সত্যব্রত ঘোষ
ছবি বিশ্বাস, ছায়া দেবী, উত্তমকুমার এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়দের নিয়ে যে তরুণটি প্রথম চিত্রপরিচালনার দায়িত্বে আসেন, তাঁকে ঈর্ষা করাটাই স্বাভাবিক ছিল সেকালের মানুষজনদের। তবে ‘রাত ভোর’ (১৯৫৬) দর্শকদের পছন্দ হয়নি এবং পরিচালকও ছবিটিকে আর মনে রাখতে চাননি। বাণিজ্যিক এবং শৈল্পিক— দুদিক থেকেই ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মৃণাল সেন। গতানুগতিক বাংলা ‘বই’-এর বৃত্ত থেকে সরিয়ে সিনেমার মধ্যে নিজের সময় এবং পরিসরকে ধরবার উপায়গুলি ক্রমশ আয়ত্ত করছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে, সিনেমার আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি কার্ল ড্রেয়ারের ‘দ্য প্যাশন অব জোন অব আর্ক’ ছবিটি বিষয়ে লিখছেন,
তা হলে প্রধান কাজটা এই। নিজের যুগটাকে চিনতে হবে। কাহিনীর মধ্যে তার সঞ্চার ঘটাতে হবে এমনভাবে যেন বিন্যাসের ভেতর সেই পরিপ্রেক্ষিত প্রকাশ পায়। চলচ্চিত্রের ভাষ্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু তা নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য, নিজেই লক্ষ্য হয়ে ওঠার জন্য নয়।
‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯) ছবিটিতে তিনি ফিরে যান ব্রিটিশ অধীন কলকাতায়। এবং এই শহরটিকে দেখতে চাইলেন চিন থেকে আসা রেশম বিক্রেতা ওয়াং লু-র চোখ দিয়ে। গৃহবধূ বাসন্তীর সঙ্গে কয়েক দণ্ড কথা বলে যে বিদেশ-বিভূঁইয়ে একাকিত্বের বিষাদ ভুলে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করবার অপরাধে বাসন্তীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওয়াং লু নিজের দেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ এই দেশ বা শহর থেকে আর কিছু পাবার আশা সে হারিয়েছে। ইট-কাঠ-পাথরের শহরটির এক মায়াবী রূপকথা রচনার প্রেক্ষিত হতে পারত ছবিটি। তার পরিবর্তে বেপরোয়া তরুণ পরিচালকটি দারিদ্র এবং অসাম্যের বাস্তব চিত্রটি নির্মমভাবে ফুটিয়ে তোলেন পর্দায়। ‘হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই’ স্লোগানটিকে মশকরায় পরিণত করা আগ্রাসী চিনের শিকার নেহেরু সরকারের পক্ষে তা হজম করা কঠিন ছিল। স্বাধীন ভারতে সেই প্রথমবার সেন্সর বোর্ড নিষেধাজ্ঞা জারি করল একটি ছবির প্রদর্শনীতে। নন্দনের বড় পর্দায় ছবিটি দেখেছিলাম প্রায় তিরিশ বছর পরে। সিনেমা যে প্রতিবাদেরও একটি ভাষা, সেই বিষয়ে অল্পবিস্তর ধারণা জন্মেছে তখন। নিজের শিরদাঁড়া সোজা রেখে যে সাহসী মানুষটি নিজের চিন্তন এবং অবস্থানকে প্রথমবার ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, বড় আপন মনে হয়েছিল তাঁকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিনটি ঘিরে যে শোকের ব্যঞ্জনা, তা শুধু সাহিত্যপ্রেমীদের বুকেই বাজে এমনটা নয়। বৃহত্তর পল্লীসমাজে এর ব্যাপ্তি অন্য একটি বিয়োগান্ত স্তরে প্রযোজ্য হতে পারে। এমন ভাবনা প্রয়োগ করবার কথা ভাবতে পারেন যিনি, স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তিনি সঞ্চয় করেছেন তাঁর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়, রাজনৈতিক চিন্তাধারার সংশ্লেষণে এবং সিনেমা মাধ্যমটির প্রতি আস্থাশীল হওয়ার অনুশীলনে। সাহিত্যের মতো, সিনেমার আবেদনও বহুস্তরীয়। এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি পঞ্চাশের মন্বন্তরকে ফিরে দেখলেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) ছবিটিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ক্ষুধার তীব্রতায় আক্রান্ত প্রিয়নাথ আর মালতীর বিবাহবার্ষিকী যেখানে চিরবিচ্ছেদে পরিণত হয়।
সৎ সিনেমা (honest film)— বিশেষণটি সিনেমা সংক্রান্ত আলোচনায় এক কালে প্রায়শই ব্যবহার হতে দেখেছি এবং শুনেছি। যারা কথাটি লিখতেন বা বলতেন, তাঁরা প্রধানত ব্যক্তির প্রশস্তি সূত্রেই সিনেমার সততা খুঁজতেন। কিন্তু বিষয় এবং আঙ্গিক অনুযায়ী সিনেমার প্রচলিত রীতিগুলিকে অতিক্রম করে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন এবং প্রয়োগের আন্তরিক প্রয়াসের মধ্যেই সৎ সিনেমার বীজ লুকিয়ে আছে। ভুবন সোম (১৯৬৯)-এর পরিচালককে আমরা সেই দিক থেকে পথিকৃৎ বলতে পারি। তিনি এখানে দুটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রথমত, ভৌগোলিক দিক থেকে তিনি এমন একটি অঞ্চলে (গুজরাটের কছ্) বনফুল রচিত কাহিনীটির প্রেক্ষিত রচনা করছেন যার সঙ্গে তাঁর পরিচিতি নিতান্তই বাহ্যিক এবং সাময়িক। দ্বিতীয়ত, সংলাপের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বাচনভঙ্গিকে ভুলে তাঁকে হিন্দি এবং অপেক্ষাকৃত অপরিচিত আঞ্চলিক ভাষার প্রতি নির্ভরশীল হতে হচ্ছে বৃহত্তর ভারতীয়ত্বের স্বার্থে। ব্যাপারটি নিয়ে পরিচালকের যে চিন্তা, তা ফুটে উঠেছে পরবর্তীকালে তাঁর লেখা এই কথাগুলিতে,
মনে পড়ে, ছবিটি দেখে অনেকেই তখন বলেছিলেন, ভুবন সোম হিন্দি হয়েও মেজাজে বাঙালি। বাঙালি, কেননা আমার সমস্ত মানসিকতায় বাংলার জলহাওয়ার ঝাপটা লাগছে সর্বক্ষণ। আমি বলব, ঠিকই। কিন্তু তার সঙ্গে এও বলব, আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বাড়ন্ত যুগে কোনও আঞ্চলিক জলহাওয়া আজ আর ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আটকে থাকতে পারছে না, তা ছড়িয়ে পড়ছে সীমার বাইরে, সমস্ত দেশে, দেশের বাইরেও। এবং বাইরের জলহাওয়াও এসে পড়েছে এখানে সেখানে বাংলাতেও… ভুবন সোমের আগে ওড়িয়া ভাষাতেও ছবি করেছি (মাটির মনিসা — ১৯৬৬)। এবং সব সময়েই— কী হিন্দি, কী তেলেগু (ওকা উরি কথা — ১৯৭৭), কী ওড়িয়া— সবেতেই অনিশ্চয়তার এক প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেছি প্রতি মুহূর্তে, ভয় কাঁটা হয়ে থেকেছি। কারণ, ছবি তো শুধু দৃশ্যবস্তুই নয়, কথাও। কথার কারচুপি যদি রপ্ত করতে না পারি অথবা পাশের মানুষটি যদি ধরিয়ে না দেন তো শিল্পকর্মে ফাঁক এসে যাবেই।
সুতরাং প্রতিকূলতাগুলিকে মোকাবিলা করবার জন্য মৃণাল সেন যে শিল্পী ও কলাকুশলীদের নির্বাচন করেন, প্রথমে তাঁদের ঐক্যবদ্ধতা এবং পেশাদারিত্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনকে কার্যায়িত করবার অনুকূল পরিবেশ রচনার প্রতি তিনি একান্ত যত্নশীল হন। বস্তুত, এই বিশেষ গুণটি তিনি চিত্রনির্মাতা হিসেবে শেষ ছবি (আমার ভুবন — ২০০২)-এও বজায় রেখেছিলেন তাঁর উষ্ণ আন্তরিকতা নিয়ে। অন্য যে উপায়টি তিনি অবলম্বন করলেন, তা কম প্রাসঙ্গিক নয়। তিনি সংলাপের প্রচলিত নাটকীয়তাকে প্রায় গৌণ করে অভিনেতাদের চরিত্রসদৃশ আচরণ, দৃশ্য রচনা এবং সম্পাদনার প্রতি বিশেষ যত্নশীল হন। পরিণামস্বরূপ, ভারতীয় সিনেমা তার অন্যতম ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত ছবিটির দ্বারা গৌরবান্বিত হয়, অনেকে যাকে ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভ সিনেমার সূত্রপাত বলে চিহ্নিত করেন। তবে ‘ভুবন সোম’ বিষয়ে মৃণাল সেন পরবর্তীকালে যা লেখেন, তা এই মানুষটির সিনেমা সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা উপলব্ধি করবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
শুনেছি, জানিও, ‘ভুবন সোম’ বহু মানুষকে খুশি করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সোমসাহেবকেও ভালো লেগেছে বহু লোকেরই। ছবিটাকে ভালো লাগা আর সোমসাহেবকে ভালোবাসা দুটোর মধ্যে কিন্তু আকাশজমিন ফারাক। ছবিটা ভালো হোক, ভালো লাগুক তা অবশ্যই চেয়েছি, কিন্তু সোমসাহেবের মতো মানুষের প্রতি সহানুভূতি গড়ে উঠুক এ কিন্তু মোটেই চাই নি। … কিন্তু যখন দেখি অভিনেতাকে ডিঙিয়ে চরিত্রকেই ভালোবেসে ফেলেন দর্শক তখনই অস্বস্তি বোধ করি, শঙ্কিত হই এই ভেবে যে হয়ত নিজের অজান্তে কোথাও কোনও গোলমাল করে ফেলেছি।
আত্মবীক্ষণের এই মানসিকতার সঙ্গে শিল্পের প্রতি শিল্পীর সততার সম্পর্কটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই কারণে যে সিনেমাজগতে প্রবেশের আগে থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মৃণাল সেন। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে কাজ করবার ব্যাপারে গোড়া থেকেই তাঁর আপত্তি ছিল। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন,
প্রত্যেকটা ছবিই একটা document হয়ে থাকে। সুতরাং একটা জায়গায় যদি আমরা open-ended হই তাহলে বাধা বা আপত্তিটা কোথায়? আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের মুখপত্র নই বা কোনও রাজনৈতিক formulations অনুযায়ী ছবি করতে রাজি নই।
বিদেশে অজস্র উদাহরণ থাকলেও এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতবর্ষে যে কয়েকজন চিত্রপরিচালক কাজ করে এসেছেন, তাদের মধ্য মৃণাল সেন অন্যতম। ছবি করতে গিয়ে তিনি তাই বারবার অনুভব করেছেন,
জীবনধারণের পদ্ধতির ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পাই সমাজে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটছে অবিরত। তাই বোঝাপড়াটা সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমার আঙ্গিকের মধ্যে হলেই চলবে না, চলে না, বোঝাপড়া সময়ের সঙ্গেও। এবং এই ত্রিবিধ আনুগত্যের প্রক্রিয়াটি বড় সহজ নয়, দুরূহ। আর সেই দুরূহ পথ অতিক্রম করেও কোনও মীমাংসায় আসা সম্ভব নয়। তাই তর্ক, প্রশ্ন থেকেই যাবে, চলবেই।
প্রেমচন্দের ‘কফন’ গল্পটি অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় ‘ওকা উরি কথা’র নির্মাণপ্রক্রিয়া বিষয়ে উপরিউক্ত কথাগুলি বলা হলেও তাঁর বহু আলোচিত কলকাতা ট্রিলজি (‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা-৭১’ এবং ‘পদাতিক’) এই দ্বন্দ্বমুখর ভাবনার তীব্রতাকে প্রতিফলিত করে। বিক্ষুব্ধ সমকালকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলবার প্রক্রিয়ায় তিনি এই পর্যায়ে পৌঁছে বুঝতে পারছিলেন যে,
শিল্পকর্মীকে আজ প্রতিনিয়ত ঘটনার চাপে খানিকটা social anthropologist-এর ভূমিকা নিতে হবে।
সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই তিনি তাই বলেন,
পুরনো বা টাটকা ঘটনা বলে নয় – যে কোনও ঘটনা, যে কোনও গল্প, যা কিছু আজকের মানুষকে আজকের কথা মনে করিয়ে দিতে পারবে, আজকের বস্তুজগতের সঙ্গে একটা যোগসূত্র খুঁজে বার করতে সাহায্য করবে তাই সমকাল বলে নির্ণীত হবে।
বিষয়বস্তু, মাধ্যম এবং সময় এই তিন উপাদানের প্রতি অনুগত থেকে চিত্রনির্মাতা যখন একের পর এক ছবি বানানোয় মন দেন তখন ঘোরতর এক শৈল্পিক সংকটের মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতেই হবে। তাঁর নিজের বাস্তববোধ এবং সময়কে বুঝে নেওয়ার চেষ্টার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠার পরিবর্তে একধরনের subjectivity ভর করে। এই অবস্থাকে ভয় পাননি মৃণাল সেন। বরং প্রগতি হিসেবে তাকে চিহ্নিত করে আত্মসমীক্ষণে মন দেন। রাজনৈতিক চিন্তায় সোচ্চার মৃণাল সেনকে তাই আমরা নতুন এক রূপে আবিষ্কার করি প্রায় এক দশক পরে। যখন তিনি গভীর মনন নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির নৈতিকতা এবং মানসিক দৈন্যকে ফুটিয়ে তোলেন ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) ছবিতে। অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘অবিরত চেনামুখ’ গল্পটি অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে আমরা আশঙ্কা, সন্দেহ, বিদ্বেষে জীর্ণ একটি পরিবারকে দেখি। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মেয়ে চিনু সেই রাতটিতে বাড়ি ফেরেনি। সদ্য ক্ষমতায় আসীন বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা শহরে মানুষ যে অসহনীয় অনিশ্চয়তায় এমন এক একটি রাত কাটায়, তা উন্মোচন করে ছবিটি। কিছু সমালোচক ছবিটিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে সেই বৃত্তটি অতিক্রম করে ‘একদিন প্রতিদিন’ একটি নতুন সমাজব্যবস্থারও ইঙ্গিত দেয়, যা প্রথাবদ্ধ সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারার ক্ষয় এবং তার অবসানে নারী ও পুরুষের চরিত্রবিচারে সাম্যতাকে গুরুত্ব দেয়। ছবিটি নির্মাণের যাথার্থ নিয়ে মৃণাল সেন বলেন,
আমার সময় সারাক্ষণ আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। সময় যেহেতু আমার ভাবনাচিন্তাকে অবিরত বদলে দিয়ে যায়, তাই আমিও সময়কে নিজের মতো করে বদলাতে থাকি।
সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশের মধ্যেও তবু মধ্যবিত্ত বাঙালির শালীনতার আড়ালটা যেন রয়েই যায়। সেই আড়ালের কারণে ‘একদিন প্রতিদিন’-এ যে রহস্যাবৃত বাতাবহ সৃষ্টি হয়, ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০) এবং ‘খারিজ’ (১৯৮২)-এ তা নির্মম হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে মৃণাল সেন আমাদের সামনেই আমাদের দ্বিচারী সত্তাটি তুলে এনে দেখান। চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখির চর্চা তাঁর বরাবর ছিল। সেই কারণে তাঁর নিজের রচনারই শরণাপন্ন হয়ে আমরা জানতে পারব আত্মবিশ্লেষণের এই জটিল এবং সৃজনাত্মক পর্যায়টিকে পরবর্তীকালে তিনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন।
আকালের সন্ধানে’র নায়ক, একজন শিক্ষিত চিত্র পরিচালক, ১৯৪৩-এর পুরো ইতিহাস বয়ে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ১৯৮০ সালের এক দারিদ্র-লাঞ্ছিত পল্লীগ্রামে। ইতিহাস বোধের সঙ্গে শিল্প-বোধের সমন্বয়ও হয়তো ঘটিয়েছিল। কিন্তু অতীত যখন বর্তমানে ঢুকে পড়ে চোরের মতো, কোনওরকম জানানি না দিয়ে, তখনই নায়ক বিচলিত হয়। এবং শেষ পর্যন্ত ‘রিয়েলিটি’ থেকে মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে যায়।
অমলেন্দু চক্রবর্তীর যে পাণ্ডুলিপিকে ভিত্তি করে আমাদের এই চিত্রনাট্য ও পরবর্তীকালে ছবি গড়ে উঠেছে, সেই পাণ্ডুলিপিরও শেষ কথা অভাগিনী দুর্গার এক বুক-কাঁপানো উক্তি : “কোথায় পালিয়ে গেলেন বাবুরা? আপনারা না আকালের ছবি তুলতে এসেছিলেন?”
রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস অবলম্বনে ‘খারিজ’ (১৯৮২) ছবিটিতে বাড়ির কাজের ছেলেটি শীতের রাতে বন্ধ রান্নাঘরে দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। গৃহস্বামী এবং তার স্ত্রী বিচলিত হলেও এই চরম অবহেলার জন্য নিজেদের দায়িত্ব নিতে নারাজ। দাহকার্য শেষ করে ছেলেটির বাবা গৃহস্বামী এবং তার স্ত্রীর মুখোমুখি এসে হাতজোড় করে দাঁড়ায় এবং ম্রিয়মাণ মুখে ফিরে যায় নিজের গ্রামে। ছবিটি দেখবার পর সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন ছেলেটির বাবা শেষে গৃহস্বামীর গালে একটা চড় মারল না কেন। ভারতীয় সিনেমায় গড়পড়তা যে নাটক তৈরি করা হয়, তার ক্লাইমেক্সে রোষের প্রকাশ না ঘটলে, অতৃপ্তি রয়ে যায়। মৃণাল সেন তাঁর উত্তরে শুধু এটুকুই বলেন যে রূপোলী পর্দায় বিপ্লব ঘটানোর জন্য তিনি সিনেমাটি করেননি। ‘খারিজ’ ছবিটি সেই অস্থিরতা নিয়ে যার কেন্দ্রে রয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির সামাজিক অস্তিত্বের টানাপোড়েনের বিভিন্ন স্তরের খনন।
সামাজিক অস্থিরতার আরেকটি দিক উন্মোচন হয় খণ্ডহর (১৯৮৩)-এ। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি নিয়ে এর সতেরো বছর আগে পূর্ণেন্দু পত্রী একটি বাংলা ছবি বানিয়েছিলেন। মৃণাল সেন যে হিন্দি ভাষায় ছবিটি বানালেন তার নিজের সমকালের সাপেক্ষে। এই প্রসঙ্গে তিনি এক নিবন্ধে লিখছেন,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মাছধরাটা বাঙালিদের একটা চালু শখ ছিল, কিন্তু এখন নেই। সেখানে ছবি তোলাটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, প্রেমেনদাকে আমি সেটা বলেও নিয়েছিলাম। এমনকি গল্পের শেষে মেয়েটি এসে যখন ছেলেটিকে বলে, ‘আপনার ছিপটিপ যে পড়ে রইল।‘ তখন ছেলেটি উত্তর করে যে ‘তেলেনাপোতার মাছ কি বারবার ফাঁকি দিতে পারবে?’ এটাও আমার কাছে কিছুটা আনডিগনিফায়েড লেগেছিল। রবীন্দ্রবিরোধী কল্লোলীয় বোহেমিয়ান-ইজম ছাড়া এটার মধ্যে আর কিছু খুঁজে পাইনি। অতএব রুচির প্রশ্নেও সরে গেছি সিনেমায়।
‘খণ্ডহর’ ছবিটির মধ্যে মৃণাল সেন-এর যে আত্মসমাহিত রূপটির পরিচয় আমরা পাই তা অভিভূত করে। কারণ, সময়ের সঙ্গে নিজের চিন্তাধারাকে তিনি যতই খাপ খাইয়ে নিক, তাঁর আগের সিনেমাগুলিতে বিভিন্ন ভাবে ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটেছে। কিন্তু ‘খন্ডহর’-এর সময়টিতে তাঁর fire within, calm without স্বরূপটি থেকে এমন ধারণা জন্মায় যে তিনি বিমর্ষ এবং নিঃসঙ্গ। তাঁর বিমর্ষতা এবং নিঃসঙ্গতার কারণ হয়তো এই যে, ঘটমান বর্তমানের চালচিত্রের একটি অংশ হয়ে ওঠার তাগিদ তিনি অনুভব করছেন ঠিকই। পাশাপাশি, এর জটিল স্তরগুলিতে আবদ্ধ হয়ে থাকবার অনুভূতি থেকে মুক্তির অন্বেষণও করছেন তিনি। এই মানসিক অবস্থাকেই পরবর্তীকালে তিনি প্রতিস্থাপিত করছেন ‘একদিন অচানক’ (১৯৮৮)-এর প্রৌঢ় অধ্যাপকের হঠাৎ নিরুদ্দিষ্ট হবার প্রেক্ষাপটটিতে। ‘খণ্ডহর’-এ বিষয়ে তাঁর ভাবনার মাঝে ফিরে গিয়ে দেখব, বাস্তবের দমবন্ধ হওয়া পরিস্থিতি থেকে নিজের দূরত্ব রচনা করবার জন্য তিনি কী উপায় অবলম্বন করছেন :
… ফটোগ্রাফার এখানে আমার অল্টারইগো। ফিল্মমেকার বা ফটোগ্রাফারের প্যারাডাইস ঐ বাড়ি। ঐ ধ্বংসস্তূপ, ঐ মা — ফাঁপা আভিজাত্য নিয়ে বেঁচে থাকা এক মহিলা। স্টিল ব্যবহার করেছি এ ছবিতে টেকনিক হিসেবে, রিমেমব্রেন্স হিসেবে। আমরা পুরনো স্মৃতিগুলো যেমন অ্যালবামের পাতা উলটিয়ে স্টিল ফোটোর মধ্যে দিয়ে দেখি সেভাবেই এ ছবিতে দেখাতে চেয়েছি। অতীত মুহূর্ত বা স্তব্ধ সময়টুকুতে স্মৃতি হিসেবে সারাক্ষণ জাগিয়ে রাখতে চেয়েছি। ঐ স্টিল ফোটো দিয়ে চলে যাবার আগে সুভাষ ছবি তুলতে গিয়েছিল কয়েকটা। হঠাৎ যামিনীকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে যামিনীর ছবিটা তুলল এবং বলল ‘থ্যাঙ্ক ইউ’। যেন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর পোজিং ফর মি অ্যান্ড থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য এক্সপিরিয়েন্স আই অ্যাকয়ার্ড ইন দ্য লাস্ট থ্রি ডেস।
বাস্তব জগতে নিত্য যে টানাপোড়েন চলতে থাকে, সংবেদনশীল মন তার দ্বারা প্রভাবিত হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু এই dynamics-এর ফলে শিল্পীকে একটি কাঠামো রচনা করতে হয়, যার মধ্যে তিনি নিজের চিন্তনকে রূপ দেবেন। জাগতিক ঘটনাপ্রবাহের নিছক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সেই রূপের মূল্যায়ণ হবে না। ঘটনাপ্রবাহের সাপেক্ষে তাঁর অবস্থানটি কোথায় তা সেই রূপকল্পে প্রকাশিত হবে। সিনেমার মাধ্যমে সেই রূপকল্পকে শৈল্পিক ঋজুতায় প্রকাশ করবার জন্য নিজের তৈরি কাঠামোগুলিকে ভাঙতে কখনও ইতস্তত করেননি মৃণাল সেন। সেই কারণেই তাঁর নির্মিত ছবিগুলিতে যে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির বিবর্তন ধরা পড়ে, তার মানবিক এবং শৈল্পিক আবেদন চিরায়ত।
রবীন্দ্রনাথের ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পকে যিনি ছোটদের জন্য চিত্রায়িত করেন, বার্ধক্যে তাঁর একটি ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠছিল। বহুবার তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, “আরেকবার যদি শুরু করা যেত।” তা হয়নি। সিনেমার আন্তর্জাতিকতা নিয়ে যে মানুষটি বরাবর মুখর ছিলেন, বিশ্বায়ন প্রকৃত অর্থেই তাঁকে বিভ্রান্ত করে। বিশ্বায়নের ফলে উদ্ভুত সম্ভাবনার পাশাপাশি তিনি হয়তো টের পাচ্ছিলেন দিগন্ত যতই প্রসারিত হোক না কেন, মানুষের সামাজিক পরিসরটি ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে উঠছে। মেরুকরণের রাজনীতির প্রবল দাপটে উদারতাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে অনিশ্চয়তাবোধ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিনেমা এবং টেলিভিশন মাধ্যমেও মধ্যবিত্ত জীবনের সংকটের উৎস নির্ণয় এবং তার মীমাংসা বিষয়ে চিন্তার প্রসার নেই। বরং তাদের আকাঙ্খাপূরণের উপায় এবং ইঙ্গিতগুলিকেই স্থুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থে। মৃণাল সেনের মতো সোজা শিরদাঁড়ার মানুষ এখন এই প্রবলভাবে এলোমেলো বর্তমানের চাপে নিজের প্রতিবাদী শৈল্পিক সত্তাকে মালিন্য থেকে কতটা সুরক্ষিত রাখতে পারতেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়।
ভাল ও তথ্যপূর্ণ লেখা।