তন্ময় ভাদুড়ি
ঘোড়ামারা। একটা দ্বীপ। ক্রম বিলীয়মান একটা দ্বীপ। বেশি দূর নয়। এই শহর কলকাতার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মাত্র ৯২ কিলোমিটার। গত তিন দশক ধরে নদী-সাগরের ঢেউ এর ধারগুলোকে কামড় দিতে দিতে প্রায় আদ্ধেকটাই গিলে ফেলেছে। কথিত আছে, এক ইংরেজ রাজপুরুষের ঘোড়াকে এই দ্বীপে বাঘে খেয়েছিল। সেই থেকেই দ্বীপের নাম হয়েছে ঘোড়ামারা। ইংরেজরা এই দ্বীপে স্থানীয় মানুষদের বসিয়েছিল পাহারাদার হিসেবে। পর্তুগিজ বা অন্য কোনও শত্রু দেশের বাণিজ্যতরী নজর রাখার জন্য। সেইসব পাহারাদারদের উত্তরপুরুষরা আজ আর শত্রুজাহাজ দেখেন না, দেখেন তাঁদের নিজেদের বাসস্থান, নিজেদের মাটি কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুগত হাজরার হিসেবে ১৯৬৯ থেকে ২০০১-এর মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবন বদ্বীপে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ ১৬২.৮৭৯ বর্গ কিমি, যার মধ্যে গত তিরিশ বছরে ৮২.৫০৫ বর্গ কিমি মাটি হারিয়ে গেছে জলের তলায়। এর মধ্যে, বাঁধ দেওয়া এবং বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতার দরুন ঘোড়ামারার ভূমিক্ষয়টা তাৎপর্যপূর্ণ। ঘোড়ামারা হুগলি মোহনায় অবস্থিত, যেখানে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা এই তিন বড় নদীর মিষ্টি জল এসে বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে মিশেছে। ফলে এখানকার হাইড্রোডায়নামিকস প্রাকৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক, এই দুদিক দিয়েই ব্যাপক প্রভাবিত হয়। সাম্প্রতিক কালেই এই মোহনা থেকে তিন তিনটে দ্বীপ— লোহাচাহারা, সুপারিভাঙ্গা এবং বেডফোর্ড— সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের একটি সময়ানুক্রমিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৭৫-এ ঘোড়ামারা দ্বীপের যে আয়তন ছিল ৮.৫১ বর্গকিমি, সেটা ২০১২-তে এসে ৪.৪৩ বর্গকিমিতে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে খাসিমারা, খাসিমারা চর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, বাগপাড়া এবং বৈষ্ণবপাড়া, এই পাঁচটি গ্রাম ঘোড়ামারা দ্বীপ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গত তিন দশক ধরে এই দ্বীপের উত্তর পশ্চিম প্রান্ত ব্যাপক ভূমিক্ষয় দেখেছে, এবং ২০০৫ থেকে দেখা যাচ্ছে দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তেও ভাঙন শুরু হয়েছে।
ঘোড়ামারার এই বিপর্যয়ের পেছনে প্রাকৃতিক শক্তির ভূমিকাকে অবজ্ঞা করা যায় না, কেউ করছেও না। কিন্তু যেটা দেখা যায় সেটা হল, এই যে বাঁধ-ব্যবস্থার ব্যর্থতা, এর পুরো দায়টাই প্রায় চাপিয়ে দেওয়া হয় জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক ঘটনার ওপরে। বন্দর নির্মাণের মতো বিষয়গুলি প্রায়শই অনুল্লেখিত থাকে। অথচ এই প্রশ্ন মোটেই অসমীচীন নয়, যে কেন পার্শ্ববর্তী নয়াচরের মতো দ্বীপ বা সমুদ্রে উন্মুক্ত জম্বুদ্বীপের মতো দ্বীপ ছেড়ে এই ঘোড়ামারাকেই এই নির্মাণের জন্য পছন্দ করা হয়েছিল। ২০০৯-এ টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পূর্বতন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়াররা এই সব দ্বীপের বিলুপ্তির জন্য সরাসরি ‘বন্দর কর্তৃপক্ষের গয়ংগচ্ছ মনোভাব এবং ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া’কে দায়ী করেছিলেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে নয়। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন চিফ হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার তপোব্রত ব্যানার্জী সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এই ভঙ্গুর দ্বীপগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক ভূতাত্ত্বিক কারণই রয়েছে। আমি যখন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে ছিলাম তখন নাব্যতা সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা একটি ৩৬০ কোটি টাকার প্রোজেক্ট জমা দিয়েছিলাম। প্রোজেক্টটিতে সাতটি কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল বেশ কিছু আন্ডারওয়াটার গাইড ওয়াল তৈরি করা। মাত্র একটি তৈরি করা হয়েছিল, এবং তারপরেই ফান্ড না থাকার কারণ দেখিয়ে প্রকল্পটিকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
সাংবাদিক অরুণাভ সেনগুপ্ত রোডস অ্যান্ড কিংডমস-এ লেখা তাঁর একটি ট্র্যাভেলগে এই বিষয়টিই উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর কথায়, “সমস্যার সূত্রপাত ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে। এই সময়েই কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এই অঞ্চলে অনেকগুলি আন্ডারওয়াটার ওয়াল দেওয়া শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে কলকাতা বন্দরমুখী জাহাজ চলাচলের রাস্তা প্রশস্ত করা। প্রকল্পটি মাঝপথে বাতিল হয়। যে আন্ডারওয়াটার ওয়ালগুলি তৈরি হয়েছিল সেগুলির জন্য এই অঞ্চলে ঢেউয়ের উচ্চতা এবং স্রোতের বেগ, দুই-ই অনেক বেড়ে যায়।” একেই এই বিপজ্জনক ইকোসিস্টেমে এখানকার দ্বীপগুলির অবস্থা সঙ্গীন, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞানী সুজাতা হাজরা জানালেন, “২০০০ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে ৩ মিলিমিটার (০.১২ ইঞ্চি) করে বাড়ত। কিন্তু গত এক দশকে এই বৃদ্ধির পরিমাণ বছরে ৫ মিলিমিটার হয়ে গেছে।”
নদীর জল জীব জড়ে ভেদ করে না। ফলে এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে এখানকার মানুষদের। এঁরা জীবন জীবিকার জন্য ভীষণভাবেই প্রকৃতি-নির্ভর। এঁদের পেশা মূলত ধান এবং পান চাষ, মাছ ধরা এবং চিংড়ির মীন সংগ্রহ। এই লাগাতার ভূমিক্ষয় এবং বাঁধে ফাটলজনিত সমস্যার কারণে সেই সবই এখন প্রবল সংকটের সম্মুখীন। ঘোড়ামারার মানুষরা ভাঙনের হাত থেকে বাঁচতে ক্রমাগত দ্বীপভূমির মাঝখানে সরে যাচ্ছেন, ফলে সেখানে জনঘনত্ব অনেকটাই বেশি। ২০১১-র জনগণনা অনুসারে এই দ্বীপে ৫১৯৩ জন মানুষের বাস, কিন্তু এই সংখ্যাটা নিয়তই পরিবর্তিত হতে থাকে। বাস্তুচ্যুত হওয়া এখানকার মানবজীবনের এক নির্মম বাস্তবতা।
ঘোড়ামারার এই মানুষদের কথা এখন স্থানীয় তথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বহু আলোচিত। আশঙ্কা, ২০২০ সালের মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবনের ৪১ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ৭০০০০ মানুষ গৃহহীন হবেন। ঘোড়ামারার বাস্তুচ্যুত মানুষদের ইতিমধ্যেই ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ বা ‘এনভায়রনমেন্টাল রিফিউজি’ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
মানুষের জীবনে— বিশেষ করে এই সব উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষেরা, যাঁদের জীবন জীবিকা, সংস্কৃতি সমস্ত কিছুই প্রকৃতির ওপরে নির্ভর— জলবায়ু পরিবর্তন কী বিষময় প্রভাব ফেলতে পারে সেটা বোঝার জন্যই এই ফটো স্টোরির চেষ্টা। ঘোড়ামারার ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছে কারণ গত দু বছরে এই দ্বীপটি নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে, এবং এই ঘোড়ামারাই ‘ভারতের নিজস্ব পরিবেশ উদ্বাস্তু’দের জন্ম দিচ্ছে। তবে প্রকৃতির কথা বলতে বলতে আমরা আমাদের নীতিনির্ধারকদের কথা প্রায়ই ভুলে যাই, যারাও কিন্তু এই মানুষদের এই অবস্থার জন্য কিছু কম দায়ী নন!