শুভাশিস রায়চৌধুরী
তখন আমি স্কুলের গণ্ডি পেরোব পেরোব করছি, সেই সময় হাতে আসে একটা ব্যান্ডের ক্যাসেট। হ্যাঁ, আমাদের সময় ক্যাসেট ছিল। গান চলতে চলতে আটকে গেলে সেই ক্যাসেটের গর্তে পেন ঢুকিয়ে ঘোরাতাম আর ক্যাসেটের বারোটা বেজে গেলে তার ভিতর থেকে ম্যাগনেটিক টেপ বার করে এনে সেটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে ডিজাইন হিসাবে লাগাতাম। সে যাক গে, হাতে পাওয়া সেই ক্যাসেটের দৌলতে প্রথমবার আমার পাকিস্তানি গান শোনা। ব্যান্ডের নাম ছিল ‘ভাইটাল সাইনস’। শোনা মাত্রই তাদের সঙ্গীতের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেই অ্যালবামের মূল গানটার কথা ছিল ‘দিল দিল পাকিস্তান, জান জান পাকিস্তান’। তাই স্বাভাবিকভাবেই টেপ রেকর্ডারে জোরে জোরে সেই গানটা বাজলে মা অপছন্দ করত, কাজের মাসি মুচকি হাসত আর প্রতিবেশী বল্টুকাকু আমাকে রাস্তায় দেখতে পেলে ভ্রূ কুঁচকাত। দেখতে দেখতে যত দিন গেল আমার ক্যাসেটের বাক্সে বাড়তে থাকল ‘ভাইটাল সাইনস’-এর ক্যাসেট সংখ্যা। পাড়ার ক্যাসেটের দোকানে পাকিস্তানি ব্যান্ডের ক্যাসেট পাওয়া যেত না সেটা বলাই বাহুল্য। আমি তাই দেড় ঘণ্টা বাসে ঝুলে এসপ্ল্যানেডের ‘এম বিশ্বাস অ্যান্ড সিম্ফনি’ থেকে কিনে নিয়ে আসতাম তাদের। আমার জীবনজুড়ে তখন শুধুই ‘ভাইটাল সাইনস’। ব্যান্ডের লিড গায়ক জুনেইদ জামশেদের ভারী গলা নকল করে গান গাইতাম, ক্যাসেটের কভারে তার চুলের বাহার দেখে তার মতো চুল রাখা শুরু করলাম, এমনকি ক্ষুদিরাম হয়ে গিটার বাজানোর তালিম নেওয়াও শুরু হয়ে গেল। এখানেই শেষ নয়, বন্ধুমহলে রীতিমত ঝামেলা করতাম পাকিস্তানি সঙ্গীত নিয়ে। ‘ভাইটাল সাইনস’-এর ‘সাঁওলি সলোনি’ গানটাকে বেমালুম টুকে তার রদ্দি বলিউডি ভার্শন বানানোর জন্য এক বলিউডের সঙ্গীতকারকে চরম গালিগালাজ, আর আমাদের দেশে কেন পাকিস্তানের ব্যান্ডগুলোর মতো ব্যান্ড হয় না সে নিয়ে হাহুতাশ– বন্ধুদের সাথে ঠেকগুলো জমে থাকত। তখন সাইবার ক্যাফে কালচার সবে শুরু হয়েছে। সেখানেই একদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানলাম আমার প্রিয় ব্যান্ড ১৯৯৮-তেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। ততদিনে বুঝলাম কেন তাদের আর কোনও ক্যাসেট বেরোয় না। তবে আমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল যখন গুগলে জুনেইদ জামশেদকে সার্চ করলাম। জানলাম তিনি পাকিস্তানে কতটা জনপ্রিয়। পাকিস্তানি ইউথ তাকে প্রায় ভগবানের মতো মনে করে। জানলাম ‘ভাইটাল সাইনস’ ছাড়ার পর তিনি এখন সোলো অ্যালবাম করেন। ব্যাস, আর যায় কোথায়? সাথে সাথে আবার ছুট এসপ্ল্যানেডে। বাড়ি নিয়ে এলাম জুনেইদের অ্যালবাম ‘উস রাহ পর’। মোহিত হয়ে গেলাম ‘আঁখো কো আঁখো নে জো সপনা দিখায়া হ্যায়’ গানটা শুনে। মাধ্যমিকের পর বাড়িতে কেবিল এসেছিল। সেখানেই একদিন ‘চ্যানেল ভি’-তে দেখলাম জুনেইদের ইন্টারভিউ। জানলাম ভারতেও আস্তে আস্তে তার জনপ্রিয়তা বাড়ার কথা। তার কয়েক বছর পর জুনেইদ হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। যাকে বলে একেবারে ধরিত্রীর বুক থেকে উধাও হয়ে যাওয়া। গুগলে না পেলাম তার কোনও খবর আর সিম্ফনিতে না পেলাম তার কোনও অ্যালবাম। এদিকে আমারও বয়স বাড়ছে, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি, একটা প্রেমও করতে শুরু করেছি। এতসবের মধ্যে তাই আস্তে আস্তে ছেলেবেলার ভালো লাগা মুছে যেতে লাগল আমার জীবন থেকে।
বহু বছর পর একদিন সেই গুগল খুলে কী একটা মনে হতে আবার সার্চ করলাম জুনেইদ জামশেদকে। দেখলাম একমুখ গোঁফচাঁছা দাড়ি আর ফেজ টুপি পরে কার যেন একটা ছবি এল। আবার সার্চ করলাম জুনেইদ জামশেদ, এবার সাথে কী ওয়ার্ড দিলাম ‘সিঙ্গার ভাইটাল সাইনস’। এবারেও দেখলাম সেই এক মানুষের ছবি। একটু ভালো করে দেখে চমকে উঠলাম। আমার ছেলেবেলার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পীর এ কী হাল হয়েছে? কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর আরও সার্চ করলাম জুনেইদকে নিয়ে। একের পর এক পড়ে ফেললাম সার্চ রেজাল্টে আসা পেজগুলো। জানলাম জুনেইদ সঙ্গীত ছেড়ে কয়েক বছর মিডিয়ার আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। তবলিঘ-ঈ-জামাত বলে এক ধর্মীয় সংস্থার কিছু ধর্মগুরুদের সাথে গিয়ে থাকতেন। জিন্স ছেড়ে পরে নেন খাদি শালওয়ার আর টুপি, রাখতে শুরু করেন দাড়ি। তাদের সাথে মেলামেশার পর তিনি বুঝতে পারেন যে ‘সঙ্গীত’ বা ‘মুসিকি’-র জায়গা ইসলামে নেই। ইসলামে সঙ্গীত হল হারাম। এতদিন ধরে তিনি যা করে এসেছেন তা পাপ, আর এ পাপ নাকি চুরি-ডাকাতি-খুনের থেকেও বড়। চুরি-ডাকাতি-খুনে পাপ শুধু তার হয় যে ঐ কাজটা করছে, আর সঙ্গীতে যে গাইছে বা বাজাচ্ছে শুধু তার একারই পাপ হয় না, যারা শুনছে তাদেরও সমান পাপ হয়। জুনেইদ তাই প্রেসে বিবৃতি দেন তার সমস্ত ফ্যানেদের কাছে ক্ষমা চেয়ে। হ্যাঁ, তিনি তাদের এত বছর ধরে গান শুনিয়ে যে পাপ করিয়েছেন তার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। খবরটা পড়ে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। এই বিবৃতি দিয়ে তিনি কি তাহলে আমার কাছেও ক্ষমা চাইলেন? ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি আমি যার সঙ্গীতকে ভালোবেসে এসেছি, তিনি আজকে সেই সঙ্গীতের জন্য ক্ষমা চাইছেন, এ ব্যাপারটা যেন মন মানতে চাইছিল না। সেদিন কেন জানি না অনেক চেষ্টা করেও আগের জুনেইদের সাথে এই জুনেইদকে মেলাতে পারিনি। খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই ইউটিউবে দেখতাম ওনার ভিডিও। সেখানে তিনি শুধু আল্লাহ্-র নাত আবৃত্তি করতেন। নাতের শেষে বলতেন তার নতুন জীবনে তিনি যারপরনাই খুশি এবং আল্লাহ্ তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ্-র পথে জীবন যে কত সুন্দর তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পরে আরও জানতে পারি, তবলিঘ-ঈ-জামাত এবং জুনেইদের দেখানো রাস্তায় প্রসিদ্ধ পাক ক্রিকেটার ইনজামাম-উল-হক, সাকলিন মুস্তাক, সইদ আনওয়ার ইত্যাদিরাও নিজেদের স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে ‘সঠিক’ পথে যোগ দেন। ‘ভাইটাল সাইনস’-এর পুরনো ব্যান্ডমেটরা জুনেইদের এই রূপান্তরে খুবই অবাক হয়েছিল। কীবোর্ডিস্ট রোহেল হায়াত এবং নির্মাতা/পরিচালক শোয়েব মনসুর মিডিয়ার সামনেও এ নিয়ে অনেকবার দুঃখ প্রকাশ করেন। তাতে অবশ্য জুনেইদের কিছুই এসে যায়নি কারণ তিনি তখন সর্বশক্তিমানকে নিজের সবটা সঁপে দিয়েছিলেন। এসব জানার পরে আমিও আর কোনওদিন ভাইটাল সাইনসের বা জুনেইদ জামশেদের গান শুনিনি এবং কোনও খবরও রাখার প্রয়োজন মনে করিনি। তার একটাই কারণ– জুনেইদের ঐ বিবৃতিতে তার একজন ভক্ত এবং সর্বোপরি একজন সঙ্গীতপ্রেমী হিসাবে নিজেকে প্রতারিত মনে হয়েছিল।
গতবছর ডিসেম্বরে ইয়াহু নিউজে দেখলাম ‘জুনেইদ জামশেদ বিমান দুর্ঘটনায় মৃত’। খবরটা দেখা মাত্রই এক লহমায় ফিরে গিয়েছিলাম সেই দিনটায় যেদিন ওনার গানের ক্যাসেটটা প্রথমবার হাতে পেয়েছিলাম। কানে বেজে উঠেছিল ‘দিল দিল পাকিস্তান’। প্রচণ্ড দুঃখ হলেও পর মুহূর্তেই আবার রাগও হয়েছিল। মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল। তিনি তো হারাম ছেড়ে হালালের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাও এরকম পরিণতি কেন হল তার? জিন্স-টিশার্ট ছেড়ে তুলে নিয়েছিলেন অ্যাঙ্কল লেন্থ খাদির শালওয়ার, গিটার ছেড়ে তুলে নিয়েছিলেন ধর্মগ্রন্থ, তাহলে কেন তার দেহ কবরটুকুও পেল না? কোটি কোটি মানুষের রোল মডেল ছিলেন তিনি। সেইখান থেকে এক ভিন্ন জীবন বেছে নিতে যারা তাকে বুঝিয়েছিল তাদের প্রতি ঘৃণায় মনটা ভরে গিয়েছিল জুনেইদের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পেয়ে। চোদ্দ তলার অফিস থেকে সিধা নিচে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে পড়ে যাচ্ছিল শোয়েব মনসুরের ‘খুদা কে লিয়ে’ ছবির সেই কোর্টরুমের দৃশ্যটা যেখানে বলা হয়েছিল কিছু খাঁটি কথা।
‘ইসলামে পয়গম্বের সংখ্যা ১,২৪,০০০। তাদের মধ্যে পবিত্র গ্রন্থ শুধু ৪ জনের উপরই আছে। মুসা (মোজেস)-এর তউরত, ঈসা (যীশু)-র ইঞ্জিল, দাউদ (ডেভিড)-এর জাবুর এবং হজরত মহম্মদের কোরান শরিফ। তার মানে এটা বলাই যায় যে এই চার জন বাকিদের তুলনায় উচ্চস্থানীয় ছিলেন। এই চারজনকে আল্লাহ্ আলাদা আলাদা ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। এঁদের মধ্যে দাউদের ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল ‘মুসিকি’। তার গলার আওয়াজ এমনই মধুর ছিল যে তা শুনে পাহাড়, নদী, আকাশও তার সাথে গেয়ে উঠত। তা যদি ‘মুসিকি’ হারামই হবে তাহলে আল্লাহ্ তার প্রিয় পয়গম্বরদের মধ্যে একজনকে কেন সেই ক্ষমতা দেবেন?’
জুনেইদের কাছেও ‘মুসিকি’ দিয়ে মানুষের মন জয় করার ক্ষমতা ছিল। ‘পাকিস্তান আমাদের শত্রু’ এটা মনে বসে যাওয়া এক কিশোরের মনে জাগিয়ে তুলেছিল পাকিস্তানের স্তুতিতে গাওয়া এক গানের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা। আমার প্রশ্ন, যারা আল্লাহ্-র নাম করে জুনেইদের ‘মুসিকি’ তার থেকে কেড়ে নিল তাদের কি আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন? নাকি শাস্তিটা শুধু জুনেইদ একাই পেল? সঙ্গীত আর জীবন, অকালে এই দুটোরই চরম মূল্য দিতে হল তাকে।
*****************************************
আজ ১৬ই জুন। ১৯৮৭-তে এই দিনে ‘দিল দিল পাকিস্তান’ প্রথমবার রেকর্ড করা হয় এবং সে বছরই ১৪ অগাস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে রিলিজ হয় এই যুগান্তকারী অ্যালবাম। ২০০৩-এ BBC-র অনলাইন একটা পোলে জনপ্রিয় গানের তালিকায় এই গান তিন নম্বর স্থান পায়।
লেখাটা একইসঙ্গে আনন্দ ও বিষণ্ণতা দিল। পাকিস্তানের ব্যান্ড সমন্ধে কিছুটা ধারনা ছিল। তবে এই তথ্যগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। লেখককে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ 🙂
হুম। বজরঙ্গীরা বলেছে খাজুরাহো ইত্যাদির ভাস্কর্য ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী!
সবই বিষ্ঠার এপিঠ আর ওপিঠ 🙂
Etai hoy mushkil, dhormer sathe baaki jinish ke guliye phelley! “Vital Signs” er besh kichu gaan shunechi jibone, protyek tai ek ekta masterpiece. Lekhok ke dhonnyobaad, onek ojana information haajir holo.
4numberplatform egiye choluk, shob bnadha bipotti periye. Khub informative ekta jayegaa hoye utheche 🙂
অনেক ধন্যবাদ অরিন্দম বাবু 🙂