জিন্নাহ : অন্তরের স্ববিরোধ

সৌমিত্র দস্তিদার    

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ — মহম্মদ আলি জিন্নাহ : ইতিহাসের অপরাধী, অবিচারের ইতিহাস

ক’বছর আগে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব টম অলটারের অভিনীত মৌলানা আজাদকে নিয়ে একটা নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। একক অভিনয়। যখন শুরু হয়েছিল তখন মনে হল ভাল লাগবে, শেষ হবার পর মনে হল কেন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল! সেই নাটকের রেশ আজও থেকে গেছে।

মৌলানা আজাদ ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁকে নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক। মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে নাটক, সিনেমার সংখ্যা অগণন। জওহরলাল নেহরু শিল্প-সাহিত্য অনুরাগী মহলে রীতিমতো প্রিয় নাম। বল্লভভাই পাটেল তো হাইজ্যাক হয়ে এখন হিন্দুত্ববাদীদের প্রিয়তম আইকন। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সেও কোথাও নেই মহম্মদ আলি জিন্না-র নাম। অথচ দেশভাগের ইতিহাসে আপনি আমি চাই বা না চাই জিন্নাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

জিন্নাকে নিয়ে কোনও সিনেমা, নাটক এদেশে হয়েছে বলে শুনিনি। গল্প উপন্যাসও বোধহয় লেখা হয়নি। আমার ধারণা খোদ পাকিস্তানেও জিন্নাচর্চা বেশ কম। বাংলাদেশে তো প্রশ্নই ওঠে না। জিন্না আর ঘৃণা উপমহাদেশেই কেমন সমার্থক শব্দ হয়ে রয়ে গেছে। অবশ্য তার পিছনে আলাদা আলাদা কারণ নিশ্চয়ই আছে।

জিন্না চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরস্পরবিরোধিতা। তা অবশ্য সবার মধ্যেই কমবেশি থাকে। কিন্তু জিন্নার মধ্যে ছিল অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশি। জীবনের অধিকাংশ সময় এই মানুষটি ছিলেন আদ্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ। পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন হল চোদ্দ আগস্ট। তার ঠিক আগে, এগারো তারিখ জিন্না অসাধারণ এক ভাষণে আশ্বস্ত করেছিলেন আমজনতাকে – পাকিস্তান শুধু মুসলমানের নয়। নিজের নিজের ধর্মপালনের অধিকার আপনাদের প্রত্যেকের।

এই ধর্মনিরপেক্ষ জিন্নাকে মেনে নেয়নি তাঁর সাধের পাকিস্তান। বস্তুত পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সে দেশে জিন্নার প্রভাব কমতে থাকে। উদার কায়দ-এ আজমকে কোণঠাসা করে তখন থেকেই পাক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকে মৌলবাদী শক্তি। ভারতীয় রাজনীতিতেও হিন্দুত্ববাদীদের দৌলতে জিন্না আগাগোড়া এক খলনায়ক। জিন্নার চরিত্র যে কোনওদিনই একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক, তা আমার দেশের প্রচলিত ইতিহাস ও রাজনীতিবিদেরা আজও স্বীকার করতে চান না।

যে প্রসঙ্গ দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম সেই নাটকটি মৌলানা আজাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারতীয় রাজনীতিরও। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭। ওই দশ বছরের টানটান চিত্রনাট্য খুঁটিনাটি দেখলেই বোঝা যায় যে দেশভাগের জন্য জিন্না মোটেও একা দায়ী নয়। তিনি বিয়োগান্ত নাটকের অনেকের ভিতর এক অন্যতম কুশীলব মাত্র।

এ সব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আপাতত থাক। আমরা এখন ‘আপাত কঠিন, নিষ্ঠুর, ক্রুরমনা’ মানুষ জিন্নাকে নিয়েই আর একটু আলোচনা সেরে রাখি।

যতই অস্বীকার করি না কেন, জিন্না চরিত্রেও নাটকের উপাদান কম নেই। ইলংন্ডে থাকার সময়ে হাজার ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও তিনি নিয়মিত নাটক দেখতে যেতেন। শেক্সপিয়র-অন্তপ্রাণ জিন্না পরবর্তী সময়ে ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন যে ওকালতি বা রাজনীতিতে না এলে তিনি হয়তো নাটক নিয়ে কেরিয়ার গড়ার কথা ভাবতেন।

‘চরম হিন্দু বিদ্বেষী’ জিন্নার বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন ভগবান, ভগবান ধোন্ডে। সারা দেশে যখন দেশভাগের আশঙ্কা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, তখন লিগ নেতা জিন্না আগ্রা কোর্টে ছুটে গেলেন বহুদিন পর কালো গাউন গায়ে শৈশবের আরেক হিন্দু বন্ধু, তাঁর পুত্রের হয়ে কেস লড়তে। জিতলেন। মিথ্যে মামলা থেকে বাঁচালেন ধর্মে ভিন্ন বন্ধুপুত্রকে।

জিন্নার পারিবারিক জীবন সুখের ছিল না। গান্ধি ও বল্লভভাই-এর মতই জন্মেছিলেন গুজরাতে। বিলেতে গিয়ে দাদাভাই নওরোজির বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে দেশে ফিরে জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী। ধাপে ধাপে জননেতা। ১৯২৮ সালে অন্যায়ভাবে কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁকে কোণঠাসা করার পরেও জিন্না বলতেন আমি আগে কংগ্রেস, পরে মুসলিম। প্রসঙ্গত, ঠিক সেই সময় স্বয়ং গান্ধী দাবি করতেন যে তিনি আগে হিন্দু, পরে ভারতীয়।

বিলেতে থাকাকালীন জিন্নার প্রথম স্ত্রী মারা যান। দেশে ফেরার পর বয়সে অনেক ছোট, বিপুল ধনী এক পার্সী কন্যাকে বিয়ে করেন। ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করার ‘অপরাধে’ জিন্নার শ্বশুর নিজের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি  কোনওদিন। তবু জিন্নাপত্নী রত্তি কোনওদিন সেভাবে সাংসারিক সুখ পাননি। তখন থেকেই রাজনীতিতে এত বেশি করে জড়িয়ে পড়েন কায়েদ-এ-আজম, যে বয়সে অনেক ছোট রত্তি নিজেকে অবহেলিত ভাবতে থাকেন। এই একাকীত্ব তাঁকে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। স্ত্রীর প্রতি মহম্মদ আলি জিন্নার ভালবাসা কিন্তু গভীর ছিল। আপাতকঠিন জিন্না স্ত্রীর শবানুগমনের সময় প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলেছিলেন। অথচ জিন্না কোনওদিন প্রকাশ্যে কোনও আবেগের প্রকাশকে প্রশ্রয় দিতেন না।

আগেই বলেছি, জিন্নার সমস্যা ছিল তাঁর চরিত্রের স্ববিরোধিতা। এখন জিন্নাচর্চা করতে গিয়ে নানা তথ্য ঘেঁটে মনে হচ্ছে জিন্না বাইরে যতই বাগ্মী হোন না কেন, ভেতরে ভেতরে ছিলেন এতই চাপা, অন্তর্মুখী যে তাঁর কাছের লোকজনও তাঁকে ভুল বুঝত। ভগবান ধোন্ডে ও আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছাড়া, একমাত্র বোন ফতিমাই ছিল জিন্নার ভরসার জায়গা। মেয়ে দিনার সঙ্গে আমৃত্যু ছিল লাভ-হেট সম্পর্ক। মায়ের অকালে চলে যাওয়া মেয়ের বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তা স্নেহময় বাবা হয়েও জিন্না কোনওদিন সারাতে পারেননি। বরং মেয়ে মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবাই দায়ী বলে মনে করত। দিনা জানতেই পারেনি স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করার জন্য ‘দোষী’ লোকটিই রাত গভীর হলে স্ত্রীর পোশাক হাতে জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদতেন। জিন্নার এই লুকিয়ে রাখা অন্তর্মুখী চরিত্রই প্রায়শই তাঁর বিপক্ষে গেছে। অজান্তে জিন্নার নিষ্ঠুর ইমেজ নির্মাণের শরিক হয়ে গেছেন জিন্না নিজেই।

মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন জিন্নাকে কষ্ট দিয়েছে। সন্তানস্নেহের প্রকাশ ঘটেছে জিন্নার জীবনের নানা সময়, নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে। দেশভাগের ঠিক আগে সারা দেশ যখন ভাঙ্গনের মুখোমুখি, উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় অংশ শ্লোগান তুলেছে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। জিন্না তাদের নয়নের মণি। এক একটা জনসভায় জিন্না মঞ্চে ওঠামাত্র জনতা আবেগে উদ্বেলিত হচ্ছে। জিন্না তখন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা যিনি সংখ্যালঘুদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন স্বাধীন এক রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্রে কোনও বৈষম্য থাকবে না, জমিদারতন্ত্র থাকবে না। সামান্য পানি চাইলে কেউ দুরদুর করে তাড়িয়ে দেবে না। দূরদূরান্ত থেকে লোক ছুটে এসেছেন স্বপ্ননির্মাতাকে একবার স্রেফ চোখের দেখা দেখতে। অদ্ভুত পাঁচমিশালি সে ভিড়। হায়দরাবাদের নিজামের পাশেই আছেন জুনাগড়ের নবাব। ইস্পাহানি আর ময়মনসিংহের চাষী এক সঙ্গে সামনের সারিতে বসে। পুরো এলাকা জুড়ে উৎসবের আবহাওয়া। মেলা বসে গেছে। সবাইকে অবাক করে মঞ্চ থেকে সটান নেমে খোদ জিন্না ঢুকে পড়লেন মেলার কোণে অবহেলায় সাজানো এক অকিঞ্চিৎকর খেলনার স্টলে। কাঠের তৈরি দুটো ঘোড়া কিনে কিছু হয়নি এমন মুখে ফের মঞ্চে৷ পরে জানা গেছিল, কবে কোন ছোটবেলায় জিন্না সাহেবকে তার এক বন্ধুর ছেলে এরকমই ঘোড়া কিনে দেবার বায়না করেছিল। সে ছেলে এখন যুবক। তাঁর নিজেরও মনে নেই শৈশবের তুচ্ছ আব্দারের কথা। জিন্না ভোলেননি। কারণ কাউকে কথা দিয়ে তা রাখতে না পারা অন্যায়। তাই নদী দিয়ে যতই জল গড়িয়ে যাক, জিন্না নিজের প্রতিজ্ঞায় অটুট, দৃঢ়চেতা। জিন্নার এক পরিচারক একবার বলেছিলেন- ‘সাহেব সারারাত ঘুমোতে পারেননি। অস্থির পায়চারি করে সময় কাটিয়েছেন। সাহেবের মনখারাপ ছিল, পরের দিন সকালে তার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ছেলে, যে কিছুদিন ধরে এ বাসায় ছিল, সে চলে যাবে।’

এই স্নেহপ্রবণ জিন্নাকে আমরা চিনি না। চিনতে চাইও না। আসলে চিনতে দেওয়াই হয়নি। কঠিন কঠোর জিন্না চরিত্র নিয়ে আমরা সতত সোচ্চার। এই নরম আবেগপ্রবণ জিন্না ইতিহাসে, ইতিহাসের প্রয়োজনে, উপেক্ষিত।

(ক্রমশ)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...