৃতার ঘনঘটা এবং পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে আপনি বেঁচে আছেন, আপনার শৈল্পিক অভিব্যক্তি, বিশেষত সিনেমার অভিনয়ে তা কি জোরালো কোনও ছাপ ফেলতে পারছে? বিশেষ করে, যদি আমরা ইদানীং কালে ‘বাহুবলী’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘ইন্দু সরকার’ এবং তারপর ‘পদ্মাবত’ নিয়ে উত্তর ভারতের ভয়ঙ্কর বিরোধিতার ঘটনাগুলি দেখি, তাহলে কি বলা যায় এখন ফিল্মে মোদি যুগ চলছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : আমার মনে হয় এই প্রশ্নের সেরা উত্তরটি আপনি নিজেই প্রশ্নের শেষে দিয়েছেন। কোনও না কোনও রুলিং এলিট বাস্তব অর্থেই নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও নিজের মধ্যে খুঁজে পাইনি। সিনেমা কি আদৌ সমাজের আয়না হয়ে উঠতে পেরেছে? নাকি আমরা যা হতে চাই তারই ছবি সিনেমা দেখায়? সিনেমা যখন প্রথম শুরু হয়, তখন ধার্মিক কাহিনী দেখানো হত। তারপর সাইলেন্ট এরা-য় হলিউডের নকল করে স্টান্ট ফিল্ম বানাত। তাতে হিরোরা ওভারকোট আর হ্যাট পরে, সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছাড়ত। এই ফিল্মগুলিতে মহিলা চরিত্রগুলিকে দেখে মনে হত ইউরোপিয়ান। আমাদের যত অ্যাসপিরেশন, তা এইসব ঘিরেই তো ছিল। ঐ সময়ে উর্দু থিয়েটারগুলিতে সেক্সপিয়রের নকল করে আগা হশ্র কাশ্মীরি এবং অন্যান্যদের লেখা নাটক অভিনয় হত। এগুলির প্রভাব আমাদের সিনেমায় পড়েছে।

সিনেমা আসলে অ্যাসপিরেশনেরই ছবি। ‘বাহুবলী’ এবং অন্য যে ছবিগুলির নাম আপনি বললেন তাতে এটা প্রমাণিত হয় যে একটি বিশেষ ফিলোজফিকে আন্ডারলাইন করে তা সাজিয়ে গুছিয়ে দেখানো হচ্ছে। ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়া চলছে। রাস্তার নাম বদলে দেওয়ার মধ্যেও এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট। হতে পারে সরকারি তরফ থেকে এমনভাবে বদলানোর কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তবে এসবের জন্য সরকারের নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। যেমন, এমারজেন্সির সময় বলা হত মাথা নুইয়ে চলতে বললে মানুষ চার হাত পায়ে শুয়ে চলত। ব্যাপারটা এমনই। সমাজের মেজরিটির এক্সপ্রেশন যে পক্ষ নেবে, সেভাবেই ছবি তৈরি হবে। গত ৭০ বছর যা হয়েছে, তা টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হবে। তাই সবকিছু নাকচ করা হচ্ছে।

এমনটা নয়, গত সত্তর বছরে যা হয়েছে তার সবকিছুই দুধে ধোয়া। তখনও ‘কিসসা কুর্সি কা’র নেগেটিভ অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে। কিশোর কুমারকে অল ইন্ডিয়া রেডিও ব্যান করেছে। সালমান রাসডি’র বইয়ের প্রচার আটকানো হয়েছে। নেহেরুজির জমানায় যে ফিল্ম তৈরি হয়েছে, ‘দে আর এগেইন রিফ্লেকশনস অফ আওয়ার অ্যাসপিরেশন’। হিন্দু মুসলিম শিখ ইশাই সবাইকে আমার সেলাম। সোশালিস্ট ধরনের একটা বেন্ট অফ মাইন্ড… যা তখনকার ছবিতে ছিল, সে রাজ কাপুরের হোক, বা মেহবুব খানের হোক, বা বিমল রায়ের ক্ষেত্রে হোক… মানে এটাও একটা অ্যাসপিরেশনের ব্যাপার।

লোকমিত্র : অর্থাৎ এভাবেই এখনকার ছবি মোদি যুগকে রিফ্লেক্ট করে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : নিশ্চয়ই করে। স্পষ্ট বোঝা যায়।

লোকমিত্র : প্রত্যেক শিল্পীর কি নিজের একটা রাজনৈতিক ধারণা এবং ন্যূনতম রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন হওয়া উচিৎ? এই রাজনৈতিক বোধ কি তাঁর অভিব্যক্তিকে আরও ব্যাপ্তি দেয়, নাকি সীমিত করে দেয়?

নাসিরুদ্দিন শাহ : আমার মনে হয় সীমিত করে দেয়। আপনার ঝোঁক যদি ঐদিকে থাকে, তাহলে আপনার সক্রিয় রাজনীতিতেই থাকা উচিৎ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা এই যে, শিল্পীদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। যদি আপনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন তাহলে প্রথম থেকেই রাজনীতিতে নেমে পড়তে পারতেন। কিন্তু একজন শিল্পীর রাজনৈতিক বোধ, তাঁর নিজের পয়েন্ট অফ ভিঊ থাকাটা দরকার। অবশ্য বাস্তবে নিজের কাজে তা রিফ্লেক্ট করবার সুযোগ থাকে না। কারণ এক অভিনেতা মূলত অন্যের আইডিয়ার একটি মিডিয়াম। আপনার পলিটিকাল ভিউজ স্পষ্ট বোঝা যাবে আপনি কী ধরনের কাজ করতে পছন্দ করেন, তা দেখে। যদি কেউ ফান্ডামেন্টালিস্টদের ডিফেন্সে ছবি বানায়, সে বলবে তালিবান বা আইএস যা করছে তা খুব ভালো এবং আমি ওদের সঙ্গে আছি। সেক্ষেত্রে আপনার ভিউটা সবাই জানবে। তার উত্তরে আপনি বলতে পারেন যে আমি শুধু টাকার জন্য করেছি। সেই কারণে শিল্পীদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে সজাগ রাখবার জন্য লেখালেখি করতে হয়। তাই এত অ্যাক্টর পরবর্তীকালে ডায়রেক্টর হয়েছেন।

লোকমিত্র : একটি সাক্ষাৎকারে আপনার একটি বিখ্যাত মন্তব্য আছে। ফিল্মগুলিতে অভিনেতার হেয়ারস্টাইল ছাড়া আর কিছুই বদলায় না। কিন্তু আমরা দেখছি একটা সময়ে আপনার অভিনীত অধিকাংশ চরিত্র চারপাশটা পাল্টে দেওয়ার জন্য মরতেও রাজি। সিনেমাটি দেখানোর পর বিপ্লব ঘটে যাবে— এমন একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চরিত্রগুলিতে যখন প্রাণসঞ্চার করছিলেন, তখন কি আপনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে আপনি একটি অর্থহীন প্রয়াসে নিজেকে যুক্ত করছেন? সে সময়ে যদি আপনার এমন উপলব্ধি না হয় তাহলে কীভাবে এই ভাবনাটা এল যে ফিল্মে হেয়ারস্টাইল ছাড়া আর কিছু বদলায় না?

নাসিরুদ্দিন শাহ : সেই সময়ে আমাদের সবারই পৃথিবীটাকে পাল্টে দেওয়ার ভাবনাটা ছিল বটে। কিন্তু সেগুলি খামখেয়াল। আমাদের এমনটা ভাবাই ঠিক হয়নি যে আমরা এই ইন্ডাস্ট্রিটাই পাল্টে দেব। আমরা এমন একটি দুনিয়া বানানোর চেষ্টা করব… এমন দুনিয়া… যে কর্মবিমুখ মানুষেরা এই দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই না করতে পারে।

লোকমিত্র : অর্থাৎ এমন ভাবাটা তখন ইউটোপিয়া ছিল?

নাসিরুদ্দিন শাহ : ইউটোপিয়াই ছিল। আমাদের এসব নিয়ে ভাবাই উচিৎ নয়। শুধু আমাদের কাজকে পারফেক্ট করবার চেষ্টায় লেগে থাকতে হবে, যা পরবর্তীকালে আমি করেছি। কোন দেশে ফিল্মের মাধ্যমে বিপ্লব এসেছে? চিনে ফিল্মের জন্য বিপ্লব হয়েছে, বা রাশিয়ায়? একেবারেই না। আমরা ফিল্মের প্রভাবকে ওভার-এস্টিমেট করি। ফিল্ম যদি সমাজকে আদৌ পাল্টাতে পারত, তাহলে এখনকার সমাজের চেহারা এমনটা হত? যত হিন্দি ফিল্ম আজ অবধি হয়েছে, তার মধ্যে একটার নাম বলুন তো যাতে আদর্শের কথা বলা হয়নি। কোনও ছবিতে কখনও কি বলা হয়েছে মা-বাপের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো? একেবারেই না। প্রতিটা ছবিতে ভালো কাজ করো, সবার খেয়াল রাখো এসবই বলা হয়। কিন্তু আমরা মা-বাবার কতটা খেয়াল রাখি?

সমাজের খারাপ দিকগুলির জন্য কেন আমরা সবসময়ে সিনেমাকেই দায়ী করব? ফিল্ম না ভালোটা করতে পারে, না খারাপটা। আমার মনে হয় না সমাজ বদলানোর ক্ষমতা সিনেমার আছে। কিন্তু হ্যাঁ, আপনার যে প্রশ্নটা, রুলিং এলিটরা কেন সিনেমাকে ভয় পায়? তার কারণ সিনেমায় ঘটমান বর্তমানকে নথিভুক্ত করবার যে ক্ষমতা আছে, তা অন্য কোনও মাধ্যমের নেই। সিনেমায় সব আর্ট ফর্মের কম্বিনেশন। তাতে কিছুটা নিউজ আছে। কিছুটা পেন্টিং আছে, আর্কিটেকচার আছে, ফটোগ্রাফিও আছে, ডান্স আছে, মিউজিক আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সব কিছু মিলিয়েই সিনেমা বানানো হয়।

রাস্তায় যা ঘটে তা সততার সঙ্গে ক্যাপচার করে অ্যাজ ইট ইজ তুলে ধরতে পারে সিনেমা। কোনওরকম অবস্ট্রাকশন ছাড়া। মিউজিক বা ডান্স, যে মাধ্যমই দেখুন, তাতে অবস্ট্রাকশন আছে। টু মেক আ পয়েন্ট। যার গুরুত্ব পারসোনাল কোনও পয়েন্টের চেয়ে বেশি। সিনেমার সেই ক্ষমতা আছে, পশ্চারিটির জন্য একে রুলিং এলিটরা ভয় পায়। তাই ডিসেন্টিং ফিল্ম, কোয়েশ্চেনিং ফিল্ম, প্রোভোকেটিভ ফিল্ম হলেই ওরা ঘাবড়ে যায়। সেই কারণে ডকুমেন্টারি ফিল্মগুলি আটকাতে চেষ্টা করে। কারণ, একটা কিছুর রেকর্ড হিসেবে ডকুমেন্টারি দেখানো যায়। ‘ফাইনাল সলিউশন’ (রাকেশ শর্মা নির্মিত ২০০৪ সালের তথ্যচিত্র, যার বিষয় ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গা)। আনন্দ পটবর্ধনের প্রত্যেকটি ফিল্মে সেন্সরের সমস্যা হয়। এখন যে ছবিটা বানিয়েছে, কে জানে তা নিয়ে কী ঘটবে। (আনন্দ পটবর্ধনের ‘রিজন’ নামে আট পর্বের একটি তথ্যচিত্র যার সময়সীমা ২১৬ মিনিট। সম্প্রতি টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ প্রদর্শিত হয়েছে।) মজাটা হল, প্রত্যেকবার একই কাণ্ড ঘটে।

আপনি যত জঘন্য ফিচার ফিল্মই তৈরি করুন। তা সেন্সরে পাশ হয়ে যাবে। আমি বলতে চাই, শিল্পের কাজ হল, প্রশ্ন করা, সলিউশন দেওয়া নয়। ইন দ্য সেভেন্টিস আমরা প্রশ্ন ওঠানোর চেষ্টা করে গেছি। সেইসব ফিল্ম মেকারসদের জন্য আমি একটা মাধ্যম ছিলাম। আমার নিজের ওইধরনের ছবিগুলির প্রতি বিলিফ একেবারে সাধারণ পর্যায়ে ছিল। আমি হিন্দি ফিল্মের হিরো হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কপালেই জুটল ‘নিশান্ত’ (১৯৭৫), ‘মন্থন’ (১৯৭৬), ‘অ্যালবার্ট পিন্টো (কা গুসসা কিউ আতা হ্যাঁয়’ – ১৯৮০)’র মতো ছবি। কোইন্সিইডেন্স বলতে পারেন, আমিই এই ধরনের ছবি নির্মাতাদের স্পোকসম্যান ছিলাম।

লোকমিত্র : … তার মানে সবাই আপনার কাঁধে বন্দুক রেখে চলেছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : ওয়েল… (খিলখিল করে কিছুক্ষণ হেসে) এটা আপনার কথা, আমার নয়। তবে হ্যাঁ, ওনাদের ভাবনা এক্সপ্রেস করছিলাম। কিন্তু ক্রমশ আমার নিজের ভাবনাও ওনাদের সঙ্গে মিলে যেতে থাকে। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল, আমি তো এইভাবে ভাবিনি এবং ভাবনাটাও সুন্দর। যেমন, ‘মন্থন’ করবার সময়ে মনে হলো, এমন জিনিয়াস ভাবনা (দুগ্ধ সমবায়) অন্য কেউ তো ভাবেনি। কত মানুষ আছে যাদের সারা জীবন কেটে যায় দুধ নিয়ে। যা কেউ ভাবেনি তা (ভার্গিস) ক্যুরিয়েন ভেবেছেন। অথবা ‘অ্যালবার্ট পিন্টো…’ করবার সময়ে অন্য কিছু মনে হয়েছিল। ‘নিশান্ত’ করবার সময় আর একটা কিছু, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এই ধরনের সিনেমা বা সমাজের প্রতি আমার যে টলমলে আস্থা তৈরি হয়, তা এই ফিল্ম মেকারদের দাক্ষিণ্যেই। এই ছবিগুলির সঙ্গে আমিও গ্র্যাজুয়ালি গ্রো করেছি।

লোকমিত্র : অর্থাৎ, পলিটিক্যালি… আইডলোজিক্যালি আপনি একটা পক্ষ নিলেন?

নাসিরুদ্দিন শাহ : সাম ওয়াট…

লোকমিত্র : কিন্তু নাসির সাব, আমি আমার আগের প্রশ্নটাই অন্য ভাবে রাখছি। সাধারণ মানুষের বিষয়ে কথা বলা সিনেমার প্রতি রুলিং এলিটদের যে প্রতিকূল মনোভাব শুধুমাত্র ভারত বা এশিয়ার অন্য দেশে যে হয় তা তো নয়। যারা নিজেদের মাদার অফ ডেমোক্রেসি বলে পরিচয় দেয়, তাঁরাও এমন চিত্রনির্মাতাদের প্রতি নজর রাখেন। তা সে ভয় থেকেই হোক, বা যাই হোক। কিছু তো একটা ব্যাপার আছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : হ্যাঁ, কিন্তু ওখানে আপনি লাইভ টেলিভিশনে দেশের প্রেসিডেন্টকে গালিগালাজ করতে পারেন।

লোকমিত্র : এটা কি ওদের সিভিক ম্যাচিউরিটি?

নাসিরুদ্দিন শাহ : (উচ্চকিত হেসে) আমেরিকার মানুষদের ম্যাচিউরড তো বলা যায় না তা বলে। পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য এবং বোকা লোকদের বাস ওদেশে। আমি বলব, সেন্স অফ হিউমার থাকায় এটা ঘটতে পেরেছে। কারণ, ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যে নিজেকে নিয়ে হাসবার একটা সংস্কৃতি আছে। এমন অনেক সিনেমা এবং নাটক ওদেশে তৈরি হয়েছে যাতে যিশুকে নিয়েও ঠাট্টা ইয়ার্কি আছে। তার জন্য কেউ কাউকে গুলি করে মারেনি। কাউকে দেশ থেকে বার করে দেওয়া হয়নি। আর আগেও আমি যা বলেছি, এখন আপনি ‘জানে ভি দো ইয়ারো’র শেষ দৃশ্য (মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্বে আকবরের প্রবেশ)-এর মতো কোনও দৃশ্য রচনা করতে পারবেন না।

লোকমিত্র : শাসকদের টলারেন্স লেভেল কমে গেছে কি?

নাসিরুদ্দিন শাহ : একেবারে কমে গেছে। এমার্জেন্সির সময়েও (স্বাধীন) অভিব্যক্তিকে আটকানো হয়েছে। কিন্তু আর কে লক্ষণ প্রতিদিন একটি কার্টুন আঁকতেন। আজ তা সম্ভব নয়। তবুও আমি বলতে চাই যে, শিল্পী নিজের কথা বলবার উপায় খুঁজে বার করে নেবেই যদি তাঁর মধ্যে সত্যিই কিছু বলবার জন্য ছটফটানি থাকে।

লোকমিত্র : এই দেশে বেশ কয়েকটি দশক ধরে জনপ্রিয় সিনেমা এবং জনগণের কথা তুলে ধরবার সিনেমার মধ্যে বিতর্ক চলেছে। কারণ, এদেশে যে সিনেমা জনগণের কথা বলে তার সবচেয়ে অথেন্টিক প্রতীক আপনি। তাই আমি আপনার থেকে জানতে চাই এই বিতর্কের আদৌ কি কোনও গুরুত্ব আছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : এটা যে কতটা ক্ষতিকর তা এখন প্রমাণিত। এই বিতর্ক নিয়ে প্রথম থেকেই আমার আপত্তি ছিল। যখন আমি কলেজে পড়ি, খ্বাজা আহমেদ আব্বাস ছবি বানাতেন। শ্যাম বেনেগাল এবং মৃণাল সেনদের অনেক আগে। ‘শহর ঔর সপনা’, ‘আসমান মহল’, ‘সাত হিন্দুস্তানি’। তখনও এগুলিকে আর্ট ফিল্ম বলা হত। কিন্তু আমার মনে হয় ছবিগুলিতে অত্যন্ত ভালো কিছু গল্প বলা হয়েছে। তাতে কাশ্মির না থাকুক, হিরোইন না থাকুক, তবুও এগুলি ভালো ছবি। কিন্তু সেগুলি চলেনি কেন? মানুষ কেন দেখতে আসেননি ছবিগুলি? এর ফলে ছবিগুলিতে লেবেল সাঁটা হল। আর্ট এবং কমার্স। তারপর সেটার বদলে প্যারালাল সিনেমা, তারপর অলটারনেটিভ সিনেমা আর না জানি কত কিছু। এতে বেশ ক্ষতি হয়েছে। কারণ এই লেবেলের জন্যই অডিয়েন্স আগেই ভেবে নিচ্ছে, আরে, এটা নিশ্চয়ই আর্ট সিনেমা।

লোকমিত্র : এই লেবেলগুলি কি ষড়যন্ত্র করে সাঁটা হয়েছে, নাকি এমনি এমনি বসে গেছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : সিনেমা নিয়ে যারা লেখালেখি করে তাঁরা বেসিক্যালি সাধারণ দর্শক। কোনও বিশেষজ্ঞ নন। এমনিতে এরা সাধারণ দর্শকদের মতোই কথাবার্তা বলে। এরাও মুগ্ধ হয়ে বলে, অমুক ছবিটা আমার ভালো লেগেছে। রিভিউ লিখতে বসে সিনেমার গল্পটাই বলে দেবে। যে বিশেষত্ব বা দুর্বলতাগুলি আপনি জানতে চাইছেন সেগুলিও। এর ফলে ক্রমশ এক ধরনের ডিস্টিংশন তৈরি হয়েছে। এখন এই বিভেদরেখা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ। তবে আমি বলতে চাই যে রিভিঊ পড়ে দর্শকরা এই সিদ্ধান্ত নেয় না যে ছবিটা আমাদের দেখা উচিৎ কি উচিৎ নয়।

আসলে অডিয়েন্স সিনেমার গন্ধ পায়। আগে থেকেই তাই ঠিক করে নেয় এই যে ছবিটা বানানো হচ্ছে, এটা দেখবই। অথবা এটা কিছুতেই দেখব না। তাঁরা আগে থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং অ্যাস ভিউয়ার্স আমরা সবাই এটা উপলব্ধি করেছি। হয়তো এই কারণে যে দর্শকদের কাছে খবরটা পৌঁছে যায় যে ছবিটা তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি ভালো রিভিঊ পড়ে কেউ ছবি দেখতে যায় না আর খারাপ রিভিউ পড়ে দর্শকরা ঠিক করে না যে এই ছবিটা দেখব না।

লোকমিত্র : আপনি যে অডিয়েন্স সিনেমার গন্ধ শুঁকে নেয় বলছেন, এটা কী এক ধরনের টেকনিক? এটা কি শুধু ভারতেই ক্ষেত্রেই খাটে না পৃথিবীর সর্বত্র এমনটাই হয়?

নাসিরুদ্দিন শাহ : সব জায়গায় ঘটে। বিশেষ করে যেখানে কনটেন্ট কম। আপনি কোরিয়ান সিনেমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখবেন। থাইল্যান্ডের সিনেমার দর্শকদেরও একই মানসিকতা। ইজিপসিয়ান ছবি, ইরানের মূলধারার ছবি তাতেও। ইরানে যে কমার্শিয়াল ছবিগুলি তৈরি হয়, সেগুলি অখাদ্য। আমাদের ভোজপুরী ছবিগুলির থেকেও খারাপ। টেকনিকের ব্যবহারে যথেষ্ট বিভ্রম ঘটায় বটে। তবে আমার মনে হয় গুছিয়ে এডিট করার উপর একটু বেশি গুরুত্ব দিলে আমরাও এখানে খুব ভালো ছবি বানাতে পারব। যেহেতু, সবখানে হিন্দিভাষী ছড়িয়ে আছে, তাই পৃথিবীর সব দেশেই হিন্দি ছবি দেখানো হয়।

লোকমিত্র : আমরা তো বলে থাকি উন্নত শিক্ষাগ্রহণের অধিকার সবার আছে, পরিশোধিত জল ব্যবহারের অধিকার সবার, স্বাস্থ্যকর সব জিনিস ভোগ করা আমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। যদি আমরা আমাদের অধিকার সম্পর্কে এতটাই সচেতন হই, তাহলে এমন সময় কি আগামী দিনে আসবে যখন সবাই বলবে ভালো সিনেমা দেখাটাও আমাদের অধিকার?

নাসিরুদ্দিন শাহ : আরে, কী মোক্ষম কথাই না তুমি বললে ভাই! পঞ্চাশ বছর আগে সত্যজিৎ রায় তাঁর বইতে কথাগুলি লিখেছিলেন। Our Films Their Films। তাতে উনি ভারতীয় সিনেমার পাশাপাশি বিদেশের ভালো ছবিগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। হলিউডের ছবিও ছিল তার মধ্যে। কিন্তু কম ছিল। উনি হলিউডের ছবিতে কনসেন্ট্রেট করেননি। অন্য দেশগুলির সিনেমায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ইটালির ছবি, জাপানি ছবি, ফরাসি ছবি। উনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে, আমাদের দেশের অডিয়েন্স উঁচু গলায় দাবি জানায় না। তবে তেমন সুসময় কোনও দিনও আসবে না। কারণ অডিয়েন্সকে আফিম খাইয়ে তাদের মগজকে ভোম করে দেওয়া হয়েছে। তাই সিনেমার এই আবর্জনা দেখে অডিয়েন্স খুশি। ওদের আর কিছু দাবি নেই। ওদের জিভে অন্য কোনও স্বাদ ভালোই লাগবে না। এরা আনফ্যামিলিয়র টেরিটরির কাছাকাছিও ভিড়বে না। তিন ঘণ্টার ঐ ফ্যামিলিয়র জিনিসগুলি পেলেই এরা ভেবে নেয় পয়সা উসুল হল। যা বারবার দেখা যায় এবং এমনভাবে দেখা যায়— ভাবটা এমন যেন কত কিছু উপাদান তার মধ্যে আছে, যার স্বাদ একবারে উপভোগ করা সম্ভব নয়। যেমন বিয়েবাড়ির খাবার— দ্বিতীয়বার গেলেও একই জিনিস খাবেন।

লোকমিত্র : যে সিনেমা প্রশ্ন তোলে বা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, তার প্রতি এই স্পর্শকাতরতা এখানকার দর্শকদের মধ্যেই লক্ষ করা যায়, না অন্য দেশেও এমনটাই ঘটছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : সারা পৃথিবীতে এমনই ঘটছে। আমেরিকায় দেখুন কী জঘন্য ধরনের সুপারহিরো মার্কা সিনেমা চালানো হচ্ছে। ‘Lords of the Ring’ জাতীয় ফিল্মকে কী বলবেন? দেখলে মনে হয় আমাদের মাইথোলজি থেকে চুরি করা হয়েছে। মূলস্রোতের নামে আমেরিকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এমন ছবিই বানাচ্ছে। নয়তো ছোট বাজেটের বিভিন্ন ছবি বানানো হচ্ছে, যেগুলিকে প্রতি বছর অস্কার দেওয়া হয়। ওদের খুব বুদ্ধি (হেসে), কারণ অস্কার পাওয়া ছবিগুলি তো ফিল্ম স্টুডিওগুলি ঝড়তিপড়তি টাকা দিয়েই বানাচ্ছে আর তারপর নিজেরাই সেগুলিকে অস্কার দিচ্ছে। আমাদের এখানেও এমন ব্যবস্থা থাকলে বেশ হত। এখানে স্রেফ দেখনদারির জন্য স্টুডিওর প্রোডিউসাররা ‘সুঁই ধাগা’র মতো ছবি বানায়।

লোকমিত্র : আপনার কি মনে হয় এর নেপথ্যে অর্গানাইজড ক্রাইমের হাত আছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : কথাটা বেশ! ‘অর্গানাইজড ক্রাইম’। অলমোস্ট লাইক দ্যাট। গত দশ বছরে বানানো হয়েছে এমন পাঁচটি হিন্দি ছবির নাম আপনি বলুন যা সব দিক থেকে ওরিজিনাল। টাইম পাস মার্কা ছবি অনেকগুলো আছে। আমি গত পাঁচ বছরে আমির খানের ‘দঙ্গল’-এর কথা বলতে পারি, যেটা সত্যিই ভালো। এছাড়া একটাও ওরিজিনাল ফিল্ম নেই। আমির খান বরাবরই ভালো ছবি বানিয়ে এসেছেন। আসলে, ভালো সিনেমা বানানোটাকে উনি নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন। বাকিদের কাছে সিনেমা কেবল লাভের অঙ্ক বাড়ানোর উপায় ছাড়া আর কিছু নয়। এরা চায় না দর্শকরা ভালো সিনেমা দেখবার দাবি তুলুক। তার কারণ, তাতে এদের ব্যবসা লাটে উঠবে। চুরি করে এখন বেশ চলছে। পকেট ভালোই ভরছে। তাই এদের লক্ষ্য keep the audience dumb। দর্শকদের আবর্জনা গেলাও, যাতে তারা নতুনের দাবি না তোলে। অনেক ভেবেচিন্তে এই ব্যাপারটা ঘটানো হচ্ছে কিনা, তা আমি জানি না। তবে হিন্দি ছবির ১০০% প্রডিউসার এই টেনডেন্সি নিয়ে ছবি বানান। সাতের দশক থেকে এই পচন ছড়ানো শুরু হয়েছে। গল্প চুরি থেকে বাকি সব কিছু।

লোকমিত্র : আগে এমনটা হত না?

নাসিরুদ্দিন শাহ : না, আগেও হত। রাজ কাপুরের কিছু ছবি দেখুন যেখানে গানের ব্যবহার নেই। কিছু আইডিয়া চার্লি চ্যাপলিনের থেকে নেওয়া আর বাকি সব অন্য ছবি থেকে তোলা। বিমল রায়ের কিছু ছবি যদি মন দিয়ে দ্যাখেন, তাহলে বুঝবেন ওগুলি (ভিত্তরিয়) ডি সিকা-র ফিল্মগুলি থেকে কপি করা হয়েছে। একজনই ছিলেন, (ভি) শান্তারাম। তিনি ওরিজিনাল ফিল্ম বানাতেন। (কে. এ.) আব্বাস বানাতেন। মৌলিক সিনেমা করেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অধিকাংশই চুরি করতেন। এরাই অডিয়েন্সের রুচিকে বিষাক্ত করে দিয়েছেন।

লোকমিত্র : আচ্ছা, চারদিকে যে এই সব ঘটছে তা কি ভেবেচিন্তে ঘটানো হচ্ছে, নাকি এরা কেউই বুঝতে পারছেন না চারপাশে এই সব কী ঘটছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : দেখুন আমি নাম বলছি না, কারণ সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু সাতের দশকে যে অ্যাকশন ছবিগুলির (চিত্রনাট্য) লেখা হত, সেগুলি অন্যসব ছবি থেকে টোকা। অধিকাংশ গানের সুর অন্য গান থেকে চুরি করা। এমন কি ফিল্মের দৃশ্যগুলি অবধি অন্য ছবির হুবহু কপি। চুরি করা এই আইডিয়াগুলি নিয়ে অনেকগুলি বড় মাপের সফল ছবির চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। এর মধ্যে এমন ছবি আছে, যাকে আজ আমরা মাস্টারপিস বলে মেনে নিই। সেই ছবি বানানোর বৃত্তান্ত নিয়ে বই অবধি লেখা হয়েছে।

ছবিটার গল্প অন্য ছবি থেকে চুরি করে লেখা। শুরু থেকে শেষ অবধি। এতে যেটা ঘটেছে, তা হল চুরি করাটা একেবারে লেজিটিমেট হয়ে যাচ্ছে। ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইটের পর কালার এল, তখন তো সবকিছু আরও সহজ হয়ে গেল। কারণ কালার ছবির চেয়ে ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট ছবি বানানো ঢের কঠিন। ছবিকে সুন্দর করে তোলাটা ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইটে খুব শক্ত একটা কাজ। কালার ছবি এসে যা ঘটাল তা হল, আপনি কাশ্মিরে গিয়ে নায়ককে পাহাড় থেকে একবার নিচে গড়িয়ে দিন— আপনার ছবি সুপারহিট। তাই (হিন্দি সিনেমার) যা অধঃপতন, তা গল্পে হোক, অভিনয়ে হোক, আইডিয়ায় হোক, লিরিকস-এ হোক, মিউজিক-এ হোক, ডায়লগে হোক, সব সেভেন্টিস থেকে শুরু।

লোকমিত্র : এতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লাভ হয়েছে, তাই করেছে। কিন্তু সমাজকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তাঁরা এগুলিকে আটকালেন না কেন? 

নাসিরুদ্দিন শাহ : কারণ, তাঁদেরও লাভ হচ্ছিল। ওনাদের জয়গানই তো গাওয়া হয়েছে ছবিগুলিতে।

লোকমিত্র : এবং হয়তো ভেবেছেন জনগণ যদি এই বিষয়ে দাবি তোলেন, অন্যান্য বিষয়েও তুলবে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : একজ্যাক্টলি।

লোকমিত্র : অর্থাৎ জনগণকে বোকা বানানো এবং তাদের বোকা বানিয়ে রাখার দস্তুরমতো একটা ব্যবস্থা?

নাসিরুদ্দিন শাহ : অ্যাবসলিউটলি… যদিও এতটা স্ট্রং ভাষা এক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিৎ কিনা তা ভাবতে হবে… কিন্তু ডেফিনিটলি… এর প্রভাব এটাই যে আমাদের অডিয়েন্স এই ধরনের ফিল্মের প্রাবল্যে বোকা হতে থাকল। এবং এখন অবধি তারা ওরিজিনাল ছবি চায়ও না। ঐ চেনা গল্পগুলি ওদের বারবার শোনাও। ওরা খুশি হবে। সেগুলি কত খারাপ ভাবে বলা হচ্ছে, তার দিকে খেয়ালই করবে না।

লোকমিত্র : এটা আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যা নয় কি? আমাদের ঘরেও বহু যুগ ধরে ঐ গল্পগুলিই বলে যাওয়া হত। এবং মজাটা হল আমরা হাজার বার সেই এক গল্প ঘরের বাইরে অন্য মাধ্যমেও শুনতে পছন্দ করি না কি?

নাসিরুদ্দিন শাহ : কালচারাল বলব না, এটা আমাদের অভ্যাস।

লোকমিত্র : গত দেড় দশক ধরে আমরা লক্ষ করছি ভারতের একটি বড় অংশ ফিল্মের বিষয়গুলির মধ্যে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে— গ্রাম, চাষি, মজুর… এসব আজ ফিল্মে দেখানো হয় না। যদিও চাষিরা আগের তুলনায় এখন আরও বেশি সমস্যার মধ্যে বেঁচে আছে। মজুরেরা সম্ভবত নিজেদের আরও বেশি অসুরক্ষিত মনে করছে। কিন্তু হিন্দি ফিল্মগুলি এদের নিয়ে কথা বলার গুরুত্ব স্বীকার করে না। এখন NRI-রা ফিল্মে জরুরি হয়ে উঠেছে। কেন?

নাসিরুদ্দিন শাহ : কারণ, প্রায় সব চাষিই নিজেদের জমিজমা বেচে শহরের বস্তিতে থাকছে। ভালোই হচ্ছে। চাষিদের সমস্যা নিয়ে যে ছবি বানাচ্ছে না, তা সম্ভবত ভালো। কারণ মালাবার হিলস-এর মতো (ধনী) জায়গায় থেকে চাষিদের সমস্যা নিয়ে কেমনভাবে ছবি বানাবে এরা? তবে হ্যাঁ, মারাঠি চাষিদের সমস্যাগুলি নিয়ে ছবি হচ্ছে। ‘ফান্ড্রি’র মতো ছবি, ‘কোর্ট’-এর মতো ছবি। এগুলি হচ্ছে, কারণ ঐ শ্রেণি থেকে উঠে আসা মানুষরা নিজেদের শ্রেণির গল্প বলতে চাইছে।

আমার মনে হয় এটা ভালো লক্ষ্মণ। এখনকার যুবসম্প্রদায় যে গল্প লিখছে, বা নাটক লিখছে, বা ফিল্ম বানাচ্ছে, তাতে নিজেদের ইস্যুগুলি তুলে আনছে। অ্যাট লিস্ট এগুলি ওরিজিনাল। সেদিক থেকে বললে এরা সৎ তো বটে, তাদের ছবিগুলি যে পর্যায়েরই হোক। কিন্তু ওরা সেই ইস্যুগুলিকেই ট্যাকেল করবার চেষ্টা করছে, যার প্রভাব ওদের জীবনে কমবেশি পড়েছে।

লোকমিত্র : নাসির স্যার, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নটা বাইপাস করলেন। আমি আবার জিজ্ঞাসা করছি… যে বিষয়গুলি নিয়ে এখন ফিল্ম হয়, তাতে গ্রামকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে?

নাসিরুদ্দিন শাহ : আমাদের ফিল্মগুলিতে কোনকালে বাস্তব ছবিটা দেখানো হত ভাই? (হেসে … হয়তো বা ব্যঙ্গ করে অথবা অসহায়ের হাসি) আমি তো আগেই বলেছি আমাদের ফিল্মগুলি আমাদের অ্যাসপিরেশনের ছবি। এতে বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলা হয় না। একটা ফ্যান্টাসির জগৎ বানিয়ে ব্যবহার করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তা যে কোনও ভাষায় হতে পারে। তেলেগু, তামিল, বাংলা, অসমীয়া, পাঞ্জাবী। একই ধরনের ছবি বানানো হয় যা দেখে মানুষ নেশাগ্রস্ত হয়ে খুশিমনে বাড়ি ফিরবে। বাস্তব দেখানোর দরকারটা কী?

লোকমিত্র : তাহলে কি সিনেমার কোনো সমাজজ্ঞান নেই?

নাসিরুদ্দিন শাহ : আমার মনে হয় সিনেমার ভূমিকা অনেকটা ইতিহাসের বইয়ের মতো হতে পারে। কিন্তু সোশ্যাল ফ্রন্ট হিসেবে সিনেমাকে ব্যবহার করা যাবে না। অ্যাজ আ রেকর্ড সিনেমার গুরুত্ব অপরিসীম।

লোকমিত্র : নট অ্যাজ অ্যান ওপিনিয়ন?

নাসিরুদ্দিন শাহ : As an opinion… but also as a record. More important than opinion is record. যেমন চ্যাপলিন স্যার হিটলারকে নিয়ে একটি ছবি বানিয়েছিলেন। খুব মজার। তবে ছবিটা দেখে আপনার সেই হরর বিষয় ধারণা হবে না যা হিটলার নিজের উদ্যোগে বানিয়েছিলেন লেনি রাইফেন্সটল নামে এক নামজাদা ফিল্মমেকারকে দিয়ে। ‘The Triumph of Will’। ওটা দেখলে আপনার রোম খাড়া হয়ে যাবে।

লোকমিত্র : একটা হাইপথেটিকাল প্রশ্ন করি। ধরে নিন, ভবিষ্যতে আজকের এই ভারত কেমন ছিল, তা জানবার মতো অন্য কোনও মাধ্যম নেই। তাহলে এখনকার বানানো ছবিগুলি থেকেই কি আমরা ভারতবর্ষের ইতিহাস জানতে পারব?

নাসিরুদ্দিন শাহ : হ্যাঁ, জানতে পারব। একটাই শর্তে। ছবিগুলি যেন সালমান খানের না হয়। (অট্টহাসি)… এবং যেন (আশুতোষ গোয়ারিকরের) ‘মহেঞ্জোদারো’র মতো না হয়। কারণ এখন তো বাবরকেও অত্যাচারী হিসেবে দেখানো হবে। আকবরকেও। তেমনটাই তোড়জোড় চলছে। এক ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বললেন বাবর নিয়ে একটা ছবি বানাচ্ছি। তাতে ওর অত্যাচারী চেহারাটা ফুটে উঠবে। আমি বললাম, আমি অভিনয় করব না, আপনি এখন আসুন।

লোকমিত্র : সমান্তরাল ছবির ব্যর্থতার পিছনে কি এই কারণটার বড় একটা ভূমিকা রয়েছে যে সমান্তরাল বা পরীক্ষামূলক সিনেমার অডিয়েন্স তৈরি হওয়ার আগেই আমরা ঐ ধরনের ছবি বানিয়ে নিয়ে এসেছি?

নাসিরুদ্দিন শাহ : অডিয়েন্স তৈরি হতে সময় লাগে। ঘটনাটা হল পরীক্ষামূলক ছবি যারা বানাচ্ছিলেন, তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি হার মেনে নেন। বিশেষ করে সাতের দশকে যারা ছিলেন। আমি তো বলব তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই মানে ৯৯% আসলে জনপ্রিয় ছবি বানানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। স্টারদের সঙ্গে কাজ করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। ওনারা সাড়ে তিন লাখ টাকার ছোট ছোট ফিল্ম এই কারণে বানাচ্ছিলেন, কারণ ছবি বানাবার আর কোনও উপায়ই তাঁদের ছিল না। অগত্যা বাধ্য হয়ে বানিয়েছেন। কোনও conviction ছিল না। ওনাদের জীবনীগুলি পড়লেই বুঝতে পারবেন পরবর্তীকালে ওনারা কী বানিয়েছেন।

লোকমিত্র : দর্শক তৈরি হবেই বা কী করে যখন ছবিই দেখানো হয় না? এলেও সেগুলিকে অন্য ছবির মতোই মনে হয় দর্শকদের। ওরা ভাবে এই ছবিগুলিতে কী এমন নতুন কথা বলা হয়েছে ভাই। মজদুরদের নিয়ে তো মনমোহন দেশাইও ছবি বানিয়েছেন। ওনার হিরো তো মজদুরদের স্বার্থে যার তার সঙ্গে লড়াই করে জিতেছে। (সমান্তরাল) এই ছবিটার নায়ক তো লড়তেই পারে না। এর কারণ এটা নয় যে, ওল্ড আর্ট ফিল্মগুলি এতটা বাস্তবসম্মত উপায়ে বানানো হত যে অডিয়েন্সের সেগুলি হজম হয়নি। একেবারেই না। এমন ধারণা ভুল। এটা মিথ্যা। সমান্তরাল সিনেমাগুলি নিজেদের দুর্বলতার কারণেই ফ্লপ হয়েছে।

নাসিরুদ্দিন শাহ : অডিয়েন্স ছিল। আজও অ্যালবার্ট পিন্টোকে মানুষ মনে রেখেছে। অথচ এখনকার কেউ দ্যাখেনি। কিন্তু সবাই নামটা শুনেছে। এবং সে সময়ে ছবিটা চলেও ছিল। সে কথা অনেকে জানেও না। জেম সিনেমায়। আমি যেতাম তখন ওখানে। সেই সময় ছবিটা দেখানোর সময় (দর্শকদের) হাততালির শব্দ শোনা যেত। কিন্তু কোনও সংস্থা (তা দেখানোর ব্যাপারে) সাহায্য করেনি। সেইসময় গভর্নমেন্ট ছবিগুলি বানানোর টাকা দিত বটে, কিন্তু সেগুলিকে nurture করবার ব্যাপারে গভর্নমেন্টের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আমাদের দিকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ফেলে দিত NFDC, কিন্তু ছবিগুলি রিলিজের কোনও ব্যবস্থা করত না।

লোকমিত্র : সমান্তরাল ছবি ব্যর্থ হওয়ার কারণ এটাও কি হতে পারে যে ছবিগুলি সরকারের সমালোচনা করছিল বটে, কিন্তু গভর্নমেন্টেরই একটা এজেন্সি (NFDC) মারফৎ সেগুলির ফাইনান্স জুটছে। এর থেকেই তো বোঝা যায় এদের স্বাধীনতা কতটা কমজোরি?

নাসিরুদ্দিন শাহ : শ্যাম বেনেগাল তো কখনও সরকারের ফাইনান্সে ছবি বানাননি। ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বাদ দিয়ে। উনি এটি দূরদর্শনের জন্য বানিয়েছিলেন। ওনাকে Blaze নামে একটি কোম্পানি ফাইনান্স করত। ‘মন্থন’-এর টাকা দিয়েছিল গুজরাট ডেয়ারি মিল্ক ফেডারেশন। ‘জুনুন’ প্রযোজনা করেছিলেন শশী কাপুর। গোবিন্দ (নিহালনি) বানিয়েছিলেন। আর সরকারের টাকা নিয়ে সরকারের সমালোচনার কথা যদি বলেন তো… (খিলখিল করে হেসে) এইটুকু সেন্স অফ হিউমার সরকারের থাকা উচিৎ।

তবে সিরিয়াসলি বললে বলতে হয়, এগুলির মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা হচ্ছিল না। আপনি খেয়াল করুন, যখন ‘নিশান্ত’ বানানো হল তখন শ্যাম বেনেগালকে সেন্সর বোর্ড অফ ইন্ডিয়া নির্দেশ দিল ছবি শুরুর আগে ক্যাপশন দেওয়া হোক ‘This happened before Independence’। আপনি এখন দেখুন ‘নিশান্ত’। তাতে লেখাটা ভেসে ওঠে… এসব আগে হত, এখন হয় না। (আবার উচ্চকিত হাসি) সব এক গোয়ালের গরু।

লোকমিত্র : এখন টেকনিক ব্যবহারের ফলে পরীক্ষামূলক সিনেমা বানানো সহজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সিনেমা নির্মাতাদের তেমন আগ্রহ তো চোখে পড়ছে না?

নাসিরুদ্দিন শাহ : সিনেমা বানানোটা আজ নিঃসন্দেহে সহজ। কিন্তু সিনেমা রিলিজ করানোটা এখন আগের থেকে অনেক বেশি কঠিন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. সমাজ-রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে পছন্দের অভিনেতার সৎ অকপট কথোপকথন ভালো লাগলো।

আপনার মতামত...