বহুমিল হ্রাবাল
তর্জমা : সর্বজিৎ সরকার
বহুমিল হ্রাবাল বিশ শতকের চেক লেখকদের মধ্যে অন্যতম। মিলান কুন্দেরা তাঁর সম্বন্ধে বলেন, হ্রাবাল এমন একজন লেখক যাঁর লেখায় রাস্তার আটপৌরে রগড় আর বারোক কল্পনা এক অদ্ভুত সাবলীল ভঙ্গিতে মিলেমিশে থাকে। হ্রাবালের লেখা এক কথায় আবহমান জীবনের এক তূরীয় উৎসব যেন। সে লেখায় একদিকে যেমন সুন্দরের খোঁজ, অন্যদিকে জীবনের নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতা। বহুমিল হ্রাবালের জন্ম ১৯১৪। মৃত্যু ১৯৯৭। এই দীর্ঘ জীবনে হ্রাবাল নানারকম পেশায় কাজ করেছেন। লেখক হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিলেন পরিণত বয়সে এসে। স্যুররিয়ালিজমের সাথে কাট অ্যান্ড পেস্ট রীতির সংমিশ্রণে এমন এক অদ্ভুত ন্যারেটিভের ব্যাবহার করতেন যা একই সাথে উচ্ছল, তাৎক্ষণিক, অথচ গভীর দার্শনিক এবং ঠিক ততটাই রাজনৈতিক। তাঁর বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে, Closely watched train, I served the king of England এবং Dancing lessons for the old in age অন্যতম।
প্রতিদিন সকালে আমার বাড়িওয়ালা পা টিপে টিপে আমার ঘরে ঢোকেন। ওনার পায়ের আওয়াজ তাও আমি শুনতে পাই। এ ঘরটা এত লম্বা যে তুমি দরজা থেকে আমার খাট অবধি অনায়াসে একটা সাইকেল চালিয়ে আসতে পারবে। আমার বাড়িওয়ালা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েন, ঘুরে দাঁড়ান, তারপর দরজায় কারও দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলেন–
“মিঃ কাফকা এখানেই আছে।”
এরপর তিনি আঙুল দিয়ে হাওয়ায় তিনবার খোঁচা মারেন, আস্তে আস্তে হেঁটে যান দরজার দিকে, যেখানে আমার বাড়িওয়ালি একটা টিনের ট্রে’র ওপর পুর দেওয়া শুকনো পাঁউরুটি আর ছোট একটা কাপে কফি নিয়ে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দেন। ট্রে নিয়ে তিনি আমার বিছানার কাছে আসেন আর যেহেতু তার হাত কাঁপে তাই, ট্রের ওপর কাপটাও ঠকঠক করে নাচতে থাকে। মাঝেমাঝে, এমত জাগরণের পর, আমি ভাবতে থাকি— ধরা যাক বাড়িওয়ালা আমাকে ডাকতে এলেন, হাঁক মেরে বললেন আমি এখানে আছি, আর দেখা গেল আমি এখানে নেই? সাঙ্ঘাতিক ঘাবড়ে যাবেন নিশ্চই, কেননা সে তো কত বছর হয়ে গেল যে তিনি এই একইভাবে আমার উপস্থিতি ঘোষণা করছেন রোজ সকালে, নিজেকে আর একবার সেই প্রথম হপ্তার কথা মনে করানোর জন্যেই এইসব ভাবি, সেই যখন ওরা প্রতিদিন আমার বিছানায় জলখাবার নিয়ে আসত আর আমি অদৃশ্য হয়ে থাকতাম।
সেই তখন, একবার বন্যার সময় যেমন ভারী বৃষ্টি পড়েছিল তেমনি জোর বৃষ্টি হচ্ছিল, নদীটা তার জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল একই অবিশ্রান্ত ধারায় যেমন সে বরাবর যেত, আর আমি সেই বৃষ্টির ধারায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কী করব, দরজায় টোকা দেব না কি এমনিই হেঁটে চলে যাব। বাতাবিলেবু গাছটার পাতাগুলো গাছের মগডালে বসা চড়াইদের মতো কিচির মিচির করছিল, তার ডালপালার ফাঁক দিয়ে স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো চুঁইয়ে পড়ছিল, আর আধ-খোলা দরজার ওপাশের ঘরে একটা শরীর জামাকাপড় ছাড়ছিল, হয় ঘুমনোর জন্যে নয়ত আদর করার জন্যে। দরজার সাদা এনামেলের ওপর ঘরের ভেতরের আলো একটা ভাঙা ছায়া ফেলছিল আর আমি ভাবছিলাম ছায়াটা কি একা আছে, না কি আর কারও সাথে? আমি কাঁপছিলাম। রাতের বৃষ্টিতে ঠান্ডা লাগছিল আর কাদাঘোলা বৃষ্টির জলে আমার পায়ের ছাপ আর দেখা যাচ্ছিল না। আর তাও, আমি ভাবছিলাম, উদ্বেগ নিয়ে বেঁচে থাকা ভালো, ভয়ে দাঁত ঠকঠক করে কাঁপছে সেও ভালো, জীবনকে ঠেলতে ঠেলতে ধ্বংসের কাছে নিয়ে গিয়ে পরেরদিন সকালকে আবার নতুন করে দেখা অবশ্যই বেশ ভালো। আবার এটাও ভালো যে চিরতরে বিদায় নিলাম আর সবকিছুর জন্যে দায়ী করলাম নিজের দুর্ভাগ্যকে, ঠিক যেভাবে বুড়ো জোব ভেবেছিল। যদিও সেই সময়ে, আমি সেই বৃষ্টির ধারায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কী করব, দরজায় টোকা দেব না কি এমনিই হেঁটে চলে যাব, কেননা, ঈর্ষার দৃষ্টিকে নিজের মাথা থেকে উপড়ে ফেলতে আমার সে সময়ে ভয়ই করছিল। মনে মনে প্রার্থনা জানাচ্ছিলাম— হে বৃষ্টিস্নাত রাত্রি, আমাকে এখানে ছেড়ে যেও না, এই সব সাদামাটা সুন্দরীদের দয়ায় আমাকে ফেলে যেও না, অন্তত এটুকু দয়া করো আমায় আমি যেন এই কাদার মধ্যে নতজানু হতে পারি, আর তাকিয়ে থাকতে পারি ওই বন্ধ বাড়িটার দিকে।
একদিন সকালে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “পোল্ডিংকা, তুমি কি এখনও আমাকে ভালোবাসো?”
“তুমি কি ভালোবাসো আমাকে এখনও?”, এই ছিল তার উত্তর।
এরপর যেদিন আমি জেগে উঠব, সেদিন ওকে জিজ্ঞেস করব, “তুমি কি এখনও ঘুমিয়ে আছ, হে মহারানি?” একদিন নিশ্চই, হয়ত, যে আয়নাটা আমি ওর মুখের সামনে ধরে রেখেছি, তাতে আর কোনও কুয়াশা থাকবে না।
এখন হাঁটছি ঊংগেল্টের রাস্তায়, দেখছি সেন্ট জেকব ক্যাথিড্রালের চূড়া, যেখানে সম্রাট চার্লসের বিয়ে হয়েছিল। একবার, মালা স্টুপারটস্কা স্ট্রিটের মোড়ে, আমার বাড়িওয়ালা হেভি পিটুনি খেয়েছিল, না না নীতিবাগীশ সঙ্ঘের গোয়ান্দাগিরি করার জন্যে নয়, দুটো মাতালের মারামারি থামাবার জন্যে। আর ওই যে ঊংগেল্টের সেই বাড়িটা যার চিলেকোঠায় কিছুদিন আমার আস্তানা ছিল, যদিও সেখানে এক অন্ধ একর্ডিয়ান বাদককে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্যে আমার ঘরের মধ্যে দিয়েই যেতে হত। এটা আমার সত্যি জানতে ইচ্ছে করে, সম্রাট চার্লস যে কী করে এমন একজন রাজকন্যাকে ভালবাসতে পারল যে কিনা খালি হাতেই ঘোড়ার পায়ের নাল সোজা করে দিত আর ধাতুর পাতকে রোল করে ফানেল বানিয়ে দিতে পারত! এসব ভাবতে ভাবতেই, চোখ গেল সেই গাড়িবারান্দার থামগুলোর দিকে যেখানে মার্কুইজে দেলা স্ত্রাদা হেঁটে বেড়াতেন, আর লোকে বলে, তার ত্বক এমন রেশমের মতো ছিল যে তিনি যখন রেড ওয়াইন পান করতেন তখন মনে হত যেন তিনি ওয়াইন ঢালছেন একটা কাঁচের বাঁশির মধ্যে।
যেখানে আমি থাকি সে বাড়িতে ঢুকলাম এখন। অনেক কাল আগে, টাইন চার্চের চূড়ায় লাগানো একটা ঘণ্টা একবার বাজতে বাজতে মাঝপথেই ভেঙে গিয়ে, টালির ছাদ ভেঙে, সিলিং ফুঁড়ে, সজোরে আছড়ে পড়েছিল আমি এখন যে ঘরটায় থাকি, সেই ঘরে। এখন, বাড়িওয়ালিকে দেখছি একমনে উদাসভাবে জানলায় হেলান দিয়ে আছে; জানলার পর্দা আর নিচের অদৃশ্য দুনিয়াটা হঠাৎ যেন তরতাজা হয়ে উঠেছে। বাড়িওয়ালি মাঝেমাঝেই তার লালচে চুলগুলোকে আমার ওপর ঢলে পড়তে দেয়, ঠিক যেমন করে আস্পারাগাসের পাতারা ছড়ায়, তেমনি করে। তার নিঃশ্বাসে ব্লুবেরি ওয়াইনের গন্ধ। আমি চার্চের দেয়ালে কুমারী মাতা’র লটকানো মূর্তির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি, এত গম্ভীরভাবে যেন আমি মারগ্রেভ গেরো। বোমাবিধ্বস্ত টাউন হলের সামনে দিয়ে পথচারীরা হাঁটে আর ওই অচেনা সৈনিকের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝোঁকায়।
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বাড়িওয়ালি ফিসিফিসিয়ে বলে, “একটা কথা বলব?”
“কী হয় যদি আমরা দুজনে একটা আলতো চুমু খাই, বন্ধুর মতোই না হয়। কেমন হয় তাহলে, মিঃ কাফকা?”
“সরি মাদাম”, আমি বলি, “আমার প্রেমিকা আমাকে বিশ্বাস করে।”
সে এবার হিসহিসিয়ে ওঠে, “ন্যাকামিও করতে পারো!” “মেয়ে দেখা আর মদ খাওয়ার সময় তো বেশ গরম, কই তখন তো এই ন্যাকামি দেখি না।” ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বাড়িওয়ালি, ব্লুবেরি ওয়াইনের গন্ধটা পিছনে ফেলে রেখে। পর্দাগুলো একবার ফুলে ওঠে, সরে যায়, আর তারপরেই কয়েক হাজার খঞ্জনা পাখি তাদের খুদে খুদে ঠোঁটে সেই অরগ্যান্ডির কাপড়কে তুলে ধরে যেন কোনও রাজকীয় বিবাহের প্রসেশন চলেছে, আর পর্দাগুলো আর একবার ঝিরিঝিরি বাতাসে কেমন ফুলে ওঠে।
এই বাড়িতেই কোথাও, কে যেন এখন, পিয়ানোয় Czerny’s School of Velocity প্র্যাকটিস করছে; নোংরা জামাকাপড় পরা একটা লোক জানলার নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার হাতের শক্ত রবারের স্যুটকেসটার মতোই তার মুখটাও অজস্র গর্তে ভরতি। চার্চের দেয়াল বেয়ে পারদ গড়িয়ে নামছে। তার কার্নিশে ফুলে থাকা পেঁচাগুলো আর বেবুনেরা ঘুমিয়ে পড়েছে।
“এই টুথব্রাশগুলো একটু দেখবেন?”
“না, আমার দরকার নেই।”
“সেই দূর ফ্রান্স থেকে নিয়ে এসেছি, আর তাছাড়া, এগুলো সব নাইলনের— এক ডজনের দাম দুশো আটষট্টি ক্রাউন মাত্র।”
“আরে না, না, না— বলছি তো আমার প্রয়োজন নেই।”
“বেশি দাম মনে হচ্ছে? একটু হতে পারে, কিন্তু স্যার, শুধু একবার ভাবুন, আমাদের এই প্রোডাক্ট দিয়ে পালিশ করা ডান্স ফ্লোরে আপনার কাস্টমাররা কী অপূর্ব সুন্দর ভঙ্গিমায় ঘুরে ঘুরে নাচতে পারবেন!”
“আচ্ছা তো এইজন্যেই ও একটু আগে ওরকম জোশ দেখিয়ে গেল।”
“আর যদি নতুন কিছু দেখতে চান, আপনাকে দেখাই, আমাদের স্টকে বাচ্চাদের জন্যে কিছু হেয়ার ব্রাশ আছে। দেখাব কয়েকটা?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি কিছুতেই ওকে ছাড়তে পারব না।”
“অবশ্যই। আর এটার র-মেটেরিয়ালটা খুব দামী।”
“ফুল আর অভিশাপ দিয়ে তোমার বাড়িটাকে আমি ডুবিয়ে ছাড়ব।”
“আর আপনি যদি ক্যাশ দেন তাহলে তো আরও টু পার্সেন্ট আপনাকে ছাড় দেব।”
“ফ্রাঙ্কো আ বোর্ডের মাধ্যমে মালটা আপনাকে পাঠিয়ে দেব, আপনি সামনের সপ্তাহেই ডেলিভারি পেয়ে যাবেন। আরে, এটা কী? এটা তো সেই হ্রিভন্যাক আর কোং-এর তৈরি গাঁজাখুরিটা। হ্যাঁ, সেই তো, যে নিজেকে দড়িতে লটকে ঝুলে পড়েছিল। কেন? আমি বলতে পারব না। আগে আপনি আমাকে বলুন যে কেন আমাদের জেলার জজসাহেব পাগলা হয়ে গিয়েছিলেন আর কেনই বা কোরোনার অট্টহাসি হেসেছিল। নিজের টাই’টা একবার শক্ত করে বাঁধুন আর নিজের ছায়াকেই জিজ্ঞেস করুন, ওরে ভাই, তুই কি সত্যিই বেঁচে আছিস?”
বিছানা থেকে একলাফে আমি নেমে পড়ি, জানলা দিয়ে গলাটা লম্বা করে বাড়িয়ে নিচের রাস্তায় তাকাই, যেন একটা গভীর কুয়োর তলাটা দেখছি। দেখি এক সোনালি চুল সুন্দরীর মাথা এক যুবকের মুখের কাছে ঘন হয়ে আসছে, আমি চুমুর আওয়াজ শুনতে পাই যেটা হালকা হাওয়ায় ভর দিয়ে চাবুকের সপাৎ শব্দ করে আমার বিছানার পাশে এসে আছড়ে পড়ে।
“সরে যেও না।” “এটা হতে পারে না যে তুমি আমাকে পুরোপুরি ছেড়ে যাবে”, সোনালি চুল জোর গলায় বলতে থাকে, আর নীরবতার বুদবুদেরা রাত্রির ক্রসবারে চোয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে ওপরে চাঁদের দিকে উড়ে যায়। আমি এখনও সেই রাঁধুনির, যে এখানেই থাকত, যার নাকের ডাক তিনটে দেয়াল ভেদ করে শোনা যেত, তার নাকডাকার আওয়াজ শুনতে পাই। লোকটা এত জোরে নাক ডাকত যে রোজ আমায় একটা করে নতুন পাঁউরুটি কিনতে হত আর তার তুলতুলে টুকরো গুঁজতে হত নিজের কানে, যাতে অন্তত একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারি। এখন দেখি, সেই সোনালি সুন্দরী, চার্চের পাশে জড়ো করে রাখা বালিতে নরম হয়ে শুয়ে পড়েছে, আর ছেলেটিকে টেনে নিচ্ছে তার বুকের ওপর, প্লাস্টারের ঢাকনা দেওয়া ধাতব রিংগুলো তাদের ওপর ঝনঝনিয়ে পড়ে, তারা খেয়ালই করে না। একটা সাদা রিং গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায় সরু গলিটা দিয়ে ঠিক একটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো। নেহাত মাতা মেরি’র দুটো হাতই সিমেন্টে গাঁথা তাই নিজের ছেলের চোখটাও এসময়ে ঢেকে রাখতে পারেন না।
ফিগারো বার, স্পাইডার, শ্যাঁপো রুজ, রোমানিয়া, আর ম্যাগনেট, সব কটা বার আজকের মতো বন্ধ হচ্ছে। মোড়ের মাথায় কে যেন বমি করছে, আর পুরনো টাউন স্কোয়ারের দিকে কে একটা যেন চিৎকার করছে, “স্যার, গর্ব করে বলতে পারি আমি একজন চেকোস্লোভাক!”
আর একটা কে যেন সপাটে তার গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলল, “তো কী হয়েছে?”
এক মহিলা যার নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, গাড়িবারান্দার থামগুলোর আড়াল থেকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে সেদিকে যেন সেও এইমাত্র এই কথাটাই বলেছে ওই বদ সহনাগরিককে, আমিও এক গর্বিত চেকোস্লোভাক। আর রাস্তার মোড়ের ঠিক মাঝখানে, কালো জামা পরা একটা লোক, ফুলের নকশা আঁকা পোশাক পরা একটা মেয়েকে রাস্তার জমা জলের ওপর দিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে খিস্তি করছে, “ওঃ! কী খানকিকেই না বিয়ে করলুম!”
মেয়েটা যতবার লোকটার পা আঁকড়ে ধরছে ততবার লোকটা লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তাকে। কুঁকড়ে গিয়ে মেয়েটা এবার এলিয়ে পড়ে জমা জলের গর্তের ওপরেই, ওভাল ফ্রেমে বাঁধানো একটা ফটোগ্রাফের মতো দেখতে লাগে তাকে, নোংরা জলের মধ্যে তার খোলা চুল ভেসে থাকে ঠিক কোনও সমুদ্র-শৈবালের মতো। লোকটা শান্ত হয়ে যায় একটু পরে। জলের মধ্যেই হাঁটুগেড়ে বসে লোকটা মেয়েটার ভেজা চুলে খোঁপা বেঁধে দেয়, কান্নাভেজা মুখটাকে তুলে ধরে, আর নিজের আঙুল দিয়ে সোহাগ বুলিয়ে দেয় মেয়েটার চোখে মুখে। তারপর নিজেই দুহাতে ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে মেয়েটাকে, এসময়ে একে অপরকে আঁকড়ে থাকে তারা, চুমু খায়, তারপর একসঙ্গে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায়, এক্কেবারে হোলি ফ্যামিলি যেন। যখন তারা স্মল স্কোয়ারে পৌঁছয়, ওই যেটা প্রিন্স রেগানের বাইরে, তখন কালো জামা পরা লোকটা যেন খাপ থেকে খোলা তলোয়ার বার করছে সেইভাবে দু দিকে দুটো হাত ছড়িয়ে দেয়, আর চিৎকার করে ফাঁকা চৌমাথাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে ওঠে, “শরীর পরাস্ত আজ, পবিত্র আত্মাই শেষে জয়ী।”
একটা পাবলিক বাস তার ভেতরে হ্যান্ডেল ধরে ঢুলতে থাকা কয়েকটা মরা লোককে সাথে নিয়ে গড়গড়িয়ে চলে যায়। এক পথচারী হোঁচট খেয়ে পড়ে আর চেষ্টা করে রাস্তার পাথরটাকেই জ্বালিয়ে দিতে। একটা দৈত্যাকার ষাঁড় শহরটাতে দাপিয়ে বেড়ায়, যদিও তার গোলাপী অণ্ডকোষ ছাড়া আর কোনওকিছুই লোকের চোখে পড়ে না।
দুপুরের কিছু আগে, উ কটচু’র খোলা বাজারের দিকে আমি হাঁটছি। বাজারের কোণে, আমি একটা সারা বছরের মাসিক রাশিফলের ক্যালেন্ডার কিনে নিই, আর লক্ষ করি সেলসগার্লদের নাক থেকে কীভাবে রঙিন ফিতে উড়ছে যখন তারা দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে ফিতে মাপে। প্রত্যেক দিন দেখি যে সব বুড়ি ডাইনিগুলো ভেষজ শেকড়বাকড় বেচে তাদের মাথায় সূর্যবলয়ের গোল ছাতা গজিয়েছে। প্রায় রোজই দেখি বাজারের অন্ধকার কোণা থেকে যে বুড়িরা বেরিয়ে আসে তাদের মুখ রাশিচক্রের ক্ষতচিহ্নে ভরা, চোখের জায়গায় যেন চিতাবাঘের গায়ের দুটো ছোপ, আর তারা ঝোলা ভরে কিসব কুটোকাটা টানতে টানতে দিনের আলোয় হেঁটে আসছে। ওদের মধ্যে একজন পুঁচকে পুঁচকে পালক দিয়ে বানানো সবুজ গোলাপ বেচছে, আর অ্যাডমিরালের একটা তরোয়াল, আর একটা অ্যাকর্ডিয়নের বোতাম, আর একজন বেচছে যুদ্ধের সময়ের যত বাড়তি হয়ে যাওয়া বক্সার-শর্ট, ক্যানভাসের তৈরি জলের বালতি আর একটা স্টাফ করা মরা বাঁদর। কয়লার বাজারে সেলসগার্লরা তাদের পেটে বাঁধা ক্যাঙ্গারু পাউচে করে নানা রঙের টিউলিপ বিক্রি করে। রিটিরস্কা স্ট্রিটের শপ উইনডোতে পায়রারা ঠোকরায় আর ডাকে, আর ছোট তোতাগুলো তাদের খাঁচার ভেতরে ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে যেন তারা এক একটা কবিতার রূপক। আমি দেখি বেশ কিছু ক্যানাডিয়ান বাঁদর তাদের কাচের খাঁচার থেকে যে চিমনি উঠেছে তার মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে লড়ে যাচ্ছে। একবার, তিনশো ক্রাউনের বিনিময়ে আমি কিছুক্ষণ সাধু সেজেছিলাম; সেবার আমি সব ময়নাগুলোকে কিনে নিয়ে হাতে করে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আহা! ভয় পাওয়া ছোট্ট পাখিগুলো যখন তোমার হাত থেকে খোলা আকাশের স্বাধীনতায় উড়ে যায় তখন যে কী অদ্ভুত অনুভূতি হয়!
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য