শুভ্রদীপ চৌধুরী
রাখু পাগলটার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ভাত খাবি? ভাত?
পাগলটা বিস্ময়ে হাঁ, মুখের লালা হাতের চেটোয় মুছে একটু হাসল।
ওষুধে কাজ দিয়েছে বুঝেই পাগলটার সামনে পাকা রাস্তায় রাখু থেবড়ে বসে পড়ল। আর একটানা বলে যেতে থাকল, খাবি?… খাবি? ভাত, ডাল,মাছ, মাংস।
পাগলটা চেঁচিয়ে উঠল, দে, ভাত দে, ভাত।
–নাম কী তোর? প্রশ্ন শুনে পাগলটা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মুখে বলল, তোর নাম কী?
অনেকদিন পর কেউ রাখুর নাম জানতে চাইল! আর দেরি না করে সে পাগলটাকে বলল, তবে চল, ওঠ।
রাখু তার লড়ঝড়ে সাইকেলটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। একটু ফাঁকা হলেই সাইকেলে তুলে নেবে। বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন, হাটখোলা সবখানে প্রতিদিন টহল মারে। শহর থেকে তার বাড়ি ছ’মাইল দূরে, তবু সে দুবেলা আসবেই। এটাই যে তার এখন একমাত্র কাজ।
রাখুর পুরো নাম রাখাল মণ্ডল। নামটা যে কে রেখেছিল সে জানে না। যেই রাখুক মোটেই নামটা তার ভালো লাগে না। এই একটা জিনিসে মানুষের নিজের হাত থাকে না।
রাখুর বাপ মরেছে গত বৈশাখে, বছর ঘুরে এখন সেই বৈশাখ। বাপের কথা মনে পড়লেই সে দেখতে পায়, অন্ধকার ঘরে তেল চিটচিটে একটা মশারির ভেতরে ‘দ’-এর মতো বসে আছে একটা চিমসে শরীর। মাঝেমধ্যেই খকখক করে কাশছে। মায়ের কথা তার তেমন পড়ে না। পড়বার কথাও নয়। বহুদিন আগে কোনও এক সকালে উঠে মাকে খুঁজেছিল, রান্নাঘরের শেকলের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিল সেখানেও নেই। হাওয়া। এরপর থানাপুলিশ। কোথাও লাশ ভেসে উঠলে খবর আসত থানা থেকে। বাপের সাথে সেও যেত।
মর্গের ভেতরে নাকে গামছা গুঁজে সে বেঢপ ফুলে ঢোল হওয়া মেয়েমানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখ মেলাত। না, একটাও মেলেনি। সে কত বছর আগের কথা, আঠেরো, উনিশ বছর তো হবেই। মর্গের সামনের উনিশ বছর আগের রাখালকে একঝলক দেখতে পেল সে। হাফপ্যান্টকে টেনে ধরে আছে একটা ডোর, গায়ে হলদেটে রঙচটা স্যান্ডো গেঞ্জি, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ছনমনে নাক। এখন অবশ্য কপালের উপরে বাড়তি পাওনা হিসেবে একটা কাটা দাগ এসে জুড়েছে। তিনটে সেলাই পড়েছিল। ভোলার দলের সঙ্গে সামান্য কিচাইন। এখন অবশ্য ভোলা তার ভালো বন্ধু।
পাগলটা পিছিয়ে পড়েছে খানিকটা, রাখু দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে খানতিনেক কষে টান দিয়ে পাগলটার দিকে বাড়িয়ে ধরল। স্পিড বাড়াল পাগলটা। রাখু অবাক হল না। এই পাগলটা দিয়ে তার কাজ হবে। আর কাজ হলেই দিন পনেরো চোখ বন্ধ করে পায়ের উপরে পা তুলে কেটে যাবে। দু’বেলার খোরাক, আজ রাতেই একটা নিব, ছোলাভাজা, ঝালকুচি নিয়ে রাতেই বসে পড়া যায়। পকেটের একশো ষাট টাকা এখন বাড়তি মনে হল। দুটো দিন অনেক ইচ্ছে হলেও একটা টাকাও সে হুট-হাট খরচ করেনি। এখন খরচ করতে বাধা কোথায়!
পাগলটা এখন তার দেওয়া সিগারেট টানছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এককালে বেশ অভ্যেস ছিল। হয়তো ধোঁয়ার রিং বানাতে পারত। রাখু পারে। ভালো মাল্লু হাতে এলে, রাস্তার হোটেল থেকে ছাট মাংস ভাত খেয়ে চৌকির উপরে শুয়ে সে রিং বানায়। মনে হচ্ছে, ছাট মাংস ভাতের দুপুর তার খুব কাছে। আশেপাশে তেমন কেউ নেই দেখে রাখু পাগলটাকে ইশারা করল, ওঠ সাইকেলে, ওঠ, ওঠ। পাগলটা উঠে পড়ল।
তার এক চিলতে ঘরখানায় পাগলটাকে নিয়ে ঢোকার পর পরই ঝড় উঠল, তারপর বৃষ্টি। জানালা বন্ধের পর অন্ধকারে পাগলটা চেঁচিয়ে উঠল, ভাত দে, ভাত… ভাত।
রাখু লক্ষ করে দেখেছে বেশিরভাগ পাগলেরা খিদেয় ছটফট করে। একবার ভাতের কথা মনে করে দিলেই কেল্লাফতে। সুড়সুড় করে যেখানে যেতে বলবে চলে যাবে। খিদের কথাও বেমালুম ভুলে যায়। শুধু মনে করিয়ে দিতে হয়। ভাতের কথা বলেই সে এখন পর্যন্ত এগারো জনকে টেনে এনেছে। কাজও হাসিল করেছে। এই লোকটা হল বারো নম্বর পাগল।
ঝড় বৃষ্টি থামলে ঘরে শেকল তুলে দিয়ে বারোটা রুটি আর ফ্রি তরকারি এনেছিল রাখু। ছ’টা ছ’টা করে ভাগ। গপগপ করে রুটি ক’টা সাবড়ে জুলজুল করে তাকিয়ে পাগলটা বলল, আর দিবি না!
রাখু বলল, স্নান কর তবে দিব।
পাগলটা হাসল, স্নান কী?
বালতি ভর্তি করে জল আনতেই পাগলটা দৌড়ে গেল ঘরের এক কোণে। পাগলদের স্নান করানো সত্যিই সমস্যার! তার আছড়ার ঘরের আনাচে কানাচে এখন পাগলটার গায়ের চিমসে ঘেমো গন্ধ। পাগলটার জন্য বিছানা করল। সব রেডিই থাকে। কয়েক আঁটি খড়। আর একটা শতচ্ছিন্ন নোংরা চাদর।
পরদিন ভাতের লোভ দেখিয়ে স্নান করাল। হোটেল থেকে আনা ভাত ও ডাল বেড়ে দিল থার্মোকলের থালায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আগের মতো গপগপ করে খেল পাগলটা।
খাওয়া হলে রাখু বলল, ঘুমাবি?
–হুম। দিন রাত ঘুমাব।
দুপুরে একদম চোখের পাতা এক করল না রাখু। পাগলটাকে পাহারা দিল। ঘুম ভাঙতেই পাগলটাকে বারান্দায় বসিয়ে ওর ঝাঁকড়া চুল খচ-খচ করে কেটে দিল। তারপর চুল হাচড়ে তেল দিয়ে পাট-পাট করে শুইয়ে দিল।
আয়নায় মুখ দেখে পাগলটা খুব হাসল। যেন খুব মজা পেয়েছে। একসেট পুরনো কাচা লুঙ্গি, জামা সবসময় রেডি রাখে রাখু। কাজের দিন সে সব পরিয়ে নিয়ে যায়। পাগলটার গায়ে জামাটা একটু ঢলঢলে হবে, হোক। সে পাখি পড়ার মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল তোর নাম জিজ্ঞেস করলে কী বলবি?
পাগলটা বলল কী নাম?
বলবি, রাম, রহিম যা খুশি।
পাগলটা হো হো করে হাসল কিছুক্ষণ, রাম কেন পরিতোষ, পরিতোষ।
রাখু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। লোকটাকে দিয়ে কাজ হবে? আগে আঁচ করে ফেলবে না তো?
গতমাসে এমনই একটাকে বাড়ি এনে চুল-দাড়ি কেটে কাচা জামা, লুঙ্গি পরিয়ে কাজ হাসিল করে একটা ট্রেকারে তুলে দিয়েছিল, তার আগে অবশ্যই প্রত্যেককে যেমন জিজ্ঞেস করে, তেমন বলেছিল, এই পাগলা বল কী চাই তোর? কতজন কত কী বলে!
চিরুনি, ভাত, ঘর…. আরও কত কী চায়। কেউ আবার শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ট্রেকার চলে যায়।
টাকা গুণে পকেটে ভরার আগে প্রতিবার পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দেয় প্রত্যেককে। একবার একটা পাগল চুল কাটার সময় তার হাতে কামড় বসিয়েছিল। চকচকে নতুন ব্লেডের খুরটা পাগলটার গলায় বসিয়ে দেবে ভেবেছিল, হাতের লক্ষ্মীর সঙ্গে এমনটা করা যায় না। রাখু খেয়াল করে দেখেছে ছোটখাটো কাজে পাগলগুলো যতটা ছটফট করে বড় কাজে ঠিক ততটাই চুপচাপ।
সন্ধে হল। পাগলটা ছটফট শুরু করল। ঝিঁঝিঁপোকারা গান শুরু করল। তার বাপের মুখে শুনেছে, এই পোকারা অনেককিছু দেখতে পায় শুধু ডানা ছোট হবার জন্য কিছুতেই উড়তে পারে না। স্বপ্নে পাওয়া দাঁতের পোকা আর অর্শের ধন্বন্তরী ওষুধ জানত তার বাপ। সে যখন ছোটবেলায় বিরক্ত হয়ে তার বাপকে বলত, ঝিঁঝিঁপোকার গান কী করে বন্ধ হবে বাপ। তার বাপ হাসত, ওটা কান্না। উড়তে না পারার যন্ত্রণা, গান নয়।
চালে ডালে ফুটিয়ে খেল দু’জনে। আজকাল স্টেশন চত্বরে দাঁড়ালে মানুষ সন্দেহের চোখে রাখুর দিকে তাকায়।
পাগলটা মেঝেতে ঘুমোচ্ছে আর বিড় বিড় করছে। রাখু কান খাড়া করল। ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করছে, একটানা শব্দ তার অসহ্য লাগছে, যেন ঝিঁঝিঁপোকাদের কাছে এসব শিখে এসেছে পাগলটা।
চুপ, বলে চেঁচিয়ে উঠল রাখু। পাগলটা পাশ ফিরল। নিশ্চিন্তে যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে, বলেই যাচ্ছে। আবার বাপের কথা মনে পড়ল তার। বাপ বলত, এই পৃথিবী হল এক আজব কারখানা।
বছরখানেক হল, সে অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছে। আধপাগলা মানুষজন ধরে কোনওক্রমে দু’বেলার খাবার জোগার করছে। প্রতি হপ্তায় দু’একটা পাইট, মাঝে মাঝে হিন্দি সিনেমা, দিনে খানসাতেক বিড়ি।
সারারাত কানে বালিশচাপা দিয়ে সে পড়ে থাকল। ঘুম এল না।
সকালে দুজনে রওনা দিল। তার আগে স্নান করিয়েছে, চুল আঁচড়ে দিয়েছে, কাচা লুঙ্গি-জামা পরিয়েছে। এখন যে কেউ পাগলাটাকে দেখে ভাববে এ তো দিব্যি ভালোমানুষ! দু’তিনবার শুধু লালা মুছিয়ে দিয়েছে রাখু। ছটা স্টপেজ পরে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, তার নীল জানালা, ঘুলঘুলির মুখে শুধু গিয়ে তার নাম বলা, সব ফিট করা আছে। বছর দেড়েক আগে হসপিটালের বাতিল ওষুধ কিনে হাটে বেচত কালু, সেই কাজটা জুটে দিয়েছিল। কালু বলেছিল, শোন রাখু পাগল ধরে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবি ওরা যন্ত্র সিল করে। আর পুরো এগারোশো পাবি। পারবি কাজটা করতে?
রাখু প্রথমটায় বোঝেনি দেখে কালু বেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। আরে ধ্যাৎ, ঠিকমতো ম্যানেজ করার জন্য আরও দুশো পাবি। হসপিটাল পর্যন্ত আনা তোর ডিউটি তারপর সব আমার।
রাখু বলেছিল, তোকে কত দেওয়া লাগবে?
কালু হেসেছিল, চারশো দিস!
ঘুলঘুলির ওপারে লোকটা হাসল বোধ হয় তার নাম বলা দেখে। রাখু পাগলাটাকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে বসে থাকল আধাঘণ্টা। বাইরের হলুদ বোর্ডে লেখা,
ভেসেকটমি– পুরুষদের জন্য বিনা অপারেশনে বন্ধ্যাত্মকরণ।
প্রতিদিন, সোমবার থেকে শনিবার।
১১০০ টাকা।
মোটিভেশন — ২০০ টাকা।
দরজার সবজে পর্দা কাঁপছে। আর কয়েক মিনিট, তারপর বারোশো টাকা। ঘুলঘুলির ওপারের লোকটাকে দু’শো দিলে এখন আর কালু এসবের খবর পায় না। দু’শো বাড়তি পকেটে এলে একটা সপ্তাহ বেশি চলে যায়।
কাজ শেষে সই করে টাকা নিল রাখু। পাগলাটা বেরিয়ে এল ঘর থেকে তারপর রাখুর দিকে না তাকিয়ে হনহন করে ছুটতে লাগল। রাখুও পেছন পেছন ছুটল। দূরে একটা ট্রেকার যাবে যাবে করে একটু এগিয়ে আবার পিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে, কোনও প্যাসেঞ্জার ছাড়বে না তারা।
পাগলাটা উঠে পড়ল ট্রেকারে। রাখুও হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে পড়ল সেটাতে। পাগলাটার কানের পাশে মুখ এনে বলল, ভাত খাবি?
পাগলাটা শুধু তাকিয়ে থাকল, কিছু বলল না। পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে পাগলাটার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, কী নিবি তুই? কী চাই?
পাগলটা চুপ করে থাকল।
বারকয়েক জিজ্ঞেস করল, পাগলটা কিছুতেই রা কাটল না।
বিরক্ত হয়ে রাখু বলল, তোর কিছু চাওয়ার নাই! কোনও ইচ্ছা নাই…….?
পাগলাটা মাথা নাড়ল, ফিসফিস করে বলল, আছে।
–কী?
–একটা ছাওয়াল, একটা না দুইটা, তিনটা…
–কী করবি তার সাথে?
–খেলব, কোলেত নিয়ে দৌড়াব, মেলাত যাব…..
কথা শেষ করে দুলে দুলে হাসতে লাগল পাগলটা।
ট্রেকারটা থেমেছে। প্রতিবারের মতো এবার নেমে যেতে হবে রাখুকে। আর বেশিদূর যাওয়া ঠিক হবে না।
আবার কাউকে খুঁজতে হবে। পাগলটা এখনও হাসছে, বিড় বিড় করছে, কোলেও নিয়ে দৌড়াব, মেলা যাব,
খেলব, আদর করব, চুমা খাব….
ট্রেকারটা থেমে আছে।
তবু রাখু আজ কিছুতেই নামতে পারছে না।