সাদিয়া সুলতানা
শর্মিলা যখন এই বাসার দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় তখন ওর শাঁখা-পলার টুংটাং শব্দে শাহানা বেগমের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে। বরাবরের মতো আজও তার কপালের সেই কুঞ্চন উচ্ছ্বসিত শর্মিলার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। শর্মিলার সিঁথিতে সিঁদুরের টান বেশ চওড়া। ইদানিং খুব কম মেয়েই মাথায় এমন চওড়া করে সিঁদুর দেয়। শর্মিলা এভাবে সিঁদুর পরতে ভালোবাসে। ওর চলাফেরায়, পোশাক-পরিচ্ছদে বেশ নির্মল ভাব আছে। বিশেষ করে ওর স্নানসিক্ত মুখটি সহজেই সবার মায়া কাড়ে। সকালে স্নান করে ও পূজা পর্ব সারে। তারপর সংসারের কাজকর্ম শেষ হলে খুটখাট করে এটাসেটা শৌখিন কিছু করতেই থাকে। আজও যেমন ও একা হাতে নারকেলের নাড়ু তৈরি করেছে।
শর্মিলা হাতের বাটিটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখে। ওর হাতের মোটা শাঁখা-পলা একটা আরেকটার সাথে লেগে টুংটাং আওয়াজ হয়। শাহানা বেগম হাতে থাকা তছবিতে চুমু খেতে খেতে শর্মিলার দিকে তাকান।
–আবার কী আনছ? গতকাল রাতেই না সাজনা তরকারি দিয়া গেলা।
শর্মিলার ফর্সা গোলমুখ খুশিতে চকচক করে। ও মনের উচ্ছ্বাস গোপন রাখতে পারে না।
–দুই রকম নাড়ু বানিয়েছি কাকিমা। চিনির পাকের আছে, গুড়ের পাকেরও আছে। গুড়ের পাকেরটা একটু বেশি কড়া। সেইবার তামিম গুড়েরটা পছন্দ করেছিল আর তনু চিনিরটা। দুই ভাইবোন তো স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরলেই ওদের দিবেন কাকিমা।
–হ, এগুলা পাইলে তো আর রক্ষা নাই, দুপুরে ভাতই খাইতে চাইব না।
–একটা-দুটা খেলে কিছু হবে না কাকিমা। একবারে বেশি খাওয়া যাবে না। ওদের জন্য কয়েকটা বাইরে রেখে বাকিগুলো হাওয়ায় জুড়িয়ে নিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখতে পারেন। অবশ্য বেশ কদিন ফ্রিজের বাইরেও রাখা যাবে।
–এতগুলা আনছ কেন মা? তোমার যত কাণ্ড!
শাহানা বেগমের গলায় অস্বস্তি। উল্টোদিকে শর্মিলার চোখেমুখে বিপুল উৎসাহ ঝরে পড়ে।
–অনেক কই কাকিমা! আমার বড়দির ছানাপোনাদের জন্য অনেকগুলো নাড়ু আলাদা করে রাখলাম, তাই তো এই বাড়ির ঘুঘু দুইটার জন্য কম পড়ল। পরেরবার বানালে বেশি করে দিব। এবার বাটিটা খালি করে দেন তো কাকিমা। আমি বিদায় হই।
–ও বাটি থাক। খালি বাটি দিছি শুনলে বউমা ফিরা রাগ করব। সেদিন তুমি কাঁচা কাঁঠালের তরকারি দিয়া খালি বাটি নিছ দেইখা আমার উপর সে রাগ হইছে। আমি বলছি, ঘরে কি বাটির অভাব? কিছু দিলে ঘরের একটা বাটিতে দিলেই তো হয়!
–ঠিক বলেছেন কাকিমা। আজ বাটিটা দিয়ে দেন। নতুবা বাটি ফেরত দিতে গিয়ে নীনাদি আবার ঝামেলা করবে।
–ও আর নতুন কী, প্রত্যেকদিনই তো দুইজনে নানান ঝামেলা করতেছ। কেউ কাউরে খালি বাটি ফেরত দিবা না— তা নিয়া তো দুইজনে প্রতিযোগিতা করো।
শাহানা বেগমের কণ্ঠের বিরক্তি টের পেয়ে শর্মিলা শব্দ করে হাসে।
–তেমন কোনও ঝামেলা না কাকিমা। নীনাদি আমাকে খুব ভালোবাসে আর ঘুঘু দুইটাকে না দিয়ে ভালো জিনিস আমার জিভে রোচে না। এই যে নাড়ু, মোয়া, আচার ওদের রেখে এসব খাই কী করে বলুন তো। আর চন্দন বাইরে গেলে ঘরে একলা আমার সময় কাটে না। তাই সারাদিনই এটাসেটা করি, আমার কাজ করতে ভালো লাগে।
–সে তোমাদের বয়স আছে, করবা মা। আমি আর পারি না। আগে করছি, এখন শরীরে কুলায় না। তার উপর নাতি-নাতনি পাহারা দিতে গিয়া তোমার কাকা আর আমার তো বাড়িতে যাওয়া বন্ধ, নারকেল গাছ ঝাড়তে পারি না। চোরের দল সব সাফা কইরা দেয়।
–আপনাদের বাড়িতে তো অনেক নারকেল গাছ আছে কাকিমা। নীনাদি বলেছে। আহা! আর আমি বাজার থেকে কিনে আনাই। কী দাম! এবার পূজার আগে বলে দেড়শো টাকা জোড়া নিল।
শর্মিলার কথা শুনে শাহানা বেগমের চোখ-মুখ ঝলমল করে ওঠে। ওর সাথে ফেলে আসা ভিটেবাড়ি, কলপাড়, পুকুর, জমিজিরাতের গল্প করতে করতে তার সময়জ্ঞান থাকে না। রান্না বসাতে দেরি হয়ে যায়। শর্মিলা বরাবরই বেশ মনোযোগী শ্রোতা। সে জানে কোথায় থামতে হয়, কখন বলতে দিতে হয়, কখন প্রশ্ন করতে হয়। শাহানা বেগম সারাদিনে কথা বলার তেমন সঙ্গী পান না বলে কেউ একটু প্রশ্রয় দিলে তার মনের ভেতরে কথার ঢেউ জাগে। তখন তিনি তার সাথে মন উজাড় করে গল্প করেন। এই এখন যেমন নিজের অজান্তে তার কপালের ভাঁজ প্রসারিত হয়ে গেছে, সব দ্বিধা ভুলে তিনি শর্মিলার সাথে গল্পে মেতেছেন।
শর্মিলা তাদের প্রতিবেশী। ছয় মাস হলো নীনার পরিবার এই পাঁচতলা বাড়ির তিনতলার পূর্ব পাশের ফ্লাটটিতে উঠেছে। নীনার বদলির চাকরি, ও বিসিএস কর্মকর্তা। এ জেলা থেকে সে জেলায় ঘোরে। ও সম্প্রতি সিরাজগঞ্জে বদলি হয়ে এসেছে। নীনার স্বামী কায়েস ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। কায়েসের বাবা ফরিদুল ইসলাম আর মা শাহানা বেগম নীনার সাথে থাকে। ওদের পাশের বাসার শর্মিলা-চন্দন দম্পতি এই বাড়ির পুরনো ভাড়াটিয়া। ওরা প্রায় সাত বছর ধরে এই বাড়িতে আছে। চন্দন ব্যবসায়ী। সিরাজগঞ্জ শহরের সমবায় মার্কেটে তার দুটো কাপড়ের দোকান আছে।
অল্প সময়ের মধ্যে পাশাপাশি বাস করা এই দুটি পরিবারের মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে। যদিও শাহানা বেগম এখনো মন খুলে শর্মিলার সাথে মিশতে পারেন না। প্রথমদিন বাড়িতে উঠেই তিনি ছেলে আর বৌমার কাছে আফসোস করেছিলেন।
–হিন্দুর পাশে বাসা ভাড়া নিলা, দরজা খুললেই পূজা পূজা গন্ধ লাগব।
কায়েস মায়ের কথা শুনে মুচকি হেসে কৃত্রিম আতঙ্কের ভঙ্গি করেছিল।
–আস্তে বলো মা। কেউ শুনলে সর্বনাশ। কে কোথা থেকে শুনে ফেলবে আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দিবে।
নীনা চমকে উঠে স্বামী আর শাশুড়ির দিকে তাকিয়েছিল।
–পূজা পূজা গন্ধ কি খারাপ মা? ওদের ভক্তি ওদের কাছে। আর প্লিজ তোমরা এসব কথা বাচ্চাদের সামনে বোলো না। ওরা ভুল বুঝবে, ভুল শিখবে। আমাদের পরিবারে এসব মানায় না।
নীনার ব্যক্তিত্বের সামনে সেদিন মা-ছেলে নিশ্চুপ হয়ে গেলেও শাহানা বেগমের অস্বস্তি দিনদিন বেড়েই চলেছে। বাসায় ওঠার দিন সাতেকের মধ্যে তিনি নীনার কাছে নাতির নামে নালিশ করেছেন।
–হিন্দু বাড়ির সাথে ভাব করো… দেখো গিয়া তোমার পোলা কী শিখছে… আমি আছরের নামাজ পইড়া সালাম ফিরাইয়া দেখি তামিম ভাইয়া রান্নাঘর থেইকা পিঁড়ি আইনা পূজার আসন সাজাইছে। বারান্দার টবের গাছের ফুল-পাতা ছিঁড়া আইনা পুতুল দিয়া পিঁড়ি সাজায় রাখছে। আমি কই, কী করো দাদু? আমারে কয়, শর্মিলা আন্টির মতো পূজা করি। আসতাগফিরুল্লাহ! কে কইব এইটা হাজী সাবের নাতি!
শাশুড়ির উদ্বেগ দেখে নীনা ছেলেকে নিজের ঘরে নিয়ে আদরে আদরে বুঝিয়েছিল। কেন শর্মিলা আন্টি পূজা করে, কেন দাদা-দাদি-মা-বাবা নামাজ পড়ে। মায়ের কথা শুনে পাঁচ বছরের তামিম বুঝদারের মতো মাথা নেড়েছে আর রাজ্যের প্রশ্ন করেছে। ‘মা, হিন্দুরা সিঁদুর পরে কেন? তুমি পরো না কেন? ঠাকুর কী? ভগবান কে? গোসল করা, চান করা কি এক? শর্মিলা আন্টি পানিকে জল বলে কেন?’ ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া তনু খিলখিল করে হেসেছে। আর পাশের ঘরে কান পেতে বসে শাহানা বেগম নিজের বিরক্তি গোপন করেছেন। তারপর যেই সেই। দু দিন পর শাহানা বেগম আবার বাড়ি মাথায় তুলেছিলেন।
–আমারে স্কুল থেইকা আইসা কয়, দাদি আমার গলা শুকায়ে গেছে, জল দেন।
–তাই কী মা! জল আর পানি তো একই।
–এক না আলাদা, তুমি আমারে শিখাইবা?
শাশুড়ি-বৌমার শীতল কথোপকথনের মাঝখানে তামিম মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
–আমি জানি একই। আমার বন্ধু শ্যামলও বলেছে। যেদিন দাদি ওয়াটার পট দিতে ভুলে যায় সেদিন আমি ক্লাসে শ্যামলের কাছ থেকে জল খাই। জল খেয়ে দেখেছি, পানি আর জল একই।
কদিন পর পরই এমন কিছু না কিছু ঘটছে। নীনা কয়েকবার শর্মিলার সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। দিন দিন শাহানা বেগম বেশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন। শর্মিলাকে আজকাল তিনি একেবারে পছন্দই করেন না। বলেন, ‘মহিলার বাচ্চাকাচ্চা নাই, পরের বাচ্চা নিয়া এত ন্যাকামি কীসের। পড়া নাই। লেখা নাই। ফাঁক পাইলেই পোলাপান দুইটারে ডাকে।’ খুব ভোরে শর্মিলা হারমোনিয়াম নিয়ে গান করতে বসে বলেও তিনি ভীষণ বিরক্ত, ‘ফজরের ওয়াক্ত যাইতে দেরি নাই, গানা-বাজনা শুরু হইয়া যায়।’ দুএকদিন তিনি আকারে ইঙ্গিতে নিজের বিরক্তির কথা শর্মিলাকে জানিয়েছেন। বুদ্ধিমান শর্মিলা এখন দরজা-জানালা ভালো করে সেঁটে গান গায়। তবু সেই সুরধ্বনি বাতাসে দুলে দুলে শাহানা বেগমের কানের কাছে গুনগুন করে, ‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি, দেখো সোনালি আকাশ, বহে ভোরের বাতাস।’
সপ্তাহান্তে ছেলে বাড়িতে এলে শাহানা বেগম ছেলের কাছে চাপাস্বরে ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া সূক্ষ্ম সব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তার অবস্থা দেখে মনে হয় প্রতিবেশী পরিবারটি তার নাতি-নাতনিকে ধর্মান্তরিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আজ সকালে অফিসে যাবার আগেও নীনা শাশুড়িকে খানিকক্ষণ বুঝিয়েছে।
–আম্মা, শর্মিলাদি আর চন্দনদা খুব ভালোমানুষ। আপনি আমাদের চেয়ে তা ভালো বোঝেন। আমাদের বিপদে-আপদে ওরা দৌড়ে আসে। সেদিন রাতে আপনার বুকে ব্যথা উঠল। কী বিপদ আমাদের, বাসায় আপনার ছেলেও নাই। চন্দন দাদা না থাকলে আমি আপনাকে একা কীভাবে হাসপাতালে নিতাম বলেন তো। আর বিয়ের এত বছর পরেও তাদের কোনও বাচ্চা-কাচ্চা নেই। কত অসহায় তারা। তামিম, তনুকে তাই খুব ভালোবাসে।
নীনার কথা শুনে সেই রাতের কথা মনে করে শাহানা বেগম চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে যখন চন্দন আর নীনা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তখন তার কোনও জ্ঞান ছিল না। পরে তিনি নীনার কাছ থেকে সব শুনেছেন। সেই রাতে নীনা হাসপাতালে থাকায় তামিম আর তনু শর্মিলাদের বাড়িতে ছিল।
বৌমার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে শাহানা বেগম বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন ভেবে কিঞ্চিৎ লজ্জিতও হয়েছেন।
–তা তো অস্বীকার করি না বৌমা। খালি একটু দূরত্ব রাইখা মিশলেই হয়। বাচ্চারা কী শিক্ষা পাইতাছে দেখতেছ না?
–ওরা দুজন ছোট মানুষ আম্মা। তাই আমাদের মতো পার্থক্য করতে পারে না। একদিন ওরা নিজেরাই বুঝে যাবে।
নীনা বেরিয়ে যেতেই শাহানা বেগম আপনমনে বিড়বিড় করেছেন, ‘আমিও কম বুঝি না বৌমা। তোমার মতো এম.এ. পাশ না কইরাও আমি সব বুঝি। আমি বাড়িতেই চইলা যামু। চোখের সামনে এইসব দেখতে ভালা লাগে না।’
এসব নিয়ে বউ-শাশুড়ির মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ টানাপোড়েন চললেও ছেলের সংসার ফেলে শাহানা বেগম নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেন না। আর কায়েসের বাবা এসবে ভ্রূক্ষেপ করেন না। ফরিদুল ইসলাম বৃদ্ধ মানুষ। তিনি একমাত্র সন্তানের বাড়ি থেকে কিছুতেই যেতে চান না। গ্রামে নিজের বাড়িতে একা থাকতে তিনি অনিশ্চয়তায় ভোগেন। আবার ছেলের সংসার দুই জায়গায় বিচ্ছিন্ন আছে দেখে তিনি মানসিক প্রশান্তিও পান না। ছেলে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ আসে। বাবা-মায়ের ভরসায় সে স্ত্রী-সন্তানদের এখানে রেখে যায়। এই দায়িত্ব ফরিদুল ইসলাম এড়াতে পারেন না। তাছাড়া বউমা, নাতি-নাতনি দুটি তার প্রাণ। এদের সুখ দেখে তিনি এই বয়সে স্বস্তিতে থাকেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া ছাড়া তার বিশেষ কোনও কাজ থাকে না বলে দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি টিভি দেখেন, পত্রিকা পড়েন আর নাতি-নাতনির সাথে খুনসুটি করে কাটান।
তনু আর তামিম আসার পর থেকে নিঃসন্তান শর্মিলারও ভালো সময় কাটে। আজ স্কুল থেকে ফিরে দুই ভাইবোন দুহাতে দুখানা করে নাড়ু নিয়ে দাদির নিষেধ সত্ত্বেও শর্মিলাদের বাসায় চলে এসেছে। শর্মিলা দুজনকে সোফায় বসিয়ে আলমারি খুলে একটা ছোট জড়িপাড় ধুতি বের করেছে। তামিমের তা দেখে প্রশ্নের শেষ নেই। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে শর্মিলা বলে–
–আজ তোকে কৃষ্ণ ঠাকুর সাজাব। এই দ্যাখ বাঁশি, ধুতি।
–আন্টি কিষ্ণ কে?
শর্মিলা আঙুল তুলে দেয়ালে থাকা কৃষ্ণের ছবি দেখায়। সে ছবিতে ঘন নীল বর্ণের কৃষ্ণ ঈষৎ বঙ্কিম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণের পরনে হলুদ রেশমি ধুতি আর মাথায় ময়ূরপুচ্ছশোভিত মুকুট। তাই দেখে তামিম ঠোঁট উল্টায়।
–এ্যা মা, আমি তো অমন কালো না।
তামিমের কথা শুনে শর্মিলা আর তনু হাসিতে ভেঙে পড়ে। মিনিট দশেক পরে কৃষ্ণ ঠাকুরটির মতো ধুতি পরে তামিম শর্মিলার ঘরে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে হাঁটে আর ঠোঁটে ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজানোর চেষ্টা করে। তাই দেখে শর্মিলা আর তনু হেসে কুটিকুটি হয়।
–তোকে যা লাগছে না! একেবারে কানাই।
ওদের দুজনের কৌতুকময় হাসির প্রতিক্রিয়ায় তামিম প্যান্টের ওপর পরে থাকা ধুতি একটানে খুলে ফেলে। ‘ধুত্তোরি! নাও, তোমার কৃষ্ণ ঠাকুরের লুঙ্গি নাও’ বলে দৌড়ে বাসায় চলে যায়। ভাইকে ক্ষেপাতে ক্ষেপাতে পিছু পিছু তনুও ছোটে। তাই দেখে হাসতে হাসতে শর্মিলার চোখে জল এসে যায়।
দিন পনেরো পরের কথা। নীনা অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢোকেনি। বার বার আসছি বলেও শর্মিলাদের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। দুজনের সেই গল্পে কোনও যতিচিহ্ন নেই। শর্মিলাদের বসার ঘরের পশ্চিম পাশের জানালার ধারের জলপাইগাছের পাতার আড়ালে দুইটি অচেনা পাখিও সেই তখন থেকে ওদের মতো কিচিরমিচির করেই চলেছে। বিরক্ত হয়ে শাহানা বেগম বাইরে এসে নীনাকে একবার ডেকে গেলেও ‘আম্মা আসছি’ বলে নীনা এখনও ঘরে ঢোকেনি। আগামীকাল অফিস ছুটি। তাই এখন বাসায় ঢুকে সাততাড়াতাড়ি কাজ সেরে ওর বাচ্চাদের পড়াতে বসানোর ঝামেলা নেই।
–ও বউমা, ঘরে আসো। একটু পর তোমার মামাশ্বশুর আইসা পড়ব। ফোন করছিল, গাড়ি মির্জাপুর পার হইছে। ভাইটা হজ কইরা ফিরা আমার সাথে দেখা করতে আসতাছে। তুমি আর কত প্যাঁচাল পাড়বা? ঘরে ঢোকো।
নীনা দাঁতে জিভ কেটে নিজেকে ভর্ৎসনা করতে করতে শর্মিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ঢোকে। দরজার ছিটকানি তুলে পিছু তাকাতেই ও শাশুড়ির থমথমে মুখ দেখতে পায়। কোনও কথা না বলে কাপড়চোপড় পাল্টে নীনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরের কাজে হাত লাগায়। ও জানে এখন আম্মার সাথে কোনও কথা বলা যাবে না। নীনা শো-কেস থেকে কাঁচের গ্লাস-প্লেট নামিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখে। টেবিলে বেশ কয়েক পদের রান্না করা তরকারি রাখা। রান্নাবান্না এখন বেশিরভাগ দিন শাহানা বেগমই করেন। তিনি একটু শুচিবাইগ্রস্ত মানুষ। রোজ নিজের হাতে বাটনা বেটে রান্না করা তার অভ্যাস। শুধু গরু বা খাসির মাংস রান্না করতে হলে তিনি ছেলের বউকে ডাকেন। বাচ্চারা মায়ের হাতে রান্না মাংস খেতে পছন্দ করে। এসব বিষয় শাহানা বেগম ঠিকই খেয়াল করেন। বউমা যেমন অনেক বিষয়ে তাকে ছাড় দেয়, তিনিও দেন।
গরুর মাংস কষিয়ে নীনা শাহানা বেগমের কাছে আসে।
–আম্মা মামা কেমন ঝাল খান?
শাহানা বেগম বেশিক্ষণ গুমোট হয়ে থাকতে পারেন না। বউমার প্রশ্ন শুনে তিনি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেন।
–আমার ভাই গ্রামের মানুষ, মুখপোড়া ঝাল খায়। গরুর মাংস রান্নার পর সরিষার তেলে শুকনা মরিচের বাগাড় দিলে খুব পছন্দ করে।
–তাহলে তাই করি আম্মা।
–না থাক। পোলাপান বেশি ঝাল খাইতে পারব না। এই সপ্তাহে তো একদিনও তুমি মাংস রাঁধো নাই। তনু বু লাফাইতাছে কখন পোলাও-মাংস খাইব। তুমি ঝাল মাপমতোই দাও।
বউমার সাথে কথা সেরে শাহানা বেগম নাতনির মাথায় তেল দিতে বসেন। হাতের তালুতে তেল নিয়ে কায়দা করে চুলে তেল ঘষতে ঘষতে তিনি নাতনিকে কপট রাগে ধমক দেন।
–সারাদিন খালি টইটই। তেল না দিয়া চুলরে ঘাসের মতো বানাইছে।
–দাদি, ঘাসে কি তেল দেয়?
দাদিকে বেকায়দায় ফেলে তনু ফিকফিকিয়ে হাসে। বোনের সাথে ভাই আর দাদাও এসে যোগ দেয়। এদের অকৃত্রিম আনন্দ দেখে শাহানা বেগমও হাসেন।
একদিন পরে। সকালে এই বাড়ির মেহমান বিদায় নিয়েছে। শাহানা বেগম আছরের নামাজ সেরে বারান্দা থেকে স্বামীর শুকনো কাপড় তুলে সেগুলো ভাঁজ করছেন। সকালে ছুটা বুয়া এসে ঘর ঝাড়ু-মোছা, কাপড় ধোয়া এসব ভারি কাজ করে গেলেও শাহানা বেগম সারাদিনই ঘরের টুকটাক কাজে হাত লাগান। বিশেষ করে নিজেদের ঘরের বিছানা, কাপড়চোপড় তিনিই গুছিয়ে রাখেন।
একটু আগে শর্মিলা এসেছে। যথারীতি ওর হাতে একটা ছোট বাটি।
–চালতার আচার কাকিমা। মাত্রই নামালাম চুলা থেকে।
শাহানা বেগমের কপালে আবার সেই ভাঁজ পড়ে।
–তুমি কষ্টও করো মাইয়া। কী দরকার বারবার এটাসেটা দেওয়ার।
শর্মিলার মুখ আগুনের আঁচ পেয়ে লাল হয়ে আছে। কপালের ঘাম আঁচলে মুছে ও লাজুক ভঙ্গিতে হাসে।
–কষ্ট না কাকিমা। দুদিন জ্বর ছিল। তেমন কিছু করা হয়নি।
–এখন শরীর কেমন?
–ভালো কাকিমা। আসলে আমি অসময়ে এলাম। একটা জিনিস চাইতে এসেছি কাকিমা।
–কী?
শর্মিলা খানিক ইতস্তত করে। ওকে দেখে মনে হয় কীসে যেন সংকোচ হচ্ছে ওর।
–নীনা দিদি কি ঘুমায় কাকিমা?
–হুম।
বাড়িঘর সুনসান। ছুটির দিনে নীনা ছেলেকে নিয়ে ভাতঘুম দিচ্ছে। তনু পড়ার ঘরে আপনমনে ছবি আঁকছে। শর্মিলার কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে ও একবার উঠে এসেছিল। আচারের বাটি দেখে খুশিতে অনেকটা আচার প্লেটে তুলে নিয়ে ও চলে গেছে। শর্মিলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ও এখনও বলেনি, ও কী চাইতে এসেছে। শাহানা বেগম প্রথমে কৌতূহল বোধ করেননি। ভেবেছেন— এ আর এমন কী, এ বাড়ি ও বাড়ি রোজ নেওয়া-দেওয়া তো চলছেই; মরিচ, লবণ থেকে সুই সুতা পর্যন্ত। আজ সকালে তিনিও ও বাসা থেকে কাঁচামরিচ চেয়ে এনেছেন। শর্মিলা সময় নিচ্ছে দেখে শাহানা বেগম অবাক হন। তিনি ওর দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকান।
–আহা, শরম পাও ক্যান? বলো, কী নিবা? কী লাগব বলো।
শাহানা বেগমের গলার আন্তরিকতা টের পেয়ে শর্মিলার চেহারা থেকে এবার আড়ষ্টতার ছায়া সরে যায়।
–কাকিমা হজ থেকে ফিরলে তো মানুষ জমজম কূপের পানি আর খেজুর আনে, তাই না?
ওর কথা শুনে শাহানা বেগমের মুখে আলো জ্বলে ওঠে।
–হ। আমার ভাইও আনছে। জমজমের পানি, খেজুর, তছবি, আমার জন্য বোরকার কাপড়, অনেক কিছু আনছে।
উৎফুল্ল শাহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে শর্মিলা এবার মৃদু হাসে।
–কাকিমা, মামার আনা জমজমের পানি থেকে আমাকে একটু পানি দিবেন? এর আগে একবার নিচতলার ভাবীর কাছ থেকে নিয়েছিলাম। উপকার পেয়েছি।
শাহানা বেগম চমকে শর্মিলার দিকে তাকান। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার দুচোখে জমে যাওয়া জল কিংবা পানির কারণে তিনি শত চেষ্টা করেও শর্মিলার মায়াকাড়া মুখটি স্পষ্টভাবে দেখতে পান না।
জল আর পানি’র যে রাজনীতি, তা কেবল মূর্খ ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীকে আফিমের নেশায় রাখে। বাস্তবতাকে অস্বীকারে নারাজ শর্মিলা তাই বুঝি শাহানা বেগমের দ্বারস্হ হতে পারে। বেশ গল্প! পড়ে ভালো লেগেছে।