‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ : কিষান মুক্তি মার্চ, দিল্লি ২০১৮

দিল্লির রাজপথে কৃষকরা, ২০১৮

স্মিতা খাটোর

 

৪৩-এর মন্বন্তরের স্মৃতি থেকে আমরা বলতে পারি গ্রাম চরম সংকটের মুখে দাঁড়ালে শহরের রাজপথে সেই সংকট প্রতিধ্বনিত হয়। ২০১৮ সালে একবার দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী তথা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের কেন্দ্র মুম্বইয়ের পর গতমাসের ২৯শে এবং ৩০শে নভেম্বর আবারও দেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লির রাজপথে আছড়ে পড়েছিল গ্রাম থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের ঢেউ। মন্বন্তরেবিধ্বস্ত, ভিক্ষাপাত্রহাতে গ্রামের মানুষের ভিড় নয়। এই ভিড় অখিল ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির আহ্বানে কিষান মুক্তি মার্চে যোগ দিয়ে দাবি আদায়ের, নিজের অবস্থা জানান দেওয়ার, বঞ্চনা আর শোষণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারির। যে ভয়াবহ কৃষি সংকটের মুখে পড়ে গ্রাম ভারত আজ আবার শহরের অভিমুখে ধাবিত হচ্ছে বারবার, একটু খতিয়ে দেখা যাক তার স্বরূপ।

কৃষি সম্পর্কিত কিছু পরিসংখ্যান

ভারতের মোট ৪৮ কোটি ১৭ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের (২০১১), ২৬ কোটি ৩০ লক্ষ অর্থাৎ ৫৪.৬% কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত, যার মধ্যে ১১ কোটি ৯০ লক্ষ কৃষক এবং ১৪ কোটি ৪০ লক্ষ কৃষিশ্রমিক। ১৯৫১ থেকে ২০১১— এই ৬০ বছরে কৃষিক্ষেত্র বহু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, একদিকে, গ্রামীণ ভারতের জনসংখ্যায় কৃষকের হার নেমে এসেছে ৭২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে, অন্যদিকে, কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে। জোতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে, আর কৃষক পরিবারগুলি উৎপাদক থেকে কৃষিশ্রমিকে পরিণত হয়েছে। জোতের পরিমাণ যত সঙ্কুচিত হয়েছে জমিতে জল এবং রাসায়নিকের ব্যবহার আরও ব্যাপক হয়ে উঠেছে, মোটা দানাশস্য এবং ডালের পরিবর্তে গম এবং তৈলবীজ চাষের প্রচলন হয়েছে। বিগত ৫০ বছরে (১৯৫০-২০০০) সারের ব্যবহার প্রায় ২৪,০০০ গুণ এবং কীটনাশকের ব্যবহার ১৬০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জোতের পরিমাণ, শস্যের বিবর্তন এবং জল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যাপক ব্যবহার, এবং ঋণ এইসকল কারণে একদিকে চাষের খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসেও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সরু দানার গমের ব্যবহার (৬৬ থেকে ১৬৩ গ্রাম) বেড়েছে; অথচ পুষ্টিকর মোটা দানাশস্যের ব্যবহার কমেছে (১১৯ থেকে ৬৮ গ্রাম)।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও মজুরি

সরকার প্রতিবছর খাদ্যশস্য বাবদ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) প্রদান করে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষকদের শস্য উৎপাদনের খরচ তুলতে সাহায্য করে এবং একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষিত রাখে। ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এমএসপি ৫০% বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১২ থেকে ২০১৮ এমন একটিও ফসল নেই যার এমএসপি ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অধিকাংশ ফসলের ক্ষেত্রে বার্ষিক এমএসপি বৃদ্ধির হার ২% থেকে ১১%-এর মধ্যে। কৃষি বর্ষ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের বার্ষিক গড় বৃদ্ধি [এমএসপি-তে] ছিল ১৯.৩%, অথচ ২০১৪ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তা হল মাত্র ৩.৬%। সরকার দ্বারা এমএসপি নির্ধারণ করার জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, তাতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম, সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতির মূল্য, বীজ, জৈব এবং রাসায়নিক সার, সেচ, কীটনাশক, কার্যকরী মূলধন, স্থায়ী মূলধন, কর, সুদ এবং ভাড়া— সমস্ত উপকরণের খরচ ধরে নির্ণয় করা হয়।

১৯৪৮ সালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনসহ সুষ্ঠুভাবে শ্রমজীবী মানুষ যাতে জীবনধারণ করতে পারেন, তারজন্য ন্যূনতম মজুরি আইন বলবৎ করা হয়। ১৯৯১ সালে ন্যূনতম মজুরির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মজুরি সুপারিশ করা হয় এবং ১৯৯৬ সালে তা দৈনিক ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এই মজুরি নিয়মিত সংশোধিত হয়ে ২০১৭ সালে ১৭৬ টাকায় পৌঁছেছে। ১৯৫৭ সালের পঞ্চদশ ভারতীয় শ্রম সম্মেলন এই মর্মে সম্মত হয় যে শুধুমাত্র শ্রমিক নয়, শ্রমিকের পরিবারকেও প্রাণধারণের উপযোগী মজুরি দ্বারা বাঁচাতে হবে। অত্যাবশ্যিক নানান খরচ বিবেচনা করে তৈরি হয় প্রাণধারণের উপযোগী মজুরি বা লিভিং ওয়েজ-এর নীতি। এই হিসেবে ২০১৮ সালে গড় লিভিং ওয়েজ দাঁড়ায় দৈনিক ৭৪৫ টাকা। ২০১৮ সালে গমের এমএসপি নির্ধারণ করার সময় যদি এই লিভিং ওয়েজ-এর নীতি অনুসরণ করা হত, তাহলে প্রতি কুইন্টালে এমএসপি দাঁড়াত ৪৮০০ টাকা, অথচ সরকার ঘোষিত ২০১৮ সালের এমএসপি ১৮৪০ টাকা।

রাষ্ট্রীয় কৃষিনীতির পরিণাম

শস্য, মূল্য এবং মজুরি সংকটের দরুণ কৃষিকাজ খুব দ্রুত চূড়ান্ত অনিশ্চিত একটি পেশা হয়ে উঠছে। ২০১১-১২ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মূল জীবিকা কৃষিকর্ম এমন এক পঞ্চমাংশের বেশি গ্রামীণ পরিবার, নিদারুণ দারিদ্র্য ভোগ করে চলেছে। অথচ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিকল্প কর্মসংস্থানের অবকাশও তেমন নেই। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় কৃষি ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। অথচ, আর্থিক রক্ষণশীলতার ফলে সেচ, জল নিকাশি ব্যবস্থা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জাতীয় বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ২০১৩-২০১৪ এবং ২০১৬-২০১৭ এই সময়কালের মধ্যে কৃষিতে বিনিয়োগ প্রতি বছর হ্রাস পেয়েছে।

যে বছর ফসল ভালো হয়েছে সেবছর চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতার কারণে ফসলের দর পড়ে গেছে। ২০১৭ সালে দেশে এ যাবৎ সর্বাধিক ২২.৯৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন ডাল উৎপাদন হয়েছিল। দেশের জনগণের গৃহস্থালির চাহিদা মেটাতে এই পরিমাণ ছিল যথেষ্ট; কিন্তু অপশাসনের চূড়ান্ত নমুনা দেখিয়ে সরকার সেই বছর রেকর্ড ৬.৬ এমএমটি ডাল আমদানি করেছে। ডালের এই অত্যধিক সরবরাহের ফলে দর পড়ে গিয়ে সৃষ্ট বিপর্যয়ের ধাক্কায় দেশের কৃষক এবং বাজার দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হল, ফলস্বরূপ কৃষকরা দারিদ্র্য ও দুর্দশার এক ভয়াবহ চক্রে আটকা পড়লেন। কাঠামোগত বৈষম্যের জন্য দেশের বাজারও কৃষকস্বার্থের পরিপন্থী; এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, খুব ভালো ফলন হওয়া সত্ত্বেও, ফসলের খোলা বাজারে উৎপাদিত শস্যের নিম্নমুখী দর খরা, ভারী বৃষ্টিপাত বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকেও বড় বিপর্যয় ডেকে আনে।

মুক্তহস্তে খাদ্যশস্য ও তুলো সহ নানান কৃষিপণ্য আমদানির ফলে দেশীয় বাজারের মূল্যে ধ্বস নেমেছে। ভারতের কৃষিপণ্য রপ্তানির হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু কৃষিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ক্রমাগত বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে।

জমি এবং জল পরস্পর সম্পৃক্ত, কিন্তু পণ্যায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ এবং অধিগ্রহণের ফলে জীবিকার উৎস হিসাবে কৃষির উপর নঞর্থক প্রভাব পড়ছে। ব্যবসায়িক দিক থেকে যথারীতি সুদূরপ্রসারী প্রভাবের মূল্যায়ন না করেই সারা দেশ জুড়ে কৃষি জমিকে অ-কৃষি জমিতে পরিণত করা হচ্ছে। জলসম্পদের ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ এবং অর্থকরী ফসল চাষে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার ফলে নদী ও ভূগর্ভস্থ জলস্তর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে, নদী এবং জলের অন্যান্য উৎস তাদের ভূতাত্ত্বিক এবং পরিবেশগত স্বাভাবিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

সরকারের সংস্কারবাদী পদক্ষেপের ফলে চাষের কাজে ব্যবহৃত আবশ্যক সামগ্রীর (ইনপুট) মূল্য থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হল। অন্যদিকে, কৃষি-বাণিজ্য কোম্পানিগুলি এই গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীগুলির মূল্য নিজেদের মর্জিমতো নির্ধারণ করে, বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ক্রমাগত সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৃষি-সামগ্রীর ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস পেয়েছে, ফলত দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া।

এমতাবস্থায় কৃষক চেষ্টা করছেন ঋণ নিয়ে অবস্থা সামাল দিতে। আর্থিক উদারীকরণের প্রায় ২৫ বছর পর, দেশের গ্রামীণ তথা কৃষক পরিবারগুলির ঋণের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ এবং গভীর হয়েছে। সারা ভারত ঋণ এবং বিনিয়োগ সমীক্ষার (অল ইন্ডিয়া ডেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সার্ভে, AIDIS) ১৯৯২ এবং ২০১৩ সালের রিপোর্ট থেকে এই অবস্থা স্পষ্ট হয়। এই সমীক্ষাগুলি পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ভারতের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দপ্তর বা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস।

ভারতের ঋণগ্রস্ত কৃষিজীবী পরিবারের হার ১৯৯২ সালের শতকরা ২৫.৯ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ৩৫ শতাংশে। ১৯৯২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, আরও বেশি বেশি পরিবারের ক্ষেত্রে, অনুমোদনহীন সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুমোদিত ক্ষেত্র (ব্যাঙ্ক, সমবায় ইত্যাদি) থেকে কৃষক পরিবারগুলির মোট ঋণের পরিমাণ ১৯৯২ সালের শতকরা ৬৬.৩ শতাংশের তুলনায় ২০১৩ সালে কমে দাঁড়ায় শতকরা ৫৮.৪ শতাংশে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল গ্রামীণ এলাকা থেকে কৃষকদের ঋণ প্রদানকারী বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া। ফলে, মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের হার সবচেয়ে দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায়। একদিকে যখন ঋণের দায়ে জর্জরিত দেশের কৃষিজীবীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন, তখন অন্যদিকে বাণিজ্য সংস্থার কর্ণধাররা মোটা টাকা ঋণ শোধ না করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন, সরকারি সুরক্ষায় দেশের বাইরে পালিয়ে যাচ্ছেন আর এর ফলে পুরনো মহাজনী প্রথা ফিরে এসে দরিদ্র জনতার শোষণের পথ প্রশস্ত করছে। দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা দুমুখো ঋণ নীতি (ক্রেডিট পলিসি) গ্রহণ করেছে। সুযোগ বুঝেই আর্থিক বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে অনাদায়ী ঋণ মকুব করে দেয়। বাণিজ্য সংস্থার মালিকদের মোটা টাকা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে দিব্যি নানান বোঝাপড়া হয়ে চলে। অথচ, দেশের ঋণদায়গ্রস্ত কৃষকদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এপ্রিল ২০১৪ থেকে এপ্রিল ২০১৮ এর মধ্যে দেশের বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থাগুলির ৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করা হয়েছে। বড় বড় আর্থিক উপদেষ্টাদের বক্তব্য কৃষি ঋণ মকুব হলে নাকি দেশের জিডিপিতে তার প্রভাব পড়বে। প্রশ্ন হল কর্পোরেট ঋণ মকুব হলে কি তার প্রভাব জিডিপিতে পড়ে না?!

সবুজ বিপ্লবের তথাকথিত সাফল্যের পরেও বেশিরভাগ কৃষিজীবী পরিবারের বার্ষিক গড় আয় বিগত চার দশকে একই থেকেছে। অথচ, বিধায়ক, মন্ত্রীসহ সমস্ত পেশার মানুষেরই বেতন তথা মজুরি বেড়েছে কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান আয়ের জন্য কৃষক সম্প্রদায় আরও প্রান্তিক অবস্থানে সরে গেছে। এই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে এখনও ৯৪ শতাংশ কৃষককে আয় সংক্রান্ত নিরাপত্তা বলয়ের বাইরেই রেখে দেওয়া হয়েছে।

এমনটা নয় যে কৃষি লাভজনক, উৎপাদনশীল হতে পারে না। পরিকাঠামোর তুলনায় কৃষিতে বিনিয়োগ করলে কম করেও পাঁচগুণ লাভবান হওয়া যায়। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা এক সংকট। কৃষিকে এই অবস্থায় না রাখলে অর্থনৈতিক উদারীকরণের নামে নেওয়া সংস্কারবাদী পথ যে টালমাটাল হয়ে পড়বে। ভারতীয় অর্থনীতির নব্য উদারতাবাদী পুনর্গঠনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ৯০-এর দশকে, বর্তমান সরকারের সময়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তা ধাবিত হচ্ছে। কৃষিব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কৃষি-ব্যবসায় নিযুক্ত বিশাল বিশাল বাণিজ্য সংস্থাগুলির হাতে দেওয়ার সব ব্যবস্থাই সরকারি মদত পাচ্ছে।

সরকারের দোসর কর্পোরেট মিডিয়া। মূলধারার সংবাদমাধ্যম চিরদিনই কৃষকদের উপেক্ষা করে এসেছে। আর যদিবা সংবাদমাধ্যম বিষয়গুলির উপর কদাচিৎ দৃষ্টিপাত করে, সেক্ষেত্রেও পুরো সংকটকে ‘ঋণ মকুব’-এর দাবিমাত্রে পর্যবসিত করা হয়েছে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিটিকে ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত করা হয়েছে বলে সরকার থেকে যে দাবি করা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম কিন্তু মোটেই তাকে প্রশ্ন করছে না, তার সত্যতা খতিয়ে দেখছে না। জাতীয় কৃষক কমিশন কৃষি এবং কৃষকদের বিষয়ে যে আরও এক গুচ্ছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছিল সে ব্যাপারেও সংবাদমাধ্যম মুখে কুলুপ এঁটেছে। এছাড়া ঋণ মকুবের আবেদনের সমালোচনা করার সময় প্রচারমাধ্যম ভুলেও উল্লেখ করে না যে, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি এবং ব্যবসায়ীরাই ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায় দেউলিয়া করে তোলা অলাভজনক সম্পদের অধিকাংশ হাতিয়ে বসে আছে।

কৃষক আত্মহত্যা এবং সংকটজাত অভিবাসন

এইরকম অবস্থায় দুটো জিনিস ঘটছিল। প্রথমত ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতের তিন লক্ষেরও অধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এই পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ বিভাগ, জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি, NCRB) থেকে প্রাপ্ত। এমনকি এই ভয়াবহ পরিসংখ্যানও যথাযথ নয়— কারণ জমির পাট্টা না থাকায় মহিলা, দলিত ও আদিবাসী— ইত্যাদি গোষ্ঠীভুক্ত কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা সঠিকভাবে এই পরিসংখ্যানের আওতায় আনাই হয়নি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ২০১৫-এর পরে কৃষকদের আত্মহত্যা বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেনি। বহু রাজ্য সরকার ২০১১ সাল থেকে তাদের রাজ্যকে ‘কৃষক আত্মহত্যাশূন্য’ বলে ঘোষণা করতে শুরু করে— অথচ আত্মহত্যার সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ২০১৪ সালের রিপোর্টে, সরকারের পক্ষ থেকে এনসিআরবি’র কৃষক আত্মহত্যার গণনা পদ্ধতিতেই বড় রদবদল ঘটানো হল। রাজ্য সরকারগুলি এখন তাদের মর্জিমাফিক যেকোনও পরিসংখ্যান দিতে পারে— এবং তাদের এই পরিসংখ্যান মূলত আসে প্রতিটি রাজ্য সরকারের রাজস্ব বিভাগ থেকে। বলা বাহুল্য, পরিসংখ্যানের নামে এটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। আত্মহত্যার সংখ্যা যত বেশি হবে, সরকারকে তত বেশি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব বিভাগগুলি আত্মহত্যার সংখ্যা তথা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ যতটা কম রাখা যায় তার চেষ্টায় সদা প্রয়াসী। আর ঠিক এই কারণেই কৃষকদের মধ্যে আত্মহননের ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়লেও আত্মহত্যার পরিসংখ্যান নিম্নমুখী।

দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্র থেকে ব্যাপক হারে কৃষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ২০০১ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে দেশের কৃষক সংখ্যা প্রায় এক কোটি কমে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ গ্রাম ছেড়ে দেশান্তরী হয়ে অন্যান্য গ্রাম, ছোট শহর ও মহানগরগুলিতে চলে যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে, অথচ এইসব জায়গায় তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থাই নেই। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে অভিবাসনের জন্য শোষণের অসংখ্য রাস্তা তৈরি হয়েছে, ফলে পরিযায়ী শ্রমিকরা দুর্বল এক কর্মীদলে পরিণত হচ্ছেন যাঁদের অনায়াসেই দাবিয়ে রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। খুচরো মজুরি এবং চুক্তি শ্রম ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের বাজার শোষণ ও নির্মমতার আতুরঘর, আইনি প্রতিকারের কোনও পথও নেই। গ্রামীণ ভারত থেকে যে তীব্র গতিতে সংকটজাত অভিবাসন ঘটছে এবং ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে, তার চাপ ভারতের শহরাঞ্চলেও ঠিক ততটাই অনুভূত হবে।

আত্মহনন থেকে প্রতিরোধে

এনসিআরবি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে ৬৪০টি প্রতিবাদ কর্মসূচি দেশ জুড়ে পালিত হয়েছিল কৃষিজীবীদের অসন্তোষ ঘিরে। দুই বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮০০টি কর্মসূচিতে। ২০১৮ সালে এসে তাতে বহুগুণ বৃদ্ধি হয়েছে। কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। মধ্যপ্রদেশে কৃষকদের উপর গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। মহারাষ্ট্রে কৃষকদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ায় তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। দেশের প্রায় সর্বত্র নোট বাতিলের কারণে কৃষিজীবীদের জীবন-জীবিকায় বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছে। গ্রামীণ মানুষের যন্ত্রণা, ক্ষোভ বেড়ে চলেছে। শুধুমাত্র কৃষকেরাই নন, শ্রমিকেরাও দেখছেন কেমন করে সুপরিকল্পিতভাবে মনরেগা (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন) প্রকল্পের কাঠামোটিকেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ, বিধ্বস্ত মৎস্যজীবী মানুষ, অরণ্যবাসী সম্প্রদায়, গ্রামীণ কারিগর, শোষিত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। ক্ষুব্ধ সেইসব মানুষেরা যাঁরা ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পড়তে পাঠিয়ে টের পাচ্ছেন রাষ্ট্র কেমন করে নিজের স্কুলগুলোকে, শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজের হাতেই হত্যা করছে। এছাড়াও, চাকরির অনিশ্চয়তায় অসন্তোষ বেড়ে চলেছে সাধারণ সরকারি কর্মচারী, পরিবহন কর্মী এবং সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত ছোটখাটো চাকুরেদের মধ্যেও। শহুরে মধ্যবিত্তও টের পেয়েছে কৃষকের অবস্থা নড়বড়ে হলে তার অবস্থাও খুব একটা পাকাপোক্ত থাকবে না। চাষি যে দুই লক্ষ টাকা খরচ করে শস্য ফলিয়ে শেষে তিন টাকা কেজি দরে তা বেচতে বাধ্য হচ্ছেন, আর নষ্ট করে দিচ্ছেন রাগে দুঃখে, সেই ফসল আপনি আমি কিনছি ৫০ টাকা কিলো দরে শহরে। একদিকে চাষি আর অন্যদিকে আমাদের মতো সকালে থলে হাতে বাজারে যাওয়া ভোক্তা। আতঙ্ক সঞ্চারিত হয়েছে তাই শহরের পেশাজীবী মানুষের মধ্যেও। কোথাও বোধহয় এই আতঙ্ক, অনিশচয়তা থেকে জন্ম নিয়েছে সংহতির বোধ। যা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম নাসিক থেকে মুম্বই লং মার্চে।

ফসলের ন্যায্য মূল্য এবং ঋণমকুব ছাড়াও কৃষিজীবীদের মধ্যে থেকে উঠে আসছিল আরও নানান দাবিদাওয়া। তার মধ্যে কয়েকটি হল— ক) ১২ বছর ধরে পড়ে থাকা জাতীয় কৃষক কমিশন বা স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা। এমএসপি বাদেও সেখানে আলোচিত হয়েছিল আরও বহু জরুরি বিষয়। খ) সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে দেওয়া। এই সংকটের স্বরূপ, কেমন করে এই সংকট লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবীকে বিপন্ন করেছে ইত্যাদি বিষয়ে দেশের মানুষকে সরাসরি তাঁরাই জানাবেন। গ) দেশের ব্যাপক জল সংকটের মোকাবিলা। শুধুমাত্র খরার প্রেক্ষিতে এই সংকটকে ভাবলে চলবে না, এই সংকট খরার তুলনায় অনেক বড়। একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে পানীয় জলের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। ঘ) খেতমজুর এবং ভূমিহীন শ্রমিকদের অধিকার। ঙ) কর্পোরেট-মুনাফা নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থা নয়, বরং এমনএক ব্যবস্থা যা গ্রামীণ সম্প্রদায়— যাদের অস্তিত্বই কৃষিনির্ভর— তাদের দ্বারা পরিচালিত, পরিবেশগতভাবে সচেতন একব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ। চ) ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইন বলবৎ করে আদিবাসী কৃষকদের অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি ছ) মহিলা কৃষিজীবীদের অধিকার। দেশের মহিলা কৃষিজীবীদের জমির মালিকানাসহ অন্যান্য অধিকারের কথা বাদ দিয়ে কিছুতেই কৃষি সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না; খেতে খামারে সর্বাধিক পরিশ্রম করেন কৃষিজীবী মহিলারাই, অতএব তাঁদের সমস্যার কথা সর্বাগ্রে ভাবতে হবে সংকটের মোকাবিলা করতে হলে। ১৫তম ভারতীয় আদমশুমারি (২০১১) ইত্যাদি জাতীয় স্তরের সমীক্ষাগুলি থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৯.৮% পুরুষ কর্মীর তুলনায় ৬৫.১% মহিলা শ্রমিক কৃষির উপর শস্য উৎপাদক অথবা কৃষিশ্রমিক হিসেবে নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) একটি সমীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত ৮১% মহিলাই আসেন দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে (আইএলও, ২০১০)। কৃষিতে তাঁদের ব্যাপক উপস্থিতি সত্ত্বেও, বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, গ্রামীণ পরিবারগুলিতে জমি মহিলাদের মালিকানাধীন রয়েছে ৬-১১% ক্ষেত্রে। লিঙ্গের ভিত্তিতে নির্ধারিত বৈষম্যমূলক মজুরি কৃষিক্ষেত্রের অন্যতম এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কৃষির সঙ্গে যুক্ত কর্মকাণ্ডের ৬০% সম্পূর্ণরূপে মহিলাদের দ্বারা সম্পাদিত হলেও, কৃষিতে প্রতি ঘন্টায় নারী শ্রমিকের মজুরি পুরুষ শ্রমিকের মজুরির তুলনায় ৫০%-৭৫% কম। কৃষিজীবীদের আত্মহত্যা সংক্রান্ত তথ্য বিকৃতির অভিযোগে এমনিতেই সরকারি সংস্থাগুলির দেওয়া পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ফলে বলাই বাহুল্য, আত্মঘাতী মহিলা কৃষকদের বিষয়ে তথ্য আরও বেশি অস্পষ্ট। মহিলা কৃষকদের এই অস্তিত্বহীনতা তাঁদের মৃত্যুতেও ঘোচে না— কৃষক পরিচয় সরিয়ে রেখে ‘গৃহবধূ’ পরিচয়ে তাঁদের চিহ্নিত করার অর্থ হল মহিলা কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘গৃহবধূর আত্মহত্যা’ বলে ভ্রান্ত প্রচার চালানো। আত্মঘাতী কৃষকদের বিধবারা প্রয়াত স্বামীর যাবতীয় আর্থিক দায়দায়িত্ব এবং ঋণের বোঝার সঙ্গে যুঝে চলেন। যৎসামান্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, বিধবা ভাতার অনুমোদন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং শিশুসন্তানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাবদ প্রাপ্ত সরকারি সহায়তা— ইত্যাদি প্রদানে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা আত্মঘাতী কৃষক পরিবারের মহিলাদের দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ। সঙ্গে আছে হিংসা এবং যৌন হয়রানি।

হাইওয়ে থেকে সংসদ মার্গে

নাসিক-মুম্বই লং মার্চের দৃষ্টান্ত থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে, উপরোক্ত এই সমস্ত দাবির কথা সোচ্চারে ঘোষণা করতে তথাদেশের সম্মুখে উপস্থিত এই ভয়াবহ সংকট বিষয়ে আলোচনা এবং অবস্থার মোকাবিলায় আইন প্রণয়ন করার জন্য সংসদের ২১ দিনব্যাপী বিশেষ অধিবেশনের দাবিতে ২৯-৩০শে নভেম্বর ২০১৮ দিল্লিতে কিষান মুক্তি মার্চ কর্মসূচি গৃহীত হয়। বিগত বছরগুলোয় আমরা দেখছিলাম বারবার কৃষকরা ফসল, সবজি, ফলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে নিজ নিজ এলাকায় রাস্তা অবরোধ করছেন। হাইওয়ের উপর রক্ত জল করে ফলানো ফসল ফেলে দিচ্ছেন। ক্রমশ এই মানুষেরা একটা ছাতার তলায় আসতে শুরু করলেন। ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রায় ২০০টি কৃষক, শ্রমিক, বহুজন ও দলিত, আদিবাসী, খেতমজুর, মহিলা কৃষিজীবীদের সংগঠন মিলে গড়ে উঠল অখিল ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি নামের এক বৃহৎ, ব্যাপক এবং অভূতপূর্ব জোট। মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হলেন রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, পরিবেশ কর্মী, সমমনস্ক সাংবাদিক লেখক এবং নানান পেশাজীবী তথা পড়ুয়া। এই যৌথ মঞ্চের ইস্তাহার বলছে মহিলা, দলিত, যাযাবর ও আদিবাসী কৃষক; পাট্টাদার কৃষক, ভাগচাষি, বর্গাদার, কৃষিশ্রমিক ও বাগান শ্রমিক; মৎস্যচাষি, পোলট্রি, গবাদি পশু পাখি প্রতিপালক, মেষপালক, সাধারণ বনজ দ্রব্য সংগ্রাহক; এবং, শস্যচাষ, মধু চাষ, ঝুম চাষ, রেশমগুটি চাষ, কেঁচো চাষ, বনানীকরণের সঙ্গে যুক্ত কৃষি পণ্যের মূল উৎপাদক প্রতিটি মানুষই হলেন কৃষক। তাঁদের লক্ষ্য লোকসানমুক্ত কৃষিকর্ম, ঋণমুক্ত কৃষক, বিষমুক্ত খাদ্য এবং কৃষক আত্মহত্যামুক্ত ভারতবর্ষ। এই মঞ্চের মাধ্যমে প্রতিবাদ স্থানীয় থেকে সর্বভারতীয় চেহারা নিল। আর লালকেল্লায় নয়, আর যন্তর মন্তরে মৃত কৃষকের খুলি নিয়ে বিক্ষোভ নয়। কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির আহ্বানে দুইদিন ব্যাপী ঐতিহাসিক কিষান মুক্তি মার্চে যোগ দিতে প্রতিবাদী মানুষ সরাসরি হাজির হলেন সংসদ মার্গে। শোনালেন তাঁদের কথা। জনপ্রতিনিধিদের দিলেন হুঁশিয়ারি। সক্রিয় যোগদান করলেন ন্যায় ও গণতন্ত্রের পক্ষে থাকা সহনাগরিক এবং অধিবাসীরা।

২৮ এবং ২৯ তারিখ বিভিন্ন রাজ্য থেকে কিষান মার্চে অংশগ্রহণ করতে আসা মানুষজন দিল্লির বিভিন্ন রেলস্টেশন সংলগ্ন ক্যাম্পে জড়ো হচ্ছিলেন। ২৯শে নভেম্বর সন্ধেবেলা রামলীলা ময়দানে ‘এক শাম কিষানো কে নাম’ বলে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের জমায়েত মানে তো শুধু স্লোগান নয়, গানও বটে। লোকগান, নৃত্য, ড্রামের আওয়াজে মুখর চতুর্দিক। কেউ বাজাচ্ছেন বাঁশি। আদিবাসী কৃষকদের নাচ গান অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। বহু সাংস্কৃতিক দল, সংস্কৃতি কর্মী ‘নেশন ফর ফারমার্স’ সহায়ক দলের অংশ হিসেবে এই মার্চে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। একইভাবে ‘ডক্টরস ফর ফারমার্স’ ব্যানার নিয়ে চিকিৎসকরা বসেছিলেন টেবিল নিয়ে, আগত মানুষজনের শারীরিক অসুবিধার উপশম করতে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কিষান মার্চের অনেক আগেই এমন বহু সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি হয়েছিল সারা দেশের নানান শহরে। নানান নাগরিক গোষ্ঠী দিল্লি এবং উপকণ্ঠে সক্রিয় ছিল। ‘স্টুডেন্টস ফর ফারমার্স’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গড়ে ওঠা মঞ্চ। দিল্লির বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা দুইদিনের কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে সমস্ত কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচার চালানো হয়। মূলধারার সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে প্রথমে যথারীতি কুলুপ এঁটেছিল। কিন্তু শেষে দেখা গেল যে তারাও হাজির হয়েছে। অবশেষে প্রথম পাতায় স্থান করে নিতে পারল কৃষি সংকট ও কৃষকদের প্রতিবাদ! আর শুধু বিমূর্ত এক সংকটের ধারণা নয়, আমরা চাষিদের মুখগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ‘ফটোগ্রাফারস ফর ফারমার্স’ নামের সহায়ক গ্রুপটি একমাস ধরে কৃষিজীবীদের ছবি তুলে প্রচার চালাচ্ছিল। অন্যান্য পেশাজীবী মধ্যবিত্ত নাগরিকদের অংশগ্রহণে কর্মসূচিটি শুধু কৃষকের মার্চ হয়ে থাকেনি। স্বতন্ত্র, ছোট ছোট সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। কৃষকের সংকট যে দেশের সংকট সেটা বুঝে বহু সাধারণ, শহুরে শ্রমজীবী মানুষও পাশে এসে দাঁড়ালেন। মুম্বইয়ের এক শহরতলির অটোচালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়েছেন কৃষি সংকট নিয়ে আলোচনা করার জন্য ২১ দিনের সংসদীয় অধিবেশনের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা আবেদনপত্র। সারাদেশের মানুষ এই বিশাল কর্মসূচির জন্য টাকাপয়সা, জিনিসপত্র দিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। দিল্লি সরকারও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নানান ক্যাম্পে, রামলীলা ময়দানে রাতে থাকার ব্যবস্থা ছিল।

পরদিন সকাল দশটা থেকে সংসদ মার্গের দিকে মিছিল শুরু হল। রামলীলা ময়দান থেকে সংসদ মার্গের দূরত্ব চার কিলোমিটার। দেশের প্রায় ১০০টি জেলা থেকে আগত মানুষ ব্যারিকেড ঠেলেই ফেস্টুন, পতাকা, ব্যানার হাতে এগোচ্ছেন। নিজ নিজ রঙে সজ্জিত বিভিন্ন গোষ্ঠী। মহারাষ্ট্রের কৃষকেরা পড়েছেন লাল জামা, উত্তরপ্রদেশের চাষিদের হাতে হলুদ পতাকা, আবার মধ্যপ্রদেশের একদল প্রতিবাদী বেগুনি টিশার্ট চাপিয়েছেন। তামিলনাডুর রং সবুজ। সবমিলিয়ে মিছিল রামধনু রঙে উজ্জ্বল। যখন সবকিছুকে এক রঙে, এক ভাবনায়, এক যুক্তিতে দেগে দেওয়ার অশুভ প্রয়াস চলছে, ঠিক সেই সময়ে কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ছাতার তলায় সমবেত হওয়া মানুষের মধ্যের বৈচিত্র্য প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের বহুত্বের ছবিটিকেই তুলে ধরে। ন্যায্যমূল্য এবং ঋণ মকুব এই সাধারণ দাবি বাদেও নানা প্রদেশের নানান স্থানীয় সমস্যার নিরিখে আলাদা আলাদা দাবি উঠে আসছে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের একদল কৃষকের অভিযোগ সেচের বন্দোবস্ত না থাকা, তীব্র জলাভাব আর চূড়ান্ত অস্বচ্ছ ফসল বিমা ঘিরে। মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্য থেকে আগত আদিবাসী কৃষকদের দাবি অবিলম্বে তাঁদের অধিকার সুরক্ষিত করতে ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইন বলবৎ করা হোক এবং বংশ পরম্পরায় চাষ করা জমির পাট্টা তাঁদের দেওয়া হোক। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, নাসিক থেকে মুম্বই লং মার্চের অন্যতম প্রধান দাবিও এটিই ছিল। হরিয়ানার কৃষকদের অভিযোগ তাঁদের গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত। এই মধ্যরাতে কেমন করেই বা খেতে জলসেচ করা সম্ভব! পঞ্জাব থেকে আগত কৃষকদের মূল সমস্যা ধান এবং গমের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘিরে। জানা গেল সার, কীটনাশক, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষে বিনিয়োগ অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ শস্যের মূল্য সমানুপাতিক হারে বাড়েনি। চাষি বাঁচবে কেমন করে? মধ্যপ্রদেশের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী কৃষকেরা এসেছেন ঝাবুয়া থেকে। রাজস্থানী চাষিদের রঙিন জামাকাপড়ের তলায় যে হতাশার রং লুকিয়ে আছে, তা তাঁদের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠল। রাজস্থানের নাগৌর জেলার ৭৫ বছরের বৃদ্ধ চাষি সুরধন সিংয়ের কথায়, “আমায় এখন আর কেউ খেতমজুরের কাজে নিতে চায় না বুড়ো হয়েছি বলে। নিজের দুর্দশার কথা বলা ছাড়া আর কিছুই আমি করতে পারি না এখন।” তাঁদের গ্রামে এমন জলকষ্ট যে বর্ষাকাল বাদে বাকি সময়টা সকলেই খেতমজুরের কাজ নিতে বাধ্য হন। বোরওয়েলে যে জল ওঠে তা এতটাই লবণাক্ত যে তাতে মোটেই চাষাবাদ সম্ভব নয়। জমি আর ফসল দুই-ই তাতে নষ্ট হয়। সারা রাজস্থান জুড়ে চাষিরা বারবার বসুন্ধরা রাজে সরকারের কৃষকবিরোধী পদক্ষেপের প্রতিবাদে রাস্তায় নামছেন। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে নির্বাচন হয়ে গেল সদ্য। ভোট দিয়েই মধ্যপ্রদেশ থেকে ট্রেন ধরেছেন অনেকে, গন্তব্য দিল্লির কিষান মার্চ। মনে করা হচ্ছে কৃষকদের অবস্থা এই দুই নির্বাচনে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে। কেউ কেউ বলছিলেন পঞ্চম তফশিলের অধীনস্থ জমি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পগুলোতে, যে উন্নয়নে মানুষের কোনও লাভই হবে না। মুষ্টিমেয় কোম্পানি মুনাফা লুটবে। বহু মহিলা কৃষকেরা তাঁদের মৃত স্বামীদের ছবি সঙ্গে নিয়ে হাঁটছেন। মহারাষ্ট্রের দাহানুর আদিবাসী মহিলা কৃষকরা জানালেন সন্তানসন্ততির মুখ চেয়েই তাঁরা পদযাত্রায় এসেছেন, কারণ জোট বেঁধে পাশাপাশি না দাঁড়ালে জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে। এসেছেন খরা কবলিত উড়িষ্যার দুমেরপাড়ার চাষিরা।

রাজস্থান, উড়িষ্যা থেকে এসেছে কৃষকদের জাঠা। মিছিলে হাঁটছিলেন আমাদের বাংলার সুন্দরবনের মেয়ে রিঙ্কু হালদার। তিনি বলছিলেন সুন্দরবনের মানুষের যন্ত্রণার কথা। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের অপদার্থতার প্রতিবাদে পোলিও আক্রান্ত রিঙ্কু শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে হেঁটেছেন মিছিলে। একই হতাশা ধ্বনিত হল উত্তরবঙ্গ থেকে আসা কৃষক ফণীভূষণবাবুর কথায়। বলছিলেন চাষির ছেলেমেয়েদের দেখুন, ভিখিরির দশা। তীব্র খরাপ্রবণ মহারাষ্ট্রের ইয়াভতমল, বিদর্ভ, মারাঠাওয়াড়া সর্বত্রই কৃষকদের দুর্দশা অসহনীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই কিষান মার্চের ঠিক অব্যবহিত পরেই মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবীশ মহারাষ্ট্রের মোট কৃষিজমির ৮৭.৭৬ লক্ষ হেক্টর জমি এবং ৮২.২৭ লক্ষ চাষি খরা কবলিত বলে ঘোষণা করেছেন।

জীবনের জ্বলন্ত নানান ইস্যু ঘিরে স্লোগানে মুখরিত তাঁদের মিছিল বেলা ১২টা নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছাল। মঞ্চ প্রস্তুত। কৃষকনেতারা বক্তব্য রাখবেন। আসন, খবরের কাগজ পেতে সবাই বসে পড়লেন। সাদামাটা খাবার সঙ্গে ছিল তাঁদের, যাঁরা সকাল সকাল এসেছিলেন। কাগজের মোড়ক খুলে ভাখরি, আচার দিয়েই খিদে মেটানো গেল। কেউ কেউ কাছাকাছি স্টলে খাবারের সন্ধান করছিলেন। বিকেল সাড়ে চারটে অবধি বক্তৃতা চলল। কৃষকনেতা বাদেও বহু রাজনৈতিক দলের নেতারা এসে পৌঁছেছিলেন। যদিও ক্ষমতাসীন দলের কোনও প্রতিনিধি আসেননি কৃষকদের কথা শুনতে। উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধি, আম আদমি পার্টির নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা, সমাজবাদী দলের শরদ যাদব, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট শরদ পাওয়ার প্রমুখ। কৃষি সংকটকে উপেক্ষা করার জন্য সকলেই বর্তমান সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। মুক্ত মঞ্চ থেকে কৃষকদের সমর্থন জানান। বক্তৃতা শেষ হলে পর আবার পথ চলা শুরু বাড়ি ফেরার তাগিদে। সমাবেশে উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের কিছু কিছু প্রতিনিধির অবধারিত প্রশ্ন ছিল, ব্যস এটুকুই? এরপর? কৃষকরা অবশ্য মনে করেন দিল্লি আসা একেবারেই সার্থক। বিহারের নাউয়া গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান কৌশল্যা দেবীর কথায়, “রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন। রিপোর্টাররা আমাদের কথা তুলে ধরছেন। এত এত চাষি একত্রিত হয়েছেন। এটা জেনে ভরসা পাই যে দুর্দশা যন্ত্রণা কেবল একা আমি ভোগ করছি না। আমার এই সমস্যা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমার মতই হাজার হাজার মানুষ আছেন।”

কৃষকদের নিরন্তর প্রতিবাদের ফলে পাবলিক ডিসকোর্সে কৃষি ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে। সারাদেশের কৃষিজীবীরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদে সরব হওয়ায় আগামী ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে দেশের সবচেয়ে জরুরি বিষয়খানিকে আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। পারস্পরিক সংহতি আর ঐক্য দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে ভরসা জোগাচ্ছে।

তথ্য সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:

 

ছবি: পরিপ্লব চক্রবর্তী

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...