সত্যব্রত ঘোষ
मै कभी सिगरेट पीता नहीं मगर हर आने वाले से पूछ लेता हूँ कि माचिस है
बहुत कुछ है जिसे मैं फूँक देना चाहता हूँ–गुलजार
আমি সিগারেট কখনও টানিনি তবু যারা আসেন তাঁদের জিজ্ঞাসা করি দেশলাই আছে কি,
এমন অনেক কিছু আছে যা আমি জ্বালিয়ে দিতে চাই–গুলজার
অবশেষে ১৭ই ডিসেম্বরে সজ্জন কুমারকে ১৯৮৪ সালে দিল্লির শিখধর্মাবলম্বীদের নিধনে প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে দিল্লি হাইকোর্টের দুই বিচারপতি এস মুরলীধর এবং বিনোদ গোয়েল আজীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিলেন। মোট ২০৩ পাতার আদেশনামায় তাঁরা বলছেন—
In the summer of 1947, during partition, this country witnessed horrific mass crimes where several lakhs of civilians, including Sikhs, Muslims and Hindus were massacred. Thirty-seven years later, the country was again to witness another enormous human tragedy… For four days between November 1 to November 4 of that year, all over Delhi, 2,733 Sikhs were brutally murdered. Their houses were destroyed. In the rest of the country too, thousands of Sikhs were killed. The aftershock of those atrocities is still being felt.
তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত এই হত্যালীলার সাক্ষীরা লিখিত বয়ান দিয়েছে। তার পরেও পুলিশ যে নিষ্ক্রিয় ছিল, তা নিন্দনীয়। অভিযুক্ত সজ্জন কুমারকে আরোপমুক্ত করবার রায় দিয়ে নিম্ন আদালত ভুল করেছে। এই সূত্রে বিচারপতিরা মধ্যপ্রদেশের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের নামও অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গত ৩৪ বছর ধরে লাগাতার প্রাণনাশের হুমকি ও হয়রানি সত্ত্বেও দুই মহিলা জগদীশ কৌর এবং নিরপ্রীত কৌর অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে অনড় ছিলেন। নিজের ছেলে এবং বৃদ্ধ বাবাকে চোখের সামনে যারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা হতে দেখেছিলেন, এই রায় আপাতত তাঁদের কিছুটা সান্ত্বনা দেবে বটে। তবে ২০১৯-এর আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের পরেও রায়টি বলবৎ থাকবে কি না, সে প্রশ্নের পরিসর এটা নয়। গুজরাটের গোধরাকাণ্ডের কাণ্ডারিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনাও তাই এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় জানবার পর পিছু ফিরে দেখবার ইচ্ছা স্বাভাবিক। ভিন্দ্রানওয়ালার নেতৃত্বে খলিস্তান আন্দোলন, ব্লু-স্টার অপারেশনে ভারতীয় সামরিক শক্তির দক্ষতা, ইন্দিরা গান্ধির শরীরে দেহরক্ষীদের গুলিবর্ষণ, শোকবিহ্বল সভাস্থলে ফুলমালায় সজ্জিত শবদেহটির পাশে বিমর্ষ অমিতাভ বচ্চনের নীরব উপস্থিতি এবং দূরদর্শনে অবিরত সরোদবাদনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শোক জ্ঞাপনের সেই প্রথম প্রয়াস। মূলত, সংবাদসূত্রেই আশঙ্কা এবং অনিশ্চয়তা ভরা সেই সময়টির সঙ্গে আমাদের পরোক্ষ পরিচয়। পরবর্তীকালে, কাশ্মির উপত্যকায় জঙ্গি আস্ফালন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয়তাকে ক্রমশ বাড়তে দেখেছি টেলিভিশনেই। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার জাফনায় প্রভাকরণের নেতৃত্বে হিংস্র টাইগার ইলামদের মোকাবিলায় পিস কিপিং ফোর্সের দাপট এবং তারপরে রাজীব গান্ধির ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের বীভৎস ছবিগুলি দেখবার অভিঘাতেই দূরদর্শনের একপেশে সংবাদ শোনা ও দেখার অনিবার্য বৃত্তটি থেকে ছিটকে বার হয়ে আসবার তাগিদ অনুভব করি। পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ঐ রেশগুলির সঙ্গে বোধবুদ্ধির সংঘাত শীর্ষে পৌঁছায় যখন করসেবকদের দেখি বাবরি মসজিদ ভাঙছে।
তারপর, কারফিউ-এর ঠান্ডা রাতগুলিতে নির্জন রাস্তা দিয়ে আনন্দ পটবর্ধনের ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রের ভিডিও ক্যাসেটটি সঙ্গে নিয়ে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আরেক বন্ধুর বাড়ি হেঁটে গিয়ে একসঙ্গে দেখতাম। ধর্মান্ধ মানুষের হিংস্রতা এবং স্বার্থান্ধ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই সব নির্জন সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে একটি ধারণা ক্রমশ পোক্ত হচ্ছিল। যে ইতিহাস পড়ে আমরা পরীক্ষায় নম্বর পেয়েছি, তা অতি সাবধানে কেটেছেঁটে তৈরি করেছে একের পর এক শাসক। সংবিধানে নাগরিকদের কিছু মৌলিক অধিকারের উল্লেখ আছে বটে। কিন্তু রাষ্ট্রের নির্মাণ যে ইতিহাস, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আশা, আকাঙ্খা, নৈরাশ্য, অনিশ্চয়তা, ভয় বা রাগকে নথিভুক্ত করবার কোনও দায় কারও নেই। শুনশান পিচ রাস্তায় পাশ দিয়ে চলে যাওয়া প্যারামিলিটারি ফোর্সের জওয়ানদের সমবেত বুটের নির্মম শব্দ, সাইরেনের তীক্ষ্ণতা শুনেছি। পরিচিত-স্বল্পপরিচিত-অপরিচিতদের চোখে জমে থাকা আতঙ্ক আর ঘৃণাও দেখেছি তখন। তাদের বিভ্রান্ত ঠোঁটগুলির ফাঁক দিয়ে মুক্তি পেয়ে গুজবেরা উড়ে নতুন কানগুলিতে পৌঁছে যখন মেরুকরণের প্রক্রিয়াটি তরান্বিত করছে, তখন স্বাধীন দেশের নাগরিক নিশ্চয়তায় একরাশ প্রশ্ন ভিড় করত বইকি।
প্রশ্নগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করে, বইপত্র ঘেঁটে, বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজের অবস্থানটি বুঝে নেওয়ার দীর্ঘ পর্বটি চলছিল। সেই সময়েই ‘মাচিস’ ছবিটি প্রথম দেখেছিলাম। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে। গুলজারের আগের কিছু ছবি টেলিভিশনে দেখেছি। তবে শুধু শ্বেতশুভ্র পোষাকেই নয়, অমলিন হাসি এবং স্বোপার্জিত মেধায় দীপ্ত মানুষটির প্রতি আমার যে একলব্যসুলভ সমর্পণ, তার কারণ ‘বাতে ফিল্মো কি’। সম্ভবত ১৯৮৮-৮৯ সালে নির্মিত দূরদর্শন এবং ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের যৌথ প্রয়াসে নির্মিত এবং বেঞ্জামিন গিলানির উপস্থাপনায় শিক্ষণীয় এই ধারাবাহিক (বিভিন্ন সার্চ ওয়ার্ড দিয়ে গুগল ঘেঁটে এর কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না)-টির দুটি পর্বে গুলজারসাহেব অতিথি শিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন। সময়কে নমনীয় এক উপাদান হিসেবে সিনেমায় ব্যবহার করবার জন্য ফ্ল্যাশব্যাক এবং অন্যান্য পদ্ধতিগুলিকে উনি নিজের বিভিন্ন ছবির দৃশ্যাবলীর সাহায্যে প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন দর্শকদের। ঘটনাক্রমে, দূরদর্শনে তারপরেই কোনও এক রবিবার সন্ধ্যায় ওনার ‘অচানক’ (১৯৭৩) ছবিটি দেখানো হয়। সদ্য শেখা মন নিয়ে ছবিটি দেখতে বসে ফিল্মমেকিং-এর প্রতি যে অমোঘ টান অনুভব করি, তা এতগুলি বছর পরেও শিথিল হয়নি।
যাই হোক, এহেন গুলজারসাহেবকে অধিকাংশ ভারতবাসী তাঁর রচিত অবিস্মরণীয় গানগুলির জন্যেই মনে রাখবেন। গীতিকার শৈলেন্দ্রর মতোই সহজ কিন্তু গভীর যার কথাগুলি শাহির লুধিয়ানভি, কৈফি আজমি, রাজেন্দ্রকৃষ্ণ এবং মজরুহ সুলতানপুরীর কালজয়ী রচনাগুলির মতোই ঋদ্ধ এবং মধুর কাব্যরসে সম্পৃক্ত। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত এক কবি যখন নিজের অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে ব্যবহার করেন, তখন সংলাপ, গান এবং অতীত ও বর্তমান কালের দৃশ্যাবলীর ‘অনায়াস’ চলনে সিনেমাই হয়ে ওঠে নিটোল এক কাব্য। হয়তো তাকে কাব্যের অতিরিক্ত কোনও নাম দেওয়াই সমীচীন। কারণ, সিনেমার দৃশ্যমালার সঙ্গে পরিশীলিত শব্দসমূহের মুর্চ্ছনা যুক্ত হয়ে যদি চরিত্র ও ঘটনাক্রমের আবেগকে দর্শকদের মনে সঞ্চারিত করে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে সিনেমা শুধুমাত্র দৃশ্য-শ্রাব্য এক মাধ্যমে সীমিত থাকে না। ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে তা তখন চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। যার প্রভাব অনন্য। আরেকভাবে বললে, কবিতার পাঠে যে দৃশ্যকল্পগুলি জন্মায়, তার মায়ায় পাঠক আবিষ্ট হয়। কিন্তু সিনেমার পর্দায় বহমান দৃশ্যমালা যে ছন্দময় চলনশীলতা (dynamics) সৃষ্টি করে, তার ব্যঞ্জনায় বাস্তব ও কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে উদ্দীপনা জাগায়। সেই হিসেবে সার্থক সিনেমার বর্ণনায় কাব্যগুণের অতিরিক্ত কোনও গতিময়তার ইঙ্গিতবাহী শব্দ প্রযুক্ত হলে আলোচনার ব্যাপ্তি বাড়ে। তবে কবিতার মতোই সিনেমার ক্ষেত্রেও একান্ত নিবিড় পাঠ আবশ্যিক। তাই এই অবধি এসে ব্যক্তিগত ভাবনার আধিক্যের জন্য মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে উল্লেখ থাক, সবাক ছবির প্রথম যুগে আমরা বরেণ্য কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বাঙলা ছবির চিত্রনাট্যরচনা এবং পরিচালনার কাজে পেয়েছি। হলিউড ও ব্রিটিশ ছবিকে বঙ্গীয়ত্ব প্রদানের যে রীতি তখন সুপ্রচলিত, আর্থিক কারণে প্রায় বাধ্য হয়েই তিনি তাতে শরিক হয়ে ‘কালো ছায়া’ (১৯৪৮), ‘কুয়াশা’ (১৯৪৯), ‘হানাবাড়ি’ (১৯৫২), ‘চুপি চুপি আসে’ (১৯৬০) প্রভৃতি ১৪টি ছবি বানিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শিল্পী ও কবি পূর্ণেন্দু পত্রীকে আমরা চিত্রপরিচালনার দায়িত্ব নিতে দেখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি গল্প— ‘স্ত্রীর পত্র’ (১৯৭২) এবং ‘মালঞ্চ’ (১৯৭৯)’র চিত্রায়ন ছাড়াও ‘স্বপ্ন নিয়ে’ (১৯৬৬), ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ (১৯৬৭), ‘ছেঁড়া তমসুক’ (১৯৭৪) সহ মোট ১১টি ছবি পরিচালনায় নিজের প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। ‘স্ত্রীর পত্র’ ছবিটি ১৯৭২ সালে রজত কমল পুরস্কারে সম্মানিত হয়। শোনা কথা, ছবিটির চিত্রনাট্য মাত্র দুদিনে সম্পূর্ণ করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের কাহিনীবিন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নিজের শিল্পীসত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে ছিলেন ছবিটিতে। অসামান্য আত্মবিশ্বাস এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে নারীর প্রতিবাদী রূপটি পর্দায় ফুটে উঠেছিল, মনে আছে।
উর্দু কবিতা ও প্রগতিবাদী সাহিত্যে একনিষ্ঠ মোটর গ্যারাজের রঙমিস্ত্রি সম্পুরণ সিং কালরা-কে অপ্রতিদ্বন্দ্বী গুলজার-এ পরিণত করবার নেপথ্যে চিত্রনির্মাতা বিমল রায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিষয়ে আমরা সবাই আজ কমবেশি জানি। প্রথমে গীতিকার, তারপর সহকারী পরিচালক এবং পরবর্তীকালে চিত্রনাট্যকার রূপে পরিণত হবার পর গুলজার প্রথম চিত্রপরিচালনায় এলেন ‘মেরে আপনে’ (১৯৭১) ছবিটির মাধ্যমে। তপন সিংহের ‘আপনজন’ (১৯৬৮) অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটিতে গুলজারের যে রাগী সত্তাটিকে দর্শকরা দেখল, প্রায় ২৫ বছর পর তার পুনঃপ্রকাশ ঘটে ‘মাচিস’ (১৯৯৬)-এ। মাঝখানের দীর্ঘ সময়টিতে তিনি মানবসম্পর্কের বিভিন্ন জটিলতাকে কাব্যিক মাত্রা প্রদান করে একের পর এক ছবি বানিয়েছেন। গভীর স্নিগ্ধতায় ভরা সেই ছবিগুলিতে অবগাহন করে দর্শকসমাজ উষ্ণ আন্তরিকতার উৎকর্ষ অনুভব করেছে। নিজের এবং অন্যের ছবির জন্য বহু স্মরণীয় গান রচনার সাবলীলতায় তিনি দর্শক ও শ্রোতাবৃন্দের অধিকাংশকে সিনেমার সাহিত্যগত গুণ বিষয়ে অবগত করেছেন নিরন্তর। কিন্তু প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র যে রক্তস্নাত হয়ে তাঁর কাছে পৌঁছাচ্ছে, তার যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন কী করে? একটি কবিতায় নিজের এই টানাপোড়েনকে মেলে ধরেছেন উনি:
ছায়ায় ছায়ায় চলছিলাম আমি নিজের শরীর বাঁচিয়ে
ভাবছিলাম আমার অন্তরকে সুন্দর এক অবয়ব দিই।
কোনও ফাটল থাকবে না তাতে, দাগও না
রোদে ঝলসাবে না, আহত হবে না,
ক্ষত স্পর্শ করবে না তাকে, ব্যাথাও পাবে না সে।
কিশোরীর এক সতেজ দেহ পরিয়ে দেব শুধু আপন অন্তরকে।
কিন্তু দুপুরের ব্যথার তাপে যন্ত্রণার রোদ মাথায় চলতে চলতে
আমার অন্তর রূপ পেল ছায়ার।ব্যথা আর শান্তির মধ্যে অদ্ভুত এক বোঝাপড়া আছে।
ছায়া যদি কোথাও পাও, তাহলে তা রোদেই পাবে।
(লেখক কৃত অনুবাদ)
ব্যথা আর শান্তির এই বোঝাপড়ার উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ তাঁর ‘মাচিস’ ছবিটি। যার প্রথম দৃশ্য থেকেই যে ক্রুদ্ধ, ব্যথার্ত গুলজারের উপস্থিতি আমরা অনুভব করি, তাঁর সঙ্গে আমাদের আগে পরিচয় হয়নি। পুলিশ কাস্টডিতে পালি ওরফে কৃপাল সিং (চন্দ্রচূড় সিং)-এর মৃত্যু হয়েছে। তার রক্তাক্ত শরীরটাকে একটি কুয়োর ভিতর থেকে টেনে তোলা হচ্ছে। গলায় বাঁধা দড়িটির সাহায্যে পুলিশবাহিনী আত্মহত্যা হিসেবে ঘটনাটিকে প্রমাণ করতে তৎপর। তবুও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ইন্সপেক্টর ভোহরা (কাঁওয়ালজিৎ সিং) ঘুমচোখে তদন্তের আশ্বাস দেয়। আন্তরিকতাহীন শুষ্ক সে আশ্বাস যে মিথ্যা, তা প্রমাণ করবার জন্যই গুলজার ফ্ল্যাশব্যাকের আশ্রয় নেন। চার তরুণ বরফ ঢাকা উপত্যকায় হাঁটতে হাঁটতে গাইছে, “ছোড় আয়ে হম উয়ো গঁলিয়া…”
গানকে যখন সিনেমার কাহিনীর বুননে নক্সা ফোটানোর কাজে প্রয়োগ করা হয়, তখন তার আবেদন নিছক আর গানে সীমিত থাকেনা। কাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই সে তখন প্রবাহমান। আমরা জানতে পারি এই যুবকেরা একটি হাইডআউট ছেড়ে আরেকটির দিকে রওনা দিয়েছে। যাত্রাপথের এই গানটির কথাতেই তৎকালীন অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটির মাঝে ‘মাচিস’কে প্রতিষ্ঠিত করেন গুলজার।
দিল দর্দ কা টুকরা হ্যাঁয়
পাত্থর কা দালি সি হ্যাঁয়
এক অন্ধা কুঁয়া হ্যাঁয় ইয়া
এক বন্ধ গলি সি হ্যাঁয়(যন্ত্রণায় দীর্ণ এক টুকরো এই হৃদয়/সাজানো পাথুরে মিষ্টির ডেলা/কালো এক কুয়ো বা/ অন্ধ এক গলির মতো)
মনের গভীরে হাহাকারের মতো আছড়ে পড়া কথাগুলির প্রভাব আজও অনুভব করি। একই সাথে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে এও বলি যে অস্থিরতা এবং অসহায় ক্রোধ নিয়ে তখন আমরা বেঁচে ছিলাম, সেই দগ্ধতায় গুলজারের কথাগুলি প্রলেপ লাগায়। যেন অভিভাবকসম কেউ পাশে বসে সহমর্মী হদয়ে বলছে, বাছা যে কষ্টে তুমি আজ কাতর, দীর্ঘ সময় ধরে তা আমি মুখে হাসি নিয়ে বহন করে চলেছি। বস্তুত, চার তরুণ কৃপাল সিং, জারমেন, কুলদীপ এবং ওয়াজির-এর ভূমিকায় যে উদ্দেশ্য নিয়ে নবাগত অভিনেতাদের (যথাক্রমে চন্দ্রচুড় সিং, জিমি শেরগিল, রবি গোঁসাই এবং সুনীল সিনহা) চয়ন করেন গুলজার, তা যথার্থ। কারণ, তাঁদের চোখেমুখে ও শারীরিক আচরণে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকদের মানসিক সংকট ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে সেই সময়ের অধিকাংশ তরুণ দর্শকের একাত্ম হতে বিশেষ অসুবিধা হয় না।
হিমাচলের বরফ ঢাকা সেই যাত্রাপথে টুকরো টুকরো সংলাপ, গান এবং ফ্ল্যাশব্যাকের মধ্যে দিয়ে আমরা ক্রমশ জানতে পারি সেই চরম পরিস্থিতিগুলি যা এই তরুণদের বিপজ্জনক এক জীবন বেছে নিতে বাধ্য করেছে। যাত্রাপথের শেষে সীমান্তের অন্যদিক থেকে সদ্য এসে পৌঁছানো এক জঙ্গিদলের সঙ্গে মেলে এই চার যুবক। নতুন জঙ্গিদলে রকেট লঞ্চার চালনায় প্রশিক্ষিত উগ্রপন্থী নিজের চেহারা উন্মুক্ত করতেই কৃপাল চমকে যায়। তার বাগদত্তা বীরাঁ (টাব্বু)-কে এই রূপে দেখাটা তার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বিস্ময়ের এই মুহূর্তটি অতিক্রান্ত হতেই একাকিনী বীরাঁর যন্ত্রণাদগ্ধ বিবরণে আসন্ন ট্র্যাজেডির আন্দাজ পাই আমরা।
অতীত হোক বা বর্তমান— একের পর এক দৃশ্যে গুলজার স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলেন একটি মর্মান্তিক সত্য। রাষ্ট্রশক্তির চোখে সন্দেহভাজন নাগরিকরা শত্রু ছাড়া আর কিছু নয়। এবং তেমন মানসিকতা নিয়েই সেই নাগরিকদের এমনভাবে কোণঠাসা করা হয়ে থাকে যে ক্রমশ ধ্বংসের একমুখী পথে তাঁদের জীবন চালিত হবে। তরুণ প্রজন্মের সারল্য অবসানে আর তাদের অশান্ত মনে চরমপন্থী বীজ বপনে রাষ্ট্রের ভূমিকাটি যে নেহাৎ তুচ্ছ নয়, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ‘মাচিস’-এ প্রকাশিত।
ক্রোধ এবং বিষাদ— দুই বিপরীতমুখী প্রবণতার মিশ্র যে প্রেক্ষাপটে গুলজার ‘মাচিস’ নির্মাণ করেন, তাতে এক অবিরত জিজ্ঞাসু মনের পরিচয় পাই আমরা। নিজের আবেগ ও যুক্তিবোধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতার মিশেল ঘটিয়ে যে ‘মাচিস’কে তিনি জনসমক্ষে আনেন, তাতে ক্রোধের বিস্ফোরণ নেই, আছে যত্রতত্র আত্মধ্বংসী আগুন জ্বলে ওঠবার সম্ভাবনাগুলিকে নিভিয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছা। বাহবা কুড়নো দেশপ্রেমের কথা উচ্চকিত কণ্ঠে বলবার চেয়ে তিনি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবসমাজে উগ্রপন্থার বিপজ্জনক প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ার বিপদটি সম্পর্কে অবগত করানোর কাজটাকেই এখানে শ্রেয় মনে করেছেন। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি ‘মাচিস’-এ উগ্রপন্থীর ডেরাগুলিকে পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর চোখ দিয়ে নয়, মানবচরিত্র বিষয় অনুসন্ধিৎসু এক বিচক্ষণ শিল্পীর মতোই নিরীক্ষণের দ্বারা রচনা করেছেন অনন্য কিছু মুহূর্ত। সেই চোখ দিয়েই আমরা পালিকে দেখি, যে বন্ধু জাসসির শরীরে ক্ষত দেখে বিচলিত হয়ে নিজের জীবনকে সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে চালিত করবার ঝুঁকি নেয়। দীর্ঘ সময় একাকিত্বের যন্ত্রণা এবং রাষ্ট্রশক্তির পেষণ ভোগ করে প্রেমিকের বেছে নেওয়া পথটিতেই মরিয়া হয়ে পাড়ি দেওয়া বীরাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুও আমরা প্রত্যক্ষ করি সেই চোখ দিয়েই।
আজকের এই মেরুকৃত ভারতে ‘মাচিস’ তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। এবং তার নতুন এক ভাষ্য রচনাও এখন জরুরি। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা এবং অসহিষ্ণুতার পরিচয় আমরা রোজদিনই পেয়ে চলেছি, তাতে এমন প্রয়াসে আগ্রহী হওয়ার তুলনায় তার পরিণাম নিয়ে চিন্তিত শিল্পীর সংখ্যাই বেশি। সেই কারণে হাস্যমুখর আবহাওয়া সৃষ্টি করে তার আড়ালে প্রয়োজনীয় বার্তাটি শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপনের প্রতিই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অথবা মেঘনা গুলজারের ‘রাজ্জি’র মতো রোমাঞ্চকর এক জীবনীচিত্রের মাধ্যমে নারীশক্তি উত্থানের প্রেরণা তথা দেশভক্তির সূক্ষ্ম প্রচার ও প্রসারে। অথবা নন্দিতা দাশের ‘মান্টো’র মতো প্রয়াসে যা বিষয়নিষ্ঠ হওয়ার চেয়ে ইতিহাসনিষ্ঠ প্রমাণে বেশি আগ্রহী। বর্তমানের বিভাজনমূলক রাজনীতি এবং সামাজিক পরিস্থিতির কারণে যে মানসিক সঙ্কীর্ণতায় সাধারণ মানুষ আজ পীড়িত, সেই আবহাওয়া ট্র্যাজেডির অনুকূল মহিমা এবং ব্যাপ্তি প্রদানে সমর্থ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। হয়তো সেই কারণেই তা রচনার প্রতি আগ্রহ বিশেষ নেই। থাকলেও তাতে জল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে, “কে কী মনে করবে। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আবেগকে আহত করবার অভিযোগে ছবিটা আটকে গেলেই সর্বনাশ।” অসুরক্ষিত এই সর্বগ্রাসী মানসিকতার উত্তরণ এখন পরম কাঙ্খিত। কারণ, যে বুদবুদের মধ্যে বসে আমরা নির্দোষ পরিদর্শকের ভান করছি, অসহিষ্ণুতার দেশলাইয়ের ছোঁয়ায় তা যে কোনও সময়েই ফেটে যেতে পারে।