প্রসেনজিত কোণার
“এই বীর সন্তান বীর সৈনিকটি কাল জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় দেশের জন্য প্রাণ বলিদান করলেন। আমরা শোকাহত, কিন্তু শহীদের বীরত্বের জন্য গর্বিত। ভারতমাতার এই শহীদ বীর সৈনিক কে শ্রদ্ধা, প্রণাম।” এই ধরনের মেসেজ এমন কেউ নেই যার চোখে পড়েনি, সাথে এটাও দেখেছেন শেয়ার কমেন্ট হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌছে গেছে, ঘটনাটিকে আর পাঁচটা সাধারণ ঘটনার সাথে মিলিয়ে দিতে পারিনি যেদিন এটা নিয়েই বন্ধুর সাথে হালকা আলোচনা ক্রমেই রাগারাগিতে পৌছে গিয়েছিল। যে ছেলেটা একটা কৃষক আত্মহত্যা করলে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না সে একটা সৈনিক মরে যাওয়ায় পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা দশগুণ বাড়িয়ে নিয়ে মৃত সৈনিকের প্রতি গর্বে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়! ছেলেটা আমার বন্ধু, তাই যতই ওর সাথে রাগারাগি হোক আবার ঠিক করে নেব, কিন্তু ভারতের প্রায় সব মানুষ যখন এমনটাই তখন কী করবেন?
একজন সৈনিকের মৃত্যু, তার প্রতি শোক প্রকাশ ও শত্রুদের ঘৃণা ছুঁড়ে দেওয়া ঘটনাটি এতটা দেখতে ঠিকই মনে হয়, কিন্তু এই মানুষগুলো হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার খবরে যখন বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না তখন কারণ খুঁজতে হয়। কেন এরা একটাও পোস্ট লিখল না “এই দেশ মায়ের বীর কৃষক সন্তানটি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, এই বীর শহীদ কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও রাষ্ট্রের প্রতি একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে আপনারা সবাই একজোট হয়ে রাষ্ট্রের প্রতি তীব্র ধিক্কার দিন!” এই সবের মূলে আছে দেশপ্রেম! দেশের প্রতি প্রেমের আগে দেশ জানিসটাই কি বুঝতে গিয়ে যখন মাথা চুলকাচ্ছি তখন সর্বরোগহর ঔষধ যাঁর কাছে থাকে সেই রবিদাদুর শরণাপণ্ণ হলাম, ঊনি যা জানালেন তাতে দেশ হল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী একটা গোটা আদ্যোপান্ত ম্যাপটি নয়, দেশের ইঊনিট মানুষ, মানুষ যদি সুখে থাকে, শান্তিতে থাকে তবে সেই চিন্ময়ী দেশও সুখী। আচ্ছা এবার যখন দেশ কাকে বলে বিষয়টি পরিষ্কার হল এবার বলুন তো যে বর্ডারে পাহারাদারি করে সেইই কি শুধু দেশ গড়ছে? যাদের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পান ওরা কি দেশ গড়ছে না? এবার ঘুরে ফিরে আসে কয়লা খাদানের শ্রমিক থেকে ডাক্তার, ঊকিল, মাস্টার সবাই তো দেশের কাজই করছেন তবে এরা কি দেশের কারিগর নন? সবাই একটা চেনে বাঁধা, সবাই পারিশ্রমিক নিচ্ছেন ও তার বদলে যে যেটাতে দক্ষ তাই করছেন।
এবার সৈনিকের কাজের সাথে পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গ টানায় নিশ্চয় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এটায় একটু পরে আসছি। তার আগে আপনার নিশ্চয়ই মনে হয়েছে কাজের তারতম্য আছে তাই সব কাজকে এক চোখে দেখতে আপনি নারাজ, এসি রুমে কম্পিউটারের সামনে বসে অফিসের কাজ করা আর হাড়কাঁপানো মাইনাস টেম্পারেচারে বন্দুক হাতে নিয়ে পাহারাদারি করা কি এক? তাই ওনাদের একটু বেশি সম্মান দিই ক্ষতি কি? আপনি এইটুকু বলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন না, আপনার প্রথমে বোঝার দরকার একটা সাধারণ ছেলে মাইনাস টেম্পারেচারে কেনই বা কাজ করতে যায়? কিসের দরকার পড়ে ঘর ছেড়ে অত দূরে পড়ে থাকার? দেশভক্তির টান? আসলে যা ভাবছেন তা নয়, সেনা বিভাগের কঠিন কাজ হয় আর্মিতে তাই আর্মির র্যালিতে গিয়ে দেখবেন হাজার হাজার ছেলে ভোর চারটা থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই কঠিন কাজটা করার জন্যই! কারণ একটাই, শুধু একটা সরকারি চাকরি! হোক না কঠিন, মধ্যবিত্ত-গরীব ঘরের ছেলেরা জানে ধানের জমিতে চাষ করার চেয়ে অনেক ভালো কাজ সৈন্য বিভাগে যাওয়া, ভালো বেতন, পরিবারের মেডিক্লেম থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা এই গরীব জীবনে অনেক, এবং ওখানে একটাও কোটিপতি ঘরের ছেলে নেই। যারা চাকরির সুযোগ পায় তাদের সেই কাজের জন্য পেশাদার করে তুলে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ করা হয় যা তাদের পেশাদারি দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে, এখানে বোঝা দরকার ওরা সেই শারীরিক পরিশ্রম দিতে পারবে দেখেই সিলেক্ট করা হয়েছে ও ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে যা তাদের দক্ষতা। আবার কোনও সফটওয়্যার ডিজাইনার সফটওয়্যারের ওপরই দক্ষ যাতে দক্ষ হতে তাকে বহুদিন পড়াশোনা প্রোজেক্ট ইত্যাদি করতে হয়েছে, কোনও শিক্ষকের যেমন দায়িত্ব থাকে ছেলেমেয়েদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার তেমনই আর্মির দায়িত্ব থাকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করা। এ সবই পেশাদারিত্ব, আশা করছি আপনারা বুঝতে পারছেন সেনাবাহিনীর কাজ কোনও ভিনগ্রহী কাজ নয়। এটা একটা বিশেষ ঊপযুক্ত দলকে বেছে নিয়ে করানো হয়, যেমনটা শিক্ষকতা ইত্যাদিতেও একই।
এবার সম্মান তবে শুধু একমুখী কেন? সৈন্য বিভাগে কী কাজ হয় যেখানে মরলে শহীদ? সৈনিকদের কাজ দেশকে জঙ্গিমুক্ত রাখা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাত লাগানো। এবার যদি কাজ করতে গিয়ে মারা যান শহীদ বলা হল, এবার যে কৃষক চাষের ঋণের বোঝা মুক্ত করার শুধুমাত্র দাবি জানানোর জন্য গুলি খেল সে শহীদ নয় কেন? কিংবা যে বাস ড্রাইভার বাস চালাতে চালাতে ট্রাকের নীচে পিষে গেল সেই বা শহীদ হবে না কেন? নাকি পেশাদারি কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুতে আমরা শহীদ বলতে পারি না? আসলেই পারি না, কারণ ওদের শহীদ বললে বিপ্লবী ক্ষুদিরামদের ছোট করা হয়, অসম্মান দেখানো হয়, যাঁদের পেশাদারি মৃত্যু নয় যা সৈনিকদের মৃত্যুর চেয়ে অনেক আলাদা। তাইই ক্ষুদিরামরা শহীদ। যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের, তবুও সৈনিকদের শহীদ বলে দেওয়ার মাঝে রয়েছে মস্ত বড় ভুল যা একচেটিয়া ও দেশপ্রেমকে বিকৃত করে, যদিও রাষ্ট্রনেতাগণ বিকৃত করার ইচ্ছে নিয়েই তা করেছেন। একচেটিয়া দেশপ্রেম জনগণের মাঝে জাগিয়ে রাখতে সৈন্যদের মরতেই হয় যা অবশ্যই পূর্ব নির্ধারিত করা থাকে, যে মেয়েটা বলেছিল যুদ্ধই তার বাবাকে মেরেছে কথাটা অদ্ভুতরকম সত্যি, ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেরই জনগণের মগজ আচ্ছা করে ওয়াশ করে দেওয়ার জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হয় যেখানে বলির পাঁঠা এই সৈনিকেরা। তাই দুই দেশের জনগণ শুধু বুলেটেই দেশপ্রেমের পারফিউম পান। এই সরকারের আমলে ২০১৪-১৬ তিন বছরে জম্মু কাশ্মীরে ১২৫জন (৩২+৩৩+৬০) জওয়ান মারা গেছেন। সেখানে এই তিন বছরে ১৯,৮২৯ জন কৃষক আত্মহত্যা কখন করল আমরা জানতেই পারলাম না! ১২৫ জনের পারফিউমেই ভেসে রইলাম!