দেবব্রত শ্যামরায়
ছোটবেলায় ‘আমাদের পরিবেশ’ বইয়ে পড়েছি— গোরু একটি গৃহপালিত প্রাণী। তখন জানতাম না, এটাই গোরুর প্রধান পরিচয় নয়। বইয়ে যা লেখা ছিল না, তা হল গোরু একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক প্রাণী, যদিও সে কোনওদিন সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। অন্তত এখনও পর্যন্ত নেয়নি (অবশ্য যে বইটি নিয়ে এখন আমরা কথা বলব, সেটা পড়ার পর গোরুর ভোটে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা নিয়ে আর নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না)। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের লোকজন একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সর্বক্ষণ ভ্র কুঁচকে গোরু নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করছে, এটা ট্রাজেডি না কমেডি, চট করে বলাই কঠিন। বস্তুত, ঠিক এই মুহূর্তে যখন এই লেখাটি তৈরি হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরে গোরক্ষক বনাম পুলিশের সংঘর্ষে নিহত পুলিশ অফিসারের মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশদ্রোহী আখ্যা পাচ্ছেন নাসিরুদ্দিন শাহ। আজমীর সাহিত্য উৎসবে তাঁর নিমন্ত্রণ বাতিল হচ্ছে। মন্তব্য, পালটা মন্তব্য জড়িয়ে পড়ছেন যোগগুরু রামদেব, এমনকি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও। অর্থাৎ শোচনীয়ভাবে, বিতর্কের কেন্দ্রে ঘুরেফিরে উঠে আসছে সেই চিরচেনা আপাত-নিরীহ তৃণভোজী প্রাণীটিই।
গোটা দেশ যখন এহেন গোময়লাঞ্ছিত, ঠিক এমন সময় হাতে এল বরিষ্ঠ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রের ব্যঙ্গরচনার সংকলন ‘এক ডজন গোরু ও অন্যান্য’। নানা সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সমসাময়িক রাজনীতির নানা টুকরো (যেগুলির প্রধান চরিত্র আমাদের দেশের গোরু) নিয়ে একগুচ্ছ ব্যঙ্গরচনার এই সমাহার বিলিতি পরিভাষায় একটি পকেটবুক, বাঙালি শীতে ওভারকোট পরলে আরামে তার পকেটের কোণে ফেলে রাখা যেত এই বই। বাসে, ট্রামে, রাস্তাঘাটে, অটোর লাইনে অপেক্ষমাণ অবস্থাতেও অনায়াসে পড়ে ফেলা যেত মাত্র দু-তিন মিনিট পাঠের একেকটি মজাদার পরিচ্ছেদ।
এক ডজন গোরু ও অন্যান্য/ শুভাশিস মৈত্র
ধানসিঁড়ি প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ২০১৮
দাম- ১৫০ টাকা
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
প্রতিদিন খাওয়ার জন্য হাজার কুড়ি গোরু মারা হত। এখন বন্ধ। ফলে দেশের ২০ কোটি গোরুর সঙ্গে দৈনিক এইসব বেঁচে যাওয়া গোরু যোগ হচ্ছে। বছরে প্রায় ৭২ লক্ষ করে৷ এই ৭২ লক্ষের ছানা জন্মাবে বছরে ৪০-৪২ লাখ করে৷ এইভাবে কোটি কোটি গোরু মোষ বাড়তে বাড়তে শহর গ্রাম ছেয়ে ফেলবে। কিন্তু তারা খাবে কী? গোরু তখন ঘাস না পেয়ে কলা, মুলো, কুমড়ো, শজনেডাঁটা, বেগুন, আলু, এসবে মুখ বাড়াবে। কিন্তু গোরু, মোষের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। ওরা সরকারি সম্পত্তি। ট্রাম বাসের মতো। ভাঙচুর করলেই জেল। দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ নাকি একটা পোড়া রুটি রাস্তার কুকুরদের থেকে কেড়ে খেয়েছে৷ দিন আসছে, যখন একফালি মিষ্টি কুমড়োর জন্য মানুষকে গোরুর সঙ্গে কাড়াকাড়ি করতে হবে৷ শুধু তাই নয়, এই হারে গোরু বাড়তে থাকলে একদিন হয়তো এমন সময় আসবে যখন গোয়ালে আর ওদের ঠাঁই হবে না। তখন ওরা মানুষের শোবার ঘরে ঢুকে এসি চালিয়ে খাটে শুয়ে ল্যাজ নাড়েবে।
(বিশ্বাসে মিলায় গোরু, তর্কে দেশদ্রোহী)
গোরুর ঘাড়ে বন্দুক রেখে লেখকের কলমে উঠে এসেছে অনেক রাজনৈতিক ইস্যুই, যেমন— বিজেপির নাম বদলের রাজনীতি, গোমাতা, ‘স্বচ্ছ ভারত’, রাজ্যের সিন্ডিকেট রাজ ইত্যাদি। আক্ষরিক এবং রূপক অর্থে, গোরুরা এদেশের দখল নিয়ে নিলে আমাদের হাল কী হতে পারে তা পড়ে হাসতে হাসতেও শিউড়ে উঠতে হয়। এই বইয়ের প্রতিটি লেখাই কোনও না কোনও তাৎক্ষণিকতার ফসল। অবশ্য প্রত্যেকটি লেখাই যে সবসময় শ্লেষের প্রত্যাশিত মান ছুঁতে পেরেছে এমন নয়৷ যেমন, একটি লেখায় কালো গোরু সাদা গোরুর অনুষঙ্গে কেন্দ্র সরকারের কালো ধন নীতিকে প্রহারের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। প্রসঙ্গত, পরপর অনেকগুলি গোরু বিষয়ক লেখার পাঠ যখন কিছুটা ক্লান্ত করতে শুরু করেছে, তখনই পুরোপুরি অন্য বিষয়ের ওপর লেখা স্যাটায়ার নতুন উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনে। শেষের দিকের বেশিরভাগ লেখাতেই, যেমন— ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ (‘বিমানবন্দরে, সরকারি অফিসে ঢোকার সময় যেমন মেটাল ডিটেকটর দিয়ে সার্চ করা হয়, তেমনি খুব শিগগিরি বাজারে চলে আসবে অ্যান্টিন্যাশনাল ডিটেকটর। নাম দেওয়া হয়েছে ‘গডসে মিটার’।’), সিংহের বাচ্চা (‘বঙ্গের কমিউনিস্টরা এত দিনে লাইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তারা নাকি লাইন পালটাতে চায়। লাইনবাদীরা বলছেন, লাইনই হল কমিউনিস্টদের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। লাইন যদি কূপিত হয় সব্বোনাশ হবে। তেরাত্তির পোয়াবে না। দলের ওলাওঠা হবে।’), বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস, চামচা কাহিনি (‘যখন আলুর দাম হবে ৩০ টাকা কেজি, ডেপুটি চামচারা তখন বিভিন্ন বাজারে গিয়ে বিরক্ত ক্রেতাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে, রাজস্থানে তো ৪০, গোয়াতে ৫০, হনুলুলুতে ২০০, একমাত্র এখানে ৩০।’), দেখার খেলা, বিপ্লবী পার্টি, গোবরডাঙ্গায় এলেন জুকেরবার্গ— ইত্যাদি লেখায় লেখকের ধারালো উইট যথাস্থানে ঝলসে ওঠে।
ছিমছাম বইটির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে অনন্য ঠাকুর স্যাটায়ারের মুডকে যথাযথ ধরেছেন। ধানসিঁড়ি প্রকাশিত এই বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ল না।
পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক টানগুলিকে তীব্র কষাঘাত করার জন্যে ‘স্যাটায়ার’-এর মতো জোরালো অস্ত্র আর নেই। পাশাপাশি এটাও ভাবনার, ব্যঙ্গের লাগাতার ব্যবহারে তৈরি হাস্যপরিহাসের পরিবেশ বাস্তবের রক্তপুঁজ-ভর্তি অন্ধকারটাকে আমাদের নিজেদের কাছে কিঞ্চিৎ সহনীয় করে তুলছে না তো? ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পথে গোমাংস নিয়ে বিবাদে খুন হল যে সদ্য-তরুণ জুনেইদ, যে রাজনীতি খুন করল তাঁকে, আমাদের লেখালেখি, স্যাটায়ার দিয়ে আমরা যথেষ্ট প্রত্যাঘাত করতে পারছি তো তাকে? এইসব সংশয় ও অমীমাংসিত প্রশ্ন মাথায় রেখেই ‘এক ডজন গোরু ও অন্যান্য’, এই ছোটখাটো কিন্তু তীক্ষ্ণ বইটি আমরা হাতে তুলে নিতেই পারি। তবে হ্যাঁ, বইটি কোনও গোরুর হাতে না যাওয়াই ভালো।
দেবব্রত, ‘এক ডজন গোরু ও অন্যান্য’ বইটির আলোচনার শেষ বাক্যটি সাংঘাতিক। শুভময়বাবুর লেখা বিভিন্ন কাগজে আমরা পড়ি, অবশ্যই খুব বুদ্ধিদীপ্ত লেখা, কিন্তু আলোচনার শেষ বাক্যে বুঝিয়ে দিলে দেবব্রতও কম যায় না।