অর্জুনের কথা

দেবরাজ গোস্বামী

 

মা ফলেষু কদাচন… কুরুক্ষেত্রের ময়দানে মহাভারতের অর্জুনকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তোমার কর্ম তুমি করে যাও, ফলের আশা কোর না। কথাগুলো হুবহু খেটে যায় মগনলালের মাইনে করা নাইফ থ্রোয়ার অর্জুনের ক্ষেত্রেও। মগনলালের ডাক পেয়ে সে যখন ঘরে এসে ঢোকে, প্রথমে কুর্নিশ করে মগনলালকে, তারপর ফেলুদা, তোপসে এবং জটায়ুকে। গোড়াতেই সে বুঝিয়ে দেয় হীরকরাজার মাইনে করা বৈজ্ঞানিকের মতো সেও একা, সে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। খাঁটি শিল্পীর মতোই সে নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত। নিজের দক্ষতার চূড়ান্ত পারফেকশানে পৌঁছনো এবং যে কোনও পরিস্থিতিতে সেটাকে ধরে রাখাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। একটা একটা করে ছুরি তুলে নিয়ে পাখির চোখের মতো লক্ষ্যভেদ করবার সময় পিছন থেকে ছুঁড়ে দেওয়া মগনলালের বাহবা, মাইনে বাড়িয়ে দেওয়ার প্রলোভন এইসব কিছুই স্পর্শ করে না তাকে। বরং তার পরনে থাকা জহর কোটের ওপর ঝুলতে থাকে বেশ কিছু মেডেল। তার শিল্পনৈপুণ্যের স্বীকৃতি। ওস্তাদ গায়কের মতো সে নিজের পোশাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় শিল্পীর বায়োডাটা। বোঝাই যায় এইসব মেডেল তার সুখস্মৃতি যা হয়ত একদা হরবংশপুরের রাজার প্রাইভেট সার্কাসে থাকার সময় সে পেয়েছিল। যে মগনলাল ভেঙে যাওয়া ফুলদানির দাম ভাড়াটে বন্দুকবাজের মাইনে থেকে কেটে নেওয়ার কথা বলে তার সাধ্য কি অর্জুনের মতো শিল্পীর গুণের কদর করে! মগনলাল যখন ভাবে অর্জুনের খেলা দিয়ে ফেলু মিত্তিরকে ভয় দেখাবে, অর্জুনের কাছে তখন সেটা একজন পারফর্মিং আর্টিস্টের পাবলিক শো। যে সুযোগ সে কখনওই ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না, অসুস্থ অবস্থাতেও কোমর বাঁকিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। আমরা একবারই অর্জুনকে বিরক্ত হতে দেখি যখন লালমোহনবাবু আস্ত ফুলদানিটা সরিয়ে রেখে আসেন। কারণ একজন আপাদমস্তক পারফেকশানিস্ট হিসেবে তার শিল্পীমন ইন্সালটেড হয়। সামান্য একজন বন্দুকবাজের সঙ্গে তার তুলনা সে মেনে নিতে পারে না। মগনলালের উদ্দেশ্য যাইই হোক অর্জুন জানে জটায়ুর শরীর থেকে যদি একবিন্দু রক্তপাত হয় সেটা হবে শিল্পী হিসেবে তার চূড়ান্ত পরাজয়, এটা সে কিছুতেই হতে দিতে পারে না। এইভাবেই সে নিজেকে প্রমাণ করে। অর্জুন এটাও জানে হরবংশপুরের রাজার প্রাইভেট সার্কাস আর মগনলালের ‘সার্কাস’ এক জিনিস নয়। সার্কাস শব্দের ন্যারেশান এখানে পাল্টে যায়। হয়তো সে মনে মনে ভাবে “আমার এই আঙ্গুলগুলোও কিনতে পারো, আপোষেও নেই আপত্তি নেই আমারও… আমাকে না আমার আপোষ কিনছ তুমি, বল কে জিতল তবে জন্মভূমি জন্মভুমি”। তামাম দুনিয়ার যত শিল্পী সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক এবং সৃজনশীল মানুষেরা পাকেচক্রে, পরিস্থিতির চাপে মগনলালদের মতো মানুষের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন, অপমানিত হন, তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার হতে দেখেও হজম করতে বাধ্য হন, নাইফ থ্রোয়ার অর্জুন চিরকাল তাদের হৃদয়ের কাছাকাছি থাকবে। গ্যালিলিও যেমন শেষ মুহূর্তে অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন ‘বাট স্টিল ইট মুভস’, ঠিক তেমনই আমি নিশ্চিত শেষ দৃশ্যে মগনলালকে দেওয়ালে ঠেসে ফেলু মিত্তিরের লক্ষ্যভেদ দেখলে অর্জুনও খাঁটি শিল্পীর মতো বলে উঠত ‘নাজুক নাজুক’…। হয়তো এই কাজটা সে নিজেই করবার স্বপ্ন দেখেছে আজীবন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. রথীমহারথী প্রধান চরিত্রদের পাশ কাটিয়ে নির্ভুল চোখে অর্জুনকে খুঁজে নিল আপনার কলম, এই লক্ষ্যভেদই বা কম কি! দারুন!

  2. শিল্পীসত্তার নির্লিপ্ততাই তার পলিটিকাল স্টেটমেন্ট এটা আমার ধারণা।

  3. শ্রীজাতকে নিয়ে বিতর্কটা মনে পড়ে গেল। সেদিন কণিষ্ক ভট্টাচার্যের একটা লেখা পড়েছিলাম, সেটাও মনে পড়ল…

আপনার মতামত...